সে দিন ছিল ১৮ই জুলাই। সকাল থেকেই সাভারের রেড়িও কলোনি, বাজার বাসস্ট্যান্ড ও পাকিজার মোড়ে পুলিশের সঙ্গে কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাঁধে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সাভার হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। নির্বিচারে গুলির পর পুলিশের সাঁজোয়া যানের ওপরে পড়ে থাকা মুমূর্ষ শিক্ষার্থীকে ঘুরানো হয়। এর এক পর্যায়ে জীবিত অবস্থায় টেনে হেঁচড়ে সাঁজোয়া যান থেকে নিচে ফেলা হয় তাকে। এমন লোমহর্ষক দৃশ্য সেদিন কয়েক মিনিটেই সামাজিক যোগাযোগ ম্যাধমে ছড়িয়ে পড়ে দেশ ও দেশের বাহিরে। বৈষম্যের বিরোধে অহিংস আন্দোলনে থাকা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। সেসময় বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে পুলিশের সাঁজোয়া যানের সামনে এসে দাঁড়ান মেধাবী শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। সেই দিন ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে সাভারে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ হন শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন।
নিহত শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক টাউন মহল্লার মো. মহিউদ্দিনের ছেলে। সে রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলী বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন, থাকতেন এমআইএসটি’র ওসমানী হলে। বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। দুই ভাই বোনের মধ্যে শাইখ ছিলেন বড়।
সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক টাউন মহল্লায় ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে কথা প্রতিবেদকের। তিনি দুঃখ নিয়ে ছেলে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনাতে বলেন, গত বুধবার (১৭ জুলাই) সকাল সাড়ে ৯টার বাজে। ইয়ামিন তার বিশ^বিদ্যালয়ের হল থেকে সাভারের ব্যাংক টাউনের বাসায় ফিরেছে। তাদের হল থেকে বের করে দিয়েছে। তবে ইয়ামিনের মনে অনেক কষ্ট নিয়েই বাসায় ফিরলো । এসে বলল, আমার বন্ধুরা অনেকেই বাড়িতে ফিরতে পারছে না। আমরা স্যারদেরকে বলছিলাম, সবাই (শিক্ষার্থীরা ) বিকেলে দিকে হল ছেড়ে যাই, তাহলে সবাই গাড়ির টিকিট কাটতে পারবে। কিন্তু শিক্ষকরা ওদের কথা শোনেননি বলল ইয়ামিন। পরে সে আমাকে বলল, খালুর বাড়িতে সাভারের গেন্ডায় তার বন্ধুদের এনে রাখবেন। কিন্তু সেদিনের যে পরিস্থিতি ছিল, তার বন্ধুরা আসতে পারেনি। বুধবার সাড়া দিনই ইয়ামিন ঘরের ভেতরেই ছিল। শুধু মাত্র নামাজের সময় ঘরের বাহিরে বের হয়েছে।
ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকালে আমি আর ইয়ামিন এক সঙ্গে নামাজ পড়ে আসলাম। পরে সাড়ে ১০টার ব্যাংকের কাজে আমি বাহিরে যাচ্ছি, তখন ইয়ামিন বিছানা থেকে দৌড়ে আমার পিছু পিছু এসে বলল আব্বু মিরপুরে তোমার পরিচিত কোনো হাসপাতাল আছে? তখন আমি বললাম, মিরপুরে নাই। কোনো কিছু হইছে? সে বলল আমার বন্ধুরা আহত হইছে, পরিচিত হাসপাতাল ছাড়া ভর্তি নিচ্ছে না। আমি তখন বলাম, টেকনিক্যালে একটি হাসপাতাল আছে। ইয়ামিন তখন রাগ নিয়েই আমাকে বললো, আমি তোমাকে মিরপুরে হসপিটালের কথা বললাম, তুমি আমাকে টেকনিক্যাল দেখাইয়া দিলা। তখনও সে আমাকে বলল, তুমি তোমার কাজে যাও আমি দেখছি বলে রুমে চলে আসে ইয়ামিন।
