alt

জাতীয়

১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে সংকটে বাংলাদেশ

জসিম উদ্দিন সিদ্দিকী, কক্সবাজার : বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো দিনদিন অরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি আশ্রিত শিবিরে তদারকি কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা নানা কৌশল অবলম্বন করে ক্যাম্প থেকে পালানোর হিড়িক পড়েছে। কেউ দালালের মাধ্যমে, আবার কেউ ক্যাম্পের বাইরে অবস্থানরত পূর্বের আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।

রোহিঙ্গাদের আকৃতি, ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ স্থানীয়দের সঙ্গে অনেকটা মিল। যার কারণেই রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুরা সহজেই স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে পারছে। ক্যাম্প ছেড়ে তাদের পালানোর বিষয়টি এখন উদ্বেগজনক। অনেক রোহিঙ্গা গত ৬ বছরের মধ্যে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন আলোচিত সমালোচিত হত্যাকান্ড, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদকসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছেন।

এভাবে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়া ১১ লাখের বেশি মায়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক নিয়ে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। শত চেষ্টা করেও গত ছয় বছরে তাদের নিজ দেশে ফেরানো যায়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যত দেরি হচ্ছে ততই বাড়ছে ঝুঁকি।

সবশেষ গত মঙ্গলবার ২৮৯ জন রোহিঙ্গাকে উখিয়া-টেকনাফ মহাসড়ক থেকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উখিয়া ডিগ্রি কলেজ গেট সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এর আগে গত সোমবার ৫৫ জন, গত রোববার ২৯ জন এবং শনিবার ২৯ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের নিজ নিজ ক্যাম্প প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে আসা ঠেকাতে পুলিশ কঠোর নজরদারি শুরু করেছে। অনেকে ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ক্যাম্পের নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে আসে। এটা ঠেকাতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে পুলিশ বিশেষ অভিযান শুরু করেছে।

ওসি বলেন, আটক রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে আসার বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়েছে। কেউ আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে, কেউ কাজের সন্ধানে, কেউ চিকিৎসার জন্য, কেউ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বের হয়েছে বলে পুলিশকে জানিয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তাদের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান ওসি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের নিজ নিজ রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে জানান তিনি।

এদিকে রোহিঙ্গাদের এভাবে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে পড়ায় উদ্বেগ বাড়ছে স্থানীয়দের মধ্যে। কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, আমরাই এখন আতঙ্কে থাকি। রোহিঙ্গারা আসার পর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত। এলাকার অনেক মানুষকে তারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে বিষয়টি জানিয়েছি। আপাতত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি।

জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী, বার্মাপাড়া, হালিমাপাড়া, ইসলামপুর, বাদশাঘোনা, খাজামঞ্জিল, বৈদ্যঘোনা, সমিতিপাড়াসহ জেলার বিভিন্ন পাহাড় অধ্যুষিত বহু এলাকায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা এসে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছে। তাদের চলাচলে কোন বাধা নেই।

শুধু তাই নয়, স্থানীয় অনেক ছেলে ক্যাম্পে এসে বিয়ে করছে। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে প্রতিদিন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের অনেকে কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বের হন। সন্ধ্যা বা রাতে কেউ ফেরেন, কেউ ফেরেন না। এভাবে পালিয়ে খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক রোহিঙ্গা। কম মজুরিতে পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের অনেকে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গৃহস্থালি এবং কৃষি, ইটভাটায় স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। আবার অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাইরে যেতে দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির নেতা মাহাবুবুর রহমান বলেন, ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করার কোন ধরনের বৈধতা নেই রোহিঙ্গাদের। কারণ, তারা প্রতি সপ্তাহে রেশনসামগ্রী পাচ্ছেন। ক্যাম্পের বাইরে এসে কাজ করলে স্থানীয়দের শ্রমবাজারের জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রোহিঙ্গারা সেটা মানছেন না।

ক্যাম্পে কাজ করা একটি এনজিও’র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে সীমানায় ঘেরা দিয়ে তার কেটে একাধিক পথ করে তারা বনজঙ্গলসহ বিভিন্ন চোরাপথ দিয়ে সহজে বের হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে। হাতেগোনা কিছু দালালের প্ররোচনায় সাগর পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও অধিকাংশ রোহিঙ্গা বিভিন্ন গ্রামে বসবাস গড়ে তুলছে। সেখানে রোহিঙ্গা মেয়েরা প্রথমে কিছুদিন স্থানীয়দের ভাষা রপ্ত করে বসবাস শুরু করে। পরে আচার-আচরণ সবকিছু স্থানীয়দের মতো শিখে ফেলে। এরপর স্থানীয়দের সঙ্গে সখ্য গড়ে কাজের সন্ধানে নেমে পড়ে। অনেকে আবার পাসপোর্ট তৈরি করে উড়াল দেয় বিদেশে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী কয়েক মাস গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে থাকে। এর আগেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আসে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। সবমিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছে।

