alt

আন্তর্জাতিক

যুদ্ধ এড়িয়ে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমন, ঐতিহাসিক নজির কেমন

বিদেশী সংবাদ মাধ্যম : শনিবার, ০৩ মে ২০২৫

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কাশ্মীরে হামলার ঘটনার পর ভারত-পাকিস্তান সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে -এএফপি

গত সপ্তাহে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক প্রাণ হারান। এ ঘটনা ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী ও কূটনীতিকদের মনে ‘দেজা ভ্যু’ বা পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তির এক ভয়াবহ অনুভূতি ফিরিয়ে এনেছে। এমন পরিস্থিতি বহুল পরিচিত। ২০১৬ সালে উরিতে ১৯ সেনা নিহত হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) পেরিয়ে পাকিস্তানে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায় ভারত। লক্ষ্য ছিল জঙ্গি ঘাঁটিগুলো।

এরপর, ২০১৯ সালে ফের একই ঘটনা ঘটে। ভারতের পুলওয়ামায় বোমা হামলায় দেশটির ৪০ আধা-সামরিক জওয়ান নিহত হন। প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানও ভারতের একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে এবং এক পাইলটকে বন্দী করে। পরে অবশ্য তাকে ফেরত দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এটি ছিল ভারতের এমন প্রথম পদক্ষেপ।

এর আগেও, ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। হোটেল, রেলস্টেশন ও একটি ইহুদি কেন্দ্র ৬০ ঘণ্টা ধরে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল সন্ত্রাসীরা। এতে প্রাণ হারায় ১৬৬ জন। প্রতিবারই ভারত এসব হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছে। ইসলামাবাদ তাদের পরোক্ষভাবে সমর্থন করছ এমন অভিযোগ এনেছে। পাকিস্তান বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালে পাকিস্তানের ভেতরে ভারতের বিমান হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সংঘাত বৃদ্ধির মাত্রা নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেছে। সীমান্ত পেরিয়ে বা আকাশপথে পাকিস্তানে ভারতের হামলা চালানো এখন যেন স্বাভাবিক ঘটনাই। জবাবে পাকিস্তানের দিক থেকেও প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। এ কারণেই পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত আবারও ‘সংঘাত উসকে দেয়া ও সংযম দেখানো’র মধ্যে দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। এটি হলো প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধের এক ভঙ্গুর ভারসাম্য। এই পুনরাবৃত্ত চক্রটি যারা উপলব্ধি করেন তার মধ্যে অন্যতম অজয় বিসারিয়া। পুলওয়ামা হামলার সময় তিন পাকিস্তানে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। হামলার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে তিনি তার স্মৃতিকথা ‘অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট : দ্য ট্রাবলড ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনশিপ বিটুইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ বইয়ে লিখেছেন।

সর্বশেষ হামলার ১০ দিন পর গত বৃহস্পতিবার অজয় বিসারিয়া বিবিসিকে বলেন, ‘পুলওয়ামা বোমা হামলা ও পেহেলগাম হত্যাকা-ের পরবর্তী পরিস্থিতির মধ্যে আকর্ষণীয় মিল রয়েছে।’ তবে তিনি উল্লেখ করেছেন, পেহেলগাম হামলা একটি পরিবর্তন নির্দেশ করে। সেটি হলো পুলওয়ামা ও উরি হামলা নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে হয়েছিল। এবারে হামলার লক্ষ্য বেসামরিক নাগরিক। বিসারিয়ার মতে, এই হামলা ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। তিনি বলেন, ‘এই হামলায় পুলওয়ামার কিছু উপাদান আছে, তবে মুম্বাইয়ের প্রভাব অনেক বেশি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আবারও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আছি এবং ঘটনা আগের মতোই একই রকমভাবে ঘটছে।’

এক সপ্তাহ আগে, পেহেলগাম হামলার পরপরই দ্রুত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় দিল্লি। প্রধান সীমান্ত পথ বন্ধ করে দেয়া হয়, গুরুত্বপূর্ণ পানিচুক্তি স্থগিত করা হয়, কূটনীতিকদের বহিষ্কার করা হয় এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দেয়া হয়। পাকিস্তানি নাগরিকদের দ্রুত ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সীমান্তে দুই পক্ষের সেনারা একে অপরকে লক্ষ্য করে বিক্ষিপ্তভাবে হালকা আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি চালিয়েছে।