ওই দিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আমি আবার বাসায় ফিরি। তখন সাভারের বিভিন্নস্থানে গেঞ্জাম চলছে। আমার ড্রাইভার ভেতরের রাস্তা দিয়ে আমাকে বাসায় নিয়ে আসে। আমি বাসায় এসে দেখি ইয়ামিন বিছানতেই আছে। আমি তখন এসে বললাম, গন্ডগোল তো শুধু ঢাকায় হয় নাই, সাভারেও হচ্ছে। ইয়ামিন তখন আমার সঙ্গে কোনো কথা বললো না। সেসময় আমার কাছে মনে হলো, আমি যেহেতু ওর বন্ধুদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করতে পারি নাই তাই রাগ করে আছে। পরে দুপুরে আমি যখন নামাজে যাবো, তখন দেখলাম ইয়ামিন গোসল করছে। আমি মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার সময় পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ইয়ামিনও আমার সঙ্গে নামাজ পড়ছে। সে দিন আমি রোজা ছিলাম, তবে ইয়ামিনও রোজা থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। ওই দিন যেহেতু কোনো কাজ নাই তাই আমি ধীরে-সুস্থে নামাজ পড়ে বেলা ২টার দিকে বের হলাম। তখন দেখি ওর মা দুই বার ফোন করেছে আমাকে। সেসময় আমি ফোন ব্যাক কমলাম, আমাকে বললো ইয়ামিন বাড়িতে নেই। আমি বললাম ও আমাকে বলেছিল ওর বন্ধুদের দেখতে যাবে। এরপরে আমি আবার ইয়ামিনকে ফোন করলাম কিন্তু ইয়ামিন ফোন ধরলো না। তখন ওর মাকে ফোনে বললাম, ইয়ামিন আমার ফোনও ধরেনি। ওর ভারসির্টির বন্ধুরা সবাই মিরপুরে থাকে। রাস্তায় গাড়ি বন্ধ ওকোথায় যাবে তুমি আবার ফোন দিয়ে দেখো। সেসময় আমার মনে একটু খটকা লাগলো ইয়ামিন কোথায় গেল। তারপরেও ওর মাকে আমি আল্লাহকে ডাকতে বললাম আর মিছিলে হয়তোবা থাকতে পারে তাই হয়তো ফোন ধরছে না জানালাম। আমি বাসায় এসে ওর বোনকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কথা শুনে তুমি নিষেধ করবা না। ওর বোন আমাকে বলল, নিষেধের কি আছে, হয়তো ওর বন্ধুরা মিছিলে আসছে তাই ও গেছে দেখে আসুক। তখন আমি বললাম ঠিক আছে, কিন্তু ওরতো কোনো অভিজ্ঞতা নাই। ওতো কখনো রাজনীতি বা মারামারি ঢিলাঢেলিতে যায়নি।
বেলা ৩টার দিকে একটি ছেলে ফোন দিয়ে ওর মাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে বলে। তখন ওর মাকে নিয়ে আমি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালে জরুরি বিভাগে খোঁজে পেলাম না। এরপরে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে যাই, কিন্তু সেখানেও নেই। পরে আমরা নিচে আসি। সে সময় হাসপাতালের একজন নারী চিকিৎসক আমাদেরকে বলল, আপনারা ইয়ামিনের বাবা-মা। তখন আমার মনে হয়েছিল, নরমালের থেকে হয়তো একটু বেশি ইনজুরি হয়েছে। সে সময় কেউ আমাদের কিছু বলছে না। জরুরি বিভাগের পিছনে তালা দেয়া একটি রুমে ইয়ামিনকে রেখেছিল। অনেক ছাত্রদের দেখলাম কিন্তু কিছু বললো না আমাদের। পরে রুমের তলা খুলে দিলে দেখি, স্ট্যোচারে ইয়ামিন শুয়ে আছে ডান দিকে মাথা কাত করা। পরে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম ওর কি হয়েছে, তখন ডাক্তার বললো ওকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে।
এ সময় মহিউদ্দিন দুঃখ করে বলেন, ফেইসবুকে যেভাবে দেখেছি। ওকে রাস্তায় ফেলা হয়েছে, টানা হেঁচড়া করা হয়েছে তার কোনো চিহ্ন পাইনি। আমি ওর বাম হাটুটার ধারে হাতে নিলাম। তখন দেখলাম, ঠান্ডাও হয়নি বা শক্তও হয়নি। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনার কি করেছেন, তখন ডাক্তার বললেন আমরা কোনো কিছু করার সুযোগ পাইনি। সেসময় আমরা হাসপাতাল থেকে ছেলেকে নিয়ে আসতে চাইলাম। তখন হাসপাতাল থেকে পুলিশের ঝামেলা ও ছাত্রদের গেঞ্জামের কথা বলছিল। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম বাহিরে লাশ নিয়ে মিছিল করার মতো কিছু একটা হচ্ছে। তখন আমি ওর এক বন্ধুর সহযোগিতায় অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুত বাসায় নিয়ে আসলাম। পরে ইয়ামিনের মরদেহ গ্রামের বাড়ি কুষ্ঠিয়া নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু হলো না। সেখান থেকে আমার চাচাতো ভাই বলল, পুলিশের ঝামেলা আছে, ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফন করতে দিবে না। পরে সেখানে ব্যর্থ হয়ে সাভারের তালবাগ কবরস্থানে চেষ্টা করলাম। সেখানকার (কবর স্থানের) সভাপতি না করলেন। পরে ব্যাংক টাউন পারিবারিক কবরস্থানেই ইয়ামিনকে কবর দেয়া হলো।
নির্বিচারে গুলিতে ছেলের মৃত্যু বিষয়ে বাবা মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। আমি কারো কাছে বিচার চাইনি। ছেলের দেহ পোস্টমার্টেম করাইনি। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। আমরা যেন ধৈয্য ধরতে পারি’।
