alt

অপরাধ ও দুর্নীতি

ময়না তদন্ত, স্থানীয় পুলিশ বলছে আত্মহত্যা, পরে পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে এলো খুন

বাকী বিল্লাহ : শনিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২১

ঘটনা ২০১৬ সালের। রাজশাহীর বোয়ালমারিতে। এক যুবক ও এক যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া যায় সেখানকার হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে। যুবকের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল। আর নারীর লাশ বিছানায় বালিশ চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল।

ঘটনার পর মামলাও হয়েছিল। মামলাটির বাদী একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি ওই মৃত তরুণীর বাবা। ওই সময় তিনি গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত ছিলেন।

মৃতদেহের ময়না তদন্ত হলো, তাতে বলা হলো আত্মহত্যা। পুলিশও তদন্ত করল। আর তারপর থানা পুলিশ-‘কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায়’ –ঐ ময়না তদন্তের ওপর ‘ভিত্তি করেই’ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দিল-আত্মহত্যা।

কিন্তু থানা পুলিশের প্রতিবেদনে আদালত সন্তুষ্ট না হওয়ায় মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআইকে তদন্তের আদেশ দেয়। পিবিআইয়ের তদন্ত টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বেশ কিছুদিন পর রাজশাহী জেলার পিবিআই তদন্ত করে দেখল ওটা ছিল হত্যাকান্ড। ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ওই দুই খুন। সাবেক প্রেমিক ও তার সহযোগী/বন্ধুরা মিলে পরিকল্পিত ভাবে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।

মামলার বাদী গোয়েন্দা কর্মকর্তার মেয়ে সুমাইয়া নাসরিন ও তার বন্ধু মিজানুর রহমান। তারা সেদিন হোটেল নাইস ইণ্টারন্যাশনালে ছিলেন। আর এ খবর পেয়ে সুমাইয়ার সাবেক প্রেমিক ও তার বন্ধুসহ কয়েকজন ওই হোটেলে যান। তারা গোপনে খবর পেয়ে পরিকল্পিত ভাবে হোটেল নাইসের পাশের একটি ভবনের ছাদ দিয়ে একটু নিচে নেমে হোটেলের জানালা খুলে তাদের কক্ষে ঢুকে। ওই সময় মিজান হোটেলের বাইরে ছিল। আর সুমাইয়া হোটেল রুমে অবস্থান করছিল। তখন অভিযুক্তরা সুমাইয়াকে দিয়ে মিজানকে ফোন করে। মিজান সুমাইয়ার ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি হোটেলে গিয়ে রুমে ঢুকলে অভিযুক্তরা সুমাইয়ার বন্ধু মিজানকে জাপটে ধরে। এরপর হোটেল রুমে সুমাইয়ার সামনে মিজানকে প্রচন্ড মারপিট করে। একপর্যায়ে রুমের ভিতরে সুমাইয়ার ওড়না নিয়ে মিজানের গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে। মিজানের লাশ ফেলে রেখে হোটেল কক্ষে অভিযুক্ত রাহাত ও আল-আমিন সুমাইয়াকে ধর্ষণ করে। এরপর তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। দুজনকে হত্যার পর মিজানের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। আর সুমাইয়ার লাশ হোটেলে বিছানায় বালিশ চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল। এ সবই বেরিয়ে এসেছে পিবিআইয়ের তদন্তে। পিবিআই আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৪ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

গ্রেফতারকৃতরা হলো, সুমাইয়ার বন্ধু আল-আমিন, বোরহানুল কবির, আহসান হাবিব ও রাহাত মাহমুদ। তারা সবাই ওই সময় ছাত্র ছিল।

শুধু এই ঘটনাই নয়, এরকম ১৩টি ‘আত্মহত্যার’ ঘটনার অধিকতর তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই দেখছে ওগুলো সবগুলোই ছিল হত্যাকান্ড। তারা অনেক অপরাধীকেই গ্রেফতার করেছে ও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত আলামত জব্দ করেছে। আর এসব মামলার অনেক অভিযুক্তই আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাছের সঙ্গে রশিতে ঝুলন্ত একটি লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ত্রিশাল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

