গাজায় এখন মৃত্যুর অনেক পথ, তবে তা বেছে নেয়ার মতো সুযোগ আমাদের কারও নেই। যে কেউ বোমায় মারা যেতে পারেন। ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে নিয়মিত মারা যাচ্ছে মানুষ। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়ে অপুষ্টিতে ইতোমধ্যে ১১৬ জন মারা গেছে যাদের বেশিরভাগই শিশু। গাজাবাসীর জন্য এখন মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলোও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। পানি এর মধ্যে অন্যতম। পানি সংগ্রহ, পান করা, সাঁতার কাটা, সরবরাহ ব্যবস্থা, সাগরে মাছ ধরা- যেকোনো কিছুই গাজাবাসীর জন্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গাজায় গণহত্যার শুরু থেকে এ উপত্যকার পানি সরবরাহের অবকাঠামো ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়মিত হামলার লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে গাজার পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামোর ৮৫ ভাগই অকার্যকর করে দিয়েছে তারা। এর মধ্যে রয়েছে পাইপলাইন, কূপ, পরিশোধন কেন্দ্র।
পানি সংক্রান্ত যেকোনো সামগ্রী এ উপত্যকায় প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এসব অবকাঠামো মেরামতও করা যাচ্ছে না। শুধু প্রবেশ আটকানোই নয়, গাজার পানিসংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের ওয়্যারহাউজেও হামলা করেছে ইসরায়েল। ধ্বংস হয়ে গেছে সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ। ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, পানি সরবরাহ অবকাঠামোর কর্মী বা যারা এগুলো মেরামতে যাচ্ছেন তাদের সরাসরি হত্যা করছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজায় এখন পানি সেক্টরে কাজ করাও প্রাণহানির মতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। গত ২১ জুলাই গাজা সিটির পার্শ্ববর্তী রেমালে পানি শোধনাগারে হামলা চালিয়ে সেখানকার ৫ কর্মীকে হত্যা করে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। গাজায় যেকটি পানি সরবরাহ কেন্দ্র এখনও টিকে আছে এর মধ্যে এটি একটি।
গাজাবাসীকে এখন নিয়মিতই খাবার ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের পানির জন্য দূরদূরান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। এ সুযোগে কিছু মানুষ উচ্চমূল্যে বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহের ব্যবসাও ফেঁদে বসেছেন। কিন্তু গাজাবাসীর সে সামর্থ্যও এখন নেই। হাতে প্লাস্টিকের জগ বা বিভিন্ন পাত্র নিয়ে তাদের পানির রেশনের লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়।
কিন্তু সেটাও নিরাপদ নয়। যখন তখন হামলা হতে পারে, মৃত্যু ঘটতে পারে। গত ১৩ জুলাই নুসাইরাতের শরণার্থী শিবিরে এমনই এক পানির ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়ানো মানুষের ওপর আঘাত হানে ইসরায়েলি মিসাইল। মারা যান ১১ জন, তাদের মধ্যে শিশু ৭টি। রেশনের পানির ট্রাকও সব সময়ে মেলে না। ফলে বাধ্য হয়ে বাড়ির আশপাশের কূপ থেকে পানি পান করতে হয়। ফলে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ছড়াচ্ছে। প্রাণহানি বাড়াচ্ছে গাজায়। সম্প্রতি আমি নিজেও হেপাটাইটিস এ- তে আক্রান্ত হই। পেটে একটানা ব্যথা নিয়ে একটি ক্লিনিকে গেলে শুধু পেইন কিলার লিখে দিয়ে শুভ কামনা জানানো হয়।
গাজায় এখন তীব্র গরম। কেউ ভাবতে পারেন হয়ত সাগরের পানিতে গা জুড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বস্তি মিলবে। কিন্তু সেটিও হওয়ার নয়। সম্প্রতি ইসরায়েলি বাহিনী গাজার পুরো উপকূল প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করেছে। ফলে সাগরে গোসল করা মাছ ধরা তো বটেই পানির কাছে যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও কেউ সৈকতে গেলে তার জন্য বরাদ্দ রয়েছে গুলি। জেলেদের কর্মসংস্থানও বন্ধ। জাতিংঘের হিসেবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ২০০ জেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এখনও এমন হত্যা চলছে।