ইয়ামিনের স্বপ্ন নিয়ে বাবা মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলের ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর মাসে জন্ম। সে সাভারের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেছে। এরপরে রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’তে (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলী বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেই বিভাগের শিক্ষকের চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। এটাই তার স্বপ্ন হয়ে ওঠেছিল বলে জানান তিনি।
এ সময় মহিউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ইয়ামিন মারা যাওয়ার পরে অনেকেই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা টানার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমি তা হতে দেইনি। ইয়ামিনের গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল। এছাড়াও আমরা কখনো রাজনীতি করিনি। আমাদের পরিবারে কেউ রাজনীতি করতাম না। আমরা ধর্মীয়ভাবে চলাফেরা করতাম। আমার ছেলেও ধর্মীয়ভাবে রীতিনীতি মেনে চলত।
এখনও ইয়ামিনের নীবরতা কষ্ট দেয় বাবা মহিউদ্দিনকে। তিনি বলেন, ইয়ামিন বাসায় আসলে অনেক চুপচাপ থাকতেন। আবার কিছু পরিচিত বা অপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলার সময় বড়দের মতো করে কথা বলতেন। একটা মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে চাইতেন এবিষয়গুলো আমাকে বেশি মনে করিয়ে দেয় ইয়ামিনকে।
৫ আগস্ট দেশে সরকার পতনের পরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজার মোড়ে নতুন করে নামকরণ করা হয় শহীদ ইয়ামিন চত্বর। এছাড়াও সাভার ব্যাংক টাউনে ইয়ামিনের নামে ব্যানার টাঙিয়ে ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা যায়।
বুধবার, ২১ আগস্ট ২০২৪
সে দিন ছিল ১৮ই জুলাই। সকাল থেকেই সাভারের রেড়িও কলোনি, বাজার বাসস্ট্যান্ড ও পাকিজার মোড়ে পুলিশের সঙ্গে কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাঁধে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সাভার হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। নির্বিচারে গুলির পর পুলিশের সাঁজোয়া যানের ওপরে পড়ে থাকা মুমূর্ষ শিক্ষার্থীকে ঘুরানো হয়। এর এক পর্যায়ে জীবিত অবস্থায় টেনে হেঁচড়ে সাঁজোয়া যান থেকে নিচে ফেলা হয় তাকে। এমন লোমহর্ষক দৃশ্য সেদিন কয়েক মিনিটেই সামাজিক যোগাযোগ ম্যাধমে ছড়িয়ে পড়ে দেশ ও দেশের বাহিরে। বৈষম্যের বিরোধে অহিংস আন্দোলনে থাকা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। সেসময় বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে পুলিশের সাঁজোয়া যানের সামনে এসে দাঁড়ান মেধাবী শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। সেই দিন ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে সাভারে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ হন শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন।
নিহত শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক টাউন মহল্লার মো. মহিউদ্দিনের ছেলে। সে রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলী বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন, থাকতেন এমআইএসটি’র ওসমানী হলে। বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। দুই ভাই বোনের মধ্যে শাইখ ছিলেন বড়।
সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক টাউন মহল্লায় ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে কথা প্রতিবেদকের। তিনি দুঃখ নিয়ে ছেলে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনাতে বলেন, গত বুধবার (১৭ জুলাই) সকাল সাড়ে ৯টার বাজে। ইয়ামিন তার বিশ^বিদ্যালয়ের হল থেকে সাভারের ব্যাংক টাউনের বাসায় ফিরেছে। তাদের হল থেকে বের করে দিয়েছে। তবে ইয়ামিনের মনে অনেক কষ্ট নিয়েই বাসায় ফিরলো । এসে বলল, আমার বন্ধুরা অনেকেই বাড়িতে ফিরতে পারছে না। আমরা স্যারদেরকে বলছিলাম, সবাই (শিক্ষার্থীরা ) বিকেলে দিকে হল ছেড়ে যাই, তাহলে সবাই গাড়ির টিকিট কাটতে পারবে। কিন্তু শিক্ষকরা ওদের কথা শোনেননি বলল ইয়ামিন। পরে সে আমাকে বলল, খালুর বাড়িতে সাভারের গেন্ডায় তার বন্ধুদের এনে রাখবেন। কিন্তু সেদিনের যে পরিস্থিতি ছিল, তার বন্ধুরা আসতে পারেনি। বুধবার সাড়া দিনই ইয়ামিন ঘরের ভেতরেই ছিল। শুধু মাত্র নামাজের সময় ঘরের বাহিরে বের হয়েছে।
ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকালে আমি আর ইয়ামিন এক সঙ্গে নামাজ পড়ে আসলাম। পরে সাড়ে ১০টার ব্যাংকের কাজে আমি বাহিরে যাচ্ছি, তখন ইয়ামিন বিছানা থেকে দৌড়ে আমার পিছু পিছু এসে বলল আব্বু মিরপুরে তোমার পরিচিত কোনো হাসপাতাল আছে? তখন আমি বললাম, মিরপুরে নাই। কোনো কিছু হইছে? সে বলল আমার বন্ধুরা আহত হইছে, পরিচিত হাসপাতাল ছাড়া ভর্তি নিচ্ছে না। আমি তখন বলাম, টেকনিক্যালে একটি হাসপাতাল আছে। ইয়ামিন তখন রাগ নিয়েই আমাকে বললো, আমি তোমাকে মিরপুরে হসপিটালের কথা বললাম, তুমি আমাকে টেকনিক্যাল দেখাইয়া দিলা। তখনও সে আমাকে বলল, তুমি তোমার কাজে যাও আমি দেখছি বলে রুমে চলে আসে ইয়ামিন।
ওই দিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আমি আবার বাসায় ফিরি। তখন সাভারের বিভিন্নস্থানে গেঞ্জাম চলছে। আমার ড্রাইভার ভেতরের রাস্তা দিয়ে আমাকে বাসায় নিয়ে আসে। আমি বাসায় এসে দেখি ইয়ামিন বিছানতেই আছে। আমি তখন এসে বললাম, গন্ডগোল তো শুধু ঢাকায় হয় নাই, সাভারেও হচ্ছে। ইয়ামিন তখন আমার সঙ্গে কোনো কথা বললো না। সেসময় আমার কাছে মনে হলো, আমি যেহেতু ওর বন্ধুদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করতে পারি নাই তাই রাগ করে আছে। পরে দুপুরে আমি যখন নামাজে যাবো, তখন দেখলাম ইয়ামিন গোসল করছে। আমি মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার সময় পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ইয়ামিনও আমার সঙ্গে নামাজ পড়ছে। সে দিন আমি রোজা ছিলাম, তবে ইয়ামিনও রোজা থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। ওই দিন যেহেতু কোনো কাজ নাই তাই আমি ধীরে-সুস্থে নামাজ পড়ে বেলা ২টার দিকে বের হলাম। তখন দেখি ওর মা দুই বার ফোন করেছে আমাকে। সেসময় আমি ফোন ব্যাক কমলাম, আমাকে বললো ইয়ামিন বাড়িতে নেই। আমি বললাম ও আমাকে বলেছিল ওর বন্ধুদের দেখতে যাবে। এরপরে আমি আবার ইয়ামিনকে ফোন করলাম কিন্তু ইয়ামিন ফোন ধরলো না। তখন ওর মাকে ফোনে বললাম, ইয়ামিন আমার ফোনও ধরেনি। ওর ভারসির্টির বন্ধুরা সবাই মিরপুরে থাকে। রাস্তায় গাড়ি বন্ধ ওকোথায় যাবে তুমি আবার ফোন দিয়ে দেখো। সেসময় আমার মনে একটু খটকা লাগলো ইয়ামিন কোথায় গেল। তারপরেও ওর মাকে আমি আল্লাহকে ডাকতে বললাম আর মিছিলে হয়তোবা থাকতে পারে তাই হয়তো ফোন ধরছে না জানালাম। আমি বাসায় এসে ওর বোনকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কথা শুনে তুমি নিষেধ করবা না। ওর বোন আমাকে বলল, নিষেধের কি আছে, হয়তো ওর বন্ধুরা মিছিলে আসছে তাই ও গেছে দেখে আসুক। তখন আমি বললাম ঠিক আছে, কিন্তু ওরতো কোনো অভিজ্ঞতা নাই। ওতো কখনো রাজনীতি বা মারামারি ঢিলাঢেলিতে যায়নি।