দিল্লি পাকিস্তানের বাণিজ্যিক ও সামরিকসহ সব ধরনের বিমানের জন্য ভারতীয় আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

এর আগে ইসলামাবাদও একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতের পদক্ষেপের পাল্টা হিসেবে পাকিস্তান ভিসা স্থগিত করেছে এবং ভারতের সঙ্গে ১৯৭২ সালের সিমলা শান্তি চুক্তি স্থগিত করেছে। বাণিজ্য সম্পর্ক স্থগিত করেছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। উভয় দেশ পুরো কাশ্মীর দাবি করলেও নিয়ন্ত্রণ করে আংশিক। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকেই পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে কাশ্মীর সংঘাতের একটি কেন্দ্রবিন্দু। অজয় বিসারিয়া তার স্মৃতিকথায় ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা হামলার পর ভারতের পদক্ষেপের কথা লিখেছেন।

হামলার পরের দিন সকালে অজয় বিসারিয়াকে দিল্লিতে তলব করা হয়। ভারত সরকার দ্রুত পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধের পদক্ষেপ নেয়। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানকে দেয়া ‘মোস্ট-ফেভার্ড-নেশন’ মর্যাদা প্রত্যাহার করা হয়। পরের দিনগুলোতে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা কমিটি পাকিস্তানি পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করে, যা কার্যত আমদানি বন্ধ করে দেয়। আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে স্থলপথে বাণিজ্যও স্থগিত করা হয়।

বিসারিয়া উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে আরও বিস্তৃত পদক্ষেপের প্রস্তাব তোলা হয়েছিল। এর বেশির ভাগই পরে বাস্তবায়ন করা হয়। এর মধ্যে ছিল আন্তঃসীমান্ত চলাচলকারী সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেন এবং দিল্লি ও লাহোরের মধ্যে চলাচলকারী বাস পরিষেবা স্থগিত করা; উভয় পক্ষের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে আলোচনা এবং শিখদের অন্যতম পবিত্র স্থান করতারপুর করিডর নিয়ে আলোচনা পেছানো; ভিসা বন্ধ করা; সীমান্ত পেরিয়ে যাতায়াত বন্ধ করা; ভারতীয়দের পাকিস্তানে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা এবং দুই দেশের মধ্যে বিমান চলাচল স্থগিত করা।

সাবেক কূটনীতিক বিসারিয়া লিখেছেন, ‘পারস্পরিক আস্থা তৈরি করা কতটা কঠিন, আর তা ভাঙা কতটা সহজ! এই কঠিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পিত, আলোচিত ও বাস্তবায়িত সব আস্থা-নির্মাণ পদক্ষেপ কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি হলুদ নোটপ্যাডে বাতিল করে দেয়া যেতে পারে!’ ২০১৯ সালে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মী সংখ্যা ১১০ থেকে কমিয়ে ৫৫ করা হয়েছিল। পেহেলগাম হামলার পর এখন তা ৩০ জনে নেমেছে। সে সময় ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক আক্রমণও শুরু করে। পুলওয়ামা হামলার একদিন পর তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া এবং ফ্রান্সসহ ২৫টি দেশের দূতদের এই হামলায় পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন জয়শ-ই-মুহাম্মদের (জেএম) ভূমিকা সম্পর্কে জানান। তিনি পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসবাদকে রাষ্ট্রীয় নীতি’ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য অভিযুক্ত করেন। ভারত, জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র জেএমকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে। সংগঠনটি হামলার দায় স্বীকার করেছিল।

ভারতের কূটনৈতিক আক্রমণ হামলার ১০ দিন পরও অব্যাহত ছিল। হামলার পর সে বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা কমিটি যাতে জেএম প্রধান মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও যাতে ‘সন্ত্রাসী তালিকায়’ তাকে অন্তর্ভুক্ত করে সেজন্য ভারত তদবির করে। পুলওয়ামা হামলার পর ভারত সরকারের ওপর সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি বাতিলের চাপ ছিল। কিন্তু ভারত সেটি না করে চুক্তির শর্ত নির্ধারিত থাকলেও পাকিস্তানকে এ বিষয়ে তথ্য দেয়া বন্ধ করে দেয়। সে সময় মোট ৪৮টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিতের বিষয়ে পর্যালোচনা করেছিল ভারত। দিল্লিতে একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হয় এবং সেখানে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাবও গৃহীত হয়।

অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির জয়

‘কাশ্মীরে হামলার তথ্য আগেই ছিল’

ছবি

স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ‘আবদালি’ পরীক্ষামূলকভাবে উৎক্ষেপণ করল পাকিস্তান

ছবি

সৌদির কাছে ৩৫০ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করছে যুক্তরাষ্ট্র

ছবি

অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচন, আলোচনায় যেসব ইস্যু

পাকিস্তান থেকে সব ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ করল ভারত

নেতানিয়াহুর অনুমোদন নিয়ে সিরিয়ার হামলা, উত্তেজনা তুঙ্গে

সিন্ধু নদে বাঁধ দিলে হামলা করবে পাকিস্তান

ছবি

দ্রুজদের সুরক্ষায় সিরিয়ায় ইসরায়েলের বোমা হামলা, শাসকগোষ্ঠীকে ‘বার্তা’

ছবি

উগ্রবাদীদের তালিকায় জার্মানির প্রধান বিরোধী দল এএফডি

ছবি

পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করলো ভারত

ছবি

ইউক্রেইন-রাশিয়া শান্তি আলোচনায় ‘আর মধ্যস্থতা নয়’: যুক্তরাষ্ট্র

ছবি

ভারতে ধর্মীয় উৎসবে পদদলিত হয়ে ৬ জনের মৃত্যু, আহত অন্তত ৬০

ছবি

মাল্টা উপকূলে গাজাগামী ত্রাণবাহী জাহাজে ড্রোন হামলা

১২০০ মাইল পথ পাড়ি দিল চালকবিহীন ট্রাক

ওয়াল্টজকে নতুন পদে বসাতে চান ট্রাম্প

পেহেলগামে হামলায় ‘লস্কর-আইএসআই চক্র’, ছক ‘পাকিস্তানে লস্কর সদরদপ্তরে’: এনআইএ

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে খনিজ সম্পদ নিয়ে চুক্তি সই

ছবি

খনিজ চুক্তিকে জেলেনস্কি ‘সমতাভিত্তিক’ বলার পরপরই রাশিয়ার ড্রোন হামলা

ছবি

সামরিক উত্তেজনায় পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক হাজারের বেশি মাদ্রাসা বন্ধ

ছবি

সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যে এলওসি এলাকায় পূর্ণমাত্রার সামরিক মহড়া চালাল পাকিস্তান

ছবি

মাইক ওয়াল্টজের পদত্যাগ, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম শীর্ষ কর্মকর্তা সরে দাঁড়ালেন

ছবি

পাকিস্তানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পেলেন আইএসআই প্রধান

ছবি

ভারত-পাকিস্তানকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের

ছবি

খনিজ সম্পদ: যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেনের মধ্যে চুক্তি সই

ছবি

পাকিস্তানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করল ভারত

ছবি

অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার ৮৬ লাখেরই জন্ম বিদেশে

ছবি

দ্বিতীয় মেয়াদের শততম দিন উৎযাপন ট্রাম্পের

জয়শঙ্কর ও শাহবাজের সঙ্গে কথা বললেন জাতিসংঘের মহাসচিব

‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান, কর্ণাটকে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা

তেলের দাম গত সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন

ছবি

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কি আসন্ন?

ছবি

এলওসি এলাকায় রাফায়েল টহলের অভিযোগ পাকিস্তানের, উত্তেজনা চরমে

ছবি

পাকিস্তানে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ভারতের হামলার পরিকল্পনার ‘বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্যের’ দাবি সেদেশের মন্ত্রীর

ছবি

কলকাতায় আবাসিক হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৪ জনের মৃত্যু

ছবি

‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে গুজরাতে আটক সাড়ে ছয় হাজার, অধিকাংশই ভারতীয় মুসলমান

tab

আন্তর্জাতিক

যুদ্ধ এড়িয়ে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমন, ঐতিহাসিক নজির কেমন

বিদেশী সংবাদ মাধ্যম

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কাশ্মীরে হামলার ঘটনার পর ভারত-পাকিস্তান সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে -এএফপি

