alt

আন্তর্জাতিক

লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য : প্রবাসীদের তীর্থ

সালাম জুবায়ের, লন্ডন থেকে ফিরে : শনিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২১

বাড়ির আঙ্গিনায় স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের সামনে আফসার খান সাদেক

যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আমির হোসেন থাকেন ম্যানচেস্টারে। লন্ডনে এসেছেন বেড়াতে, কিছু কাজও আছে। কাজের ফাঁকে ছুটে এসেছেন টাওয়ার হ্যামলেট এলাকায়। উদ্দেশ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেখা।

আমির হোসেনের মতো অনেক বাঙালি লন্ডনে এলেই ছুটে যান টাওয়ার হ্যামলেটের সেই বাড়ির সামনে, যেখানে দেশপ্রেমিক প্রবাসী বাঙালি আফসার খান সাদেক তার বাড়ির বাগানে স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। ঐতিহাসিক লল্ডন শহরে এ ভাস্কর্য এখন পুরো ইউরোপে প্রবাসী বাঙালিদের গৌরব ও বীরত্বের প্রতীক এবং তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে।

আফসার খান সাদেকের বাড়ির আঙিনায় স্থাপিত ভস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় ম্যানচেস্টার থেকে আসা প্রবাসী আমির হোসেনের সঙ্গে। বললেন, অনেক বছর ধরে যুক্তরাজ্যের ফুটবল শহর ম্যানচেস্টারে থাকি। কয়েক বছর ধরে শুনছি, লন্ডনে নাকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। আজ দেখতে এসেছি।

আমিরের ভাষায়; আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি, তার মৃত্যুর পর আমার জন্ম হয়েছে। শুনেছি সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু লোক তাকে সপরিবারে হত্যা করেছে। তার সম্পর্কে মনে এক ধরনের ভালোবাসা আছে। তাই এবার লন্ডনে এসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেখতে এলাম। কথাগুলো বলার সময় আমিরের চোখে-মুখে এক ধরনের গৌরববোধ কাজ করছিল।

শুধু আমির হোসেনই নয়, লন্ডনে একাধিক প্রবাসীর সঙ্গে কথা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে। সবাই তাদের গৌরববোধের কথা জানিয়েছেন। ইউরোপের অন্য দেশ থেকে কেউ বেড়াতে লন্ডনে এলে পরিচিতজনরা তাকে নিয়ে যান টাওয়ার হ্যামলেটের সেই বাড়ির সামনে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য দেখাতে। আমারও সেভাবেই এ ভাস্কর্য দেখতে আসা।

জলবায়ু সম্মেলন, প্রবাসী ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী সম্মেলন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকসহ বেশ কিছু কর্মসূচিতে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্য সফর করেন। যুক্তরাজ্য থেকে তিনি প্যারিসও সফর করেছেন। সেই সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী সাংবাদিক হিসেবে লন্ডন যাওয়ার সুযোগ হয় আমার।

লন্ডনে আমাদের থাকার জায়গা ছিল ভারতীয় মালিকানার তাজ হোটেল। লন্ডন পৌঁছে হোটেলে উঠার পরপরই দেখা পাই অনেক প্রবাসীর। বেশ কয়েকজন স্বজনও পেয়ে যাই। ঐতিহাসিক শহর লন্ডনে বেড়ানোর জায়গার অভাব নেই। যেদিকে চোখ যায়, সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে শত শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য। এসব ঐতিহাসিক স্থান দেখার পাশাপাশি ইস্ট লন্ডনের বাঙালিপাড়া টাওয়ার হ্যামলেটে যাওয়া কোন কারণেই যেন বাদ না পড়ে সে পরামর্শ ছিল সবার। আর টাওয়ার হ্যামলেটে গিয়ে লন্ডনে বাঙালি ও প্রবাসীদের গৌরবের প্রতীক আফসার খান সাদেকের বাড়ির আঙিনায় স্থাপিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য দেখতে যেন ভুল না করি- এমন পরামর্শ দিতে কেউ ভোলেননি। আমার লন্ডনপ্রবাসী ভাগনে হিমেল এক বিকেলে আমাকে নিয়ে গেল টাওয়ার হ্যামলেটে আফসার খান সাদেকের বাড়ির সামনে। উদ্দেশ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেখানো।

পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের সিডনি স্ট্রিটে আফসার খান সাদেকের বাড়ির আযিনায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের সামনে কিছু সময় কাটিয়ে সত্যিই মনে হলো এটি প্রবাসী বাঙালিদের একটি আবেগ আর গৌরবের প্রাঙ্গণ হয়ে উঠেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই দেখা মিলল আমির হোসেনসহ বেশ কয়েকজন প্রবাসীর। তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়িয়ে নানা পোজে ছবি তুলছেন, খুটিয়ে খুটিয়ে ভাস্কর্য দেখছেন, প্রাঙ্গণে বসানো নামফলকের লেখা পড়ছেনÑ এভাবে সে এলাকায় কিছু সময় কাটানোর মধ্যে অনেক প্রবাসী মনে আনন্দ অনুভব করেন। লন্ডনের মতো ঐতিহাসিক এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরীতে জাতির জনকের ভাস্কর্য স্থাপন করে প্রবাসী বাঙালিরা ইতিহাসের অংশ হলেন। খোদ ব্রিটিশ এবং অনেক বিদেশি পর্যটকÑ যারাই ইস্ট লন্ডনে বেড়াতে যান, কেউই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য না দেখে ফেরেননা। লন্ডনের বিশিষ্ট স্থানগুলোর মধ্যে আফসার সাদেকের বাড়ির আঙিনার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও স্থান পেয়েছে। এটাও বাঙালির গৌরবের বিষয়।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য যখন দেখতে যাই, ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোক্তা আফসার খান সাদেক তখন বাসায় ছিলেন না। এ জন্য তার সঙ্গে সামনা-সামনি কথা বলতে পারিনি। পরে ফোনে তার কাছে প্রথম জানতে চাই, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের পিছনের কাহিনী।

ভাস্কর্যের কথা উঠলেই আফসার খান সাদেক আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ইউরোপের অন্যতম প্রধান দেশ, এক সময় আমাদের বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষ শাসনকারী দেশ ব্রিটেনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল। দীর্ঘদিন ধরে লল্ডনে বসবাস করছি কিন্তু এখনকার বাঙালি প্রবাসীদের গৌরব করার মতো কোন কিছুই নেই। আমার চিন্তা ছিল এখানে এমন একটা কিছু প্রতিষ্ঠা করা যা দেখে সারাবিশ্বের মানুষ, যারাই লন্ডনে আসেন, তারা যেন বাংলাদেশের কথা মনে করতে পারে। সে চিন্তা থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

কিভাবে আপনার সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করলেন? অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে এজন্যÑ বললেন আফসার খান সাদেক। কিছুটা ক্ষোভের সুরেই বললেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের মহান নেতা হলেও, আমাদের স্বাধীনতা এনে দিলেও, আমাদের দেশেরই কুলঙ্গার সন্তান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। সেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা এখনো আমাদের মধ্যে আছে। তারা সুযোগ পেলেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কথা বলে। তেমন কিছু মানুষ আমি যাতে লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি সে জন্য অনেক চেষ্টা করেছে, আইনি বাধা দিতেও আদাজল খেয়ে লেগেছিল। কিন্তু পারেনি, বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে লাখো মানুষের সামনে তুলে ধরতে পেরেছি।

কারা বাধা সৃষ্টি করেছিল জানতে চাইলে আফসার খান সাদেক সংবাদকে বলেন, আমি ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে প্ল্যানিং পারমিশনের আবেদন করলেও ২০১৪ সালের জুলাই মাসে তিনি ভাস্কর্য স্থাপনের অনুমতি পান। ভারত থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরি করে আনেন। ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভাস্কর্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এর পরপরই একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী মামলা করে আফছার খান সাদেকের বিরুদ্ধে। ভাস্কর্য এক মাসের মধ্যে তুলে ফেলতে হবে বলে এনফোর্সমেন্ট নোটিশ জারি করে। আফসার খান হতাশ হলেও দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি নিরূপায় হয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করলেন। আদালক রায় দিল- এ ভাস্কর্য আইনকানুন মেনেই হয়েছে, এটা থাকবে আজীবন। রায় আসে ২০১৭ সালের জুন মাসে।