এ ঘটনায়ও ময়না তদন্তে বলা হয় এটা আত্মহত্যা। এ মামলার বাদীর অভিযোগ থাকার পরও থানা পুলিশ নিয়মিত বা অপমৃত্যুর মামলা না নিয়ে সাধারণ ডাইরি (জিডি) নিয়ে ময়না তদন্তের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ঘটনার নিষ্পত্তি করে।

আদালত থানা পুলিশের প্রতিবেদন গ্রহণ না করে নিয়মিত মামলা করার নির্দেশ দেয়। ত্রিশাল থানা মামলাটি তদন্ত শুরু করেছিল। তবে বাদী থানা পুলিশের তদন্তে অনাস্থা পোষণ করলে আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। পিবিআইয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত মেম্বার পদপ্রার্থী কাইয়ুমসহ ১১ জন মিলে ঘটনার দিন রাতে মোনায়েম মেম্বারকে স্থানীয় তারা মিয়া ওরফে তারুর বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে। পরে লাশ গাছের ডালে রশিতে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে।

রাজনৈতিক ও পূর্বশত্রুতার জেরে ওই হত্যাকান্ড। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়ে মোনায়েম মেম্বারকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিয়ে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে গলা টিপে হত্যা করে তার প্রতিপক্ষ। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় ময়না তদন্ত করতে গিয়ে চিকিৎসক তার প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ঘটনাটি আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু বলে উল্লেখ করেছেন।

এ ঘটনায় পিবিআই ৫ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে। এরমধ্যে তিনজন আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। পিবিআই এই হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অটোরিকশা (সিএনজি) ও অন্যান্য আলামত উদ্ধার করেছে। পিবিআই তদন্ত শেষে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিটও দিয়েছে।

এভাবে বগুড়া জেলার শেরপুর থানার একটি মামলা, ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানার একটি মামলা, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার চকবাজার থানার একটি মামলা, গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার একটি মামলা, শ্রীপুর মডেল থানার একটি মামলা, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানার একটি মামলা, ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানার একটি মামলা, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার একটি মামলা, টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর থানার একটি মামলা, রংপুরের একটি মামলা ও গোপালগঞ্জ জেলার একটিসহ এই ধরনের ১৩টি মামলা পিবিআইয়ের তদন্তে রহস্য উদঘাটন ও হত্যা মামলা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এসব মামলায় ময়না তদন্তে আত্মহত্যা বলা হলেও পিবিআইয়ের তদন্তে পরিকল্পিত খুন বলে প্রমাণ হয়েছে।

পিবিআই কর্তৃপক্ষ তাদের মতামতে বলেছে, “ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের ফরেনসিক বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। ময়না তদন্ত করতে পারবে ওই সব ডাক্তারদের কী কী প্রশিক্ষণ থাকা দরকার সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার।”

“ময়না তদন্ত যেহেতু একটি বিশেষ ধরনের আইনগত দায়িত্ব এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক সাক্ষ্য - এ কাজের গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আলাদা স্থান দরকার। ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতালে একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আবশ্যই থাকতে হবে। আর ময়না তদন্ত রিপোর্ট পেতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হয়। এতে মামলার তদন্তের ধারাবাহিকতায় বিঘ্ন ঘটে।”

বলা হয়, ময়না তদন্তে ডাক্তাররা ডোমদের সাহায্য নিয়ে থাকেন। অথচ ডোমদের দায়িত্ব ময়না তদন্তের জন্য মৃতদেহ প্রস্তুত করে ডাক্তারের কাছে উপস্থাপন করা। কোন কোন ক্ষেত্রে ময়না তদন্তের পর রাসায়নিক পরীক্ষকের মতামত ভিন্ন হলে সেক্ষেত্রে বিশেষ বোর্ড গঠন করে চূড়ান্ত মতামত নেয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে ময়না তদন্ত রিপোর্ট বা পোস্টমর্টেম রিপোর্টের পাশাপাশি অন্যান্য তদন্ত সহায়ক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে সঠিক, বস্তনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে হবে।

পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার তার লিখিত প্রতিবেদনে বলেছেন, “সঠিক ময়না তদন্ত না হওয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রধান কারণ হলো ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের ফরেনসিক এর ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনা না থাকা। তদন্তের ক্ষেত্রে সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর পিবিআইয়ের টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বাদী-বিবাদীসহ সবার সঙ্গে কথা বলে মামলার ক্লু উদঘাটন করেছে।

একজন অভিজ্ঞ ডোম সংবাদকে জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা ডোম ছিল। তাদের কাছ থেকে এবং জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের কাছ থেকে শিখে এখন ডোম হিসেবে কাজ করছেন। তাদের আলাদা কোন প্রশিক্ষণ নেই। তার মতে ঢাকায় ময়না তদন্ত ভালো হলেও ঢাকার বাইরে সমস্যা হচ্ছে। সেখানে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের অভাব রয়েছে।

একজন সাবেক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সংবাদকে বলেন, “ময়না তদন্তের ইনভেস্টিগেশন ঠিকমতো না হওয়ায় বা ত্রুটি থাকায় সমস্যা হচ্ছে। আগে ময়না তদন্ত ছাড়াও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সব কিছু বিবেচনা করে প্রতিবেদন দিত। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। যার কারণে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। আর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের অভাবও রয়েছে। জেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ নেই। কলেজগুলোতে বিশেষজ্ঞ থাকলেও জেলা হাসপাতালে নেই। সেখানে ত্রুটি হতে পারে।”

ছবি

অর্থপাচার মামলায় বিএসবি গ্লোবালের বাশার ১০ দিনের রিমান্ডে

জাফলংয়ে বিএনপি নেতার নেতৃত্বে ইজারা বহির্ভূত ইসিএ এলাকা থেকে বালু লুটপাটের মহোৎসব

ছবি

পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা না পেয়ে আবাসন প্রতিষ্ঠানে হামলা, তিনজন আটক

ছবি

মিডফোর্ড হত্যাকাণ্ড: অভিযুক্তদের একজন বলছে ‘আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম, কাউকে মারিনি’, অন্যজন নিজেকে ‘ফাঁসানো’র দাবি

ছবি

১০ মাসে সাড়ে সাত হাজার গ্রেপ্তার, পাঁচ শতাধিক অস্ত্র উদ্ধার:র‌্যাব

ছবি

শ্রীনগরে স্বপন মেম্বার ধর্ষণ ও পর্ণোগ্রাফি মামলায় গ্রেফতার

সোনারগাঁয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে স্কুল ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, পুলিশের উদাসীনতায় ঘটনা ধামাচাপার চেষ্টা

শেখ হাসিনার বিচার শুরুর নির্দেশ, রাজসাক্ষী হতে চান সাবেক আইজিপি মামুন

ছবি

হাতিরঝিলের হত্যা মামলায় সুব্রত বাইনকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি

ছবি

‘বিদেশ থেকে প্রমাণ না মেলায় তদন্ত বিলম্বিত’ — দুদক

ছবি

মালয়েশিয়ায় ‘জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা’: ঢাকায় ৩৫ প্রবাসীর বিরুদ্ধে মামলা

ছবি

লোহাগাড়ায় ১১ মৃত্যু: অবশেষে ধরা পড়লেন বাস চালক সোহেল

ছবি

অস্ত্র মামলায় আনিসুল হকের দুই দিনের রিমান্ড

ছবি

পলাতক ২৩ জনকে আদালতে হাজিরের নির্দেশ, হাজির না হলে অনুপস্থিতিতেই বিচার

ছবি

পীরগাছায় পুলিশের অভিযানে চুরি হওয়া ৩ মোটরসাইকেলসহ গ্রেফতার ৫

ছবি

মুরাদনগরে নারী নির্যাতনের ঘটনায় মূল উসকানিদাতা ভাই শাহ পরাণ: পরিকল্পনায় ‘মব’, ভিডিওও তার ‘নির্দেশে’

