alt

জাতীয়

আগুনের পর জানা যায় নানা অনিয়ম

মাসুদ রানা : রোববার, ০৩ মার্চ ২০২৪

ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের বিভিন্ন ভবনে অসংখ্য রেস্তোরাঁ, যাকে অনেকেই বলছেন মৃত্যুকূপ। এই ভবনগুলোতে এসব রেস্তোরাঁ নিয়ম মেনে হয়েছে কিনা তা কেউ জানে না-সংবাদ

নিমতলী বা চুড়িহাট্টার আগুনে শতাধিক মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, সেখানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রাসায়নিকের মজুদ প্রাণ কেড়েছে। রাজধানীর বনানীতে এফ আর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৭ জনের মৃত্যুর পরেই প্রকাশ্যে আসে ভবনের নানা গুরুতর অনিয়মের কথা। কর্তৃপক্ষ ‘জাগ্রত হয়ে’ জানায় নকশা বহির্ভূত অতিরিক্ত তলাসহ নিরাপত্তার ঘাটতির কথা।

এভাবে প্রতি বছরই আগুনে মানুষ হতাহত হওয়ার পর জানা যায় ভবনের অনুমোদন সংক্রান্ত নানা অনিয়মের কথা। প্রতিবারই প্রশ্ন উঠে, মানুষ মরলেই কেন কর্তৃপক্ষের ‘ঘুম ভাঙে’, স্বাভাবিক সময়ে এত বড় বড় ভবনে দৃশ্যমান অনিয়মগুলো কেনো চোখে পড়ে না? ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁওসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এক ভবনে অনেকগুলো রেস্তোরাঁ খুলে বসা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। ধানমন্ডির একটি ভবনের স্থপতি তার নকশা করা ভবনটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলছেন, কারণ সেটি জুড়ে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো রেস্তোরাঁ, যেখানে অগ্নিনিরাপত্তার বালাই নেই।

সাবেক মন্ত্রীর অসহায়ত্ব, অভিযোগ
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, ২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনা তদন্ত করে ৬২ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। সে সময় অননুমোদিত ১ হাজার ৩০০ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেগুলো ভাঙা সম্ভব হয়নি। নারায়ণগঞ্জে একটি ফুড ফ্যাক্টরিতে আগুনের ঘটনায় রোববার (৪ মার্চ) পর্যন্ত বিচার শুরু হয়নি। এসব ঘটনাকে একধরনের দায়মুক্তি উল্লেখ করে শ ম রেজাউল করিম এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারে প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান।

অগ্নিকাণ্ডে নিরীহ মানুষের প্রাণহানিতে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মামলা করা হয়। এসব মামলাও থেকে যাচ্ছে অবহেলায়ই। দীর্ঘদিনেও শেষ হয় না বিচার। বিচার শেষ না হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছেন অপরাধীরা। আর প্রকৃত অপরাধীরা থেকে যাচ্ছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। গত এক যুগে ঢাকায় অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড়োসড়ো অগ্নিদুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি যেমন হয়েছে, তেমনি স্বজন হারিয়ে পথে নেমেছে অনেক পরিবার।

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডে করা মামলাগুলোর মধ্যে এখনও কোনো মামলার রায় হয়নি। এসব মামলায় সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন না। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে মামলাগুলো দ্রুত শেষ করা।’

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, ‘ধানমন্ডির সাতমসজিদ এলাকায় একটা ভবনে ১৫টি রেস্টুরেন্ট। সেগুলোর কোনো অনুমতি নেই। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডের রাস্তার পাশে ভবনে কয়েকশত রেস্টুরেন্ট, কিন্তু সেগুলোর অনুমতি নেই। খিলগাঁওয়ের তালতলায় বহুতল ভবনে একই অবস্থা। আরও এ রকম ঘটনা ঘটবে। যদি সরকার এ বিষয়ে সচেতন না হয়, সরকারকে বলব, দায়দায়িত্ব নিয়ে এগুলোর জন্য কারা কারা দায়ী, সেটা রাজউক হোক, ফায়ার সার্ভিস হোক, পরিবেশ অধিদপ্তর হোক, তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হোক। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার ব্যবস্থা করা।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলছেন, ‘গ্রিন কোজি কটেজের মত একটা বাণিজ্যিক ভবন পরিচালনার জন্য সরকারের যে ৮টি সংস্থার অনুমোদন লাগে, এসব সংস্থার প্রত্যেকটিকেই এই অবহেলাজনিত হত্যার আসামি হওয়ার উচিত।’