অথচ কয়েক কিলোমিটার উত্তরে ইসরায়েলিরা একই ভূমধ্যসাগরের ঢেউ উপভোগ করছে নির্বিঘেœ। সূর্যস্নান করছে, সাঁতার কাটছে। ইসরায়েলিরা দিনে জনপ্রতি ২৪৭ লিটার (৬৫ গ্যালন) পানি ব্যবহার করতে পারছে। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাভাবিক চাহিদা পূরণে একজন মানুষের দিনে ১০০ লিটার (২৬ গ্যালন) পানি প্রয়োজন। গাজার মানুষ এখন দিনে পাচ্ছে দুই থেকে ৯ লিটার (০.৫-২.৩ গ্যালন)। পানি নিয়ে এ সংগ্রাম গাজাবাসীর প্রতিদিনের অসংখ্য লড়াইয়ের একটি অংশ মাত্র। আমি বুঝতে পারি না, এই ২১ শতকেও কিভাবে আমাদের এরকম মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। যেখানে প্রতিদিনই বিশ্ব নেতারা মানবাধিকার, আইনের শাসন ও মানবজাতির অগ্রগতির কথা বলছেন।
গত ডিসেম্বরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশ্যেই বলেছে, গাজায় গণহত্যা চলছে। পানি থেকে গাজাবাসীকে বঞ্চিত করাকে পরিকল্পিত বলেও মন্তব্য করেছে তারা। ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত হাজারো গাজাবাসী পানিশূন্যতা, অপুষ্টি ও নানা রোগে মারা গেছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এরপর এক বছর কেটে গেছে। ইসরায়েলিরা পানিকে একটি মারণাস্ত্রে পরিণত করায় গাজা উপত্যকায় অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। এগুলো ঠিকই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। তবু বিশ্ব নির্বিকার, ইসরায়েলকে ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপই দেখা যাচ্ছে না।
মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫
গাজায় এখন মৃত্যুর অনেক পথ, তবে তা বেছে নেয়ার মতো সুযোগ আমাদের কারও নেই। যে কেউ বোমায় মারা যেতে পারেন। ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে নিয়মিত মারা যাচ্ছে মানুষ। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়ে অপুষ্টিতে ইতোমধ্যে ১১৬ জন মারা গেছে যাদের বেশিরভাগই শিশু। গাজাবাসীর জন্য এখন মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলোও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। পানি এর মধ্যে অন্যতম। পানি সংগ্রহ, পান করা, সাঁতার কাটা, সরবরাহ ব্যবস্থা, সাগরে মাছ ধরা- যেকোনো কিছুই গাজাবাসীর জন্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গাজায় গণহত্যার শুরু থেকে এ উপত্যকার পানি সরবরাহের অবকাঠামো ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়মিত হামলার লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে গাজার পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামোর ৮৫ ভাগই অকার্যকর করে দিয়েছে তারা। এর মধ্যে রয়েছে পাইপলাইন, কূপ, পরিশোধন কেন্দ্র।
পানি সংক্রান্ত যেকোনো সামগ্রী এ উপত্যকায় প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এসব অবকাঠামো মেরামতও করা যাচ্ছে না। শুধু প্রবেশ আটকানোই নয়, গাজার পানিসংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের ওয়্যারহাউজেও হামলা করেছে ইসরায়েল। ধ্বংস হয়ে গেছে সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ। ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, পানি সরবরাহ অবকাঠামোর কর্মী বা যারা এগুলো মেরামতে যাচ্ছেন তাদের সরাসরি হত্যা করছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজায় এখন পানি সেক্টরে কাজ করাও প্রাণহানির মতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। গত ২১ জুলাই গাজা সিটির পার্শ্ববর্তী রেমালে পানি শোধনাগারে হামলা চালিয়ে সেখানকার ৫ কর্মীকে হত্যা করে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। গাজায় যেকটি পানি সরবরাহ কেন্দ্র এখনও টিকে আছে এর মধ্যে এটি একটি।