ছবি

মুরাদনগরে ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় চার আসামির তিন দিনের রিমান্ড

ভোটবিহীন নির্বাচন মামলায় নূরুল হুদা কারাগারে, পেলেন না জামিন

ছবি

শেখ রেহানার স্বামী ও তারিক সিদ্দিকের সম্পত্তি জব্দের আদেশ

ছবি

আদালত অবমাননায় শেখ হাসিনার ৬ মাসের কারাদণ্ড

ছবি

বিএনপির মামলায় সাবেক সিইসি নূরুল হুদার জবানবন্দি রেকর্ড শুরু

ছবি

আবু সাঈদ হত্যা মামলা: বেরোবির সাবেক উপাচার্যসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

ছবি

তিনটি হত্যা মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ, আছেন সাবেক এসপিও

ধর্ষণের পর বিবস্ত্র অবস্থায় মারধর, ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৫

ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাইকোর্টের নির্দেশ

রূপগঞ্জে মদ্যপ অবস্থায় অশোভন আচরণ, প্রতিবাদ করায় দুই যুবককে গুলি

নাইক্ষ্যংছড়িতে ইমাম হত্যা,৫ জনকে আসামী করে মামলা

ছবি

হত্যা মামলায় ইনু, কামাল, পলকসহ চারজনকে গ্রেপ্তার দেখালো আদালত

ছবি

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ মামলায় প্রিন্স মামুনের বিচার শুরু

ছবি

ব্রিটিশ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ অস্বীকার করে দুদক চেয়ারম্যান, টিউলিপকে বাংলাদেশি নাগরিক বলেও মন্তব্য

ছবি

১৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবরুদ্ধ, এস আলম গ্রুপ ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতের কঠোর পদক্ষেপ

ছবি

‘ভোটের প্রতারণা’ অভিযোগে রিমান্ড শুনানিতে নিজেকে নির্দোষ দাবি নূরুল হুদার

ছবি

নগদের ১ কোটি টাকার ডাকাতি: রহস্য উদঘাটনের দাবি পুলিশের, উদ্ধার সাড়ে ৩২ লাখ

ছবি

স্বপ্না হত্যা: থানা থেকে সিআইডি, তবু রহস্য অজানা

ছবি

সাক্ষ্যগ্রহণের দিনে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালাল অপহরণ ও হত্যার আসামি

ছবি

আদালত অবমাননার মামলায় আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামানকে ট্রাইব্যুনালের সহায়তাকারী নিযুক্ত

tab

অপরাধ ও দুর্নীতি

ময়না তদন্ত, স্থানীয় পুলিশ বলছে আত্মহত্যা, পরে পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে এলো খুন

বাকী বিল্লাহ

শনিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২১

ঘটনা ২০১৬ সালের। রাজশাহীর বোয়ালমারিতে। এক যুবক ও এক যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া যায় সেখানকার হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে। যুবকের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল। আর নারীর লাশ বিছানায় বালিশ চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল।

ঘটনার পর মামলাও হয়েছিল। মামলাটির বাদী একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি ওই মৃত তরুণীর বাবা। ওই সময় তিনি গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত ছিলেন।

মৃতদেহের ময়না তদন্ত হলো, তাতে বলা হলো আত্মহত্যা। পুলিশও তদন্ত করল। আর তারপর থানা পুলিশ-‘কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায়’ –ঐ ময়না তদন্তের ওপর ‘ভিত্তি করেই’ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দিল-আত্মহত্যা।

কিন্তু থানা পুলিশের প্রতিবেদনে আদালত সন্তুষ্ট না হওয়ায় মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআইকে তদন্তের আদেশ দেয়। পিবিআইয়ের তদন্ত টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বেশ কিছুদিন পর রাজশাহী জেলার পিবিআই তদন্ত করে দেখল ওটা ছিল হত্যাকান্ড। ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ওই দুই খুন। সাবেক প্রেমিক ও তার সহযোগী/বন্ধুরা মিলে পরিকল্পিত ভাবে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।

