পিডিবির লোকসান দেখিয়ে গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। লোকসানের বোঝা এসে পড়েছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। কিন্তু সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি এবং আরইবির অধীনস্থ বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা মুনাফা দেখাচ্ছে। মুনাফার ৫ শতাংশ ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো এক অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান দিয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে সরকারি ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি লাভ করেছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এ হিসেবে কর্মীদের প্রফিট বোনাস দাঁড়ায় ৭৫ কোটি টাকা। কোম্পানিভেদে একজন কর্মী বছরে ৩ থেকে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রফিট বোনাস পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এভাবে প্রতি বছর বিদ্যুৎ কর্মীরা নিয়ে যাচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। একই অবস্থা জ্বালানি খাতের কয়েকটি কোম্পানিতেও।
প্রফিট (মুনাফা) বোনাস পাওয়া কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি, শ্রমিক আইন অনুযায়ী কোম্পানির বার্ষিক মুনাফার ৫ শতাংশ বোনাস তারা পেয়ে থাকেন। এখানে আইনের ব্যতয় হয়নি। তবে ক্রমাগত লোকসানে থাকা বিদ্যুৎ খাতের জন্য এই আইন কতটা প্রযোজ্য তা নিয়ে আলোচনা আছে।
পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘আইনটা দেখলে আপনিও বুঝবেন। আইনটা মূলত হয়েছিল গার্মেন্ট শ্রমিক, বেসরকারি শিল্প, কল-কারখানা শ্রমিকদের জন্য। আইনে বলা আছে, প্রতিষ্ঠানের কর পূর্ব মুনাফার পাঁচ শতাংশ কর্মীদের দিতে হবে।’
শ্রমিক আইনে প্রতিষ্ঠানের সিইওি (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) বা এমডিকে (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) বোনাসের আওতায় রাখা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইন বলা হয়েছে এই পদে সাধারণত প্রতিষ্ঠানের মালিক বা অংশীদাররা থাকেন।
তিনি বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির সিইও বা এমডিরা প্রতিষ্ঠানের মালিক বা অংশীদার না। কিন্তু তারা প্রফিট বোনাস পান না। কারণ, আইনে এটাই বলা আছে। তাই বলা চলে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় এই আইন করা হয়েছিল। কারণ, মালিকরা শ্রমিক ঠকায়, এমন নজির অহড়হ দেখা যায়। মালিকদের লাভের একটা অংশ শ্রমিকদের দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।’
সরকারি অন্যান্য চাকরির তুলনায় রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায় আড়াই গুণ বেশি বেতন-ভাতা পান উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রফিট বোনাসের এই আইন সরকারি বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয় বলে তিনি মনে করেন।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৬ বছরে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি লোকসান দেখিয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১৮৮ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের শুরুর দিকে এ লোকসান অনেক কম ছিল। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লোকসান অনেক বেড়ে গেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুনেছিল ৮২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান হয়েছে ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এরপর হঠাৎ করেই লোকসান অনেক বেড়ে গেছে। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪; এই তিন অর্থবছরে রেকর্ড এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে পিডিবির। লোকসানের কারণে সরকার দেড় দশকে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পিডিবি বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানিকে দিয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত তৎকালীন সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি নিট মুনাফা করেছে ১৫১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর ৫ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রফিট বোনাস হিসেবে দাঁড়ায় ৭৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। যে কোম্পানি যত বেশি লাভ করে তার কর্মীরা যে অনুযায়ী প্রফিট বোনাস পান।
সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনস্থ লাভে থাকা কোম্পানিগুলো হলো- আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির (এপিএসসিএল), ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি (ইজিসিবি), নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (নওপাজেকো), রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) এবং বি-আর পাওয়ার জেন (বিআরপিএল)। এর আগের তিন অর্থবছরও এই কোম্পানিগুলো লাভে ছিল।