তদারকি নেই, যথেচ্ছ ব্যবহার

গত বছরের ৭ মার্চ গুলিস্তানে ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণেও প্রাণ যায় ২৩ জনের। ওই ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেছিলেন, ‘ভবনটিতে কোনো সংস্কার হত না, পয়ঃনিস্কাশন নিয়মিত তদারকি হত না, পার্কিং এলাকায় গুদাম ভাড়া দেয়ার নিষেধ থাকার পরেও দেয়া হয়েছে, ব্যবসায়ীরা জেনেও নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সংস্থার তদারকিরও অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।’ সেই ঘটনার পরও তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে, সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয় নিয়ে কথা হয়েছে। জানানো হয়, সেই ভবন মালিককে নোটিসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ আর কিছুই করা হয়নি। বেইলি রোডের এই ভবনটিতে এতগুলো রেস্তোরাঁ বসানোর বৈধতা ছিল না, ফায়ার সার্ভিস তাদেরকে নোটিসও দিয়েছিল, কিন্তু আর কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।

বেইলি রোডের ওই ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, ‘ভবনটিতে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। আমরা দু-একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখেছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা একটি মাত্র সিঁড়ি, একটাই পথ।’ তিনি জানান, যে কক্ষে মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে কোনো ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই, একটি জানলাও নেই। প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে খাবারে দোকান, গ্যাস সিলিন্ডারগুলো রাখা ছিল অপরিকল্পিতভাবে।

গত বৃহস্পতিবার রাতের অগ্নিকাণ্ডের পর প্রকাশ পায় বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে রেস্টুরেন্ট বসানোর অনুমোদনই ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলছেন, ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভবন কর্তৃপক্ষকে তারা একাধিকবার নোটিস দিয়েছিলেন। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিনা তা জানাননি তিনি।

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সাবেক উপপরিচালক সেলিম নেওয়াজ ভুঁইয়া এখন অগ্নি নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আইনগতভাবে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে ফায়ার সার্ভিস একটা নোটিস দেবে। তা না মানলে সেই ভবন ব্যবহারযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করতে হবে।’

বারবার নোটিস দেয়ার বিধান কোনো আইনে আছে সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আইনে বলা আছে তারা যদি সেইফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন না করে আপনি তখন অ্যাকশনে যাবেন। আপনার (ফায়ার সার্ভিসের) মামলা করার এখতিয়ার না থাকলে সিটি করপোরেশন বা জেলা প্রশাসনসহ যেসব কর্তৃপক্ষ মামলা করতে পারে আপনি তাদেরকে চিঠি দিয়ে জানান।’

ভবনের অনিয়ম দেখার কর্তৃপক্ষ আসলে কার?

প্রথমত, যে কোনো ভবনের নকশা অনুমোদন দেয়ার এখতিয়ার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের। নকশা অনুমোদনের সময়ই নির্ধারণ করে দেয়া হয় সেটি আবাসিক না বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হবে। বাণিজ্যিক ভবন হলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা এর নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা দেয়ার কথা। কিন্তু ভবনগুলোতে মানুষ মরার পর অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

রাজধানীতে কোনো ভবন বা বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরিতে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার অনুমোদন লাগে, কিন্তু যেসব শর্তে সেসব অনুমোদন দেয়া হয়, সেগুলো পালন হয় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ভবনটির এক থেকে ৭ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে অনুমোদন নেয়া ছিল। তবে সেখানে রেস্তোরাঁ বা দোকানের জন্য অনুমোদন ছিল না। ওই অনুমোদনে সেখানে অফিস হতে পারত।’ আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও ভবনটি যেহেতু বাণিজ্যিক, সেহেতু আলাদা অগ্নি নির্গমন পথ রাখা দরকার ছিল বলে মনে করেন আশরাফুল।

