অবরুদ্ধ গাজায় এক বছরের বেশি সময় ধরে চালানো ইসরায়েলি আগ্রাসনে প্রায় ৪৩ হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। যার সিংহভাগ শিশু ও নারী। গাজা থেকে ফেরার পর ইসরায়েলের হাজার হাজার সেনা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। নিজেদের চালানো বর্বরতা দেখে ‘পাগল’ হয়ে গেছেন। কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। ২১ অক্টোবর সোমবার সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) সদস্যদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। ইসরায়েলি নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন বিভাগ উল্লেখ করেছে যে, প্রতিমাসে এক হাজারেরও বেশি নতুন সেনা চিকিৎসার জন্য যুদ্ধে থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। যার মধ্যে ৩৫ শতাংশই তাদের মানসিক অবস্থার ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন এবং ২৭ শতাংশ পিটিএসডি-তে ভুগছেন।
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ প্রায় ১৪ হাজার আহত ইসরায়েলি সেনা চিকিৎসা নিতে পারে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এরমধ্যে ৪০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইডিএফের একজন চিকিৎসক সিএনএনকে বলেছেন, কিছু যুবক সেনা ট্রমার শিকার হয়েছেন এবং প্রায়ই কাঁদেন বা আবেগ-প্রবণ হয়ে পড়েন।
ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ জানিয়েছে, সংবাদপত্রের প্রাপ্ত সামরিক তথ্য অনুসারে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ১১ মে পর্যন্ত ১০ জন সেনা আত্মহত্যা করেছেন। তবে আইডিএফ আত্মহত্যাকারী সেনাদের সঠিক তথ্য সিএনএনকে দেয়নি। গাজা যুদ্ধে পাস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) বা মানসিক অসুস্থতায় ভোগা হাজার হাজার সৈন্যকে তারা চিকিৎসা দিচ্ছে বলে জানিয়েছে।
যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েলি সেনাদের আত্মহত্যার সংখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে একজন মনোবিজ্ঞানী এবং আইডিএফ-এর কমব্যাট রেসপন্স ইউনিটের কমান্ডার উজি বেচোর বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলার অনুমতি দেয়া হয় না। তবে আইডিএফ আত্মহত্যার হারকে বড় করে দেখে।’
গাজায় যুদ্ধ করা ইসরায়েলি সৈন্যরা সিএনএনকে জানিয়েছেন, ‘তারা এমন ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন যা বাইরের বিশ্বের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে বোঝা সম্ভব নয়’। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সমালোচিত “চিরস্থায়ী যুদ্ধে” অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় বেশিরভাগ সৈন্যদের মধ্যে আত্মঘৃণার মনোভাব তৈরি হয়েছে। তাই বাড়িতে ফিরে অনেকাংশই আড়ালে রয়েছে বা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
এমনই একজন ইসরায়েলি সেনাসদস্য এলিরান মিজরাহি (৪০)। চার সন্তানের এই পিতাকে ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধেও জন্য পাঠানো হয়েছিল। যুদ্ধের ছয় মাসের মাথায় আহত হলে তাকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনা হয়। সেখান থেকে ফিরে পিটিএসডির সঙ্গে লড়াই করছিলেন। এরপর তিনি সাপ্তাহিক থেরাপি নিতে থাকেন। তবে এই চিকিৎসা তার কোনো উপকারে আসেনি। পুনরায় এলিরানকে যুদ্ধে পাঠানোর আগেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি।
এলিরান মিজরাহি ছুটিতে থাকার সময় রাগ ও অনিদ্রায় ভুগছিলেন। তিনি সামাজ থেকেও দূরে সরে যান বলে তার পরিবার জানায়। তিনি তার পরিবারকে বলেছিলেন, তার সঙ্গে যারা গাজায় ছিল তারাই বুঝতে পারে তার কী অবস্থা। এলিরানের মা জেনি মিজরাহি বলেন, ‘সে গাজা ছেড়েছিল, তবে গাজা তাকে ছাড়েনি। সেই অবসাদেই আমার ছেলে মারা গেল।’
তার বোন শির সিএনএনকে বলেছেন, সে সবসময় বলত, আমি যে কী দেখে এসেছি, তা কেউ বুঝবে না। যুদ্ধে নৃশংসতার দৃশ্য তার হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। জেনি সন্দেহ করেছিলেন যে তার ছেলে কাউকে হত্যা করেছে এবং তা মেনে নিতে পারেনি।
ভাই এলিরানের মৃত্যুর জন্য শির যুদ্ধ’কে দায়ী করেছেন। বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীর কারণে এবং এই যুদ্ধের কারণে আমার ভাই আজ এখানে অনুপস্থিত। তিনি যুদ্ধে গুলির আঘাতে মারা যাননি, তবে “অদৃশ্য গুলির” অর্থাৎ মানসিক যন্ত্রণার কারণে মারা গেছেন।