সর্বাত্মক চেষ্টা করেও গত ছয় বছরে সরকার একজন রোহিঙ্গাকেও নিজ দেশ মায়ানমারে ফেরাতে পারেনি। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বারংবার আশ্বাস দিলেও মায়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নানা টালবাহানা করছে। এই অবস্থায় লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। কক্সবাজারের জনজীবনে কিছুটা চাপ কমাতে এক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়ায় পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক। ক্যাম্পে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার পরও অনেক রোহিঙ্গা আরও সচ্ছল জীবনের আশায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে। এই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সবাই সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে এই সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করছি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের নভেম্বরে অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পার্সন্স ফ্রম রাখাইন স্টেট নামে বাংলাদেশ ও মায়ানমার একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ওই চুক্তির আওতায় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মায়ানমার। তবে চলতি মাসের মাঝামাঝিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা রয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

ছবি

আইভীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, ৬ ঘন্টার আভিযান, এলাকাবাসীর বাধা

ছবি

বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা বহাল থাকছে দুই মাস

‘উলবাকিয়া মশা’ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নতুন সম্ভাবনা: আইসিডিডিআর’বি

সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মৌন প্রতিবাদ সমাবেশ

বিএনপির সদস্য সংগ্রহ: যোগ দিতে পারে আ’লীগের ‘ক্লিন ইমেজের’ লোকও

ছবি

ববি’র ভিসির পদত্যাগ দাবি : শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন শিক্ষকরাও

ছবি

আবদুল হামিদের দেশত্যাগ: পুলিশ সুপার প্রত্যাহার, তদন্ত কমিটি গঠন

ছবি

বিচার কার্যক্রম ত্বরান্বেতে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২

ছবি

মুন্সীগঞ্জের নিমতলায় ৫ জনসহ পাঁচ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১১

রমনা বটমূলে বোমা হামলা: হাইকোর্টের রায়ের পরবর্তী অংশ ঘোষণা ১৩ মে

এবার টিউলিপকে দুদকে তলব

ছাত্রদের বাদ দিয়ে ‘দ্বি-দলীয় বন্দোবস্তে’ ফিরতে ‘এস্টাবলিশমেন্ট অপেক্ষমাণ’: তথ্য উপদেষ্টা

চট্টগ্রাম বন্দরে ৮০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে নেদারল্যান্ড: বিডা চেয়ারম্যান

প্রতিদিন নতুন নতুন সংস্কারের লিস্ট, সব জটিল হয়ে যাচ্ছে: মির্জা ফখরুল

ছবি

ভারত-পাকিস্তান: পাল্টাপাল্টি হামলা অব্যাহত, বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা

ছবি

সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারলে পদত্যাগ করবেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

পাকিস্তানে ভারতের হামলা দুঃখজনক: চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন

ছবি

ছাত্রদের বাদ দিয়ে দ্বিদলীয় বন্দোবস্তে ফিরতে চায় এস্টাবলিশমেন্ট: মাহফুজ আলম

চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

ছবি

রমনা বটমূলে বোমা হামলা: হাইকোর্টে রায় পড়া শুরু

খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা, সবাইকে ধন্যবাদ তারেক রহমানের

হত্যার তিন মাস পর কারামুক্ত হই, আদালতকে লিটন

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর নির্দেশ

সাবেক আইজিপি শহীদুল ও দুইজনকে দ্বিতীয় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি

মিথ্যা মামলা: আসামি খালাস, বাদীর সাজা

ছবি

বিশ্বকবির ১৬৪তম জন্মবার্ষিকী বৃহস্পতিবার

ছবি

দেশে প্রথম জলাভূমিনির্ভর প্রাণীদের দু’টি অভয়ারণ্য ঘোষণা

ছবি

ঘোড়াঘাটে পানির দরে আলু বিক্রি, পথে বসেছেন চাষিরা

ছবি

একযোগে বিআরটিএ’র ৩৫ কার্যালয়ে দুদকের অভিযান

ভারত যেভাবে লোকজনকে ঠেলে দিচ্ছে, তা ‘ঠিক নয়’: খলিলুর

ছবি

কুড়িগ্রামে ৩৬ রোহিঙ্গাসহ ৮ বাংলাদেশিকে পুশইন করেছে বিএসএফ

ছবি

শেখ হাসিনাকে দুদকে তলব

নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের প্রশ্ন

৬ হাজার কোটি টাকার হিসাব না দিয়েই ‘পালিয়েছেন’ সাবেক প্রকল্প পরিচালক : উপদেষ্টা

সালমান পরিবারের ৯৪ কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ

ঐকমত্যে পৌঁছাতে ছাড় দেবে নাগরিক ঐক্য

tab

জাতীয়

১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে সংকটে বাংলাদেশ

জসিম উদ্দিন সিদ্দিকী, কক্সবাজার

বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো দিনদিন অরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি আশ্রিত শিবিরে তদারকি কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা নানা কৌশল অবলম্বন করে ক্যাম্প থেকে পালানোর হিড়িক পড়েছে। কেউ দালালের মাধ্যমে, আবার কেউ ক্যাম্পের বাইরে অবস্থানরত পূর্বের আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।

