alt

নগর-মহানগর

আগুন আর বিস্ফোরণ ঝুঁকিতে পুরান ঢাকার অলিগলি

মাসুদ রানা : শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩

সিদ্দিক বাজারে বিধ্বস্ত ভবনকে স্টিল পিলার দিয়ে ঠেকা দেয়ার কাজ চলছে -সংবাদ

আগুন আর বিস্ফোরণ ঝুঁকিতেই রয়েছে পুরান ঢাকার প্রতিটি অলিগলি। বিশেষ করে শতশত কেমিক্যাল গুদাম, প্লাস্টিক কারখানা, জুতার কারখানা, ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাসের লাইন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকাকে আতঙ্কের নগরীতে পরিণত করেছে। একের পর এক যুক্ত হচ্ছে ট্র্যাজেডি। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। কোন বড় দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্টরা ঝুঁকিমুক্ত করতে নানা পদক্ষেপের কথা শোনালেও বাস্তবায়ন হয় না কিছুই। বিশেষ করে কেমিক্যাল গোদামগুলো সরানো হয়নি এখনও। এগুলোকে রাসায়সিক পল্লীতে স্থানান্তরের কথা বলা হলেও কবে নাগাদ সেখানে সরানো হবে সেটিরও নির্দিষ্ট কোন উত্তর নেই কারো কাছে। ফলে বছরের পর বছর ধরে আতঙ্ক নিয়েই পুরান ঢাকায় বসবাস করছেন বাসিন্দারা। পুরান ঢাকায় বিস্ফোরণের ঝুঁকি এড়াতে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। একই সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে পুরনো গ্যাসের লাইন সংস্কার ও কেমিক্যাল গুদাম সরানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১০ সালে নিমতলি ট্র্যাজেডির পর গঠিত তদন্ত কমিটি ১৭টি সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেছিল। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে পুরান ঢাকায় আর এত বড় বড় ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটত না। কিন্তু দুঃখের বিষয় সরকার ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন থেকে সরে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিমতলী ট্র্যাজেডির পর করা ওই ১৭ দফা সুপারিশের মধ্যে রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, কেনাবেচা এবং লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার কথা ছিল।

বিভিন্ন সময় পুরান ঢাকায় লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করা ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা বলছেন, পুরান ঢাকার আবাসিক ভবনের নিচতলায় কেমিক্যালের গোডাউন, উপরে বসবাস। এমন আগুনে ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট হয়ে অনেকে মারা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী একটি বহুতল ভবনে যা যা থাকার কথা ভবনগুলোতে এর কিছুই নেই। ভবনের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ভবন মালিকের হলেও তিনি তা করছেন না।

পুরান ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এরকম একটি জায়গায় কেমিক্যালের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়ায় পুরান ঢাকার বাসিন্দারা শতভাগ ঝুঁঁকিতে রয়েছে। এই এলাকায় ভবিষ্যতে নিমতলী ট্র্যাজেডির মতো একই পরিমাণ কিংবা এর চেয়েও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। পুুরান ঢাকাবাসীকে অগ্নিঝুঁঁকি থেকে মুক্ত করতে হলে আবাসিক এলাকায় ও ভবনের ভেতরে কেমিক্যাল গোডাউন না রাখা, অল্প ভূমিকম্পে ভেঙে পড়তে পারে এমন ভবন এখনই ভেঙে ফেলা, যত সম্ভব রাস্তা প্রশস্ত করা, ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করার পরামর্শ ফায়ার সার্ভিসের।