ভবন নির্মাণের সময় এবং নির্মাণের পরে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভবনের নিরাপত্তা যাচাই করে সেখানে স্থাপিত বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর অনুমোদন দেয়ার কথা। কিন্তু কেউ সেগুলো করছেন না বলে জানান ইকবাল হাবিবের। বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ ঘুরে এসে তিনি বলেন, ‘ভবনটির প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে ফায়ার এক্সিট, তার মূল যে সিঁড়ি, প্রত্যেকটি আইনের ব্যত্যয় করে অত্যন্ত সরু। পুরো ভবনটি আবদ্ধ, তার কোনো নরমাল ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই।

প্রাণঘাতী আগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গ্রিন কোজি কটেজের ঝুঁকির বিষয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তারা তিনবার নোটিস দিয়েছেন। কিন্তু পরোয়া করেননি মালিক পক্ষ। ‘ভবনের যে জায়গাগুলোতে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়ার কথা ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক দেখাচ্ছিলেন, সেই কক্ষগুলোতে কোনো ধরনের আলো-বাতাস ঢোকার জায়গা ছিল না। মানুষগুলো দম বন্ধ হয়ে, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে মারা গেছেন।’

কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলোর কারণে কোনোভাবেই রাজউকের এই ভবনের অনুমোদন দেয়ার সুযোগ ছিল না বলেও মত এই প্রকৌশলীর। বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে অনুমোদন নিয়ে রেস্তোরাঁ কীভাবে হয়- সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘রেস্তরাঁর রান্নাঘরগুলো হচ্ছে বাণিজ্যিক রান্নাঘর। এর নকশা অত্যন্ত জটিল। সেটি এখানে অনুমোদন পেতে পারে না।’ এসব অনুমোদন ছাড়া সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দিতে পারে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সেবা সংস্থাগুলো যারা এর অনুমোদন দিয়েছে তারা কোনো না কোনোভাবে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। যারা যারা অনুমোদন দিয়েছেন কিন্তু সরেজমিনে দেখেন নাই, এই কমপ্লায়েন্স ইস্যুগুলো নিশ্চিত করেন নাই, তাদের প্রত্যেককে আসামি দেখতে চাই।’

ধানমণ্ডির সাতমসজিদ রোড়ে ‘মৃত্যুকূপ’
পুরো ঢাকাজুড়ে এখন বহুতল ঝাঁ চকচকে ভবনে রেস্তোরাঁ করার চল গড়ে উঠেছে। ধানমণ্ডির সাতমসজিদ সড়কের দুপাশে এ রকম অন্তত এক ডজন ভবন গড়ে উঠেছে যেগুলোর একেকটিতে ২০টি পর্যন্ত রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান রয়েছে। সেগুলো আদৌ নিরাপদ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আগেও ছিল, বেইলি রোডের ঘটনার পর তা আরও বড় হয়েছে। স্থপতি তরিকুল লাভলু সাতমসজিদ রোডের ১৪ তলা ‘গাউসিয়া টুইন পিক’ ভবনের ছবি দিয়ে এ রকম প্রশ্ন তোলার পর এই ভবনটির স্থপতি মুস্তফা খালিদ পলাশ তার ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন, ওই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং তিনি প্রতিনিয়ত সেটি নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকেন। গাউসিয়া টুইন পিক ভবনে দশটির বেশি রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান রয়েছে।

স্থপতি খালিদ লিখেছেন, ‘নকশা এবং অনুমোদন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে হলেও এর ব্যবহারে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সার্বিকভাবে একে সমূহ অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে। স্থপতি হিসেবে শেষ যে ক্ষমতাটুকু রাজউক দিয়েছে অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের জন্য রিপোর্ট স্বাক্ষর করার, তার তোয়াক্কাও এখানে করা হয়নি। অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না নিয়েই চলছে দেদার ব্যবসা।’ স্থপতি হিসেবে রিপোর্ট ও এজবিল্ট ড্রইং প্রদান থেকে বিরত থেকে জমির মালিক, ডেভেলপারকে বার বার লিখিত বার্তায় সতর্ক করেছেন খালিদ। তিনি লেখেন, ‘কোনো ফলপ্রসূ অগ্রগতি হয়নি। ডেভেলপারকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে, তাদের নাকি ফায়ার লাইসেন্স আছে।’