গাজাবাসীকে এখন নিয়মিতই খাবার ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের পানির জন্য দূরদূরান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। এ সুযোগে কিছু মানুষ উচ্চমূল্যে বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহের ব্যবসাও ফেঁদে বসেছেন। কিন্তু গাজাবাসীর সে সামর্থ্যও এখন নেই। হাতে প্লাস্টিকের জগ বা বিভিন্ন পাত্র নিয়ে তাদের পানির রেশনের লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়।
কিন্তু সেটাও নিরাপদ নয়। যখন তখন হামলা হতে পারে, মৃত্যু ঘটতে পারে। গত ১৩ জুলাই নুসাইরাতের শরণার্থী শিবিরে এমনই এক পানির ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়ানো মানুষের ওপর আঘাত হানে ইসরায়েলি মিসাইল। মারা যান ১১ জন, তাদের মধ্যে শিশু ৭টি। রেশনের পানির ট্রাকও সব সময়ে মেলে না। ফলে বাধ্য হয়ে বাড়ির আশপাশের কূপ থেকে পানি পান করতে হয়। ফলে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ছড়াচ্ছে। প্রাণহানি বাড়াচ্ছে গাজায়। সম্প্রতি আমি নিজেও হেপাটাইটিস এ- তে আক্রান্ত হই। পেটে একটানা ব্যথা নিয়ে একটি ক্লিনিকে গেলে শুধু পেইন কিলার লিখে দিয়ে শুভ কামনা জানানো হয়।
গাজায় এখন তীব্র গরম। কেউ ভাবতে পারেন হয়ত সাগরের পানিতে গা জুড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বস্তি মিলবে। কিন্তু সেটিও হওয়ার নয়। সম্প্রতি ইসরায়েলি বাহিনী গাজার পুরো উপকূল প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করেছে। ফলে সাগরে গোসল করা মাছ ধরা তো বটেই পানির কাছে যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও কেউ সৈকতে গেলে তার জন্য বরাদ্দ রয়েছে গুলি। জেলেদের কর্মসংস্থানও বন্ধ। জাতিংঘের হিসেবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ২০০ জেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এখনও এমন হত্যা চলছে।
অথচ কয়েক কিলোমিটার উত্তরে ইসরায়েলিরা একই ভূমধ্যসাগরের ঢেউ উপভোগ করছে নির্বিঘেœ। সূর্যস্নান করছে, সাঁতার কাটছে। ইসরায়েলিরা দিনে জনপ্রতি ২৪৭ লিটার (৬৫ গ্যালন) পানি ব্যবহার করতে পারছে। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাভাবিক চাহিদা পূরণে একজন মানুষের দিনে ১০০ লিটার (২৬ গ্যালন) পানি প্রয়োজন। গাজার মানুষ এখন দিনে পাচ্ছে দুই থেকে ৯ লিটার (০.৫-২.৩ গ্যালন)। পানি নিয়ে এ সংগ্রাম গাজাবাসীর প্রতিদিনের অসংখ্য লড়াইয়ের একটি অংশ মাত্র। আমি বুঝতে পারি না, এই ২১ শতকেও কিভাবে আমাদের এরকম মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। যেখানে প্রতিদিনই বিশ্ব নেতারা মানবাধিকার, আইনের শাসন ও মানবজাতির অগ্রগতির কথা বলছেন।
গত ডিসেম্বরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশ্যেই বলেছে, গাজায় গণহত্যা চলছে। পানি থেকে গাজাবাসীকে বঞ্চিত করাকে পরিকল্পিত বলেও মন্তব্য করেছে তারা। ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত হাজারো গাজাবাসী পানিশূন্যতা, অপুষ্টি ও নানা রোগে মারা গেছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এরপর এক বছর কেটে গেছে। ইসরায়েলিরা পানিকে একটি মারণাস্ত্রে পরিণত করায় গাজা উপত্যকায় অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। এগুলো ঠিকই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। তবু বিশ্ব নির্বিকার, ইসরায়েলকে ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপই দেখা যাচ্ছে না।