বিক্ষোভকারীদের হাতে হামাস ও যুদ্ধবিরোধী প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে -এএফপি
গত কয়েক দিনে গাজা ভূখণ্ডে হামাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অনেককেই অবাক করেছে। বিশ্লেষকেরাও এই বিক্ষোভকে স্বতঃস্ফূর্ত বা খাঁটি বলে মনে করতে দ্বিধা বোধ করছেন। কারণ, দশক ধরে হামাস কঠোর হাতে গাজা শাসন করেছে এবং যেকোনো ধরনের ভিন্নমত দমন করেছে। তাই বিরল এই আন্দোলন কি স্বতঃস্ফূর্ত, নাকি এটি কোনো বিশেষ কৌশলের অংশ এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মধ্যে।
উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় এই বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। সাধারণত গাজায় প্রতিবাদ মানেই ইসরায়েলবিরোধী স্লোগান। কিন্তু এবারের বিক্ষোভের অন্যতম ব্যতিক্রম ছিল সরাসরি হামাসবিরোধী স্লোগান, যেখানে বিক্ষোভকারীরা চিৎকার করে বলছিলেন ‘হামাস, গেট আউট!’ গাজায় হামাসের দীর্ঘ ১৮ বছরের শাসনে এমন স্লোগান অভূতপূর্ব।
বিক্ষোভকারীরা হামাস নেতাদেরও সমালোচনা করেছেন। বিশেষত হামাস নেতা ওসামা হামদানকে লক্ষ্য করে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান চেয়েও স্লোগান দিতে শোনা যায়, যা ইসরায়েলি জিম্মিদের ইঙ্গিত করছিল।
তবে প্রথম দিকে হামাসের শীর্ষ নেতারা এই বিক্ষোভকে অস্বীকারের চেষ্টা করেন। হামাস নেতা হামদান দাবি করেন, এই বিক্ষোভ ইসরায়েল কর্তৃক সংগঠিত। অন্যদিকে হামাসের আরকে নেতা বাসেম নাইম কাতারের আল-আরাবি টেলিভিশনকে বলেন, এই বিক্ষোভে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল প্রভাব বিস্তার করেছে, যাতে হামাসের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা যায়।
হামাস চায় জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামকে তাদের সঙ্গে একাকার করে দেখাতে। ফলে যেকোনো হামাসবিরোধী আন্দোলনকে তারা ইসরায়েলের সহায়ক শক্তি হিসেবে চিত্রিত করতে চায়। হামাস ও আল জাজিরার মতো তাদের ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমও প্রথমে এই বিক্ষোভ এড়িয়ে যায়। তারা ইসরায়েলবিরোধী স্লোগানগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে এবং হামাসবিরোধী বক্তব্য পুরোপুরি এড়িয়ে যায়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আল-জাজিরা স্বল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভের কথা স্বীকার করলেও এর অর্থ ও প্রভাব নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ করেনি।
প্রবাসী গাজাবাসী এবং হামাসবিরোধী ভ্লগার হামজা আল-মাসরি এই বিক্ষোভের ভিডিও প্রচার করেছেন। তিনি বলেন, গাজার মানুষের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল ১৮ বছর ধরে। এবার তারা মুখ খুলেছে। এই ভিডিও প্রকাশের পরেই তিনি হামাসের পক্ষ থেকে হত্যার হুমকি পাচ্ছেন। তবে এই আন্দোলনকে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের আহ্বান বলে মনে করা যাবে না। গাজার অধিকাংশ মানুষ এখনো প্রতিরোধের ধারণাকে সমর্থন করে এবং হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জাদিন আল-কাসসাম ব্রিগেড এখনো তাদের কাছে নায়ক। তবে এই বিক্ষোভ মূলত হামাসের প্রশাসনিক শাসনের বিরুদ্ধে, যা গাজার জনগণের দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী।
ইসরায়েলও এই বিক্ষোভে কিছুটা হতচকিত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ গাজাবাসীদের আহ্বান জানিয়েছেন, ‘বেইত লাহিয়ার জনগণের কাছ থেকে শিক্ষা নিন, হামাসের পতনের দাবি তুলুন।’ কিন্তু এই আহ্বান হামাসের জন্য আরও একটি সুযোগ এনে দিতে পারে, যেখানে তারা বিক্ষোভকারীদের ‘ইসরায়েলের দোসর’ হিসেবে চিত্রিত করবে এবং কঠোরভাবে দমন করবে।
আশার কথা, গাজায় ১৮ বছর ধরে চলে আসা ভয়ের শাসন কিছুটা হলেও ভাঙতে শুরু করেছে। এটি গাজার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। তবে ইসরায়েল যদি এই বিক্ষোভকে অতিরিক্তভাবে সমর্থন করে, তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হতে পারে। আবার একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকলে এই আন্দোলন দমন হতে পারে, যেমনটি অতীতে ‘বিদনা নিইশ’ (আমরা বাঁচতে চাই) আন্দোলনের ক্ষেত্রে হয়েছিল। সর্বোপরি, গাজায় একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যা হামাস ও ইসরায়েল উভয়ের জন্য নতুন কৌশল নির্ধারণের ইঙ্গিত বহন করছে।