আফসার খান বলেন, এখন আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দ যে, যেই হোক না কেন, যে দেশের নাগরিকই হোকনা কেন, এখানে দাঁড়িয়ে ভাস্কর্য দেখে। তারপরই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চায়। এই ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে অনেক দেশের অনেক সাধারণ মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পেরেছি- এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে।

লেবানন-সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলা

ছবি

ট্রাম্পের কঠোর শুল্ক আরোপের হুমকিতে চাপ নয়, বরং স্বস্তিতে রাশিয়া

মে মাসে ইরানের তেল রপ্তানিতে সর্বকালের রেকর্ড

ছবি

জোটে ভাঙন, অস্তিত্ব সংকটে নেতানিয়াহুর সরকার

ইসরায়েলিদের ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে গাজায় বাড়িঘর ধ্বংস করছে সেনারা

ছবি

বেপরোয়া হুতি, ২০ মাসে ৭০ জাহাজে হামলা

ছবি

দালাই লামার উত্তরাধিকারের ওপর বেইজিংয়ের অধিকার দাবি, নয়াদিল্লিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে : ম্যাখোঁ

ছবি

দুই হাজার বছর আগে ডুবে যাওয়া শহরের খোঁজ

কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীকে গৃহবন্দি করল ভারত

ছবি

আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে কী কারণে স্বীকৃতি দিল রাশিয়া

সিরিয়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, নিহত ৩০

ছবি

গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতা চলছেই, নিহত ৫৮ হাজার ছাড়াল

ছবি

সিরিয়ায় বেদুইন সুন্নি-দ্রুজ সংঘর্ষে নিহত অন্তত ৩০

ছবি

ইসরায়েলি হামলায় আহত হয়েছিলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট, জরুরি পথে পালিয়ে বাঁচেন

ছবি

নাইজেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারি আর নেই

ছবি

ইসরায়েলের পদক্ষেপে উদ্বেগ, গাজার পরিস্থিতি ঠেকাতে ব্রিটিশ এমপিদের চিঠি

ছবি

গণহত্যা রুখতে ২০টির বেশি দেশের সম্মেলনে বাংলাদেশেরও অংশগ্রহণ

ছবি

শুল্কহার কমিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে যেতে চায় ভারত

ছবি

অভিযানের সময় আহত শ্রমিকের মৃত্যু, আক্রমণাত্মক কৌশল স্থগিতের নির্দেশ আদালতের

যুক্তরাষ্ট্র হামলা না চালানোর নিশ্চয়তা দিলে আলোচনায় বসবে ইরান

ছবি

বিশ্বের সর্বাধিক মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হতে চলেছে ভারত

ইউক্রেনে রাশিয়ার যে কোন কাজের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের ঘোষণা কিমের

ছবি

পুতিনকে নিয়ে ‘হতাশ’ ট্রাম্পের পরবর্তী সিদ্ধান্ত কী হবে

মায়ানমারে সংঘাত, থাই সীমান্ত দিয়ে পালাল শতাধিক সেনা

ছবি

মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলছে ‘নীরব বিপ্লব’

ছবি

গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে ২৪ জন নিহত, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর অভিযোগ

ছবি

এয়ার ইন্ডিয়া উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার কারণ: সুইচের অপ্রত্যাশিত বন্ধ হওয়া, তদন্তে জানা গেছে

ছবি

মাত্র ১২ দিনেই যুদ্ধবিরতি’, ইরানের পাল্টা হামলায় তেল আবিবে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি

১২ দিনের যুদ্ধে ৫০০ ইসরায়েলি নিহত: ইরান

ছবি

ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ গেছে ৮০০ ফিলিস্তিনির

মায়ানমারে বৌদ্ধ মঠে বিমান হামলায় নিহত ২৩

ছবি

হুথিদের সাহায্য করে কারা, কীভাবে তারা অস্ত্র পায়?

