রাশিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবন -এএফপি
বিশ্বে এখন পর্যন্ত বড় বড় যত ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম; কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি সেই মাত্রার সর্বনাশা সুনামি নিয়ে আসেনি, যেমনটা সবাই ভয় করছিল। বুধবার স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানার পর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলবর্তী লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০০৪ সালের বক্সিং ডেতে ভারত মহাসাগরে এবং ২০১১ সালে জাপানে সুনামির ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির কথা মাথায় রেখে কামচাটকায় ভূমিকম্পের খবর পাওয়ার পরপরই বিভিন্ন দেশ তাদের উপকূলীয় এলাকা থেকে কোটি কোটি লোককে সরিয়ে নেয়। ওই দুই ভয়াবহ সুনামিও এমন ‘মেগা’ ভূমিকম্পের পরই দেখা গিয়েছিল।
সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হলেও বুধবারের সুনামি ছিল সে তুলনায় বেশ দুর্বল। কেন এমন ভয়াবহ ভূমিকম্প আর সুনামি হয়, কেনইবা এবার প্রাথমিকভাবে যতটা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, ততটা প্রবল হয়নি সুনামি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে সেসবই তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে।
ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণ কী: কামচাটকা উপদ্বীপ প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হলেও এটি ‘প্যাসিফিক রিং অব ফায়ারের’ মধ্যে পড়েছে। এই রিং-এর মধ্যে অবস্থিত অঞ্চলজুড়ে অধিক ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি দেখা যায়। পৃথিবীর উপরের স্তরগুলো অনেকগুলো অংশ বা টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত। এসব প্লেট একে অপরের সাপেক্ষে ক্রমশ সরছে।
‘প্যাসিফিক রিং অব ফায়ার’ হল এসব প্লেটের মাঝে এমন এক বক্ররেখা যা প্রশান্ত মহাসাগরের চারপাশে বিস্তৃত। এই রিংজুড়ে বিশ্বের ৮০ শতাংশ ভূমিকম্প হয়, বলছে ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা। কামচাটকা উপকূলের ঠিক বাইরে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় বা প্যাসিফিক প্লেটটি প্রতি বছর উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রায় ৮ সেন্টিমিটার করে সরছে, টেকটোনিক গতির দিক থেকেও এটা বেশ দ্রুত।
সরতে সরতে এটি আরেকটি ছোট প্লেটের সংস্পর্শে এসেছে, যাকে ডাকা হচ্ছে ওখটস্ক মাইক্রোপ্লেট নামে। প্যাসিফিক প্লেটটি সমুদ্রজাত, যার মানে হচ্ছে এর মধ্যে থাকা পাথরগুলোর ঘনত্ব বেশি এবং এটি তুলনামূলক কম ঘনত্বের মাইক্রোপ্লেটের নিচে ডুবে যেতে চায়।
পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে ডুবে যেতে থাকা প্যাসিফিক প্লেটের অংশ গরম হয়ে গলতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে কার্যত অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু এটি সবসময় মসৃণভাবে ঘটে না। প্রায়ই প্লেটগুলো একে অপরের পাশ দিয়ে চলার সময় আটকে যায় এবং উপরে থাকা প্লেটকে টেনে নিচে নামানোর চেষ্টা হয়।
এই ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট শক্তি হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকতে পারে, কিন্তু এক পর্যায়ে হঠাৎ করে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা বের হয়ে যায়। এটাই প্রচ- ভূকম্পনের সৃষ্টি করে, যা ‘মেগাথ্রাস্ট আর্থকোয়াক’ নামে পরিচিত।
এবারের সুনামি বিধ্বংসী হল না কেন: বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত করার সময় প্লেটগুলোর হঠাৎ সরে যাওয়া উপরে থাকা পানিকে জায়গা থেকে ছিটকে ফেলে, যার ধাক্কা পরে সুনামি হয়ে তীরে আছড়ে পড়ে। গভীরে সমুদ্রে সুনামি ঘণ্টায় ৫০০ মাইলেরও (৮০০ কিলোমিটার) বেশি গতিতে ছুটতে পারে, অনেকটা যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের মতো।
