সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘পরিপূর্ণ রূপ দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে’ নিজের ঘাড়ে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ নিয়ে ভিসি নিজেই এখন লাপাত্তা। গত বছরের ৫ জানুয়ারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যোগদানের পর সংবাদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছয় বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করবেন।
এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভিসির দায়িত্বে ছিলেন এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাক্তার মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী। এরপর তার মেয়াদ শেষকালীন সময়ে তিনি পুনরায় ভিসি হওয়ার তৎপরতা শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিয়ম বহির্ভূতভাবে মাধ্যমে জনবল নিয়োগসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকা-ের কারণে কর্তৃপক্ষ তার মেয়াদ বৃদ্ধি করেননি। এর আগে তার অনিয়ন ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে সংবাদে একটি খবর প্রকাশের তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। এরপরই চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার এ এইচ এম এনায়েত হোসেনকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তখন নবনিযুক্ত এই ভিসি জানতেন তার উত্তরসূরি অনিয়ম-দুর্নীতি করে গিয়েছেন।
এই ভিসি যোগদানের পর তাকে স্বাগত জানাতে আসা অনেক কর্মকর্তা- কর্মচারীর ফুলের শুভেচ্ছাও তিনি গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন, তার সঙ্গে স্বাগত জানানোর ছবি তুলে কেউ অপকর্ম করতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি যে কতো ধুরন্ধর প্রকৃতির সেই রূপ প্রকাশ পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মিত উপস্থিতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অনেক অভিযোগ এখন ভেসে বেড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে। শুরুতে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জাতীয় সংসদে সিলেট-৩ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিবের প্রস্তাবে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নাম বদল করে রাখা হয় ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।’
ওই সময় এমপি হাবিব সংবাদকে জানিয়েছিলেন, তার প্রস্তাবনার কারণেই এই নামকরণ হয়েছে। তবে সরকার পতনের পর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ভিসি এনায়েতের পদত্যাগের দাবি তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে কোনো ধরনের ছুটি ছাড়া গত ৫ আগস্ট থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাপাত্তা। এরপর থেকে প্রকাশ হতে থাকে তার বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতা।
অনুপস্থিত থাকেন চার দিন
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেছেন, ভিসি হিসেবে এনায়েত হোসেনের সিলেটে সার্বক্ষণিক অবস্থান করার বিধান থাকলেও তিনি সপ্তাহে গড়ে চার দিন ঢাকায় থাকেন। সচরাচর তিনি মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন। বাকি সময় চক্ষুবিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক ঢাকায় চেম্বারে রোগী দেখেন। এর বাইরে তিনি যখন সিলেটে অবস্থান করেন, তখন এখানেও চেম্বারে রোগী দেখে থাকেন। আর এটার প্রমাণ মিলেছে দুজনের কাছ থেকে। তাদেরই একজন নগরীর জিন্দাবাজার রাজা ম্যানশনের ব্যবসায়ী সুহেল আহমদ। দীর্ঘদিন থেকে তিনি চক্ষু সমস্যায় ভুগছেন। তিনি জানান, অনেক ডাক্তার দেখিয়ে তার চক্ষু ভালো না হওয়ায় সর্বশেষ তিনি এনায়েত হোসেনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
সুহেল জানান, নগরের পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকার কম্পিউটার অপটিক এবং সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পাঠানপাড়া এলাকায় ইনক্লুসিভ আই হসপিটালে-এই দুই জায়গাতেই বিভিন্ন সময়ে তিনি এনায়েতের চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। ভিসির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এভাবে চেম্বার করার বিষয়টি অনৈতিক হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
নার্সিং কলেজে দুর্নীতি
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্র পরিদর্শনের নিয়ম আছে। এর বিপরীতে প্রতিবার ভিসির জন্য ৫ হাজার টাকা এবং বাকি সদস্যদের জনপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র পরিদর্শনে না গিয়েই অর্ধলক্ষাধিক টাকার বিল তুলে নেয়ার অভিযোগ এনায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে।
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ১৩ বার কেন্দ্র পরিদর্শন দেখিয়ে এনায়েত হোসেন ৬৫ হাজার টাকা বিল প্রস্তুত করে আয়কর বাদ দিয়ে ৫৮ হাজার ৫০০ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগার থেকে তুলে নেন। কেন্দ্র পরিদর্শন না করেই এমন বিল তুলে নিয়ে তিনি বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, তার আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে পরিচিত সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালনকারী মো. বিলাল আহমদ চৌধুরীও ভিসির মতো ১৩ বার কেন্দ্র পরিদর্শন দেখিয়ে টাকা তুলে নেন। অন্য তিন সদস্য সর্বনিম্ন ২টি থেকে সর্বোচ্চ ৪টি কেন্দ্র পরিদর্শন দেখিয়ে বিল তুলেছেন।