কুর্দি বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণে তুরস্কের জয় হয়েছে : এরদোয়ান

ছবি

‘বিধ্বস্ত হওয়ার আগে জ্বালানি সুইচ বন্ধ হয় এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনের’

ছবি

‘আমি জ্বালানির সুইচ বন্ধ করিনি’: বিধ্বস্তের আগে পাইলট

tab

আন্তর্জাতিক

লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য : প্রবাসীদের তীর্থ

সালাম জুবায়ের, লন্ডন থেকে ফিরে

বাড়ির আঙ্গিনায় স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের সামনে আফসার খান সাদেক

শনিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২১

যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আমির হোসেন থাকেন ম্যানচেস্টারে। লন্ডনে এসেছেন বেড়াতে, কিছু কাজও আছে। কাজের ফাঁকে ছুটে এসেছেন টাওয়ার হ্যামলেট এলাকায়। উদ্দেশ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেখা।

আমির হোসেনের মতো অনেক বাঙালি লন্ডনে এলেই ছুটে যান টাওয়ার হ্যামলেটের সেই বাড়ির সামনে, যেখানে দেশপ্রেমিক প্রবাসী বাঙালি আফসার খান সাদেক তার বাড়ির বাগানে স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। ঐতিহাসিক লল্ডন শহরে এ ভাস্কর্য এখন পুরো ইউরোপে প্রবাসী বাঙালিদের গৌরব ও বীরত্বের প্রতীক এবং তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে।

আফসার খান সাদেকের বাড়ির আঙিনায় স্থাপিত ভস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় ম্যানচেস্টার থেকে আসা প্রবাসী আমির হোসেনের সঙ্গে। বললেন, অনেক বছর ধরে যুক্তরাজ্যের ফুটবল শহর ম্যানচেস্টারে থাকি। কয়েক বছর ধরে শুনছি, লন্ডনে নাকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। আজ দেখতে এসেছি।

আমিরের ভাষায়; আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি, তার মৃত্যুর পর আমার জন্ম হয়েছে। শুনেছি সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু লোক তাকে সপরিবারে হত্যা করেছে। তার সম্পর্কে মনে এক ধরনের ভালোবাসা আছে। তাই এবার লন্ডনে এসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেখতে এলাম। কথাগুলো বলার সময় আমিরের চোখে-মুখে এক ধরনের গৌরববোধ কাজ করছিল।

শুধু আমির হোসেনই নয়, লন্ডনে একাধিক প্রবাসীর সঙ্গে কথা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে। সবাই তাদের গৌরববোধের কথা জানিয়েছেন। ইউরোপের অন্য দেশ থেকে কেউ বেড়াতে লন্ডনে এলে পরিচিতজনরা তাকে নিয়ে যান টাওয়ার হ্যামলেটের সেই বাড়ির সামনে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য দেখাতে। আমারও সেভাবেই এ ভাস্কর্য দেখতে আসা।

জলবায়ু সম্মেলন, প্রবাসী ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী সম্মেলন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকসহ বেশ কিছু কর্মসূচিতে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্য সফর করেন। যুক্তরাজ্য থেকে তিনি প্যারিসও সফর করেছেন। সেই সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী সাংবাদিক হিসেবে লন্ডন যাওয়ার সুযোগ হয় আমার।

লন্ডনে আমাদের থাকার জায়গা ছিল ভারতীয় মালিকানার তাজ হোটেল। লন্ডন পৌঁছে হোটেলে উঠার পরপরই দেখা পাই অনেক প্রবাসীর। বেশ কয়েকজন স্বজনও পেয়ে যাই। ঐতিহাসিক শহর লন্ডনে বেড়ানোর জায়গার অভাব নেই। যেদিকে চোখ যায়, সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে শত শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য। এসব ঐতিহাসিক স্থান দেখার পাশাপাশি ইস্ট লন্ডনের বাঙালিপাড়া টাওয়ার হ্যামলেটে যাওয়া কোন কারণেই যেন বাদ না পড়ে সে পরামর্শ ছিল সবার। আর টাওয়ার হ্যামলেটে গিয়ে লন্ডনে বাঙালি ও প্রবাসীদের গৌরবের প্রতীক আফসার খান সাদেকের বাড়ির আঙিনায় স্থাপিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য দেখতে যেন ভুল না করি- এমন পরামর্শ দিতে কেউ ভোলেননি। আমার লন্ডনপ্রবাসী ভাগনে হিমেল এক বিকেলে আমাকে নিয়ে গেল টাওয়ার হ্যামলেটে আফসার খান সাদেকের বাড়ির সামনে। উদ্দেশ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেখানো।

পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের সিডনি স্ট্রিটে আফসার খান সাদেকের বাড়ির আযিনায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের সামনে কিছু সময় কাটিয়ে সত্যিই মনে হলো এটি প্রবাসী বাঙালিদের একটি আবেগ আর গৌরবের প্রাঙ্গণ হয়ে উঠেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই দেখা মিলল আমির হোসেনসহ বেশ কয়েকজন প্রবাসীর। তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়িয়ে নানা পোজে ছবি তুলছেন, খুটিয়ে খুটিয়ে ভাস্কর্য দেখছেন, প্রাঙ্গণে বসানো নামফলকের লেখা পড়ছেনÑ এভাবে সে এলাকায় কিছু সময় কাটানোর মধ্যে অনেক প্রবাসী মনে আনন্দ অনুভব করেন। লন্ডনের মতো ঐতিহাসিক এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরীতে জাতির জনকের ভাস্কর্য স্থাপন করে প্রবাসী বাঙালিরা ইতিহাসের অংশ হলেন। খোদ ব্রিটিশ এবং অনেক বিদেশি পর্যটকÑ যারাই ইস্ট লন্ডনে বেড়াতে যান, কেউই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য না দেখে ফেরেননা। লন্ডনের বিশিষ্ট স্থানগুলোর মধ্যে আফসার সাদেকের বাড়ির আঙিনার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও স্থান পেয়েছে। এটাও বাঙালির গৌরবের বিষয়।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য যখন দেখতে যাই, ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোক্তা আফসার খান সাদেক তখন বাসায় ছিলেন না। এ জন্য তার সঙ্গে সামনা-সামনি কথা বলতে পারিনি। পরে ফোনে তার কাছে প্রথম জানতে চাই, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের পিছনের কাহিনী।

ভাস্কর্যের কথা উঠলেই আফসার খান সাদেক আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ইউরোপের অন্যতম প্রধান দেশ, এক সময় আমাদের বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষ শাসনকারী দেশ ব্রিটেনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল। দীর্ঘদিন ধরে লল্ডনে বসবাস করছি কিন্তু এখনকার বাঙালি প্রবাসীদের গৌরব করার মতো কোন কিছুই নেই। আমার চিন্তা ছিল এখানে এমন একটা কিছু প্রতিষ্ঠা করা যা দেখে সারাবিশ্বের মানুষ, যারাই লন্ডনে আসেন, তারা যেন বাংলাদেশের কথা মনে করতে পারে। সে চিন্তা থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

কিভাবে আপনার সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করলেন? অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে এজন্যÑ বললেন আফসার খান সাদেক। কিছুটা ক্ষোভের সুরেই বললেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের মহান নেতা হলেও, আমাদের স্বাধীনতা এনে দিলেও, আমাদের দেশেরই কুলঙ্গার সন্তান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। সেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা এখনো আমাদের মধ্যে আছে। তারা সুযোগ পেলেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কথা বলে। তেমন কিছু মানুষ আমি যাতে লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি সে জন্য অনেক চেষ্টা করেছে, আইনি বাধা দিতেও আদাজল খেয়ে লেগেছিল। কিন্তু পারেনি, বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে লাখো মানুষের সামনে তুলে ধরতে পেরেছি।

কারা বাধা সৃষ্টি করেছিল জানতে চাইলে আফসার খান সাদেক সংবাদকে বলেন, আমি ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে প্ল্যানিং পারমিশনের আবেদন করলেও ২০১৪ সালের জুলাই মাসে তিনি ভাস্কর্য স্থাপনের অনুমতি পান। ভারত থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরি করে আনেন। ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভাস্কর্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এর পরপরই একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী মামলা করে আফছার খান সাদেকের বিরুদ্ধে। ভাস্কর্য এক মাসের মধ্যে তুলে ফেলতে হবে বলে এনফোর্সমেন্ট নোটিশ জারি করে। আফসার খান হতাশ হলেও দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি নিরূপায় হয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করলেন। আদালক রায় দিল- এ ভাস্কর্য আইনকানুন মেনেই হয়েছে, এটা থাকবে আজীবন। রায় আসে ২০১৭ সালের জুন মাসে।

আফসার খান বলেন, এখন আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দ যে, যেই হোক না কেন, যে দেশের নাগরিকই হোকনা কেন, এখানে দাঁড়িয়ে ভাস্কর্য দেখে। তারপরই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চায়। এই ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে অনেক দেশের অনেক সাধারণ মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পেরেছি- এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে।

back to top