ভবনটি বানিয়েছে গাউসিয়া ডেভেলপারস লিমিটেড। তাদের ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক পাতা থেকে ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ ফোন ধরেননি। ওই এলাকাটি ফায়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের অধীনে। মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা মো. ফখরুদ্দীন বলছেন, তিনি স্থপতি মুস্তফা খালিদ পলাশের কোনো চিঠি পাননি। তবে তার আপত্তির বিষয়টি মৌখিকভাবে শুনেছেন। ফখরুদ্দীন বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। আমাদের ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে হবে অভিযোগের সত্যতা কতখানি, সেটা কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ, ভবনের সেইফটি-সিকিউরিটির কী অবস্থা। তার আগে আসলে হুট করে কিছু বলা ঠিক হবে না।’

বেইলি রোডে ‘দাহ্য অন্দরসজ্জা’
বেইলি রোডের ওই ভবনে আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানিয়েছেন, ভবনটির ভেতরে ঠাসা ছিল দাহ্য অন্দরসজ্জার নানা উপকরণে। সেগুলোই দাউ দাউ করে জ্বলেছে আর ধোঁয়া উৎপন্ন করেছে প্রচুর। ফায়ার সার্ভিসের একজন লিডার বলছেন, তারা এখন যে কোনো বাসা-বাড়িতে আগুন নেভাতে গেলেই দেখেন ভেতরে প্রচুর দাহ্য সামগ্রী ব্যবহার করা হয়।

ভবনের নকশা ও অন্দরসজ্জার কাজে নিয়োজিত কোম্পানি ‘ডট ফাইভ’ এর কর্ণধার মাহফুজ খান বলেন, ‘এটা সত্যি যে ভবনের অভ্যন্তরীণ সজ্জায় প্রচুর দাহ্য বস্তু ব্যবহার করা হয়। ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে ভবনের অন্দরসজ্জা করা হয় পার্টিকেল বোর্ড দিয়ে, যেটা অতি দাহ্য। ‘ভবনের সিলিংয়ের ডিজাইন, ওয়্যাল প্যানেলিং, পার্টিশন ওয়াল সবকিছুতেই এই বোর্ড ব্যবহার করা হয়, যার কারণে আগুন লাগার পর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।’

খোঁজ-খবর নিচ্ছি, সত্য বেরিয়ে আসবে : কাদের

ছবি

গাজীপুরের টঙ্গীতে নাশকতায় ক্ষতি প্রায় ৩৪ কোটি টাকা

মেট্রোরেল বন্ধে ভোগান্তিতে ৬ লাখ মানুষ

ছবি

অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করুন : প্রধানমন্ত্রী

কোটা আন্দোলন: সিলেটে ৩৮ শিক্ষার্থীকে বিস্ফোরক মামলায় শোন অ্যারেস্ট

বিএনপি জামায়াত শিবিরের ক্যাডাররা দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল -মুক্তিযুদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী

বেরোবির উপাচার্যের বাসভবনে আক্রমন-আগুন, যেভাবে উদ্ধার হলেন অবরুদ্ধ ২০ জন

ছবি

আজ সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল

ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এল রেল কর্তৃপক্ষ

ছবি

হামলা, ধ্বংসযজ্ঞের বিচারের ভার জনগণকে দিলেন প্রধানমন্ত্রী

ছবি

‘আমার সব শেষ’, ‘বাড়িতেও নিরাপদ না মানুষ?’