গাজায় মোতায়েন হওয়ার পর এলিরানকে ৬২ টনের একটি সাঁজোয়া যান ডি-৯ বুলডোজার চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। যাতে প্রচুর গুলি এবং বিস্ফোরক ছিল। বেসামরিক এলিরান একটি নির্মাণ কোম্পানিতে ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর তিনি যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন বলে তার মা সিএনএনকে জানিয়েছেন।
এলিরান মিজরাহির বন্ধু এবং বুলডোজারের সহ-চালক গাই জাকেন তাদের গাজায় কাটানো সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বলেছেন, ‘আমরা খুবই, খুবই, খুবই কঠিন জিনিস দেখেছি। এমন জিনিস যা মেনে নেয়া কঠিন।’
গাজায় ইসরায়েলি সৈন্যদের মানসিক আঘাত নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন প্রাক্তন এই সৈনিক। জুন মাসে ইসরায়েলের সংসদ নেসেটে দেয়া এক সাক্ষ্যে জাকেন বলেছিলেন, বহুবার সৈন্যদের ‘শত-শত জীবিত এবং মৃত সন্ত্রাসীদের ওপর দিয়ে বুলডোজার চালাতে হয়েছে। তাদের দেহ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে সবকিছু ছিটকে বেরিয়ে আসে।’
জাকেন এখন আর মাংস খেতে পারেন না। কারণ মাংস খেতে গেলেই গাজায় দেখা নৃশংসতার দৃশ্যের কথা মনে পড়ে তার। রাতে ঘুমাতেও কষ্ট হয়, মাথায় এখনও বিস্ফোরণের শব্দ বাজতে থাকে। লাশগুলোকে ‘মাংস’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যখন আপনি বাইরে আমাদেও ও তাদের (হামাস) অনেক মাংস এবং রক্ত দেখেন, তখন এটি খাওয়ার সময় আপনাকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে।’
হামাস যোদ্ধারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে থাকার অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে। তাই আমাদের যুদ্ধের ময়দানে ‘সাধারণ মানুষ’ বলে কিছু নেই। তবে, সৈন্যরা যখন প্রকৃতপক্ষ বেসামরিক মানুষদের মুখোমুখি হয় তখন অনেকেই নৈতিক সংকটে পড়ে যান বলে একজন আইডিএফ কমান্ডার জানান।
আইডিএফ জানিয়েছে, তারা গাজায় বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করছে। যার মধ্যে রয়েছে মেসেজ পাঠানো, ফোন কল করা এবং হামলার আগে লোকদের সতর্ক করার জন্য লিফলেট ফেলা। তবুও, গাজার বেসামরিক লোকেরা বারবার ব্যাপক হারে নিহত হয়েছেন। এমনকি সেইসব এলাকায়ও যেগুলো সেনাবাহিনী নিজেই ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গাজায় মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ত্রাণ সংস্থা এবং জাতিসংঘ একাধিকবার গাজায় বেসামরিক জনগণের উপর যুদ্ধের বিপর্যয়কর মানসিক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছে। গাজাবাসীরা ইতোমধ্যেই ১৭ বছরের অবরোধ এবং ইসরায়েলের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধের ফলে মানসিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগস্ট মাসে এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার মানুষদের অভিজ্ঞতা ‘প্রচলিত বায়োমেডিক্যাল সংজ্ঞা’ অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা কঠিন।
১৯৮২ সালে লেবানন যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে ছয় বছর কাজ করা লন্ডনের কিংস কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আহরন ব্রেগম্যান বলেছেন, ‘গাজার যুদ্ধ অন্য যেকোনো যুদ্ধের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। এটি দীর্ঘ এবং শহুরে যুদ্ধ। যার মানে সৈন্যদের অনেক মানুষের মধ্যে লড়াই করতে হয়, যার বিশাল সংখ্যকই বেসামরিক।’
বুলডোজার চালকরা যুদ্ধের নৃশংসতার সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষদর্শী উল্লেখ করে তিনি সিএনএনকে বলেন, ‘তারা যা দেখে তা হলো লাশ, এবং তারা এগুলোকে ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে পরিষ্কার করে। আবার লাশের উপর দিয়ে চলেও যায়। অনেকের জন্যই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে বেসামরিক জীবনে ফেরা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, বিশেষ করে নারীদের ও শিশুদের মৃত্যু দেখে।’
ব্রেগম্যান বলেন, ‘আপনি কীভাবে আপনার সন্তানদের ঘুম পাড়াবেন, যখন আপনি জানেন, আপনি গাজায় শিশুদের মরতে দেখেছেন?