সূত্র জানায়, নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সিটি করপোরেশন, শিল্প মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই কমিটি পুরান ঢাকায় অতি ঝুঁঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, এমন ১ হাজার ৯২৪ জন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীর তালিকা করে। এই তালিকা মন্ত্রিসভায়ও জমা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানান্তরে আলোর মুখ দেখেনি। অথচ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে অগ্নিকা-ের জন্য পুরান ঢাকার ৫০৮টি প্লাস্টিক কারখানা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসা-বাড়িতে। মাত্র আড়াই হাজার গোডাউনকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের মতো গোডাউন অবৈধ। এসব গোডাউনে ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে। যার অনেকগুলোতেই রয়েছে সোডিয়াম আনহাইড্রোজ, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোপাইল ও টলুইনের মতো ২৯ ধরনের কেমিক্যাল, যেগুলো আগুনের আঁচ পেলেই ভয়াবহ ধরনের অগ্নিকা- তৈরি করতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১১ বছরে শুধু পুরান ঢাকায় পৃথক ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকা-ের মধ্যে মাত্র ৩টি ঘটনার পর মামলা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে অগ্নিকা-ে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও তারা সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনের ৯৮ ভাগই অবৈধ। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাসায়নিকের এক একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী, যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে।

এদিকে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর গুলিস্তানে ক্যাফে কুইন স্যানিটারি মার্কেট ভবনে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরণে মারা যায় ২৪টি। আহত হয় দুই শতাধিক। ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিস্ফোরণ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে সব লাশ উদ্ধারের পর ভবনটি ধসে পড়ার শঙ্কায় বন্ধ রাখা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কার্যক্রম। নিমতলী, চুড়িহাট্টা, আরমানিটোলা ট্র্যাজেডির পর এই ঘটনায় আবারও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা।

সিদ্দিক বাজারের স্যানিটারি ব্যবসায়ী ‘ফরহাদ ট্রেডিংয়ের’ মালিক ফরহাদ হোসেন বলেন, পুরান ঢাকা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। এরপরেও আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এখানে থাকছি, ব্যবসা করছি। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে একের পর এক বড় ট্র্যাজেডির সাক্ষী হতে হচ্ছে আমাদের। সর্বশেষ ক্যাফে কুইন স্যানিটারি মার্কেট ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে পরিচিত অনেককে হারাতে হলো। যাদের দেখে ব্যবসা করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি, চোখের সামনে তাদের চাপাপড়া লাশ উদ্ধার করতে দেখেছি। এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে। আমরা আর আতঙ্ক নিয়ে বাস করতে চাই না। পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হোক। গ্যাস লাইন সংস্কার করে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, অপ্রশস্ত রাস্তা, কেমিক্যাল গুদাম, অপরিকল্পিত ভবনের কারণে সব সময় পুরান ঢাকা ঝুঁকিতে থাকে। এই ঝুঁকিমুক্ত হতে সবার আগে পুরান ঢাকাবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তারা ঐক্যবদ্ধ নয় বলেই নিমতলী ট্র্যাজেডির পর যে ১৭ দফা বাস্তবায়নের কথা ছিল সরকার সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে। পরবর্তীতে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা আর সরকারের ওপর চাপও প্রয়োগ করতে পারেনি। উল্টো তারা ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। এর থেকে বেড়িয়ে এসে রাজনৈতিকভাবে কঠোর অবস্থানে গিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করে নিতে হবে। পাশাপাশি বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, রাস্তা প্রশস্তকরণ, আধুনিক গ্যাস লাইন ব্যবস্থা, ডিটেইল এড়িয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী পুরান ঢাকা পুনর্গঠনে ২-৩ শতাংশ সুদে পুরান ঢাকা পুনর্গঠনের বিশেষ প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে প্রত্যেক ভবনে বসবাসযোগ্য নবায়নযোগ্য সার্টিফিকেট ব্যবস্থা চালু করতে হবে। নিজের বাড়ি ও প্রতিবেশীর বাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও বাসিন্দাদের উদ্যগী হতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, পুরান ঢাকার ঝুঁকি এড়াতে সেমিনারের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ আমরা করে যাচ্ছি। তবে বাসিন্দাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। কেননা পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউন, প্লাস্টিক কারখানাগুলোর কারণে ঝুঁকি কয়েকগুণ বেশি। অগ্নিকা- বা বিস্ফোরণ ঘটলে সরু রাস্তার কারণে উদ্ধার অভিযানেও আমাদের বেগ পেতে হয়। এসব কিছু বিবেচনায় যত দ্রুত সম্ভব কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক কারখানা সরিয়ে নেয়া হলে ভালো হবে। ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাসের লাইন সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার ডিজি বলেন, এ বিষয়ে তিতাস কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে। তবে ঝুঁকি এড়াতে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।