পরিদর্শন কমিটির একজন সদস্য সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শিশির রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, তিনি যখন তিনটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন, তখন ভিসি এনায়েত হোসেন সঙ্গে ছিলেন না।
দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম
সহযোগী একটি দৈনিকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দাপ্তরিক ভবনের মেরামতকাজের (সিভিল, স্যানিটেশন, বৈদ্যুতিক কাজ) জন্য আগ্রহী ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটেশন আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই কোটেশন আহ্বান করেন মেরামতকাজ সম্পাদন ও তদারকি কমিটির সভাপতি ভিসি এনায়েত হোসেন। কোটেশন জমাদানের শেষ তারিখ ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি। সর্বনিম্ন দরদাতা দেখিয়ে এ কাজটি দেয়া হয় সিলেট নগরের বালুচর এলাকার মেসার্স আফরা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি পণ্য সরবরাহ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।
একই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আফরা এন্টারপ্রাইজ ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩০০ টাকা দর দেখিয়ে কাজ পেয়েছিল। ভ্যাট ও আয়কর বাদে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৫১২ টাকার চেক পায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষকে এড়িয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে দেয়া চেক পাস হয় ভিসির স্বাক্ষরে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী চেকে কোষাধ্যক্ষের স্বাক্ষর থাকার বিধান রয়েছে।
জানা যায়, কোটেশন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবুল কালাম মো. ফজলুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে এ কমিটির সভা কবে হয়েছে, সে তারিখ উপস্থিতি-কাগজে উল্লেখ ছিল না। এছাড়া তিন সদস্যবিশিষ্ট ওই উন্মুক্তকরণ কমিটির সভায় চেয়ারম্যান ছাড়া বাকি দুজনই অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে সেই উপস্থিতি-কাগজে কমিটির চেয়ারম্যান ছাড়া সদস্য সচিব ও সদস্যের কোনো স্বাক্ষরও নেই।
২ লাখ ৯৯ হাজার ২৫০ টাকার সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে উদয়ন অফসেট প্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ১৯ হাজার কপি ‘পরীক্ষার মূল উত্তরপত্র’ সরবরাহ করার জন্য চলতি বছরের ৩ জুলাই কার্যাদেশ দেয়া হয়। এ-সংক্রান্ত কাগজপত্রে দেখা গেছে, ৩ জুলাই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। তবে সাত সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটির সভায় কেবল ভিসি ও রেজিস্ট্রার উপস্থিত ছিলেন। বাকি সদস্যদের মধ্যে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. বদরুল ইসলাম, এমসি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌফিক এজদানী চৌধুরী, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক প্রেমানন্দ দাস, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আহমদ চৌধুরী এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আরিফ আহমদ অনুপস্থিত ছিলেন।
ভিসির বিরুদ্ধে এমন অসংখ্য অভিযোগের ভিত্তিতে বক্তব্য জানতে সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে তার ব্যক্তিগত নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি। শেষ পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারকে ফোন দিলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।
সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘পরিপূর্ণ রূপ দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে’ নিজের ঘাড়ে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ নিয়ে ভিসি নিজেই এখন লাপাত্তা। গত বছরের ৫ জানুয়ারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যোগদানের পর সংবাদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছয় বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করবেন।
এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভিসির দায়িত্বে ছিলেন এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাক্তার মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী। এরপর তার মেয়াদ শেষকালীন সময়ে তিনি পুনরায় ভিসি হওয়ার তৎপরতা শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিয়ম বহির্ভূতভাবে মাধ্যমে জনবল নিয়োগসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকা-ের কারণে কর্তৃপক্ষ তার মেয়াদ বৃদ্ধি করেননি। এর আগে তার অনিয়ন ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে সংবাদে একটি খবর প্রকাশের তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। এরপরই চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার এ এইচ এম এনায়েত হোসেনকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তখন নবনিযুক্ত এই ভিসি জানতেন তার উত্তরসূরি অনিয়ম-দুর্নীতি করে গিয়েছেন।