রোহিঙ্গাদের আকৃতি, ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ স্থানীয়দের সঙ্গে অনেকটা মিল। যার কারণেই রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুরা সহজেই স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে পারছে। ক্যাম্প ছেড়ে তাদের পালানোর বিষয়টি এখন উদ্বেগজনক। অনেক রোহিঙ্গা গত ৬ বছরের মধ্যে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন আলোচিত সমালোচিত হত্যাকান্ড, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদকসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছেন।

এভাবে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়া ১১ লাখের বেশি মায়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক নিয়ে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। শত চেষ্টা করেও গত ছয় বছরে তাদের নিজ দেশে ফেরানো যায়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যত দেরি হচ্ছে ততই বাড়ছে ঝুঁকি।

সবশেষ গত মঙ্গলবার ২৮৯ জন রোহিঙ্গাকে উখিয়া-টেকনাফ মহাসড়ক থেকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উখিয়া ডিগ্রি কলেজ গেট সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এর আগে গত সোমবার ৫৫ জন, গত রোববার ২৯ জন এবং শনিবার ২৯ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের নিজ নিজ ক্যাম্প প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে আসা ঠেকাতে পুলিশ কঠোর নজরদারি শুরু করেছে। অনেকে ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ক্যাম্পের নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে আসে। এটা ঠেকাতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে পুলিশ বিশেষ অভিযান শুরু করেছে।

ওসি বলেন, আটক রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে আসার বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়েছে। কেউ আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে, কেউ কাজের সন্ধানে, কেউ চিকিৎসার জন্য, কেউ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বের হয়েছে বলে পুলিশকে জানিয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তাদের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান ওসি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের নিজ নিজ রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে জানান তিনি।

এদিকে রোহিঙ্গাদের এভাবে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে পড়ায় উদ্বেগ বাড়ছে স্থানীয়দের মধ্যে। কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, আমরাই এখন আতঙ্কে থাকি। রোহিঙ্গারা আসার পর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত। এলাকার অনেক মানুষকে তারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে বিষয়টি জানিয়েছি। আপাতত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি।

জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী, বার্মাপাড়া, হালিমাপাড়া, ইসলামপুর, বাদশাঘোনা, খাজামঞ্জিল, বৈদ্যঘোনা, সমিতিপাড়াসহ জেলার বিভিন্ন পাহাড় অধ্যুষিত বহু এলাকায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা এসে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছে। তাদের চলাচলে কোন বাধা নেই।

শুধু তাই নয়, স্থানীয় অনেক ছেলে ক্যাম্পে এসে বিয়ে করছে। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে প্রতিদিন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের অনেকে কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বের হন। সন্ধ্যা বা রাতে কেউ ফেরেন, কেউ ফেরেন না। এভাবে পালিয়ে খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক রোহিঙ্গা। কম মজুরিতে পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের অনেকে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গৃহস্থালি এবং কৃষি, ইটভাটায় স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। আবার অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাইরে যেতে দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির নেতা মাহাবুবুর রহমান বলেন, ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করার কোন ধরনের বৈধতা নেই রোহিঙ্গাদের। কারণ, তারা প্রতি সপ্তাহে রেশনসামগ্রী পাচ্ছেন। ক্যাম্পের বাইরে এসে কাজ করলে স্থানীয়দের শ্রমবাজারের জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রোহিঙ্গারা সেটা মানছেন না।

ক্যাম্পে কাজ করা একটি এনজিও’র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে সীমানায় ঘেরা দিয়ে তার কেটে একাধিক পথ করে তারা বনজঙ্গলসহ বিভিন্ন চোরাপথ দিয়ে সহজে বের হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে। হাতেগোনা কিছু দালালের প্ররোচনায় সাগর পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও অধিকাংশ রোহিঙ্গা বিভিন্ন গ্রামে বসবাস গড়ে তুলছে। সেখানে রোহিঙ্গা মেয়েরা প্রথমে কিছুদিন স্থানীয়দের ভাষা রপ্ত করে বসবাস শুরু করে। পরে আচার-আচরণ সবকিছু স্থানীয়দের মতো শিখে ফেলে। এরপর স্থানীয়দের সঙ্গে সখ্য গড়ে কাজের সন্ধানে নেমে পড়ে। অনেকে আবার পাসপোর্ট তৈরি করে উড়াল দেয় বিদেশে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী কয়েক মাস গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে থাকে। এর আগেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আসে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। সবমিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছে।

সর্বাত্মক চেষ্টা করেও গত ছয় বছরে সরকার একজন রোহিঙ্গাকেও নিজ দেশ মায়ানমারে ফেরাতে পারেনি। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বারংবার আশ্বাস দিলেও মায়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নানা টালবাহানা করছে। এই অবস্থায় লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। কক্সবাজারের জনজীবনে কিছুটা চাপ কমাতে এক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়ায় পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক। ক্যাম্পে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার পরও অনেক রোহিঙ্গা আরও সচ্ছল জীবনের আশায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে। এই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সবাই সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে এই সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করছি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের নভেম্বরে অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পার্সন্স ফ্রম রাখাইন স্টেট নামে বাংলাদেশ ও মায়ানমার একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ওই চুক্তির আওতায় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মায়ানমার। তবে চলতি মাসের মাঝামাঝিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা রয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

back to top