alt

অপরাধ ও দুর্নীতি

চালের সাইলোতে রাখা গম, নেপথ্যে দুর্নীতিবাজ চক্র

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক : সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

>>বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলের বিস্ময়

>>নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ

>>অনিয়মের সুযোগ না পেয়ে এমন অনিয়ম

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও মজুত ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে দেশে সাতটি চাল সংরক্ষণাগার বা সাইলো নির্মাণ করছে খাদ্য অধিদপ্তর। পুষ্টিগুণ অটুট রেখে এখানে কয়েক বছর চাল সংরক্ষণ করা সম্ভব। আধুনিক স্টিল রাইস সাইলো নির্মাণে বেশির ভাগ অর্থ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে ময়মনসিংহে ২০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৮ হাজার টন ধারণক্ষমতার সাইলোটি উদ্বোধন হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। টাঙ্গাইলের সাইলোও যাত্রা শুরু করেছে।

তবে উদ্বোধনের পর থেকেই এসব সাইলোতে শুরু হয়েছে অনিয়ম। চালের জন্য প্রস্তুত করা সাইলোতে রাখা হয়েছে গম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাইলোতে চালের বদলে গম রাখার বিষয়টি ছোটখাটো হেরফের মনে হলেও এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির বড় উপাদান। কারণ, আধুনিক এসব সাইলোর পুরোটাই ডিজিটাল। মাঠ থেকে সংগ্রহ করা চাল এখানে রাখতে গেলেই মুহূর্তেই চালের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, ওজন, মজুতের তারিখসহ সব তথ্য সংরক্ষণ হয়ে যাবে। পুরোনো চালকে নতুন বলে চালিয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। ফলে অনিয়মের সুযোগ না পেয়ে এসব সাইলোতে রাখা হচ্ছে আমদানি করা গম।

সম্প্রতি ময়মনসিংহের সাইলো পরিদর্শন করেছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল। তারা চালের সাইলোতে গম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, চালের সাইলোতে গম রাখার প্রযুক্তিগত কোনো সুবিধা নেই। গম রাখা বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিস্ফোরণের আশঙ্কাও আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জেলা-উপজেলার খাদ্যগুদামগুলোতে চাল সংরক্ষণ করা হয়। এসব গুদামে চাল সংগ্রহ ব্যবস্থায় মিলার ও পরিবহন ঠিকাদারদের ছিল বড় অনিয়ম। সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরোনো চাল নতুন কেনা বলে দেখানো হতো। গুদামে চালের ধারণক্ষমতাও ছিল খুবই কম। ফলে চাল নিয়ে কারসাজির কারণে বাজারে দাম বেড়ে যেত।

এমন পরিস্থিতিতে আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে সাতটি সাইলো নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। প্রথমে আটটি সাইলো নির্মাণের কথা থাকলেও শেষে নওগাঁর সাইলো বাদ দিয়ে এখন বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মহেশ্বরপাশা, চট্টগ্রাম ও মধুপুরে ৪ দশমিক ৮৭ লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক স্টিল সাইলো নির্মাণ হচ্ছে। খাদ্য ঘাটতি থেকে মুক্তি দেওয়াই ছিল এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

ময়মনসিংহের সাইলোর পাশাপাশি টাঙ্গাইলের মধুপুরসহ আরও কয়েকটি সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এজন্য তড়িঘড়ি করে গত জুন ও সেপ্টেম্বরে দুই দফায় ২০ হাজার টন গম স্থানান্তরের সূচি জারি করা হয়েছে।

গম রাখায় যান্ত্রিক ত্রুটি:

বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল রাইস সাইলো পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, সাইলোর ক্লিনার টাওয়ার না থাকায় ধুলা-ময়লায় বিল লাইনার (পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার হয়) পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। চিলার (তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র) ও ফিউমেগেশন (জীবাণুমুক্তকরণ) প্রক্রিয়া অকেজো হয়ে পড়েছে। চালের সাইলোতে প্রযুক্তিগত কারণে গম রাখা সম্ভব নয় বলে প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ মত দিয়েছিলেন।