গুগলের ক্যাশ সার্ভার চালুর নির্দেশনা বিটিআরসি’র

ভিন্নমত ও দাবি আদায়ের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অপরাধ নয়, সাংবিধানিক অধিকার: টিআইবি

৩-৪ দিনের মধ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

চাঁদপুর থেকে সীমিত পরিসরে লঞ্চ চলাচল শুরু

ছবি

অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধই থাকছে প্রাথমিক বিদ্যালয়

ছবি

মহাখালী থেকে ছাড়ছে দূরপাল্লার বাস

ছবি

কয়েকদিনের মধ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

পাঁচ দিন পর খুললো অফিস

কোটা সংস্কার ও তাদের দাবি নিয়ে যা বললো সমন্বয়করা

ছবি

সব গ্রেডে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন

সীমিত পরিসরে সারাদেশে চালু হয়েছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট

সাভারে পুলিশ-ছাত্রলীগ ও শিক্ষার্থীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

ছবি

আলোচনার পথ খোলা আছে, আন্দোলনকারীদের ঘোষণা

লিবিয়া থেকে ফিরেছেন ১৪৪ বাংলাদেশী

ছবি

শিক্ষার্থীরা যখন চায় তখনই আলোচনাঃ আইনমন্ত্রী

ছবি

বেরোবি শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় পুলিশের তদন্ত কমিটি

ছবি

এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় : চীনা রাষ্ট্রদূত

ছবি

বাড়তি ভাড়া রিকশা-সিএনজিতে, ভরসা মেট্রোরেল-বিআরটিসি

ছবি

ঢাকাসহ সারা দেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন

ছবি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পুলিশে হামলায় রণক্ষেত্র, হতাহত দুই শতাধিক

ছবি

কোটা আন্দোলনকারীদের নতুন কর্মসূচী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’, ঢাবি হল ছেড়েছেন শিক্ষার্থীরা, থমথমে পরিবেশ

ছবি

বিচারবিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর, আদালতের রায়ের জন্য ধৈর্য্যের আহ্বান

ছবি

জবি : ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে ২ ঘন্টার আল্টিমেটাম

ছবি

সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন শেখ হাসিনা

ছবি

ঢাবির ১৮ হল থেকে বিতাড়িত ছাত্রলীগ, দখলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা

tab

জাতীয়

আগুনের পর জানা যায় নানা অনিয়ম

মাসুদ রানা

ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের বিভিন্ন ভবনে অসংখ্য রেস্তোরাঁ, যাকে অনেকেই বলছেন মৃত্যুকূপ। এই ভবনগুলোতে এসব রেস্তোরাঁ নিয়ম মেনে হয়েছে কিনা তা কেউ জানে না-সংবাদ

রোববার, ০৩ মার্চ ২০২৪

নিমতলী বা চুড়িহাট্টার আগুনে শতাধিক মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, সেখানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রাসায়নিকের মজুদ প্রাণ কেড়েছে। রাজধানীর বনানীতে এফ আর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৭ জনের মৃত্যুর পরেই প্রকাশ্যে আসে ভবনের নানা গুরুতর অনিয়মের কথা। কর্তৃপক্ষ ‘জাগ্রত হয়ে’ জানায় নকশা বহির্ভূত অতিরিক্ত তলাসহ নিরাপত্তার ঘাটতির কথা।

এভাবে প্রতি বছরই আগুনে মানুষ হতাহত হওয়ার পর জানা যায় ভবনের অনুমোদন সংক্রান্ত নানা অনিয়মের কথা। প্রতিবারই প্রশ্ন উঠে, মানুষ মরলেই কেন কর্তৃপক্ষের ‘ঘুম ভাঙে’, স্বাভাবিক সময়ে এত বড় বড় ভবনে দৃশ্যমান অনিয়মগুলো কেনো চোখে পড়ে না? ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁওসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এক ভবনে অনেকগুলো রেস্তোরাঁ খুলে বসা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। ধানমন্ডির একটি ভবনের স্থপতি তার নকশা করা ভবনটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলছেন, কারণ সেটি জুড়ে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো রেস্তোরাঁ, যেখানে অগ্নিনিরাপত্তার বালাই নেই।

সাবেক মন্ত্রীর অসহায়ত্ব, অভিযোগ
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, ২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনা তদন্ত করে ৬২ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। সে সময় অননুমোদিত ১ হাজার ৩০০ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেগুলো ভাঙা সম্ভব হয়নি। নারায়ণগঞ্জে একটি ফুড ফ্যাক্টরিতে আগুনের ঘটনায় রোববার (৪ মার্চ) পর্যন্ত বিচার শুরু হয়নি। এসব ঘটনাকে একধরনের দায়মুক্তি উল্লেখ করে শ ম রেজাউল করিম এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারে প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান।