লাভ দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মুনাফা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার নজির জ্বালানি খাতের সরকারি কোম্পানিতেও আছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৮ লাখ টাকা করে মুনাফা বোনাস দিয়েছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (কেজিডিসিএল)। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ‘কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের (কাফকো)’ কাছে বেশি দামে গ্যাস বিক্রি করে এই মুনাফা করেছিল কেজিডিসিএল। অথচ এ টাকা দেয়ার কথা ছিল পেট্রোবাংলাকে।
কারণ, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নির্দেশনা অনুসারে সরকারি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস বিক্রি বাবদ যে মাশুল (বিতরণ মার্জিন) পায় সেটি ছাড়া মুনাফার বাড়তি অর্থ নিজেদের কাছে রাখতে পারে না। জমা দিতে হয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা পেট্রোবাংলাকে। বিইআরসির নির্দেশনা না মেনে মুনাফার বাড়তি টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এছাড়া জ্বালানি খাতের সরকারি কোম্পানি জিটিসিএল, তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎ খাতের সরকারি কোম্পানি পিজিসিবিসহ সরকারি অন্যান্য কোম্পানিতে মুনাফা বোনাস প্রদানে প্রতিযোগিতার নজির রয়েছে।
মুনাফা ভাগ করে নেয়ার বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম শামসুল আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা যে পাপের টাকা, চুরির টাকা, তা কেউ বুঝতে চায় না। বরং বুক ফুলিয়ে বলে আমি এতো মুনাফা করেছি।’
পিডিবির লোকসানের বিষয়ে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, নিজের কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে পিডিবি। দর যাচাই-বাছাই যেন না করা যায় সেজন্য করা হয়েছে বিশেষ আইন। তিনি আরও বলেন, ‘যাচাই বাছাই যে করবে এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। কারণ চাকরি বাঁচাতে গেলে এগুলো করতে হয়। সঠিক কাজ করলে নানা রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়।’
বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর একক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান পিডিবি। তারা বেশিদামে বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে কম দামে দেয়ায় লস হয়। তবে বেশিদামে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিগুলোতেই গলদ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো লাভ করে মুনাফার একটা অংশ নিজেরা ভাগ করে নিচ্ছে। অথচ পুরো মুনাফাটা পিডিবিকে দেয়া উচিত। তাতে সরকারের কাছ থেকে প্রতি বছর পিডিবির নেয়া ভর্তুকির পরিমাণ কমে আসবে।’
বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
পিডিবির লোকসান দেখিয়ে গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। লোকসানের বোঝা এসে পড়েছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। কিন্তু সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি এবং আরইবির অধীনস্থ বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা মুনাফা দেখাচ্ছে। মুনাফার ৫ শতাংশ ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো এক অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান দিয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে সরকারি ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি লাভ করেছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এ হিসেবে কর্মীদের প্রফিট বোনাস দাঁড়ায় ৭৫ কোটি টাকা। কোম্পানিভেদে একজন কর্মী বছরে ৩ থেকে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রফিট বোনাস পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এভাবে প্রতি বছর বিদ্যুৎ কর্মীরা নিয়ে যাচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। একই অবস্থা জ্বালানি খাতের কয়েকটি কোম্পানিতেও।
প্রফিট (মুনাফা) বোনাস পাওয়া কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি, শ্রমিক আইন অনুযায়ী কোম্পানির বার্ষিক মুনাফার ৫ শতাংশ বোনাস তারা পেয়ে থাকেন। এখানে আইনের ব্যতয় হয়নি। তবে ক্রমাগত লোকসানে থাকা বিদ্যুৎ খাতের জন্য এই আইন কতটা প্রযোজ্য তা নিয়ে আলোচনা আছে।
পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘আইনটা দেখলে আপনিও বুঝবেন। আইনটা মূলত হয়েছিল গার্মেন্ট শ্রমিক, বেসরকারি শিল্প, কল-কারখানা শ্রমিকদের জন্য। আইনে বলা আছে, প্রতিষ্ঠানের কর পূর্ব মুনাফার পাঁচ শতাংশ কর্মীদের দিতে হবে।’
শ্রমিক আইনে প্রতিষ্ঠানের সিইওি (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) বা এমডিকে (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) বোনাসের আওতায় রাখা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইন বলা হয়েছে এই পদে সাধারণত প্রতিষ্ঠানের মালিক বা অংশীদাররা থাকেন।
তিনি বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির সিইও বা এমডিরা প্রতিষ্ঠানের মালিক বা অংশীদার না। কিন্তু তারা প্রফিট বোনাস পান না। কারণ, আইনে এটাই বলা আছে। তাই বলা চলে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় এই আইন করা হয়েছিল। কারণ, মালিকরা শ্রমিক ঠকায়, এমন নজির অহড়হ দেখা যায়। মালিকদের লাভের একটা অংশ শ্রমিকদের দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।’