তিনি এক প্রতিবেদনে বলেন, সাইলোতে বিকল্প কোনো পণ্য রাখা হলে যন্ত্রাংশগুলো সঠিকভাবে কাজ করবে না। কিছু কিছু যন্ত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি বিস্ফোরণের আশঙ্কাও আছে।

এছাড়া গত জুনে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে একটি চিঠিতে ময়মনসিংহ স্টিল রাইস সাইলোর সুপার ফয়জুল্লাহ খান শিবলী জানান, চালের সাইলোতে ক্লিনার টাওয়ার না থাকায় গম ডাস্টমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। চিলার ও নাইট্রোজেন ফিউমিগেশন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

ময়মনসিংহের সুপার বলেন, কোনো যান্ত্রিক পরিবর্তন না করেই চালের সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। এখানে আমার কিছু করার নেই। আমরা এটি বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলকেও জানিয়েছি।

প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ বলেন, তখন পরীক্ষা করার জন্য চাল পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই পরীক্ষা করার জন্য গম রাখা হয়েছে।

কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তরের চলাচল সংরক্ষণ ও সাইলো বিভাগের পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেওয়া আছে। প্রকল্পের টেকনিক্যাল কমিটিও গম রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। কারণ আমাদের গমের সাইলো মাত্র দুটি। ফলে চালের সাইলোতে গম রাখার অনুমোদন দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। দুজনের কথাতেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখও টেকনিক্যাল কমিটিতে ছিলেন। তিনি প্রকল্পের শুরুতে বলেছিলেন গম রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। ওই কমিটিতে আরও ছিলেন প্রকল্পের একজন কনসালট্যান্ট, যিনি সাইলো প্রকৌশলী। তারা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। খাদ্য কর্মকর্তাদের অভিযোগ, স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেটের স্বার্থরক্ষার জন্য এ প্রতিবেদন দিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, গমের সাইলোতে চাল রাখা যাবে না, চালের সাইলোতে গম রাখা যাবে। প্রকল্প শুরুতে আমি কী বলেছি, মনে নেই। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে কোনো সাইলোতে দীর্ঘ মেয়াদে গম রাখার কথা বলিনি। পরীক্ষামূলকভাবে রাখা যাবে বলেছি। এখন আমি নেই। যদি বর্তমান প্রশাসন মনে করে এটা রাখা ঠিক নয়, তাহলে চাল রাখবে।

এ বিষয়ে প্রকল্পের কনসালট্যান্ট মহিউদ্দিন বলেন, আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। ফলে এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না।

নেপথ্য কারণ:

দেশে চাল উৎপাদনে ময়মনসিংহ প্রসিদ্ধ। এ বিভাগে ১ দশমিক ১৯ লাখ টন ধারণক্ষমতার খাদ্যগুদাম আছে। সংগ্রহ করা চাল সরবরাহ, বস্তা কেনা, গোডাউনে রাখাসহ বিভিন্ন এলাকায় পরিবহনসহ নানা কাজে রয়েছে সরকারের বড় বরাদ্দ। এছাড়া কর্মকর্তারা মিলার ও পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ উৎকোচ পান। পাশাপাশি সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরোনো চাল নতুন কেনা দেখানোর মতো অনিয়মের অভিযোগ আছে। মানহীন চালও পুরোনো এই গোডাউনে রাখা যায়, যা আধুনিক সাইলোতে সম্ভব নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, আধুনিক চালের সাইলোতে গেলে এসব অনিয়ম বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ সব অটোমেশন হবে।

প্রকল্পে কর্মরত দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে চলা অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহকেন্দ্রিক দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তি ও মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় চালের সাইলোতে গম রাখার বিষয়ে প্রকল্প অফিস থেকে মতামত দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিটি সংগ্রহ মৌসুমে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র। এতে একদিকে যেমন অর্থ অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সাইলোর যন্ত্রাংশ ও রক্ষিত গম নষ্ট হচ্ছে।

এ দিকে খাদ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, সাইলোগুলো নির্মাণের স্থান নিয়েও নানান আলোচনা রয়েছে। যেমন মধুপুরে সাইলোর কোন প্রয়োজন ছিলনা, তবুও সেসময় খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক তার এলাকা মধুপুরে একটি সাইলো নির্মাণ করেন।