বেলা ৩টার দিকে একটি ছেলে ফোন দিয়ে ওর মাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে বলে। তখন ওর মাকে নিয়ে আমি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালে জরুরি বিভাগে খোঁজে পেলাম না। এরপরে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে যাই, কিন্তু সেখানেও নেই। পরে আমরা নিচে আসি। সে সময় হাসপাতালের একজন নারী চিকিৎসক আমাদেরকে বলল, আপনারা ইয়ামিনের বাবা-মা। তখন আমার মনে হয়েছিল, নরমালের থেকে হয়তো একটু বেশি ইনজুরি হয়েছে। সে সময় কেউ আমাদের কিছু বলছে না। জরুরি বিভাগের পিছনে তালা দেয়া একটি রুমে ইয়ামিনকে রেখেছিল। অনেক ছাত্রদের দেখলাম কিন্তু কিছু বললো না আমাদের। পরে রুমের তলা খুলে দিলে দেখি, স্ট্যোচারে ইয়ামিন শুয়ে আছে ডান দিকে মাথা কাত করা। পরে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম ওর কি হয়েছে, তখন ডাক্তার বললো ওকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে।
এ সময় মহিউদ্দিন দুঃখ করে বলেন, ফেইসবুকে যেভাবে দেখেছি। ওকে রাস্তায় ফেলা হয়েছে, টানা হেঁচড়া করা হয়েছে তার কোনো চিহ্ন পাইনি। আমি ওর বাম হাটুটার ধারে হাতে নিলাম। তখন দেখলাম, ঠান্ডাও হয়নি বা শক্তও হয়নি। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনার কি করেছেন, তখন ডাক্তার বললেন আমরা কোনো কিছু করার সুযোগ পাইনি। সেসময় আমরা হাসপাতাল থেকে ছেলেকে নিয়ে আসতে চাইলাম। তখন হাসপাতাল থেকে পুলিশের ঝামেলা ও ছাত্রদের গেঞ্জামের কথা বলছিল। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম বাহিরে লাশ নিয়ে মিছিল করার মতো কিছু একটা হচ্ছে। তখন আমি ওর এক বন্ধুর সহযোগিতায় অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুত বাসায় নিয়ে আসলাম। পরে ইয়ামিনের মরদেহ গ্রামের বাড়ি কুষ্ঠিয়া নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু হলো না। সেখান থেকে আমার চাচাতো ভাই বলল, পুলিশের ঝামেলা আছে, ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফন করতে দিবে না। পরে সেখানে ব্যর্থ হয়ে সাভারের তালবাগ কবরস্থানে চেষ্টা করলাম। সেখানকার (কবর স্থানের) সভাপতি না করলেন। পরে ব্যাংক টাউন পারিবারিক কবরস্থানেই ইয়ামিনকে কবর দেয়া হলো।
নির্বিচারে গুলিতে ছেলের মৃত্যু বিষয়ে বাবা মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। আমি কারো কাছে বিচার চাইনি। ছেলের দেহ পোস্টমার্টেম করাইনি। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। আমরা যেন ধৈয্য ধরতে পারি’।
ইয়ামিনের স্বপ্ন নিয়ে বাবা মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলের ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর মাসে জন্ম। সে সাভারের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেছে। এরপরে রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’তে (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলী বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেই বিভাগের শিক্ষকের চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। এটাই তার স্বপ্ন হয়ে ওঠেছিল বলে জানান তিনি।
এ সময় মহিউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ইয়ামিন মারা যাওয়ার পরে অনেকেই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা টানার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমি তা হতে দেইনি। ইয়ামিনের গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল। এছাড়াও আমরা কখনো রাজনীতি করিনি। আমাদের পরিবারে কেউ রাজনীতি করতাম না। আমরা ধর্মীয়ভাবে চলাফেরা করতাম। আমার ছেলেও ধর্মীয়ভাবে রীতিনীতি মেনে চলত।
এখনও ইয়ামিনের নীবরতা কষ্ট দেয় বাবা মহিউদ্দিনকে। তিনি বলেন, ইয়ামিন বাসায় আসলে অনেক চুপচাপ থাকতেন। আবার কিছু পরিচিত বা অপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলার সময় বড়দের মতো করে কথা বলতেন। একটা মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে চাইতেন এবিষয়গুলো আমাকে বেশি মনে করিয়ে দেয় ইয়ামিনকে।
৫ আগস্ট দেশে সরকার পতনের পরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজার মোড়ে নতুন করে নামকরণ করা হয় শহীদ ইয়ামিন চত্বর। এছাড়াও সাভার ব্যাংক টাউনে ইয়ামিনের নামে ব্যানার টাঙিয়ে ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা যায়।