ছবি

পহেলা বৈশাখে জাহানারা জাদুঘরের বিশেষ প্রদর্শনী

ছবি

চট্টগ্রামে বস্তিতে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৯ ইউনিট

ছবি

ঢাকায় পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার ৮

ঢাবি চারুকলার বকুলতলায় গান-নাচ-আবৃত্তিতে চৈত্রসংক্রান্তি উদ্‌যাপন

ছবি

ঢাকায় এসেছে ইসরায়েলের ফ্লাইট, বেবিচকের ব্যাখা

ছবি

বর্ষবরণের অপেক্ষায় রমনা

ছবি

যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর গাড়িতে আগুন লাগে জানান পুলিশ

লঞ্চের দড়ি ছিঁড়ে ৫ জনের মৃত্যু : আসামিদের তিন দিনের রিমান্ড

ছবি

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর প্রাইভেট কারে আগুন

রাজধানীর শাহজাদপুরে বুথের নিরাপত্তা প্রহরীকে হত্যা

ছবি

যাত্রীদের পিটুনিতে হয়নি চালক-সহকারীর মৃত্যু, হেলপার গল্প সাজিয়েছে বলছে পুলিশ

ছবি

ঈদের দিন বন্ধ থাকবে মেট্রোরেল

ছবি

মেট্রোরেলের পিলারে বাসের ধাক্কা

ছবি

কেএনএফের তৎপরতা নিয়ে ঢাকায় কোনো শঙ্কা নেই: ডিএমপি কমিশনার

ছবি

আবাসিক হোটেল থেকে নির্মাতা সোহানুর রহমানের মেয়ের মরদেহ উদ্ধার

কেটলির শর্টসার্কিট থেকে লিকেজের গ্যাসে বিস্তার

ছবি

জনগণের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে পুলিশের সব ইউনিট একযোগে কাজ করছে : আইজিপি

ছবি

কমলাপুর স্টেশনে বেড়েছে যাত্রীর চাপ, টিকেট ছাড়া প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা

ছবি

ঈদে ঢাকা ছাড়ার আগে নগরবাসীকে ডিএমপির ১৪ পরামর্শ

ছবি

আগামী দিনে সদরঘাট আরও ফিটফাট হবে : নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

ছবি

মেট্রোরেলে ভ্যাট, ঘোষণা কে দিলো ‘জানেন না’ ওবায়দুল কাদের

ছবি

পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্যে ধর্ষণের ভিডিও করা হয় : পুলিশ

এডিস মশা : ডাবের খোসাসহ পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি কিনবে ঢাকা উত্তর সিটি

ছবি

মেট্রোরেলের ভাড়া বাড়ছেে, ১৫% ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্ত

ঈদ যাত্রায় টার্মিনালের বাইরে যাত্রী ওঠানামা নয়: ট্রাফিক পুলিশ

ছবি

তেলবাহী লরি উল্টে আগুন : দগ্ধ আরও একজনের মৃত্যু

ছবি

ডেমরায় ১৪ বাসে আগুন নিয়ে রহস্য

ছবি

দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাজুক : মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান

ছবি

‘বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে’

ছবি

তেলের লরি উল্টে আগুনে দগ্ধদের কেউ শংকামুক্ত নন: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ছবি

সাভারে তেলের লরি উল্টে আগুনে দগ্ধ ৪ জনের অবস্থা গুরুতর

ধর্ষণ:যত বড় হোক, নাম যেন তদন্তে আসে’