ছবি

একাধিক হত্যা মামলার আসামি কাউন্সিলর ফোরকান গ্রেপ্তার

ছবি

এস আলম ও পরিবারের ব্যাংক শেয়ার জব্দের নির্দেশ, দুদককে তদন্তের নির্দেশ

ছবি

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা : হাইকোর্টের রায় রোববার

ছবি

আত্মসমর্পণ করে জামিন পেলেন সেই তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি

ছবি

গণহত্যা মামলায় মামুন-জিয়াউলসহ আরও ৬ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখানো হলো

ছবি

জমি নিয়ে বিরোধ: মাদারীপুরে ২ বোনকে লাঠিপেটা, ভিডিও ভাইরাল

ছবি

উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিপণ, নজরদারিতে শিশুটির বাবা

ছবি

প্রতিবেশীর সাথে মুরগী নিয়ে ঝগড়া, সংঘর্ষে একজন নিহত, আহত ২

ছবি

রাজধানীর আজিমপুরে ডাকাতি মালামালের সঙ্গে দুধের শিশুকেও নিয়ে যায় ডাকাতরা

সূত্রাপুরে সাংবাদিকের বাসার গ্রিল কেটে ২০ ভরি স্বর্ণ ও আড়াই লাখ টাকা চুরি

ঝিকরগাছায় যুবদল কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা: ছাত্রদল নেতাসহ গ্রেপ্তার ৪

হাত খরচের টাকার জন্য মাকে খুন, ছেলে গ্রেপ্তার

ছবি

বেক্সিমকো ফার্মায় রিসিভার নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত

ছবি

শরীয়তপুরে সড়কের পাশে পড়ে থাকা দশটি ব্যাগ থেকে ১২৩টি ককটেল বোমা উদ্ধার

ছবি

কেন শিশু মুনতাহাকে হত্যা করে তার গৃহশিক্ষিকা?

ছবি

ঝিকরগাছায় দলীয় প্রতিপক্ষের হাতে যুবদল কর্মী খুন

জামালপুরে সেনা সদস্যের স্ত্রী ধর্ষণসহ হত্যা মামলার পলাতক আসামী গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১৪

আরিচা-কাজিরহাট-বাঘাবাড়ী ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুটে ড্রেজিংয়ের নামে ৭০০ কোটি টাকা লোপাট

ছবি

আদালতে আমুর আইনজীবীকে পিটুনি

সিলেটে ভারতীয় বৃহৎ চোরাই চালান জব্দ

নারায়ণগঞ্জে স্কুলছাত্রী হত্যায় যুবকের যাবজ্জীবন

যশোরে ‘বাজার কেন্দ্রীক বিরোধে’ খুন হন ব্যবসায়ী জামায়াত নেতা সজল

হত্যা মামলায় কারাগারে যশোর নগর বিএনপির সভাপতি মুল্লুক চাঁদ

না’গঞ্জে নারী পোশাক কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা, পুলিশ বলছে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’

ছবি

উখিয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, ৩ ব্যবসায়ীকে অর্থদণ্ড

ছবি

গান বাংলার চেয়ারম্যান তাপস গ্রেপ্তার

যশোরে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে ট্রাক হেলপার খুন

ছিনতাই ও চুরি হওয়া ৪৫টি মোবাইল ফোনসেট উদ্ধার

ছবি

সাবেক মন্ত্রী উবায়দুল মোকতাদির ৫ দিনের রিমান্ডে

চৌগাছায় ইউপি চেয়ারম্যান আশা হত্যাকান্ডের ২২ বছর পর তার ভাই খুন

ছবি

মিরপুরের সাবেক ডিসি জসিম গ্রেপ্তার

রাজশাহী নগরীতে যুবলীগ কর্মীকে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা

যশোরে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ দেশ ক্লিনিকের লাইসেন্স বাতিল ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি

খাগড়াছড়ি বিজিবি’র অভিযানে পানছড়ি সীমান্তে ভারতীয় মালামাল উদ্ধার

ছবি

খুলনায় ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যার দায়ে ২১ জনের যাবজ্জীবন