সেখানে ঢেউগুলোর মধ্যে দূরত্ব থাকে অনেক দীর্ঘ, ঢেউগুলো খুব একটা বড়ও হয় না, বিরল ক্ষেত্রে ১ মিটারের (সোয়া তিন ফুট) বেশি হয়। কিন্তু সুনামি যখন স্থলের কাছে অগভীর পানিতে পৌঁছায়, এর গতি কমে প্রায়শই ঘণ্টায় ২০ থেকে ৩০ মাইলে নেমে আসে। ঢেউয়ের দূরত্ব ছোট হয়ে আসতে থাকে, উচ্চতা বাড়তে থাকে, কখনো কখনো সেগুলো উপকূলের কাছে পানির দেয়ালও তৈরি করতে পারে।
কিন্তু এর মানে এই নয় যে, ভয়াবহ শক্তিশালী ভূমিকম্প হলেই সুনামির লম্বা লম্বা ঢেউ দূরদূরান্তে আছড়ে পড়বে। বুধবারের ভূমিকম্পের পর রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের কোথাও কোথাও ৪ মিটার (১৩ ফুট) উচ্চতার ঢেউ দেখা গেছে বলে জানিয়েছে সেখানকার কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু এরপরও এই উচ্চতা ভারত মহাসাগরে ২০০৪ সালের বক্সিং ডে-র সুনামি কিংবা ২০১১ সালে জাপান সুনামির ঢেউয়ের তুলনায় অনেক কম। বক্সিং ডে সুনামিতে কোথাও কোথাও ঢেউয়ের উচ্চতা দেড়শ ফুট ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
“উপকূলের কাছে সমুদ্রতলের আকৃতি এবং যেখানে আছড়ে পড়ছে সেখানকার ভূমির আকৃতিরও সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতার ওপর প্রভাব ফেলে। এসব বিষয়ের পাশাপাশি, উপকূল কতটা ঘনবসতিপূর্ণ তার ওপর সুনামির ক্ষয়ক্ষতি কতটা হবে তা নির্ভর করে,” বলেছেন ইউনিভার্সিটি অব সাউথ্যাম্পটনের টেকটোনিকসের অধ্যাপক লিসা ম্যাকনেইল।
ইউএসজিএসের প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, বুধবারের ভূমিকম্পটির কেন্দ্র বেশ গভীরে ছিল না, ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২০ দশমিক ৭ কিলোমিটারের মতো নিচে ছিল।
এমন ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সমুদ্রতলে বড় ধরনের স্থানচ্যুতি ঘটতে পারে, ফলশ্রুতিতে সুনামির বড় বড় ঢেউ দেখা যাওয়া কথা, যদিও এমনটাই যে ঘটবে তা ভূমিকম্পের ঠিক পরপর বলাও যায় না।
রাশিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবন -এএফপি
বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫
বিশ্বে এখন পর্যন্ত বড় বড় যত ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম; কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি সেই মাত্রার সর্বনাশা সুনামি নিয়ে আসেনি, যেমনটা সবাই ভয় করছিল। বুধবার স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানার পর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলবর্তী লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০০৪ সালের বক্সিং ডেতে ভারত মহাসাগরে এবং ২০১১ সালে জাপানে সুনামির ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির কথা মাথায় রেখে কামচাটকায় ভূমিকম্পের খবর পাওয়ার পরপরই বিভিন্ন দেশ তাদের উপকূলীয় এলাকা থেকে কোটি কোটি লোককে সরিয়ে নেয়। ওই দুই ভয়াবহ সুনামিও এমন ‘মেগা’ ভূমিকম্পের পরই দেখা গিয়েছিল।
সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হলেও বুধবারের সুনামি ছিল সে তুলনায় বেশ দুর্বল। কেন এমন ভয়াবহ ভূমিকম্প আর সুনামি হয়, কেনইবা এবার প্রাথমিকভাবে যতটা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, ততটা প্রবল হয়নি সুনামি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে সেসবই তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে।
ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণ কী: কামচাটকা উপদ্বীপ প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হলেও এটি ‘প্যাসিফিক রিং অব ফায়ারের’ মধ্যে পড়েছে। এই রিং-এর মধ্যে অবস্থিত অঞ্চলজুড়ে অধিক ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি দেখা যায়। পৃথিবীর উপরের স্তরগুলো অনেকগুলো অংশ বা টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত। এসব প্লেট একে অপরের সাপেক্ষে ক্রমশ সরছে।
