মফিদুল হক
আহমদুল কবিরের জন্মশতবর্ষে মনে পড়ে তার দীর্ঘ জীবন পরিক্রমণ, যৌবনের শুরু থেকে উদার অসাম্প্রদায়িক আধুনিক ভাবনায় তিনি যে আলোড়িত হয়েছিলেন, জীবনভর সেই পরিচ্ছন্ন ও প্রগতিবাদী চেতনা তিনি বহন করেছেন এবং সমাজবিকাশে তার মতো করে অবদান রচনা করেছেন। আমরা তাকে দেখেছি ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে, যখন পাকিস্তানি তমসা ভেদ করে বাঙালির জাতীয় মুক্তি আকাক্সক্ষা নানাভাবে পল্লবিত হচ্ছিল। তিনি ‘সংবাদ’-এর হাল ধরা নাবিক, সচেতন কাণ্ডারির মতোই হিন্দু না ওরা মুসলিম, সেই প্রশ্নের পরোয়া না করে মায়ের সন্তানদের রক্ষায় অকুতোভয় ও দৃঢ়চেতা। ১৯৬৪ সালে কাশ্মিরে হযরতবাল মসজিদে রক্ষিত নবীজীর কেশ হারিয়ে যাওয়া নিয়ে পাক-ভারতজুড়ে যে দাঙ্গার সূত্রপাত, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রুখে দাঁড়ানোতে সংবাদ এবং তার ও সংবাদকর্মী শহিদুল্লাহ কায়সার, জহুর হোসেন চৌধুরীসহ সবার যে ভূমিকা সেটা জানতে বুঝতে পারলে আজও আমরা প্রেরণা খুঁজে পেতে পারি। আহমদুল কবির স্বল্পবাক মানুষ, পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী, বসনে-বচনে-আচারে আভিজাত্যের ছোঁয়া, অথচ মননে চৈতন্যে তিনি বামপন্থায় সমর্পিত। আমরা তখন ছাত্র আন্দোলনে শরিক, আমাদের কাছে তিনি দূরের মানুষ হয়তো, কিন্তু সমীহ ও সম্ভ্রম আদায় করে নেন অনায়াসে। অগ্রজ মতিউর রহমান, আবুল হাসনাতের সঙ্গে আড্ডায় আলাপে তার প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে। দীর্ঘদেহী সুপুরুষ, মাথার ঝাকড়া চুল একপাশে হেলানো, পোশাকে পরিপাটি, কথনে রুচিবান, সবকিছু তাকে নায়কোচিত করে তুলেছিল। সেই সময় ঢাকায় আয়োজিত বুলগেরীয় চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত এক ছবির কথা মনে পড়ে, নায়িকা কাজ করছে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে, পূর্বতন প্রেমিক নায়কের সঙ্গে সেখানে তার আকস্মিক দেখা, তার চেহারার সঙ্গে আমরা খুঁজে পাই আহমেদুল কবীরের মিল। আরও অভিভূত হই যখন দেখি কৃষক আন্দোলনের প্রতি এই মানুষটির দরদ ও পৃষ্ঠপোষকতা।
তারপর তো বিপুল মূল্যের বিনিময়ে দেশ অর্জন করে স্বাধীনতা, অনেক আনন্দের সঙ্গে মিশে থাকে অব্যক্ত বেদনা, শহিদুল্লাহ কায়সারের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড তাকে কতখানি ব্যথিত করেছিল তা আমাদের জানা হয় না, তবে সংবাদের দায়িত্ব তিনি আরও নিবিড়ভাবে গ্রহণ করেন। বাণিজ্যিকভাবে হয়তো সফল নয় পত্রিকা, তবে সংবাদপত্রের সামাজিক-ঐতিহাসিক দায়মোচনে সংবাদ বহন করে চলে অপার সম্পদবান এক ধারা, যার উৎস বাঙালি জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনসমূহ, যেখান থেকে উঠে এসেছেন আহমেদুল কবীর।
আহমদুল কবির নিজের কথা বিশেষ লেখেননি, অন্যদের লেখায় বিচ্ছুরণের মতো কিছু তথ্য মেলে, তাতে কলকাতার যৌবনের আহমেদুল কবীরকে কিছুটা চেনা যায়। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, নাজমুদ্দিন হাশেম প্রমুখ, জহুর হোসেন চৌধুরী কিংবা শহিদুল্লাহ কায়সার তো সেই সময়ে কলকাতাবাসী, আরও আছেন কেউ কেউ, শেখ মুজিবুর রহমানও তখন মহানগরীতে রাজনীতিতে দীক্ষা নিচ্ছেন। অন্যদিকে সমাজ ভাগ হয়ে যাচ্ছে হিন্দুত্ব ও মুসলমানিত্বে। সেই সময় অন্তরে প্রজ্ঞা ও অঙ্গীকার নিয়ে তার ও সহযাত্রীদের যে অভিযাত্রা, সেটাই সম্ভব করেছে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তৎপরবর্তী লড়াই ও বিকাশ। অনেকের অবদানে ভাস্বর যে জাতীয় মুক্তির স্পৃহা ও সংগ্রাম, আহমেদুল কবীর বাংলার চিদাকাশের সেই তারকামণ্ডলীর অন্যতম ও ব্যতিক্রমী এক নক্ষত্র, উজ্জ্বল ও স্বতন্ত্র। জন্মশতবর্ষে তাকে জানাই ইতিহাসের ও বঙ্গীয় সমাজের স্বীকৃতি ও অভিবাদন, জাতির যা-কিছু সুকৃতি ও সঞ্চয়, সেখানে জমা রয়েছে তার অবদান।
মফিদুল হক
শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
আহমদুল কবিরের জন্মশতবর্ষে মনে পড়ে তার দীর্ঘ জীবন পরিক্রমণ, যৌবনের শুরু থেকে উদার অসাম্প্রদায়িক আধুনিক ভাবনায় তিনি যে আলোড়িত হয়েছিলেন, জীবনভর সেই পরিচ্ছন্ন ও প্রগতিবাদী চেতনা তিনি বহন করেছেন এবং সমাজবিকাশে তার মতো করে অবদান রচনা করেছেন। আমরা তাকে দেখেছি ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে, যখন পাকিস্তানি তমসা ভেদ করে বাঙালির জাতীয় মুক্তি আকাক্সক্ষা নানাভাবে পল্লবিত হচ্ছিল। তিনি ‘সংবাদ’-এর হাল ধরা নাবিক, সচেতন কাণ্ডারির মতোই হিন্দু না ওরা মুসলিম, সেই প্রশ্নের পরোয়া না করে মায়ের সন্তানদের রক্ষায় অকুতোভয় ও দৃঢ়চেতা। ১৯৬৪ সালে কাশ্মিরে হযরতবাল মসজিদে রক্ষিত নবীজীর কেশ হারিয়ে যাওয়া নিয়ে পাক-ভারতজুড়ে যে দাঙ্গার সূত্রপাত, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রুখে দাঁড়ানোতে সংবাদ এবং তার ও সংবাদকর্মী শহিদুল্লাহ কায়সার, জহুর হোসেন চৌধুরীসহ সবার যে ভূমিকা সেটা জানতে বুঝতে পারলে আজও আমরা প্রেরণা খুঁজে পেতে পারি। আহমদুল কবির স্বল্পবাক মানুষ, পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী, বসনে-বচনে-আচারে আভিজাত্যের ছোঁয়া, অথচ মননে চৈতন্যে তিনি বামপন্থায় সমর্পিত। আমরা তখন ছাত্র আন্দোলনে শরিক, আমাদের কাছে তিনি দূরের মানুষ হয়তো, কিন্তু সমীহ ও সম্ভ্রম আদায় করে নেন অনায়াসে। অগ্রজ মতিউর রহমান, আবুল হাসনাতের সঙ্গে আড্ডায় আলাপে তার প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে। দীর্ঘদেহী সুপুরুষ, মাথার ঝাকড়া চুল একপাশে হেলানো, পোশাকে পরিপাটি, কথনে রুচিবান, সবকিছু তাকে নায়কোচিত করে তুলেছিল। সেই সময় ঢাকায় আয়োজিত বুলগেরীয় চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত এক ছবির কথা মনে পড়ে, নায়িকা কাজ করছে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে, পূর্বতন প্রেমিক নায়কের সঙ্গে সেখানে তার আকস্মিক দেখা, তার চেহারার সঙ্গে আমরা খুঁজে পাই আহমেদুল কবীরের মিল। আরও অভিভূত হই যখন দেখি কৃষক আন্দোলনের প্রতি এই মানুষটির দরদ ও পৃষ্ঠপোষকতা।
তারপর তো বিপুল মূল্যের বিনিময়ে দেশ অর্জন করে স্বাধীনতা, অনেক আনন্দের সঙ্গে মিশে থাকে অব্যক্ত বেদনা, শহিদুল্লাহ কায়সারের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড তাকে কতখানি ব্যথিত করেছিল তা আমাদের জানা হয় না, তবে সংবাদের দায়িত্ব তিনি আরও নিবিড়ভাবে গ্রহণ করেন। বাণিজ্যিকভাবে হয়তো সফল নয় পত্রিকা, তবে সংবাদপত্রের সামাজিক-ঐতিহাসিক দায়মোচনে সংবাদ বহন করে চলে অপার সম্পদবান এক ধারা, যার উৎস বাঙালি জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনসমূহ, যেখান থেকে উঠে এসেছেন আহমেদুল কবীর।
আহমদুল কবির নিজের কথা বিশেষ লেখেননি, অন্যদের লেখায় বিচ্ছুরণের মতো কিছু তথ্য মেলে, তাতে কলকাতার যৌবনের আহমেদুল কবীরকে কিছুটা চেনা যায়। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, নাজমুদ্দিন হাশেম প্রমুখ, জহুর হোসেন চৌধুরী কিংবা শহিদুল্লাহ কায়সার তো সেই সময়ে কলকাতাবাসী, আরও আছেন কেউ কেউ, শেখ মুজিবুর রহমানও তখন মহানগরীতে রাজনীতিতে দীক্ষা নিচ্ছেন। অন্যদিকে সমাজ ভাগ হয়ে যাচ্ছে হিন্দুত্ব ও মুসলমানিত্বে। সেই সময় অন্তরে প্রজ্ঞা ও অঙ্গীকার নিয়ে তার ও সহযাত্রীদের যে অভিযাত্রা, সেটাই সম্ভব করেছে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তৎপরবর্তী লড়াই ও বিকাশ। অনেকের অবদানে ভাস্বর যে জাতীয় মুক্তির স্পৃহা ও সংগ্রাম, আহমেদুল কবীর বাংলার চিদাকাশের সেই তারকামণ্ডলীর অন্যতম ও ব্যতিক্রমী এক নক্ষত্র, উজ্জ্বল ও স্বতন্ত্র। জন্মশতবর্ষে তাকে জানাই ইতিহাসের ও বঙ্গীয় সমাজের স্বীকৃতি ও অভিবাদন, জাতির যা-কিছু সুকৃতি ও সঞ্চয়, সেখানে জমা রয়েছে তার অবদান।