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জায়োনবাদীদের দ্বন্দ্ব, দীর্ঘদিনের নিপীড়নের জবাবে হামাসের হামলা ইসরায়েলিদের একত্রিত হচ্ছে উদ্বুদ্ধ করেছে। তবে গাজায় ফিলিস্তিনের দুর্ভোগ সিংহভাগই ইসরায়েলি টেলিভিশনে জায়গা পায় না। সেখানে গাজায় জিম্মি ইসরায়েলি নাগরিকদের সংবাদই প্রাধান্য পাচ্ছে।
হামাসের আক্রমণের পর জরিপগুলোতে দেখা যায়, বেশিরভাগ ইসরায়েলি গাজার যুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছেন। এবং জিম্মিদের মুক্তির জন্য আলোচনা করার সময়ও সরকারকে লড়াই বন্ধ করতে চাননি। ৭ অক্টোবরের হামলার বর্ষপূতিতে ইসরায়েলের ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, মাত্র ৬ শতাংশ ইসরায়েলি মনে করেন গাজার যুদ্ধ ‘মানব জীবনের উপর বিপুল ব্যয়ের’ কারণে বন্ধ করা উচিত।
বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪
অবরুদ্ধ গাজায় এক বছরের বেশি সময় ধরে চালানো ইসরায়েলি আগ্রাসনে প্রায় ৪৩ হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। যার সিংহভাগ শিশু ও নারী। গাজা থেকে ফেরার পর ইসরায়েলের হাজার হাজার সেনা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। নিজেদের চালানো বর্বরতা দেখে ‘পাগল’ হয়ে গেছেন। কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। ২১ অক্টোবর সোমবার সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) সদস্যদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। ইসরায়েলি নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন বিভাগ উল্লেখ করেছে যে, প্রতিমাসে এক হাজারেরও বেশি নতুন সেনা চিকিৎসার জন্য যুদ্ধে থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। যার মধ্যে ৩৫ শতাংশই তাদের মানসিক অবস্থার ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন এবং ২৭ শতাংশ পিটিএসডি-তে ভুগছেন।
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ প্রায় ১৪ হাজার আহত ইসরায়েলি সেনা চিকিৎসা নিতে পারে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এরমধ্যে ৪০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইডিএফের একজন চিকিৎসক সিএনএনকে বলেছেন, কিছু যুবক সেনা ট্রমার শিকার হয়েছেন এবং প্রায়ই কাঁদেন বা আবেগ-প্রবণ হয়ে পড়েন।
ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ জানিয়েছে, সংবাদপত্রের প্রাপ্ত সামরিক তথ্য অনুসারে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ১১ মে পর্যন্ত ১০ জন সেনা আত্মহত্যা করেছেন। তবে আইডিএফ আত্মহত্যাকারী সেনাদের সঠিক তথ্য সিএনএনকে দেয়নি। গাজা যুদ্ধে পাস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) বা মানসিক অসুস্থতায় ভোগা হাজার হাজার সৈন্যকে তারা চিকিৎসা দিচ্ছে বলে জানিয়েছে।
যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েলি সেনাদের আত্মহত্যার সংখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে একজন মনোবিজ্ঞানী এবং আইডিএফ-এর কমব্যাট রেসপন্স ইউনিটের কমান্ডার উজি বেচোর বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলার অনুমতি দেয়া হয় না। তবে আইডিএফ আত্মহত্যার হারকে বড় করে দেখে।’