অগ্নিকাণ্ডে নিরীহ মানুষের প্রাণহানিতে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মামলা করা হয়। এসব মামলাও থেকে যাচ্ছে অবহেলায়ই। দীর্ঘদিনেও শেষ হয় না বিচার। বিচার শেষ না হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছেন অপরাধীরা। আর প্রকৃত অপরাধীরা থেকে যাচ্ছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। গত এক যুগে ঢাকায় অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড়োসড়ো অগ্নিদুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি যেমন হয়েছে, তেমনি স্বজন হারিয়ে পথে নেমেছে অনেক পরিবার।

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডে করা মামলাগুলোর মধ্যে এখনও কোনো মামলার রায় হয়নি। এসব মামলায় সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন না। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে মামলাগুলো দ্রুত শেষ করা।’

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, ‘ধানমন্ডির সাতমসজিদ এলাকায় একটা ভবনে ১৫টি রেস্টুরেন্ট। সেগুলোর কোনো অনুমতি নেই। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডের রাস্তার পাশে ভবনে কয়েকশত রেস্টুরেন্ট, কিন্তু সেগুলোর অনুমতি নেই। খিলগাঁওয়ের তালতলায় বহুতল ভবনে একই অবস্থা। আরও এ রকম ঘটনা ঘটবে। যদি সরকার এ বিষয়ে সচেতন না হয়, সরকারকে বলব, দায়দায়িত্ব নিয়ে এগুলোর জন্য কারা কারা দায়ী, সেটা রাজউক হোক, ফায়ার সার্ভিস হোক, পরিবেশ অধিদপ্তর হোক, তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হোক। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার ব্যবস্থা করা।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলছেন, ‘গ্রিন কোজি কটেজের মত একটা বাণিজ্যিক ভবন পরিচালনার জন্য সরকারের যে ৮টি সংস্থার অনুমোদন লাগে, এসব সংস্থার প্রত্যেকটিকেই এই অবহেলাজনিত হত্যার আসামি হওয়ার উচিত।’

তদারকি নেই, যথেচ্ছ ব্যবহার

গত বছরের ৭ মার্চ গুলিস্তানে ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণেও প্রাণ যায় ২৩ জনের। ওই ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেছিলেন, ‘ভবনটিতে কোনো সংস্কার হত না, পয়ঃনিস্কাশন নিয়মিত তদারকি হত না, পার্কিং এলাকায় গুদাম ভাড়া দেয়ার নিষেধ থাকার পরেও দেয়া হয়েছে, ব্যবসায়ীরা জেনেও নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সংস্থার তদারকিরও অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।’ সেই ঘটনার পরও তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে, সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয় নিয়ে কথা হয়েছে। জানানো হয়, সেই ভবন মালিককে নোটিসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ আর কিছুই করা হয়নি। বেইলি রোডের এই ভবনটিতে এতগুলো রেস্তোরাঁ বসানোর বৈধতা ছিল না, ফায়ার সার্ভিস তাদেরকে নোটিসও দিয়েছিল, কিন্তু আর কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।

বেইলি রোডের ওই ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, ‘ভবনটিতে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। আমরা দু-একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখেছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা একটি মাত্র সিঁড়ি, একটাই পথ।’ তিনি জানান, যে কক্ষে মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে কোনো ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই, একটি জানলাও নেই। প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে খাবারে দোকান, গ্যাস সিলিন্ডারগুলো রাখা ছিল অপরিকল্পিতভাবে।

গত বৃহস্পতিবার রাতের অগ্নিকাণ্ডের পর প্রকাশ পায় বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে রেস্টুরেন্ট বসানোর অনুমোদনই ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলছেন, ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভবন কর্তৃপক্ষকে তারা একাধিকবার নোটিস দিয়েছিলেন। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিনা তা জানাননি তিনি।

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সাবেক উপপরিচালক সেলিম নেওয়াজ ভুঁইয়া এখন অগ্নি নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আইনগতভাবে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে ফায়ার সার্ভিস একটা নোটিস দেবে। তা না মানলে সেই ভবন ব্যবহারযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করতে হবে।’