ছবি

রংপুরে কিশোরকে চোরের অপবাদে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন, ভিডিও ভাইরাল

tab

অপরাধ ও দুর্নীতি

চালের সাইলোতে রাখা গম, নেপথ্যে দুর্নীতিবাজ চক্র

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

>>বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলের বিস্ময়

>>নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ

>>অনিয়মের সুযোগ না পেয়ে এমন অনিয়ম

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও মজুত ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে দেশে সাতটি চাল সংরক্ষণাগার বা সাইলো নির্মাণ করছে খাদ্য অধিদপ্তর। পুষ্টিগুণ অটুট রেখে এখানে কয়েক বছর চাল সংরক্ষণ করা সম্ভব। আধুনিক স্টিল রাইস সাইলো নির্মাণে বেশির ভাগ অর্থ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে ময়মনসিংহে ২০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৮ হাজার টন ধারণক্ষমতার সাইলোটি উদ্বোধন হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। টাঙ্গাইলের সাইলোও যাত্রা শুরু করেছে।

তবে উদ্বোধনের পর থেকেই এসব সাইলোতে শুরু হয়েছে অনিয়ম। চালের জন্য প্রস্তুত করা সাইলোতে রাখা হয়েছে গম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাইলোতে চালের বদলে গম রাখার বিষয়টি ছোটখাটো হেরফের মনে হলেও এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির বড় উপাদান। কারণ, আধুনিক এসব সাইলোর পুরোটাই ডিজিটাল। মাঠ থেকে সংগ্রহ করা চাল এখানে রাখতে গেলেই মুহূর্তেই চালের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, ওজন, মজুতের তারিখসহ সব তথ্য সংরক্ষণ হয়ে যাবে। পুরোনো চালকে নতুন বলে চালিয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। ফলে অনিয়মের সুযোগ না পেয়ে এসব সাইলোতে রাখা হচ্ছে আমদানি করা গম।

সম্প্রতি ময়মনসিংহের সাইলো পরিদর্শন করেছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল। তারা চালের সাইলোতে গম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, চালের সাইলোতে গম রাখার প্রযুক্তিগত কোনো সুবিধা নেই। গম রাখা বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিস্ফোরণের আশঙ্কাও আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জেলা-উপজেলার খাদ্যগুদামগুলোতে চাল সংরক্ষণ করা হয়। এসব গুদামে চাল সংগ্রহ ব্যবস্থায় মিলার ও পরিবহন ঠিকাদারদের ছিল বড় অনিয়ম। সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরোনো চাল নতুন কেনা বলে দেখানো হতো। গুদামে চালের ধারণক্ষমতাও ছিল খুবই কম। ফলে চাল নিয়ে কারসাজির কারণে বাজারে দাম বেড়ে যেত।

এমন পরিস্থিতিতে আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে সাতটি সাইলো নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। প্রথমে আটটি সাইলো নির্মাণের কথা থাকলেও শেষে নওগাঁর সাইলো বাদ দিয়ে এখন বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মহেশ্বরপাশা, চট্টগ্রাম ও মধুপুরে ৪ দশমিক ৮৭ লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক স্টিল সাইলো নির্মাণ হচ্ছে। খাদ্য ঘাটতি থেকে মুক্তি দেওয়াই ছিল এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

ময়মনসিংহের সাইলোর পাশাপাশি টাঙ্গাইলের মধুপুরসহ আরও কয়েকটি সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এজন্য তড়িঘড়ি করে গত জুন ও সেপ্টেম্বরে দুই দফায় ২০ হাজার টন গম স্থানান্তরের সূচি জারি করা হয়েছে।

গম রাখায় যান্ত্রিক ত্রুটি:

বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল রাইস সাইলো পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, সাইলোর ক্লিনার টাওয়ার না থাকায় ধুলা-ময়লায় বিল লাইনার (পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার হয়) পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। চিলার (তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র) ও ফিউমেগেশন (জীবাণুমুক্তকরণ) প্রক্রিয়া অকেজো হয়ে পড়েছে। চালের সাইলোতে প্রযুক্তিগত কারণে গম রাখা সম্ভব নয় বলে প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ মত দিয়েছিলেন।