গাজায় যুদ্ধ করা ইসরায়েলি সৈন্যরা সিএনএনকে জানিয়েছেন, ‘তারা এমন ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন যা বাইরের বিশ্বের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে বোঝা সম্ভব নয়’। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সমালোচিত “চিরস্থায়ী যুদ্ধে” অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় বেশিরভাগ সৈন্যদের মধ্যে আত্মঘৃণার মনোভাব তৈরি হয়েছে। তাই বাড়িতে ফিরে অনেকাংশই আড়ালে রয়েছে বা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
এমনই একজন ইসরায়েলি সেনাসদস্য এলিরান মিজরাহি (৪০)। চার সন্তানের এই পিতাকে ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধেও জন্য পাঠানো হয়েছিল। যুদ্ধের ছয় মাসের মাথায় আহত হলে তাকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনা হয়। সেখান থেকে ফিরে পিটিএসডির সঙ্গে লড়াই করছিলেন। এরপর তিনি সাপ্তাহিক থেরাপি নিতে থাকেন। তবে এই চিকিৎসা তার কোনো উপকারে আসেনি। পুনরায় এলিরানকে যুদ্ধে পাঠানোর আগেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি।
এলিরান মিজরাহি ছুটিতে থাকার সময় রাগ ও অনিদ্রায় ভুগছিলেন। তিনি সামাজ থেকেও দূরে সরে যান বলে তার পরিবার জানায়। তিনি তার পরিবারকে বলেছিলেন, তার সঙ্গে যারা গাজায় ছিল তারাই বুঝতে পারে তার কী অবস্থা। এলিরানের মা জেনি মিজরাহি বলেন, ‘সে গাজা ছেড়েছিল, তবে গাজা তাকে ছাড়েনি। সেই অবসাদেই আমার ছেলে মারা গেল।’
তার বোন শির সিএনএনকে বলেছেন, সে সবসময় বলত, আমি যে কী দেখে এসেছি, তা কেউ বুঝবে না। যুদ্ধে নৃশংসতার দৃশ্য তার হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। জেনি সন্দেহ করেছিলেন যে তার ছেলে কাউকে হত্যা করেছে এবং তা মেনে নিতে পারেনি।
ভাই এলিরানের মৃত্যুর জন্য শির যুদ্ধ’কে দায়ী করেছেন। বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীর কারণে এবং এই যুদ্ধের কারণে আমার ভাই আজ এখানে অনুপস্থিত। তিনি যুদ্ধে গুলির আঘাতে মারা যাননি, তবে “অদৃশ্য গুলির” অর্থাৎ মানসিক যন্ত্রণার কারণে মারা গেছেন।
গাজায় মোতায়েন হওয়ার পর এলিরানকে ৬২ টনের একটি সাঁজোয়া যান ডি-৯ বুলডোজার চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। যাতে প্রচুর গুলি এবং বিস্ফোরক ছিল। বেসামরিক এলিরান একটি নির্মাণ কোম্পানিতে ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর তিনি যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন বলে তার মা সিএনএনকে জানিয়েছেন।
এলিরান মিজরাহির বন্ধু এবং বুলডোজারের সহ-চালক গাই জাকেন তাদের গাজায় কাটানো সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বলেছেন, ‘আমরা খুবই, খুবই, খুবই কঠিন জিনিস দেখেছি। এমন জিনিস যা মেনে নেয়া কঠিন।’
গাজায় ইসরায়েলি সৈন্যদের মানসিক আঘাত নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন প্রাক্তন এই সৈনিক। জুন মাসে ইসরায়েলের সংসদ নেসেটে দেয়া এক সাক্ষ্যে জাকেন বলেছিলেন, বহুবার সৈন্যদের ‘শত-শত জীবিত এবং মৃত সন্ত্রাসীদের ওপর দিয়ে বুলডোজার চালাতে হয়েছে। তাদের দেহ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে সবকিছু ছিটকে বেরিয়ে আসে।’
জাকেন এখন আর মাংস খেতে পারেন না। কারণ মাংস খেতে গেলেই গাজায় দেখা নৃশংসতার দৃশ্যের কথা মনে পড়ে তার। রাতে ঘুমাতেও কষ্ট হয়, মাথায় এখনও বিস্ফোরণের শব্দ বাজতে থাকে। লাশগুলোকে ‘মাংস’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যখন আপনি বাইরে আমাদেও ও তাদের (হামাস) অনেক মাংস এবং রক্ত দেখেন, তখন এটি খাওয়ার সময় আপনাকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে।’