বারবার নোটিস দেয়ার বিধান কোনো আইনে আছে সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আইনে বলা আছে তারা যদি সেইফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন না করে আপনি তখন অ্যাকশনে যাবেন। আপনার (ফায়ার সার্ভিসের) মামলা করার এখতিয়ার না থাকলে সিটি করপোরেশন বা জেলা প্রশাসনসহ যেসব কর্তৃপক্ষ মামলা করতে পারে আপনি তাদেরকে চিঠি দিয়ে জানান।’

ভবনের অনিয়ম দেখার কর্তৃপক্ষ আসলে কার?

প্রথমত, যে কোনো ভবনের নকশা অনুমোদন দেয়ার এখতিয়ার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের। নকশা অনুমোদনের সময়ই নির্ধারণ করে দেয়া হয় সেটি আবাসিক না বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হবে। বাণিজ্যিক ভবন হলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা এর নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা দেয়ার কথা। কিন্তু ভবনগুলোতে মানুষ মরার পর অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

রাজধানীতে কোনো ভবন বা বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরিতে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার অনুমোদন লাগে, কিন্তু যেসব শর্তে সেসব অনুমোদন দেয়া হয়, সেগুলো পালন হয় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ভবনটির এক থেকে ৭ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে অনুমোদন নেয়া ছিল। তবে সেখানে রেস্তোরাঁ বা দোকানের জন্য অনুমোদন ছিল না। ওই অনুমোদনে সেখানে অফিস হতে পারত।’ আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও ভবনটি যেহেতু বাণিজ্যিক, সেহেতু আলাদা অগ্নি নির্গমন পথ রাখা দরকার ছিল বলে মনে করেন আশরাফুল।

ভবন নির্মাণের সময় এবং নির্মাণের পরে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভবনের নিরাপত্তা যাচাই করে সেখানে স্থাপিত বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর অনুমোদন দেয়ার কথা। কিন্তু কেউ সেগুলো করছেন না বলে জানান ইকবাল হাবিবের। বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ ঘুরে এসে তিনি বলেন, ‘ভবনটির প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে ফায়ার এক্সিট, তার মূল যে সিঁড়ি, প্রত্যেকটি আইনের ব্যত্যয় করে অত্যন্ত সরু। পুরো ভবনটি আবদ্ধ, তার কোনো নরমাল ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই।

প্রাণঘাতী আগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গ্রিন কোজি কটেজের ঝুঁকির বিষয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তারা তিনবার নোটিস দিয়েছেন। কিন্তু পরোয়া করেননি মালিক পক্ষ। ‘ভবনের যে জায়গাগুলোতে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়ার কথা ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক দেখাচ্ছিলেন, সেই কক্ষগুলোতে কোনো ধরনের আলো-বাতাস ঢোকার জায়গা ছিল না। মানুষগুলো দম বন্ধ হয়ে, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে মারা গেছেন।’

কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলোর কারণে কোনোভাবেই রাজউকের এই ভবনের অনুমোদন দেয়ার সুযোগ ছিল না বলেও মত এই প্রকৌশলীর। বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে অনুমোদন নিয়ে রেস্তোরাঁ কীভাবে হয়- সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘রেস্তরাঁর রান্নাঘরগুলো হচ্ছে বাণিজ্যিক রান্নাঘর। এর নকশা অত্যন্ত জটিল। সেটি এখানে অনুমোদন পেতে পারে না।’ এসব অনুমোদন ছাড়া সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দিতে পারে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সেবা সংস্থাগুলো যারা এর অনুমোদন দিয়েছে তারা কোনো না কোনোভাবে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। যারা যারা অনুমোদন দিয়েছেন কিন্তু সরেজমিনে দেখেন নাই, এই কমপ্লায়েন্স ইস্যুগুলো নিশ্চিত করেন নাই, তাদের প্রত্যেককে আসামি দেখতে চাই।’