শনিবার, ০৩ মে ২০২৫

গত সপ্তাহে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক প্রাণ হারান। এ ঘটনা ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী ও কূটনীতিকদের মনে ‘দেজা ভ্যু’ বা পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তির এক ভয়াবহ অনুভূতি ফিরিয়ে এনেছে। এমন পরিস্থিতি বহুল পরিচিত। ২০১৬ সালে উরিতে ১৯ সেনা নিহত হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) পেরিয়ে পাকিস্তানে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায় ভারত। লক্ষ্য ছিল জঙ্গি ঘাঁটিগুলো।

এরপর, ২০১৯ সালে ফের একই ঘটনা ঘটে। ভারতের পুলওয়ামায় বোমা হামলায় দেশটির ৪০ আধা-সামরিক জওয়ান নিহত হন। প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানও ভারতের একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে এবং এক পাইলটকে বন্দী করে। পরে অবশ্য তাকে ফেরত দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এটি ছিল ভারতের এমন প্রথম পদক্ষেপ।

এর আগেও, ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। হোটেল, রেলস্টেশন ও একটি ইহুদি কেন্দ্র ৬০ ঘণ্টা ধরে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল সন্ত্রাসীরা। এতে প্রাণ হারায় ১৬৬ জন। প্রতিবারই ভারত এসব হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছে। ইসলামাবাদ তাদের পরোক্ষভাবে সমর্থন করছ এমন অভিযোগ এনেছে। পাকিস্তান বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালে পাকিস্তানের ভেতরে ভারতের বিমান হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সংঘাত বৃদ্ধির মাত্রা নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেছে। সীমান্ত পেরিয়ে বা আকাশপথে পাকিস্তানে ভারতের হামলা চালানো এখন যেন স্বাভাবিক ঘটনাই। জবাবে পাকিস্তানের দিক থেকেও প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। এ কারণেই পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত আবারও ‘সংঘাত উসকে দেয়া ও সংযম দেখানো’র মধ্যে দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। এটি হলো প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধের এক ভঙ্গুর ভারসাম্য। এই পুনরাবৃত্ত চক্রটি যারা উপলব্ধি করেন তার মধ্যে অন্যতম অজয় বিসারিয়া। পুলওয়ামা হামলার সময় তিন পাকিস্তানে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। হামলার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে তিনি তার স্মৃতিকথা ‘অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট : দ্য ট্রাবলড ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনশিপ বিটুইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ বইয়ে লিখেছেন।

সর্বশেষ হামলার ১০ দিন পর গত বৃহস্পতিবার অজয় বিসারিয়া বিবিসিকে বলেন, ‘পুলওয়ামা বোমা হামলা ও পেহেলগাম হত্যাকা-ের পরবর্তী পরিস্থিতির মধ্যে আকর্ষণীয় মিল রয়েছে।’ তবে তিনি উল্লেখ করেছেন, পেহেলগাম হামলা একটি পরিবর্তন নির্দেশ করে। সেটি হলো পুলওয়ামা ও উরি হামলা নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে হয়েছিল। এবারে হামলার লক্ষ্য বেসামরিক নাগরিক। বিসারিয়ার মতে, এই হামলা ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। তিনি বলেন, ‘এই হামলায় পুলওয়ামার কিছু উপাদান আছে, তবে মুম্বাইয়ের প্রভাব অনেক বেশি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আবারও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আছি এবং ঘটনা আগের মতোই একই রকমভাবে ঘটছে।’

এক সপ্তাহ আগে, পেহেলগাম হামলার পরপরই দ্রুত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় দিল্লি। প্রধান সীমান্ত পথ বন্ধ করে দেয়া হয়, গুরুত্বপূর্ণ পানিচুক্তি স্থগিত করা হয়, কূটনীতিকদের বহিষ্কার করা হয় এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দেয়া হয়। পাকিস্তানি নাগরিকদের দ্রুত ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সীমান্তে দুই পক্ষের সেনারা একে অপরকে লক্ষ্য করে বিক্ষিপ্তভাবে হালকা আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি চালিয়েছে।

দিল্লি পাকিস্তানের বাণিজ্যিক ও সামরিকসহ সব ধরনের বিমানের জন্য ভারতীয় আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