ছবি

মার্চ মাসে ২৪৫জন নারী ও কন্যা নির্যাতিত: মহিলা পরিষদ

ছবি

ফুটপাতসহ বিপণি বিতানগুলোতে জমে উঠেছে ঈদ কেনাকাটা

ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর গলায় ফাঁস

ছবি

বিদ্যুতের তারে পলিথিন, মেট্রোরেল বন্ধ এক ঘণ্টা

tab

নগর-মহানগর

আগুন আর বিস্ফোরণ ঝুঁকিতে পুরান ঢাকার অলিগলি

মাসুদ রানা

সিদ্দিক বাজারে বিধ্বস্ত ভবনকে স্টিল পিলার দিয়ে ঠেকা দেয়ার কাজ চলছে -সংবাদ

শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩

আগুন আর বিস্ফোরণ ঝুঁকিতেই রয়েছে পুরান ঢাকার প্রতিটি অলিগলি। বিশেষ করে শতশত কেমিক্যাল গুদাম, প্লাস্টিক কারখানা, জুতার কারখানা, ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাসের লাইন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকাকে আতঙ্কের নগরীতে পরিণত করেছে। একের পর এক যুক্ত হচ্ছে ট্র্যাজেডি। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। কোন বড় দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্টরা ঝুঁকিমুক্ত করতে নানা পদক্ষেপের কথা শোনালেও বাস্তবায়ন হয় না কিছুই। বিশেষ করে কেমিক্যাল গোদামগুলো সরানো হয়নি এখনও। এগুলোকে রাসায়সিক পল্লীতে স্থানান্তরের কথা বলা হলেও কবে নাগাদ সেখানে সরানো হবে সেটিরও নির্দিষ্ট কোন উত্তর নেই কারো কাছে। ফলে বছরের পর বছর ধরে আতঙ্ক নিয়েই পুরান ঢাকায় বসবাস করছেন বাসিন্দারা। পুরান ঢাকায় বিস্ফোরণের ঝুঁকি এড়াতে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। একই সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে পুরনো গ্যাসের লাইন সংস্কার ও কেমিক্যাল গুদাম সরানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১০ সালে নিমতলি ট্র্যাজেডির পর গঠিত তদন্ত কমিটি ১৭টি সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেছিল। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে পুরান ঢাকায় আর এত বড় বড় ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটত না। কিন্তু দুঃখের বিষয় সরকার ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন থেকে সরে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিমতলী ট্র্যাজেডির পর করা ওই ১৭ দফা সুপারিশের মধ্যে রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, কেনাবেচা এবং লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার কথা ছিল।

বিভিন্ন সময় পুরান ঢাকায় লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করা ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা বলছেন, পুরান ঢাকার আবাসিক ভবনের নিচতলায় কেমিক্যালের গোডাউন, উপরে বসবাস। এমন আগুনে ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট হয়ে অনেকে মারা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী একটি বহুতল ভবনে যা যা থাকার কথা ভবনগুলোতে এর কিছুই নেই। ভবনের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ভবন মালিকের হলেও তিনি তা করছেন না।

পুরান ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এরকম একটি জায়গায় কেমিক্যালের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়ায় পুরান ঢাকার বাসিন্দারা শতভাগ ঝুঁঁকিতে রয়েছে। এই এলাকায় ভবিষ্যতে নিমতলী ট্র্যাজেডির মতো একই পরিমাণ কিংবা এর চেয়েও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। পুুরান ঢাকাবাসীকে অগ্নিঝুঁঁকি থেকে মুক্ত করতে হলে আবাসিক এলাকায় ও ভবনের ভেতরে কেমিক্যাল গোডাউন না রাখা, অল্প ভূমিকম্পে ভেঙে পড়তে পারে এমন ভবন এখনই ভেঙে ফেলা, যত সম্ভব রাস্তা প্রশস্ত করা, ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করার পরামর্শ ফায়ার সার্ভিসের।

সূত্র জানায়, নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সিটি করপোরেশন, শিল্প মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই কমিটি পুরান ঢাকায় অতি ঝুঁঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, এমন ১ হাজার ৯২৪ জন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীর তালিকা করে। এই তালিকা মন্ত্রিসভায়ও জমা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানান্তরে আলোর মুখ দেখেনি। অথচ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে অগ্নিকা-ের জন্য পুরান ঢাকার ৫০৮টি প্লাস্টিক কারখানা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসা-বাড়িতে। মাত্র আড়াই হাজার গোডাউনকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের মতো গোডাউন অবৈধ। এসব গোডাউনে ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে। যার অনেকগুলোতেই রয়েছে সোডিয়াম আনহাইড্রোজ, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোপাইল ও টলুইনের মতো ২৯ ধরনের কেমিক্যাল, যেগুলো আগুনের আঁচ পেলেই ভয়াবহ ধরনের অগ্নিকা- তৈরি করতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১১ বছরে শুধু পুরান ঢাকায় পৃথক ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকা-ের মধ্যে মাত্র ৩টি ঘটনার পর মামলা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে অগ্নিকা-ে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও তারা সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনের ৯৮ ভাগই অবৈধ। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাসায়নিকের এক একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী, যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে।