এদিকে, গাজায় ৮২ শতাংশ মানবিক সহায়তা কার্যক্রম ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বাধার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় (ঙঈঐঅ)। মার্চ ১৮ থেকে ২৪ পর্যন্ত এক সপ্তাহে এসব কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে, যা জরুরি সরঞ্জাম সংগ্রহ এবং বেকারিতে জ্বালানি সরবরাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজকে কার্যত থামিয়ে দিয়েছে।
গাজায় তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ত্রাণ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা এবং সাহায্য সংস্থাগুলোর নিরাপদ চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডঋচ) সতর্ক করেছে যে, গাজার লাখ লাখ মানুষ চরম খাদ্য সংকট এবং অপুষ্টির মুখে পড়তে যাচ্ছে। ডঋচ জানায়, গাজায় সামরিক কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং খাদ্য সহায়তা কার্যক্রমে বাধার ফলে সাহায্যকর্মীদের জীবনও বিপদে পড়ছে। গত তিন সপ্তাহ ধরে গাজায় কোনো ত্রাণ প্রবেশ করতে পারেনি, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য এক চরম মানবিক সংকট তৈরি করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে কমপক্ষে ৫০ হাজার ২০৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরও ১ লাখ ১৩ হাজার ৯১০ জন আহত হয়েছেন। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস ইসরায়েলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানির সংখ্যা আপডেট করে ৬১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি উল্লেখ করে জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
বিক্ষোভকারীদের হাতে হামাস ও যুদ্ধবিরোধী প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে -এএফপি
শুক্রবার, ২৮ মার্চ ২০২৫
গত কয়েক দিনে গাজা ভূখণ্ডে হামাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অনেককেই অবাক করেছে। বিশ্লেষকেরাও এই বিক্ষোভকে স্বতঃস্ফূর্ত বা খাঁটি বলে মনে করতে দ্বিধা বোধ করছেন। কারণ, দশক ধরে হামাস কঠোর হাতে গাজা শাসন করেছে এবং যেকোনো ধরনের ভিন্নমত দমন করেছে। তাই বিরল এই আন্দোলন কি স্বতঃস্ফূর্ত, নাকি এটি কোনো বিশেষ কৌশলের অংশ এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মধ্যে।
উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় এই বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। সাধারণত গাজায় প্রতিবাদ মানেই ইসরায়েলবিরোধী স্লোগান। কিন্তু এবারের বিক্ষোভের অন্যতম ব্যতিক্রম ছিল সরাসরি হামাসবিরোধী স্লোগান, যেখানে বিক্ষোভকারীরা চিৎকার করে বলছিলেন ‘হামাস, গেট আউট!’ গাজায় হামাসের দীর্ঘ ১৮ বছরের শাসনে এমন স্লোগান অভূতপূর্ব।
বিক্ষোভকারীরা হামাস নেতাদেরও সমালোচনা করেছেন। বিশেষত হামাস নেতা ওসামা হামদানকে লক্ষ্য করে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান চেয়েও স্লোগান দিতে শোনা যায়, যা ইসরায়েলি জিম্মিদের ইঙ্গিত করছিল।
তবে প্রথম দিকে হামাসের শীর্ষ নেতারা এই বিক্ষোভকে অস্বীকারের চেষ্টা করেন। হামাস নেতা হামদান দাবি করেন, এই বিক্ষোভ ইসরায়েল কর্তৃক সংগঠিত। অন্যদিকে হামাসের আরকে নেতা বাসেম নাইম কাতারের আল-আরাবি টেলিভিশনকে বলেন, এই বিক্ষোভে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল প্রভাব বিস্তার করেছে, যাতে হামাসের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা যায়।