মামলার বাদী গোয়েন্দা কর্মকর্তার মেয়ে সুমাইয়া নাসরিন ও তার বন্ধু মিজানুর রহমান। তারা সেদিন হোটেল নাইস ইণ্টারন্যাশনালে ছিলেন। আর এ খবর পেয়ে সুমাইয়ার সাবেক প্রেমিক ও তার বন্ধুসহ কয়েকজন ওই হোটেলে যান। তারা গোপনে খবর পেয়ে পরিকল্পিত ভাবে হোটেল নাইসের পাশের একটি ভবনের ছাদ দিয়ে একটু নিচে নেমে হোটেলের জানালা খুলে তাদের কক্ষে ঢুকে। ওই সময় মিজান হোটেলের বাইরে ছিল। আর সুমাইয়া হোটেল রুমে অবস্থান করছিল। তখন অভিযুক্তরা সুমাইয়াকে দিয়ে মিজানকে ফোন করে। মিজান সুমাইয়ার ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি হোটেলে গিয়ে রুমে ঢুকলে অভিযুক্তরা সুমাইয়ার বন্ধু মিজানকে জাপটে ধরে। এরপর হোটেল রুমে সুমাইয়ার সামনে মিজানকে প্রচন্ড মারপিট করে। একপর্যায়ে রুমের ভিতরে সুমাইয়ার ওড়না নিয়ে মিজানের গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে। মিজানের লাশ ফেলে রেখে হোটেল কক্ষে অভিযুক্ত রাহাত ও আল-আমিন সুমাইয়াকে ধর্ষণ করে। এরপর তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। দুজনকে হত্যার পর মিজানের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। আর সুমাইয়ার লাশ হোটেলে বিছানায় বালিশ চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল। এ সবই বেরিয়ে এসেছে পিবিআইয়ের তদন্তে। পিবিআই আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৪ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

গ্রেফতারকৃতরা হলো, সুমাইয়ার বন্ধু আল-আমিন, বোরহানুল কবির, আহসান হাবিব ও রাহাত মাহমুদ। তারা সবাই ওই সময় ছাত্র ছিল।

শুধু এই ঘটনাই নয়, এরকম ১৩টি ‘আত্মহত্যার’ ঘটনার অধিকতর তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই দেখছে ওগুলো সবগুলোই ছিল হত্যাকান্ড। তারা অনেক অপরাধীকেই গ্রেফতার করেছে ও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত আলামত জব্দ করেছে। আর এসব মামলার অনেক অভিযুক্তই আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাছের সঙ্গে রশিতে ঝুলন্ত একটি লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ত্রিশাল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

এ ঘটনায়ও ময়না তদন্তে বলা হয় এটা আত্মহত্যা। এ মামলার বাদীর অভিযোগ থাকার পরও থানা পুলিশ নিয়মিত বা অপমৃত্যুর মামলা না নিয়ে সাধারণ ডাইরি (জিডি) নিয়ে ময়না তদন্তের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ঘটনার নিষ্পত্তি করে।

আদালত থানা পুলিশের প্রতিবেদন গ্রহণ না করে নিয়মিত মামলা করার নির্দেশ দেয়। ত্রিশাল থানা মামলাটি তদন্ত শুরু করেছিল। তবে বাদী থানা পুলিশের তদন্তে অনাস্থা পোষণ করলে আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। পিবিআইয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত মেম্বার পদপ্রার্থী কাইয়ুমসহ ১১ জন মিলে ঘটনার দিন রাতে মোনায়েম মেম্বারকে স্থানীয় তারা মিয়া ওরফে তারুর বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে। পরে লাশ গাছের ডালে রশিতে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে।

রাজনৈতিক ও পূর্বশত্রুতার জেরে ওই হত্যাকান্ড। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়ে মোনায়েম মেম্বারকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিয়ে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে গলা টিপে হত্যা করে তার প্রতিপক্ষ। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় ময়না তদন্ত করতে গিয়ে চিকিৎসক তার প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ঘটনাটি আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু বলে উল্লেখ করেছেন।