এদিকে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর গুলিস্তানে ক্যাফে কুইন স্যানিটারি মার্কেট ভবনে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরণে মারা যায় ২৪টি। আহত হয় দুই শতাধিক। ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিস্ফোরণ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে সব লাশ উদ্ধারের পর ভবনটি ধসে পড়ার শঙ্কায় বন্ধ রাখা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কার্যক্রম। নিমতলী, চুড়িহাট্টা, আরমানিটোলা ট্র্যাজেডির পর এই ঘটনায় আবারও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা।

সিদ্দিক বাজারের স্যানিটারি ব্যবসায়ী ‘ফরহাদ ট্রেডিংয়ের’ মালিক ফরহাদ হোসেন বলেন, পুরান ঢাকা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। এরপরেও আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এখানে থাকছি, ব্যবসা করছি। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে একের পর এক বড় ট্র্যাজেডির সাক্ষী হতে হচ্ছে আমাদের। সর্বশেষ ক্যাফে কুইন স্যানিটারি মার্কেট ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে পরিচিত অনেককে হারাতে হলো। যাদের দেখে ব্যবসা করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি, চোখের সামনে তাদের চাপাপড়া লাশ উদ্ধার করতে দেখেছি। এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে। আমরা আর আতঙ্ক নিয়ে বাস করতে চাই না। পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হোক। গ্যাস লাইন সংস্কার করে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, অপ্রশস্ত রাস্তা, কেমিক্যাল গুদাম, অপরিকল্পিত ভবনের কারণে সব সময় পুরান ঢাকা ঝুঁকিতে থাকে। এই ঝুঁকিমুক্ত হতে সবার আগে পুরান ঢাকাবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তারা ঐক্যবদ্ধ নয় বলেই নিমতলী ট্র্যাজেডির পর যে ১৭ দফা বাস্তবায়নের কথা ছিল সরকার সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে। পরবর্তীতে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা আর সরকারের ওপর চাপও প্রয়োগ করতে পারেনি। উল্টো তারা ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। এর থেকে বেড়িয়ে এসে রাজনৈতিকভাবে কঠোর অবস্থানে গিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করে নিতে হবে। পাশাপাশি বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, রাস্তা প্রশস্তকরণ, আধুনিক গ্যাস লাইন ব্যবস্থা, ডিটেইল এড়িয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী পুরান ঢাকা পুনর্গঠনে ২-৩ শতাংশ সুদে পুরান ঢাকা পুনর্গঠনের বিশেষ প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে প্রত্যেক ভবনে বসবাসযোগ্য নবায়নযোগ্য সার্টিফিকেট ব্যবস্থা চালু করতে হবে। নিজের বাড়ি ও প্রতিবেশীর বাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও বাসিন্দাদের উদ্যগী হতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, পুরান ঢাকার ঝুঁকি এড়াতে সেমিনারের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ আমরা করে যাচ্ছি। তবে বাসিন্দাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। কেননা পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউন, প্লাস্টিক কারখানাগুলোর কারণে ঝুঁকি কয়েকগুণ বেশি। অগ্নিকা- বা বিস্ফোরণ ঘটলে সরু রাস্তার কারণে উদ্ধার অভিযানেও আমাদের বেগ পেতে হয়। এসব কিছু বিবেচনায় যত দ্রুত সম্ভব কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক কারখানা সরিয়ে নেয়া হলে ভালো হবে। ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাসের লাইন সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার ডিজি বলেন, এ বিষয়ে তিতাস কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে। তবে ঝুঁকি এড়াতে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।

back to top