তিনি সরকারি চাকরি করেছেন। ব্যাংকারও ছিলেন। নানা ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। রাজনীতি করেছেন। একাধিক বামপন্থি দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। নতুন দলও করেছেন। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। এই সংবাদ পত্রিকা তারই তৈরি করা। তাই তিনি ‘সংবাদ’-এর আহমদুল কবির। আজ (৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) তার শততম জন্মবার্ষিকী।
আহমদুল কবিরের মৃত্যুর পর প্রখ্যাত সাংবাদিক, অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার এক সময়কার সম্পাদক প্রয়াত ওবায়েদ উল হক লিখেছিলেন, “ ‘সংবাদ’ ছিল তার গর্ব, তার গৌরব। ‘সংবাদ’-এর প্রধান সম্পাদক এই ছিল তার শ্রেষ্ঠ ও শেষ পরিচয়।’
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে পাকিস্তানি আমলের প্রথমভাগে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার মানদ- তৈরি করেছেন যে কয়েকজন ক্ষণজন্মা সাংবাদিক তাদেরই একজন ছিলেন প্রয়াত আহমদুল কবির। সাংবাদিকতা এবং ব্যবস্থাপনার আধুনিক ধারা যেসব মানুষের পরিকল্পনা এবং শ্রমে বর্ধিত হয়েছে আহমদুল কবির ছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি ‘সংবাদ’-এ সাংবাদিকতা এবং সংবাদপত্র প্রকাশনার যে নতুন পথ তৈরি করেছেন তা ছিল বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ। তারপর কয়েক যুগে বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা অনেক এগিয়েছে, বিকশিত হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে আহমদুল কবির সংবাদ পত্রিকাকে যেভাবে সাংবাদিকতার নতুন পথে যাত্রা শুরু করিয়েছেন সেই পথ এখনও ক্ষেত্রবিশেষে কিছু বিন্যাস ঘটিয়ে চলমান রয়েছে।
চরম প্রতিকূল রাজনৈতিক আবহে ‘সংবাদ’ পত্রিকা তৈরিতে প্রগতিশীলতা ও আধুনিকতার একটি নতুন ধারা প্রবর্তনে তার অবদান অনেকটা পথিকৃতের মতো। ‘সংবাদ’ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার দৈনিক পত্রিকা। তবে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র নিয়ে। সে অবস্থা থেকে আহমদুল কবির ‘সংবাদ’কে তুলে এনেছেন, নবজীবন দিয়েছেন আদর্শের সত্যনিষ্ঠ পথচলায়।
‘সংবাদ‘-এর আবির্ভাব ঘটে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের মুখপত্র হিসেবে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের সাড়া জাগানো বিজয় ও মুসলিম লীগের ভরাডুবির পর ৫৪ সালে আহমদুল কবির ‘সংবাদ’-এর মালিকানা কিনে নেন।
ওবায়েদ উল হকের ভাষায়- ‘অন্য কোন মূল্যবান অর্থকরী প্রতিষ্ঠান নয়, কিনলেন একটি সংবাদপত্র। কেন? গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ সংবাদপত্র। জনস্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী সংবাদপত্র। সেই সংবাদপত্রই তিনি কিনলেন। বোধগম্য কারণেই। জনগণের সঙ্গে তার নাড়ির যোগ অবিচ্ছেদ্য। জনকল্যাণমূলক কোন কাজে সাংবাদিকতার ভূমিকার গুরুত্ব সঠিক অনুধাবন করেই তিনি তা করেছিলেন।’
ওবায়েদ উল হক আরও বলছেন, “আহমদুল কবিরের মালিকানা ও সম্পাদনায় ‘সংবাদ’ অল্পদিনের মধ্যেই একটি আধুনিক, উদার, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। একদা মুসলিম লীগ সরকারের মুখপত্র ‘সংবাদ’ আজ বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী, নির্ভীক, গণতন্ত্রের মুখপত্র জাতীয় দৈনিক।”
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সরকার ‘সংবাদ’ অফিস পুড়িয়ে দেয় এবং আহমদুল কবিরকে গ্রেপ্তার করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ‘সংবাদ’ পত্রিকা প্রকাশের জন্য অনেক প্রলোভন দেখায়; কিন্তু আহমদুল কবির পত্রিকা প্রকাশ করেননি। স্বাধীনতার পরপরই তিনি জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন এবং ‘সংবাদ’ পুনঃপ্রকাশ করেন।
‘সংবাদ’-এর প্রগতিশীল রূপান্তর নিয়ে ওবায়েদ উল হক লিখেছেন, ‘এই বিস্ময়কর রূপান্তরের ইতিহাসও বেশ বেদনাদায়ক। বিজ্ঞাপন বন্ধ, কালো তালিকাভুক্তি ও প্রকাশনা নিষিদ্ধ ইত্যাদি নিবর্তনমূলক পদক্ষেপের পরও মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাক হানাদার বাহিনী-এর কার্যালয় পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তাকে (আহমদুল কবির) কারারুদ্ধও করা হয়, কিন্তু তিনি আপোষ করেননি। কোন নির্যাতনই আহমদুল কবিরকে তার গণতান্ত্রিক বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। অসীম মনোবলের অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি দৈহিক নির্যাতন ও আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেও নীতিতে অটল থাকতে পেরেছিলেন।’
আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর প্রয়াত খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের ভাষায়- ‘সাংবাদিক মহলে শুনেছি সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক হয়েও তিনি ছিলেন সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পক্ষে। তিনি তার নিজ পত্রিকার সাংবাদিকদেরও পেশাগত দায়িত্ব পালনে কখনোও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন না। মতপার্থক্যের কারণে কারও প্রতি বিরূপ আচরণ করতেন না। পেশাগত কাজকর্মে এথিকস মেনে চলতেন তিনি। জমিদার নন্দন হয়েও সংবাদ পত্রিকায় একঝাঁক বামপন্থি প্রগতিশীল স্বচ্ছ চিন্তার সাংবাদিককে পরিপালন করে তিনি এক দরদি মনের পরিচয় রেখেছেন আহমদুল কবির।’
সাংবাদিকতার পাশাপাশি আহমদুল কবির ছিলেন প্রতিভাদীপ্ত আদর্শবাদী রাজনীতিক। মূলত তার রাজনৈতিক দর্শন ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করা। তদানীন্তন পাকিস্তানের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল যে ধারা এ দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপুল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চেতনাকে নাড়া দিয়েছিল, সেই ধারার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন আহমদুল কবির। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজনীতির নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন আহমদুল কবির।
আহমদুল কবির দেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তাও ছিলেন। এ দেশের শিল্প-বাণিজ্য প্রসারে তার সক্রিয় অবদান রয়েছে। তবে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলছেন, ‘ব্যবসায়ী চরিত্রে তিনি ছিলেন বেশ দুর্বল। তার দরদি আভিজাত্যই ব্যবসায়িক সাফল্যের অন্তরায় ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য যে পেশাগত স্বার্থপরতার প্রয়োজন তা তিনি প্রদর্শন করতে পারেননি। স্বার্থপরতা যেন তার চরিত্রের পরিপন্থী। তাই সর্বপ্রকার অনুকূল পরিবেশেও যে ধরনের বিরাট সাফল্য অর্জন করা সম্ভব ছিল তা হয়ে ওঠেনি।’
১৯২৩ সালের এই দিনে নরসিংদীর ঘোড়াশালে মিয়া বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা মরহুম আবু ইউসুফ লুৎফুল কবির ছিলেন ঘোড়াশালের জমিদার। মায়ের নাম মরহুমা সুফিয়া খাতুন। ২০০৩ সালের ২৪ নভেম্বর কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহমদুল কবির মারা যান।
আহমদুল কবির তদানীন্তন পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি কৃষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। আশির দশকে তার নেতৃত্বে গণতন্ত্রী পার্টি গঠিত হয় এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৪৫-৪৬ সালে ডাকসুর প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া ১৯৪২-৪৩ সালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে নরসিংদী-২ (পলাশ-শিবপুর) নির্বাচনী এলাকা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে নরসিংদী-২ (পলাশ) নির্বাচনী এলাকা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। আহমদুল কবির অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করার পর রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ায় যোগদান করেন এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালে তিনি পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি নিজের ব্যবসায় যোগদান করেন।
কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতির পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি।
আহমদুল কবির ১৯৫৪ সালে ‘সংবাদ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে প্রধান সম্পাদক হন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আহমদুল কবির স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে ও অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও রাজনৈতিক অনুসারী রেখে গেছেন। প্রয়াত আহমদুল কবিরের স্ত্রী লায়লা রহমান কবির দেশের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তার বড় ছেলে আলতামাশ কবির ‘সংবাদ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সম্পাদক, দ্বিতীয় ছেলে আরদাশির কবির দেশের বিশিষ্ট চা ব্যবসায়ী এবং একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার নিহাদ কবির সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত।
শততম জন্মবার্ষিকীর কর্মসূচি
আহমদুল কবিরের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সকাল ১০টা জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া তার গ্রামের বাড়ি ঘোড়াশালে মিয়াবাড়িতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে; সকালে কোরআন খতম, সকাল ১০টায় তার কবরে পুস্পস্তবক অর্পণ, সাড়ে ১০টায় আলোচনা সভা, ১১টায় গরিবদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ, বাদ জুমা মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং বাদ আসর কেক কাটা অনুষ্ঠান।
শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
তিনি সরকারি চাকরি করেছেন। ব্যাংকারও ছিলেন। নানা ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। রাজনীতি করেছেন। একাধিক বামপন্থি দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। নতুন দলও করেছেন। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। এই সংবাদ পত্রিকা তারই তৈরি করা। তাই তিনি ‘সংবাদ’-এর আহমদুল কবির। আজ (৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) তার শততম জন্মবার্ষিকী।
আহমদুল কবিরের মৃত্যুর পর প্রখ্যাত সাংবাদিক, অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার এক সময়কার সম্পাদক প্রয়াত ওবায়েদ উল হক লিখেছিলেন, “ ‘সংবাদ’ ছিল তার গর্ব, তার গৌরব। ‘সংবাদ’-এর প্রধান সম্পাদক এই ছিল তার শ্রেষ্ঠ ও শেষ পরিচয়।’
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে পাকিস্তানি আমলের প্রথমভাগে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার মানদ- তৈরি করেছেন যে কয়েকজন ক্ষণজন্মা সাংবাদিক তাদেরই একজন ছিলেন প্রয়াত আহমদুল কবির। সাংবাদিকতা এবং ব্যবস্থাপনার আধুনিক ধারা যেসব মানুষের পরিকল্পনা এবং শ্রমে বর্ধিত হয়েছে আহমদুল কবির ছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি ‘সংবাদ’-এ সাংবাদিকতা এবং সংবাদপত্র প্রকাশনার যে নতুন পথ তৈরি করেছেন তা ছিল বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ। তারপর কয়েক যুগে বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা অনেক এগিয়েছে, বিকশিত হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে আহমদুল কবির সংবাদ পত্রিকাকে যেভাবে সাংবাদিকতার নতুন পথে যাত্রা শুরু করিয়েছেন সেই পথ এখনও ক্ষেত্রবিশেষে কিছু বিন্যাস ঘটিয়ে চলমান রয়েছে।
চরম প্রতিকূল রাজনৈতিক আবহে ‘সংবাদ’ পত্রিকা তৈরিতে প্রগতিশীলতা ও আধুনিকতার একটি নতুন ধারা প্রবর্তনে তার অবদান অনেকটা পথিকৃতের মতো। ‘সংবাদ’ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার দৈনিক পত্রিকা। তবে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র নিয়ে। সে অবস্থা থেকে আহমদুল কবির ‘সংবাদ’কে তুলে এনেছেন, নবজীবন দিয়েছেন আদর্শের সত্যনিষ্ঠ পথচলায়।
‘সংবাদ‘-এর আবির্ভাব ঘটে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের মুখপত্র হিসেবে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের সাড়া জাগানো বিজয় ও মুসলিম লীগের ভরাডুবির পর ৫৪ সালে আহমদুল কবির ‘সংবাদ’-এর মালিকানা কিনে নেন।
ওবায়েদ উল হকের ভাষায়- ‘অন্য কোন মূল্যবান অর্থকরী প্রতিষ্ঠান নয়, কিনলেন একটি সংবাদপত্র। কেন? গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ সংবাদপত্র। জনস্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী সংবাদপত্র। সেই সংবাদপত্রই তিনি কিনলেন। বোধগম্য কারণেই। জনগণের সঙ্গে তার নাড়ির যোগ অবিচ্ছেদ্য। জনকল্যাণমূলক কোন কাজে সাংবাদিকতার ভূমিকার গুরুত্ব সঠিক অনুধাবন করেই তিনি তা করেছিলেন।’
ওবায়েদ উল হক আরও বলছেন, “আহমদুল কবিরের মালিকানা ও সম্পাদনায় ‘সংবাদ’ অল্পদিনের মধ্যেই একটি আধুনিক, উদার, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। একদা মুসলিম লীগ সরকারের মুখপত্র ‘সংবাদ’ আজ বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী, নির্ভীক, গণতন্ত্রের মুখপত্র জাতীয় দৈনিক।”
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সরকার ‘সংবাদ’ অফিস পুড়িয়ে দেয় এবং আহমদুল কবিরকে গ্রেপ্তার করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ‘সংবাদ’ পত্রিকা প্রকাশের জন্য অনেক প্রলোভন দেখায়; কিন্তু আহমদুল কবির পত্রিকা প্রকাশ করেননি। স্বাধীনতার পরপরই তিনি জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন এবং ‘সংবাদ’ পুনঃপ্রকাশ করেন।
‘সংবাদ’-এর প্রগতিশীল রূপান্তর নিয়ে ওবায়েদ উল হক লিখেছেন, ‘এই বিস্ময়কর রূপান্তরের ইতিহাসও বেশ বেদনাদায়ক। বিজ্ঞাপন বন্ধ, কালো তালিকাভুক্তি ও প্রকাশনা নিষিদ্ধ ইত্যাদি নিবর্তনমূলক পদক্ষেপের পরও মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাক হানাদার বাহিনী-এর কার্যালয় পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তাকে (আহমদুল কবির) কারারুদ্ধও করা হয়, কিন্তু তিনি আপোষ করেননি। কোন নির্যাতনই আহমদুল কবিরকে তার গণতান্ত্রিক বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। অসীম মনোবলের অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি দৈহিক নির্যাতন ও আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেও নীতিতে অটল থাকতে পেরেছিলেন।’
আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর প্রয়াত খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের ভাষায়- ‘সাংবাদিক মহলে শুনেছি সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক হয়েও তিনি ছিলেন সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পক্ষে। তিনি তার নিজ পত্রিকার সাংবাদিকদেরও পেশাগত দায়িত্ব পালনে কখনোও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন না। মতপার্থক্যের কারণে কারও প্রতি বিরূপ আচরণ করতেন না। পেশাগত কাজকর্মে এথিকস মেনে চলতেন তিনি। জমিদার নন্দন হয়েও সংবাদ পত্রিকায় একঝাঁক বামপন্থি প্রগতিশীল স্বচ্ছ চিন্তার সাংবাদিককে পরিপালন করে তিনি এক দরদি মনের পরিচয় রেখেছেন আহমদুল কবির।’
সাংবাদিকতার পাশাপাশি আহমদুল কবির ছিলেন প্রতিভাদীপ্ত আদর্শবাদী রাজনীতিক। মূলত তার রাজনৈতিক দর্শন ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করা। তদানীন্তন পাকিস্তানের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল যে ধারা এ দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপুল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চেতনাকে নাড়া দিয়েছিল, সেই ধারার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন আহমদুল কবির। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজনীতির নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন আহমদুল কবির।
আহমদুল কবির দেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তাও ছিলেন। এ দেশের শিল্প-বাণিজ্য প্রসারে তার সক্রিয় অবদান রয়েছে। তবে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলছেন, ‘ব্যবসায়ী চরিত্রে তিনি ছিলেন বেশ দুর্বল। তার দরদি আভিজাত্যই ব্যবসায়িক সাফল্যের অন্তরায় ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য যে পেশাগত স্বার্থপরতার প্রয়োজন তা তিনি প্রদর্শন করতে পারেননি। স্বার্থপরতা যেন তার চরিত্রের পরিপন্থী। তাই সর্বপ্রকার অনুকূল পরিবেশেও যে ধরনের বিরাট সাফল্য অর্জন করা সম্ভব ছিল তা হয়ে ওঠেনি।’
১৯২৩ সালের এই দিনে নরসিংদীর ঘোড়াশালে মিয়া বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা মরহুম আবু ইউসুফ লুৎফুল কবির ছিলেন ঘোড়াশালের জমিদার। মায়ের নাম মরহুমা সুফিয়া খাতুন। ২০০৩ সালের ২৪ নভেম্বর কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহমদুল কবির মারা যান।
আহমদুল কবির তদানীন্তন পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি কৃষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। আশির দশকে তার নেতৃত্বে গণতন্ত্রী পার্টি গঠিত হয় এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৪৫-৪৬ সালে ডাকসুর প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া ১৯৪২-৪৩ সালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে নরসিংদী-২ (পলাশ-শিবপুর) নির্বাচনী এলাকা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে নরসিংদী-২ (পলাশ) নির্বাচনী এলাকা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। আহমদুল কবির অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করার পর রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ায় যোগদান করেন এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালে তিনি পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি নিজের ব্যবসায় যোগদান করেন।
কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতির পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি।
আহমদুল কবির ১৯৫৪ সালে ‘সংবাদ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে প্রধান সম্পাদক হন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আহমদুল কবির স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে ও অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও রাজনৈতিক অনুসারী রেখে গেছেন। প্রয়াত আহমদুল কবিরের স্ত্রী লায়লা রহমান কবির দেশের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তার বড় ছেলে আলতামাশ কবির ‘সংবাদ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সম্পাদক, দ্বিতীয় ছেলে আরদাশির কবির দেশের বিশিষ্ট চা ব্যবসায়ী এবং একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার নিহাদ কবির সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত।
শততম জন্মবার্ষিকীর কর্মসূচি
আহমদুল কবিরের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সকাল ১০টা জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া তার গ্রামের বাড়ি ঘোড়াশালে মিয়াবাড়িতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে; সকালে কোরআন খতম, সকাল ১০টায় তার কবরে পুস্পস্তবক অর্পণ, সাড়ে ১০টায় আলোচনা সভা, ১১টায় গরিবদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ, বাদ জুমা মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং বাদ আসর কেক কাটা অনুষ্ঠান।