‘প্যাসিফিক রিং অব ফায়ার’ হল এসব প্লেটের মাঝে এমন এক বক্ররেখা যা প্রশান্ত মহাসাগরের চারপাশে বিস্তৃত। এই রিংজুড়ে বিশ্বের ৮০ শতাংশ ভূমিকম্প হয়, বলছে ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা। কামচাটকা উপকূলের ঠিক বাইরে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় বা প্যাসিফিক প্লেটটি প্রতি বছর উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রায় ৮ সেন্টিমিটার করে সরছে, টেকটোনিক গতির দিক থেকেও এটা বেশ দ্রুত।
সরতে সরতে এটি আরেকটি ছোট প্লেটের সংস্পর্শে এসেছে, যাকে ডাকা হচ্ছে ওখটস্ক মাইক্রোপ্লেট নামে। প্যাসিফিক প্লেটটি সমুদ্রজাত, যার মানে হচ্ছে এর মধ্যে থাকা পাথরগুলোর ঘনত্ব বেশি এবং এটি তুলনামূলক কম ঘনত্বের মাইক্রোপ্লেটের নিচে ডুবে যেতে চায়।
পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে ডুবে যেতে থাকা প্যাসিফিক প্লেটের অংশ গরম হয়ে গলতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে কার্যত অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু এটি সবসময় মসৃণভাবে ঘটে না। প্রায়ই প্লেটগুলো একে অপরের পাশ দিয়ে চলার সময় আটকে যায় এবং উপরে থাকা প্লেটকে টেনে নিচে নামানোর চেষ্টা হয়।
এই ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট শক্তি হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকতে পারে, কিন্তু এক পর্যায়ে হঠাৎ করে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা বের হয়ে যায়। এটাই প্রচ- ভূকম্পনের সৃষ্টি করে, যা ‘মেগাথ্রাস্ট আর্থকোয়াক’ নামে পরিচিত।
এবারের সুনামি বিধ্বংসী হল না কেন: বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত করার সময় প্লেটগুলোর হঠাৎ সরে যাওয়া উপরে থাকা পানিকে জায়গা থেকে ছিটকে ফেলে, যার ধাক্কা পরে সুনামি হয়ে তীরে আছড়ে পড়ে। গভীরে সমুদ্রে সুনামি ঘণ্টায় ৫০০ মাইলেরও (৮০০ কিলোমিটার) বেশি গতিতে ছুটতে পারে, অনেকটা যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের মতো।
সেখানে ঢেউগুলোর মধ্যে দূরত্ব থাকে অনেক দীর্ঘ, ঢেউগুলো খুব একটা বড়ও হয় না, বিরল ক্ষেত্রে ১ মিটারের (সোয়া তিন ফুট) বেশি হয়। কিন্তু সুনামি যখন স্থলের কাছে অগভীর পানিতে পৌঁছায়, এর গতি কমে প্রায়শই ঘণ্টায় ২০ থেকে ৩০ মাইলে নেমে আসে। ঢেউয়ের দূরত্ব ছোট হয়ে আসতে থাকে, উচ্চতা বাড়তে থাকে, কখনো কখনো সেগুলো উপকূলের কাছে পানির দেয়ালও তৈরি করতে পারে।
কিন্তু এর মানে এই নয় যে, ভয়াবহ শক্তিশালী ভূমিকম্প হলেই সুনামির লম্বা লম্বা ঢেউ দূরদূরান্তে আছড়ে পড়বে। বুধবারের ভূমিকম্পের পর রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের কোথাও কোথাও ৪ মিটার (১৩ ফুট) উচ্চতার ঢেউ দেখা গেছে বলে জানিয়েছে সেখানকার কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু এরপরও এই উচ্চতা ভারত মহাসাগরে ২০০৪ সালের বক্সিং ডে-র সুনামি কিংবা ২০১১ সালে জাপান সুনামির ঢেউয়ের তুলনায় অনেক কম। বক্সিং ডে সুনামিতে কোথাও কোথাও ঢেউয়ের উচ্চতা দেড়শ ফুট ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
“উপকূলের কাছে সমুদ্রতলের আকৃতি এবং যেখানে আছড়ে পড়ছে সেখানকার ভূমির আকৃতিরও সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতার ওপর প্রভাব ফেলে। এসব বিষয়ের পাশাপাশি, উপকূল কতটা ঘনবসতিপূর্ণ তার ওপর সুনামির ক্ষয়ক্ষতি কতটা হবে তা নির্ভর করে,” বলেছেন ইউনিভার্সিটি অব সাউথ্যাম্পটনের টেকটোনিকসের অধ্যাপক লিসা ম্যাকনেইল।
ইউএসজিএসের প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, বুধবারের ভূমিকম্পটির কেন্দ্র বেশ গভীরে ছিল না, ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২০ দশমিক ৭ কিলোমিটারের মতো নিচে ছিল।
এমন ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সমুদ্রতলে বড় ধরনের স্থানচ্যুতি ঘটতে পারে, ফলশ্রুতিতে সুনামির বড় বড় ঢেউ দেখা যাওয়া কথা, যদিও এমনটাই যে ঘটবে তা ভূমিকম্পের ঠিক পরপর বলাও যায় না।