হামাস চায় জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামকে তাদের সঙ্গে একাকার করে দেখাতে। ফলে যেকোনো হামাসবিরোধী আন্দোলনকে তারা ইসরায়েলের সহায়ক শক্তি হিসেবে চিত্রিত করতে চায়। হামাস ও আল জাজিরার মতো তাদের ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমও প্রথমে এই বিক্ষোভ এড়িয়ে যায়। তারা ইসরায়েলবিরোধী স্লোগানগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে এবং হামাসবিরোধী বক্তব্য পুরোপুরি এড়িয়ে যায়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আল-জাজিরা স্বল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভের কথা স্বীকার করলেও এর অর্থ ও প্রভাব নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ করেনি।
প্রবাসী গাজাবাসী এবং হামাসবিরোধী ভ্লগার হামজা আল-মাসরি এই বিক্ষোভের ভিডিও প্রচার করেছেন। তিনি বলেন, গাজার মানুষের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল ১৮ বছর ধরে। এবার তারা মুখ খুলেছে। এই ভিডিও প্রকাশের পরেই তিনি হামাসের পক্ষ থেকে হত্যার হুমকি পাচ্ছেন। তবে এই আন্দোলনকে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের আহ্বান বলে মনে করা যাবে না। গাজার অধিকাংশ মানুষ এখনো প্রতিরোধের ধারণাকে সমর্থন করে এবং হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জাদিন আল-কাসসাম ব্রিগেড এখনো তাদের কাছে নায়ক। তবে এই বিক্ষোভ মূলত হামাসের প্রশাসনিক শাসনের বিরুদ্ধে, যা গাজার জনগণের দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী।
ইসরায়েলও এই বিক্ষোভে কিছুটা হতচকিত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ গাজাবাসীদের আহ্বান জানিয়েছেন, ‘বেইত লাহিয়ার জনগণের কাছ থেকে শিক্ষা নিন, হামাসের পতনের দাবি তুলুন।’ কিন্তু এই আহ্বান হামাসের জন্য আরও একটি সুযোগ এনে দিতে পারে, যেখানে তারা বিক্ষোভকারীদের ‘ইসরায়েলের দোসর’ হিসেবে চিত্রিত করবে এবং কঠোরভাবে দমন করবে।
আশার কথা, গাজায় ১৮ বছর ধরে চলে আসা ভয়ের শাসন কিছুটা হলেও ভাঙতে শুরু করেছে। এটি গাজার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। তবে ইসরায়েল যদি এই বিক্ষোভকে অতিরিক্তভাবে সমর্থন করে, তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হতে পারে। আবার একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকলে এই আন্দোলন দমন হতে পারে, যেমনটি অতীতে ‘বিদনা নিইশ’ (আমরা বাঁচতে চাই) আন্দোলনের ক্ষেত্রে হয়েছিল। সর্বোপরি, গাজায় একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যা হামাস ও ইসরায়েল উভয়ের জন্য নতুন কৌশল নির্ধারণের ইঙ্গিত বহন করছে।
এদিকে, গাজায় ৮২ শতাংশ মানবিক সহায়তা কার্যক্রম ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বাধার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় (ঙঈঐঅ)। মার্চ ১৮ থেকে ২৪ পর্যন্ত এক সপ্তাহে এসব কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে, যা জরুরি সরঞ্জাম সংগ্রহ এবং বেকারিতে জ্বালানি সরবরাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজকে কার্যত থামিয়ে দিয়েছে।
গাজায় তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ত্রাণ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা এবং সাহায্য সংস্থাগুলোর নিরাপদ চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডঋচ) সতর্ক করেছে যে, গাজার লাখ লাখ মানুষ চরম খাদ্য সংকট এবং অপুষ্টির মুখে পড়তে যাচ্ছে। ডঋচ জানায়, গাজায় সামরিক কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং খাদ্য সহায়তা কার্যক্রমে বাধার ফলে সাহায্যকর্মীদের জীবনও বিপদে পড়ছে। গত তিন সপ্তাহ ধরে গাজায় কোনো ত্রাণ প্রবেশ করতে পারেনি, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য এক চরম মানবিক সংকট তৈরি করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে কমপক্ষে ৫০ হাজার ২০৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরও ১ লাখ ১৩ হাজার ৯১০ জন আহত হয়েছেন। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস ইসরায়েলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানির সংখ্যা আপডেট করে ৬১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি উল্লেখ করে জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।