এ ঘটনায় পিবিআই ৫ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে। এরমধ্যে তিনজন আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। পিবিআই এই হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অটোরিকশা (সিএনজি) ও অন্যান্য আলামত উদ্ধার করেছে। পিবিআই তদন্ত শেষে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিটও দিয়েছে।

এভাবে বগুড়া জেলার শেরপুর থানার একটি মামলা, ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানার একটি মামলা, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার চকবাজার থানার একটি মামলা, গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার একটি মামলা, শ্রীপুর মডেল থানার একটি মামলা, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানার একটি মামলা, ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানার একটি মামলা, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার একটি মামলা, টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর থানার একটি মামলা, রংপুরের একটি মামলা ও গোপালগঞ্জ জেলার একটিসহ এই ধরনের ১৩টি মামলা পিবিআইয়ের তদন্তে রহস্য উদঘাটন ও হত্যা মামলা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এসব মামলায় ময়না তদন্তে আত্মহত্যা বলা হলেও পিবিআইয়ের তদন্তে পরিকল্পিত খুন বলে প্রমাণ হয়েছে।

পিবিআই কর্তৃপক্ষ তাদের মতামতে বলেছে, “ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের ফরেনসিক বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। ময়না তদন্ত করতে পারবে ওই সব ডাক্তারদের কী কী প্রশিক্ষণ থাকা দরকার সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার।”

“ময়না তদন্ত যেহেতু একটি বিশেষ ধরনের আইনগত দায়িত্ব এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক সাক্ষ্য - এ কাজের গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আলাদা স্থান দরকার। ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতালে একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আবশ্যই থাকতে হবে। আর ময়না তদন্ত রিপোর্ট পেতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হয়। এতে মামলার তদন্তের ধারাবাহিকতায় বিঘ্ন ঘটে।”

বলা হয়, ময়না তদন্তে ডাক্তাররা ডোমদের সাহায্য নিয়ে থাকেন। অথচ ডোমদের দায়িত্ব ময়না তদন্তের জন্য মৃতদেহ প্রস্তুত করে ডাক্তারের কাছে উপস্থাপন করা। কোন কোন ক্ষেত্রে ময়না তদন্তের পর রাসায়নিক পরীক্ষকের মতামত ভিন্ন হলে সেক্ষেত্রে বিশেষ বোর্ড গঠন করে চূড়ান্ত মতামত নেয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে ময়না তদন্ত রিপোর্ট বা পোস্টমর্টেম রিপোর্টের পাশাপাশি অন্যান্য তদন্ত সহায়ক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে সঠিক, বস্তনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে হবে।

পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার তার লিখিত প্রতিবেদনে বলেছেন, “সঠিক ময়না তদন্ত না হওয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রধান কারণ হলো ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের ফরেনসিক এর ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনা না থাকা। তদন্তের ক্ষেত্রে সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর পিবিআইয়ের টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বাদী-বিবাদীসহ সবার সঙ্গে কথা বলে মামলার ক্লু উদঘাটন করেছে।

একজন অভিজ্ঞ ডোম সংবাদকে জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা ডোম ছিল। তাদের কাছ থেকে এবং জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের কাছ থেকে শিখে এখন ডোম হিসেবে কাজ করছেন। তাদের আলাদা কোন প্রশিক্ষণ নেই। তার মতে ঢাকায় ময়না তদন্ত ভালো হলেও ঢাকার বাইরে সমস্যা হচ্ছে। সেখানে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের অভাব রয়েছে।

একজন সাবেক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সংবাদকে বলেন, “ময়না তদন্তের ইনভেস্টিগেশন ঠিকমতো না হওয়ায় বা ত্রুটি থাকায় সমস্যা হচ্ছে। আগে ময়না তদন্ত ছাড়াও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সব কিছু বিবেচনা করে প্রতিবেদন দিত। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। যার কারণে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। আর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের অভাবও রয়েছে। জেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ নেই। কলেজগুলোতে বিশেষজ্ঞ থাকলেও জেলা হাসপাতালে নেই। সেখানে ত্রুটি হতে পারে।”

back to top