ধানমণ্ডির সাতমসজিদ রোড়ে ‘মৃত্যুকূপ’
পুরো ঢাকাজুড়ে এখন বহুতল ঝাঁ চকচকে ভবনে রেস্তোরাঁ করার চল গড়ে উঠেছে। ধানমণ্ডির সাতমসজিদ সড়কের দুপাশে এ রকম অন্তত এক ডজন ভবন গড়ে উঠেছে যেগুলোর একেকটিতে ২০টি পর্যন্ত রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান রয়েছে। সেগুলো আদৌ নিরাপদ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আগেও ছিল, বেইলি রোডের ঘটনার পর তা আরও বড় হয়েছে। স্থপতি তরিকুল লাভলু সাতমসজিদ রোডের ১৪ তলা ‘গাউসিয়া টুইন পিক’ ভবনের ছবি দিয়ে এ রকম প্রশ্ন তোলার পর এই ভবনটির স্থপতি মুস্তফা খালিদ পলাশ তার ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন, ওই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং তিনি প্রতিনিয়ত সেটি নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকেন। গাউসিয়া টুইন পিক ভবনে দশটির বেশি রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান রয়েছে।

স্থপতি খালিদ লিখেছেন, ‘নকশা এবং অনুমোদন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে হলেও এর ব্যবহারে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সার্বিকভাবে একে সমূহ অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে। স্থপতি হিসেবে শেষ যে ক্ষমতাটুকু রাজউক দিয়েছে অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের জন্য রিপোর্ট স্বাক্ষর করার, তার তোয়াক্কাও এখানে করা হয়নি। অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না নিয়েই চলছে দেদার ব্যবসা।’ স্থপতি হিসেবে রিপোর্ট ও এজবিল্ট ড্রইং প্রদান থেকে বিরত থেকে জমির মালিক, ডেভেলপারকে বার বার লিখিত বার্তায় সতর্ক করেছেন খালিদ। তিনি লেখেন, ‘কোনো ফলপ্রসূ অগ্রগতি হয়নি। ডেভেলপারকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে, তাদের নাকি ফায়ার লাইসেন্স আছে।’

ভবনটি বানিয়েছে গাউসিয়া ডেভেলপারস লিমিটেড। তাদের ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক পাতা থেকে ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ ফোন ধরেননি। ওই এলাকাটি ফায়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের অধীনে। মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা মো. ফখরুদ্দীন বলছেন, তিনি স্থপতি মুস্তফা খালিদ পলাশের কোনো চিঠি পাননি। তবে তার আপত্তির বিষয়টি মৌখিকভাবে শুনেছেন। ফখরুদ্দীন বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। আমাদের ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে হবে অভিযোগের সত্যতা কতখানি, সেটা কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ, ভবনের সেইফটি-সিকিউরিটির কী অবস্থা। তার আগে আসলে হুট করে কিছু বলা ঠিক হবে না।’

বেইলি রোডে ‘দাহ্য অন্দরসজ্জা’
বেইলি রোডের ওই ভবনে আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানিয়েছেন, ভবনটির ভেতরে ঠাসা ছিল দাহ্য অন্দরসজ্জার নানা উপকরণে। সেগুলোই দাউ দাউ করে জ্বলেছে আর ধোঁয়া উৎপন্ন করেছে প্রচুর। ফায়ার সার্ভিসের একজন লিডার বলছেন, তারা এখন যে কোনো বাসা-বাড়িতে আগুন নেভাতে গেলেই দেখেন ভেতরে প্রচুর দাহ্য সামগ্রী ব্যবহার করা হয়।

ভবনের নকশা ও অন্দরসজ্জার কাজে নিয়োজিত কোম্পানি ‘ডট ফাইভ’ এর কর্ণধার মাহফুজ খান বলেন, ‘এটা সত্যি যে ভবনের অভ্যন্তরীণ সজ্জায় প্রচুর দাহ্য বস্তু ব্যবহার করা হয়। ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে ভবনের অন্দরসজ্জা করা হয় পার্টিকেল বোর্ড দিয়ে, যেটা অতি দাহ্য। ‘ভবনের সিলিংয়ের ডিজাইন, ওয়্যাল প্যানেলিং, পার্টিশন ওয়াল সবকিছুতেই এই বোর্ড ব্যবহার করা হয়, যার কারণে আগুন লাগার পর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।’

back to top