সরকারি অন্যান্য চাকরির তুলনায় রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায় আড়াই গুণ বেশি বেতন-ভাতা পান উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রফিট বোনাসের এই আইন সরকারি বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয় বলে তিনি মনে করেন।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৬ বছরে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি লোকসান দেখিয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১৮৮ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের শুরুর দিকে এ লোকসান অনেক কম ছিল। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লোকসান অনেক বেড়ে গেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুনেছিল ৮২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান হয়েছে ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এরপর হঠাৎ করেই লোকসান অনেক বেড়ে গেছে। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪; এই তিন অর্থবছরে রেকর্ড এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে পিডিবির। লোকসানের কারণে সরকার দেড় দশকে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পিডিবি বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানিকে দিয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত তৎকালীন সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি নিট মুনাফা করেছে ১৫১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর ৫ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রফিট বোনাস হিসেবে দাঁড়ায় ৭৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। যে কোম্পানি যত বেশি লাভ করে তার কর্মীরা যে অনুযায়ী প্রফিট বোনাস পান।
সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনস্থ লাভে থাকা কোম্পানিগুলো হলো- আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির (এপিএসসিএল), ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি (ইজিসিবি), নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (নওপাজেকো), রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) এবং বি-আর পাওয়ার জেন (বিআরপিএল)। এর আগের তিন অর্থবছরও এই কোম্পানিগুলো লাভে ছিল।
লাভ দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মুনাফা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার নজির জ্বালানি খাতের সরকারি কোম্পানিতেও আছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৮ লাখ টাকা করে মুনাফা বোনাস দিয়েছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (কেজিডিসিএল)। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ‘কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের (কাফকো)’ কাছে বেশি দামে গ্যাস বিক্রি করে এই মুনাফা করেছিল কেজিডিসিএল। অথচ এ টাকা দেয়ার কথা ছিল পেট্রোবাংলাকে।
কারণ, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নির্দেশনা অনুসারে সরকারি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস বিক্রি বাবদ যে মাশুল (বিতরণ মার্জিন) পায় সেটি ছাড়া মুনাফার বাড়তি অর্থ নিজেদের কাছে রাখতে পারে না। জমা দিতে হয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা পেট্রোবাংলাকে। বিইআরসির নির্দেশনা না মেনে মুনাফার বাড়তি টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এছাড়া জ্বালানি খাতের সরকারি কোম্পানি জিটিসিএল, তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎ খাতের সরকারি কোম্পানি পিজিসিবিসহ সরকারি অন্যান্য কোম্পানিতে মুনাফা বোনাস প্রদানে প্রতিযোগিতার নজির রয়েছে।
মুনাফা ভাগ করে নেয়ার বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম শামসুল আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা যে পাপের টাকা, চুরির টাকা, তা কেউ বুঝতে চায় না। বরং বুক ফুলিয়ে বলে আমি এতো মুনাফা করেছি।’
পিডিবির লোকসানের বিষয়ে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, নিজের কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে পিডিবি। দর যাচাই-বাছাই যেন না করা যায় সেজন্য করা হয়েছে বিশেষ আইন। তিনি আরও বলেন, ‘যাচাই বাছাই যে করবে এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। কারণ চাকরি বাঁচাতে গেলে এগুলো করতে হয়। সঠিক কাজ করলে নানা রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়।’
বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর একক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান পিডিবি। তারা বেশিদামে বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে কম দামে দেয়ায় লস হয়। তবে বেশিদামে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিগুলোতেই গলদ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো লাভ করে মুনাফার একটা অংশ নিজেরা ভাগ করে নিচ্ছে। অথচ পুরো মুনাফাটা পিডিবিকে দেয়া উচিত। তাতে সরকারের কাছ থেকে প্রতি বছর পিডিবির নেয়া ভর্তুকির পরিমাণ কমে আসবে।’