এর আগে ইসলামাবাদও একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতের পদক্ষেপের পাল্টা হিসেবে পাকিস্তান ভিসা স্থগিত করেছে এবং ভারতের সঙ্গে ১৯৭২ সালের সিমলা শান্তি চুক্তি স্থগিত করেছে। বাণিজ্য সম্পর্ক স্থগিত করেছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। উভয় দেশ পুরো কাশ্মীর দাবি করলেও নিয়ন্ত্রণ করে আংশিক। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকেই পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে কাশ্মীর সংঘাতের একটি কেন্দ্রবিন্দু। অজয় বিসারিয়া তার স্মৃতিকথায় ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা হামলার পর ভারতের পদক্ষেপের কথা লিখেছেন।

হামলার পরের দিন সকালে অজয় বিসারিয়াকে দিল্লিতে তলব করা হয়। ভারত সরকার দ্রুত পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধের পদক্ষেপ নেয়। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানকে দেয়া ‘মোস্ট-ফেভার্ড-নেশন’ মর্যাদা প্রত্যাহার করা হয়। পরের দিনগুলোতে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা কমিটি পাকিস্তানি পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করে, যা কার্যত আমদানি বন্ধ করে দেয়। আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে স্থলপথে বাণিজ্যও স্থগিত করা হয়।

বিসারিয়া উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে আরও বিস্তৃত পদক্ষেপের প্রস্তাব তোলা হয়েছিল। এর বেশির ভাগই পরে বাস্তবায়ন করা হয়। এর মধ্যে ছিল আন্তঃসীমান্ত চলাচলকারী সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেন এবং দিল্লি ও লাহোরের মধ্যে চলাচলকারী বাস পরিষেবা স্থগিত করা; উভয় পক্ষের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে আলোচনা এবং শিখদের অন্যতম পবিত্র স্থান করতারপুর করিডর নিয়ে আলোচনা পেছানো; ভিসা বন্ধ করা; সীমান্ত পেরিয়ে যাতায়াত বন্ধ করা; ভারতীয়দের পাকিস্তানে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা এবং দুই দেশের মধ্যে বিমান চলাচল স্থগিত করা।

সাবেক কূটনীতিক বিসারিয়া লিখেছেন, ‘পারস্পরিক আস্থা তৈরি করা কতটা কঠিন, আর তা ভাঙা কতটা সহজ! এই কঠিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পিত, আলোচিত ও বাস্তবায়িত সব আস্থা-নির্মাণ পদক্ষেপ কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি হলুদ নোটপ্যাডে বাতিল করে দেয়া যেতে পারে!’ ২০১৯ সালে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মী সংখ্যা ১১০ থেকে কমিয়ে ৫৫ করা হয়েছিল। পেহেলগাম হামলার পর এখন তা ৩০ জনে নেমেছে। সে সময় ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক আক্রমণও শুরু করে। পুলওয়ামা হামলার একদিন পর তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া এবং ফ্রান্সসহ ২৫টি দেশের দূতদের এই হামলায় পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন জয়শ-ই-মুহাম্মদের (জেএম) ভূমিকা সম্পর্কে জানান। তিনি পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসবাদকে রাষ্ট্রীয় নীতি’ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য অভিযুক্ত করেন। ভারত, জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র জেএমকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে। সংগঠনটি হামলার দায় স্বীকার করেছিল।

ভারতের কূটনৈতিক আক্রমণ হামলার ১০ দিন পরও অব্যাহত ছিল। হামলার পর সে বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা কমিটি যাতে জেএম প্রধান মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও যাতে ‘সন্ত্রাসী তালিকায়’ তাকে অন্তর্ভুক্ত করে সেজন্য ভারত তদবির করে। পুলওয়ামা হামলার পর ভারত সরকারের ওপর সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি বাতিলের চাপ ছিল। কিন্তু ভারত সেটি না করে চুক্তির শর্ত নির্ধারিত থাকলেও পাকিস্তানকে এ বিষয়ে তথ্য দেয়া বন্ধ করে দেয়। সে সময় মোট ৪৮টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিতের বিষয়ে পর্যালোচনা করেছিল ভারত। দিল্লিতে একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হয় এবং সেখানে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাবও গৃহীত হয়।

back to top