তিনি এক প্রতিবেদনে বলেন, সাইলোতে বিকল্প কোনো পণ্য রাখা হলে যন্ত্রাংশগুলো সঠিকভাবে কাজ করবে না। কিছু কিছু যন্ত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি বিস্ফোরণের আশঙ্কাও আছে।

এছাড়া গত জুনে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে একটি চিঠিতে ময়মনসিংহ স্টিল রাইস সাইলোর সুপার ফয়জুল্লাহ খান শিবলী জানান, চালের সাইলোতে ক্লিনার টাওয়ার না থাকায় গম ডাস্টমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। চিলার ও নাইট্রোজেন ফিউমিগেশন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

ময়মনসিংহের সুপার বলেন, কোনো যান্ত্রিক পরিবর্তন না করেই চালের সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। এখানে আমার কিছু করার নেই। আমরা এটি বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলকেও জানিয়েছি।

প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ বলেন, তখন পরীক্ষা করার জন্য চাল পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই পরীক্ষা করার জন্য গম রাখা হয়েছে।

কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তরের চলাচল সংরক্ষণ ও সাইলো বিভাগের পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেওয়া আছে। প্রকল্পের টেকনিক্যাল কমিটিও গম রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। কারণ আমাদের গমের সাইলো মাত্র দুটি। ফলে চালের সাইলোতে গম রাখার অনুমোদন দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। দুজনের কথাতেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখও টেকনিক্যাল কমিটিতে ছিলেন। তিনি প্রকল্পের শুরুতে বলেছিলেন গম রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। ওই কমিটিতে আরও ছিলেন প্রকল্পের একজন কনসালট্যান্ট, যিনি সাইলো প্রকৌশলী। তারা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। খাদ্য কর্মকর্তাদের অভিযোগ, স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেটের স্বার্থরক্ষার জন্য এ প্রতিবেদন দিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, গমের সাইলোতে চাল রাখা যাবে না, চালের সাইলোতে গম রাখা যাবে। প্রকল্প শুরুতে আমি কী বলেছি, মনে নেই। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে কোনো সাইলোতে দীর্ঘ মেয়াদে গম রাখার কথা বলিনি। পরীক্ষামূলকভাবে রাখা যাবে বলেছি। এখন আমি নেই। যদি বর্তমান প্রশাসন মনে করে এটা রাখা ঠিক নয়, তাহলে চাল রাখবে।

এ বিষয়ে প্রকল্পের কনসালট্যান্ট মহিউদ্দিন বলেন, আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। ফলে এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না।

নেপথ্য কারণ:

দেশে চাল উৎপাদনে ময়মনসিংহ প্রসিদ্ধ। এ বিভাগে ১ দশমিক ১৯ লাখ টন ধারণক্ষমতার খাদ্যগুদাম আছে। সংগ্রহ করা চাল সরবরাহ, বস্তা কেনা, গোডাউনে রাখাসহ বিভিন্ন এলাকায় পরিবহনসহ নানা কাজে রয়েছে সরকারের বড় বরাদ্দ। এছাড়া কর্মকর্তারা মিলার ও পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ উৎকোচ পান। পাশাপাশি সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরোনো চাল নতুন কেনা দেখানোর মতো অনিয়মের অভিযোগ আছে। মানহীন চালও পুরোনো এই গোডাউনে রাখা যায়, যা আধুনিক সাইলোতে সম্ভব নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, আধুনিক চালের সাইলোতে গেলে এসব অনিয়ম বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ সব অটোমেশন হবে।

প্রকল্পে কর্মরত দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে চলা অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহকেন্দ্রিক দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তি ও মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় চালের সাইলোতে গম রাখার বিষয়ে প্রকল্প অফিস থেকে মতামত দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিটি সংগ্রহ মৌসুমে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র। এতে একদিকে যেমন অর্থ অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সাইলোর যন্ত্রাংশ ও রক্ষিত গম নষ্ট হচ্ছে।

এ দিকে খাদ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, সাইলোগুলো নির্মাণের স্থান নিয়েও নানান আলোচনা রয়েছে। যেমন মধুপুরে সাইলোর কোন প্রয়োজন ছিলনা, তবুও সেসময় খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক তার এলাকা মধুপুরে একটি সাইলো নির্মাণ করেন।

back to top