হামাস যোদ্ধারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে থাকার অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে। তাই আমাদের যুদ্ধের ময়দানে ‘সাধারণ মানুষ’ বলে কিছু নেই। তবে, সৈন্যরা যখন প্রকৃতপক্ষ বেসামরিক মানুষদের মুখোমুখি হয় তখন অনেকেই নৈতিক সংকটে পড়ে যান বলে একজন আইডিএফ কমান্ডার জানান।
আইডিএফ জানিয়েছে, তারা গাজায় বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করছে। যার মধ্যে রয়েছে মেসেজ পাঠানো, ফোন কল করা এবং হামলার আগে লোকদের সতর্ক করার জন্য লিফলেট ফেলা। তবুও, গাজার বেসামরিক লোকেরা বারবার ব্যাপক হারে নিহত হয়েছেন। এমনকি সেইসব এলাকায়ও যেগুলো সেনাবাহিনী নিজেই ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গাজায় মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ত্রাণ সংস্থা এবং জাতিসংঘ একাধিকবার গাজায় বেসামরিক জনগণের উপর যুদ্ধের বিপর্যয়কর মানসিক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছে। গাজাবাসীরা ইতোমধ্যেই ১৭ বছরের অবরোধ এবং ইসরায়েলের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধের ফলে মানসিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগস্ট মাসে এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার মানুষদের অভিজ্ঞতা ‘প্রচলিত বায়োমেডিক্যাল সংজ্ঞা’ অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা কঠিন।
১৯৮২ সালে লেবানন যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে ছয় বছর কাজ করা লন্ডনের কিংস কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আহরন ব্রেগম্যান বলেছেন, ‘গাজার যুদ্ধ অন্য যেকোনো যুদ্ধের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। এটি দীর্ঘ এবং শহুরে যুদ্ধ। যার মানে সৈন্যদের অনেক মানুষের মধ্যে লড়াই করতে হয়, যার বিশাল সংখ্যকই বেসামরিক।’
বুলডোজার চালকরা যুদ্ধের নৃশংসতার সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষদর্শী উল্লেখ করে তিনি সিএনএনকে বলেন, ‘তারা যা দেখে তা হলো লাশ, এবং তারা এগুলোকে ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে পরিষ্কার করে। আবার লাশের উপর দিয়ে চলেও যায়। অনেকের জন্যই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে বেসামরিক জীবনে ফেরা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, বিশেষ করে নারীদের ও শিশুদের মৃত্যু দেখে।’
ব্রেগম্যান বলেন, ‘আপনি কীভাবে আপনার সন্তানদের ঘুম পাড়াবেন, যখন আপনি জানেন, আপনি গাজায় শিশুদের মরতে দেখেছেন?
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জায়োনবাদীদের দ্বন্দ্ব, দীর্ঘদিনের নিপীড়নের জবাবে হামাসের হামলা ইসরায়েলিদের একত্রিত হচ্ছে উদ্বুদ্ধ করেছে। তবে গাজায় ফিলিস্তিনের দুর্ভোগ সিংহভাগই ইসরায়েলি টেলিভিশনে জায়গা পায় না। সেখানে গাজায় জিম্মি ইসরায়েলি নাগরিকদের সংবাদই প্রাধান্য পাচ্ছে।
হামাসের আক্রমণের পর জরিপগুলোতে দেখা যায়, বেশিরভাগ ইসরায়েলি গাজার যুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছেন। এবং জিম্মিদের মুক্তির জন্য আলোচনা করার সময়ও সরকারকে লড়াই বন্ধ করতে চাননি। ৭ অক্টোবরের হামলার বর্ষপূতিতে ইসরায়েলের ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, মাত্র ৬ শতাংশ ইসরায়েলি মনে করেন গাজার যুদ্ধ ‘মানব জীবনের উপর বিপুল ব্যয়ের’ কারণে বন্ধ করা উচিত।