এই ভিসি যোগদানের পর তাকে স্বাগত জানাতে আসা অনেক কর্মকর্তা- কর্মচারীর ফুলের শুভেচ্ছাও তিনি গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন, তার সঙ্গে স্বাগত জানানোর ছবি তুলে কেউ অপকর্ম করতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি যে কতো ধুরন্ধর প্রকৃতির সেই রূপ প্রকাশ পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মিত উপস্থিতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অনেক অভিযোগ এখন ভেসে বেড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে। শুরুতে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জাতীয় সংসদে সিলেট-৩ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিবের প্রস্তাবে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নাম বদল করে রাখা হয় ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।’
ওই সময় এমপি হাবিব সংবাদকে জানিয়েছিলেন, তার প্রস্তাবনার কারণেই এই নামকরণ হয়েছে। তবে সরকার পতনের পর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ভিসি এনায়েতের পদত্যাগের দাবি তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে কোনো ধরনের ছুটি ছাড়া গত ৫ আগস্ট থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাপাত্তা। এরপর থেকে প্রকাশ হতে থাকে তার বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতা।
অনুপস্থিত থাকেন চার দিন
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেছেন, ভিসি হিসেবে এনায়েত হোসেনের সিলেটে সার্বক্ষণিক অবস্থান করার বিধান থাকলেও তিনি সপ্তাহে গড়ে চার দিন ঢাকায় থাকেন। সচরাচর তিনি মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন। বাকি সময় চক্ষুবিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক ঢাকায় চেম্বারে রোগী দেখেন। এর বাইরে তিনি যখন সিলেটে অবস্থান করেন, তখন এখানেও চেম্বারে রোগী দেখে থাকেন। আর এটার প্রমাণ মিলেছে দুজনের কাছ থেকে। তাদেরই একজন নগরীর জিন্দাবাজার রাজা ম্যানশনের ব্যবসায়ী সুহেল আহমদ। দীর্ঘদিন থেকে তিনি চক্ষু সমস্যায় ভুগছেন। তিনি জানান, অনেক ডাক্তার দেখিয়ে তার চক্ষু ভালো না হওয়ায় সর্বশেষ তিনি এনায়েত হোসেনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
সুহেল জানান, নগরের পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকার কম্পিউটার অপটিক এবং সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পাঠানপাড়া এলাকায় ইনক্লুসিভ আই হসপিটালে-এই দুই জায়গাতেই বিভিন্ন সময়ে তিনি এনায়েতের চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। ভিসির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এভাবে চেম্বার করার বিষয়টি অনৈতিক হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
নার্সিং কলেজে দুর্নীতি
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্র পরিদর্শনের নিয়ম আছে। এর বিপরীতে প্রতিবার ভিসির জন্য ৫ হাজার টাকা এবং বাকি সদস্যদের জনপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র পরিদর্শনে না গিয়েই অর্ধলক্ষাধিক টাকার বিল তুলে নেয়ার অভিযোগ এনায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে।
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ১৩ বার কেন্দ্র পরিদর্শন দেখিয়ে এনায়েত হোসেন ৬৫ হাজার টাকা বিল প্রস্তুত করে আয়কর বাদ দিয়ে ৫৮ হাজার ৫০০ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগার থেকে তুলে নেন। কেন্দ্র পরিদর্শন না করেই এমন বিল তুলে নিয়ে তিনি বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, তার আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে পরিচিত সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালনকারী মো. বিলাল আহমদ চৌধুরীও ভিসির মতো ১৩ বার কেন্দ্র পরিদর্শন দেখিয়ে টাকা তুলে নেন। অন্য তিন সদস্য সর্বনিম্ন ২টি থেকে সর্বোচ্চ ৪টি কেন্দ্র পরিদর্শন দেখিয়ে বিল তুলেছেন।
পরিদর্শন কমিটির একজন সদস্য সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শিশির রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, তিনি যখন তিনটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন, তখন ভিসি এনায়েত হোসেন সঙ্গে ছিলেন না।
দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম
সহযোগী একটি দৈনিকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দাপ্তরিক ভবনের মেরামতকাজের (সিভিল, স্যানিটেশন, বৈদ্যুতিক কাজ) জন্য আগ্রহী ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটেশন আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই কোটেশন আহ্বান করেন মেরামতকাজ সম্পাদন ও তদারকি কমিটির সভাপতি ভিসি এনায়েত হোসেন। কোটেশন জমাদানের শেষ তারিখ ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি। সর্বনিম্ন দরদাতা দেখিয়ে এ কাজটি দেয়া হয় সিলেট নগরের বালুচর এলাকার মেসার্স আফরা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি পণ্য সরবরাহ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।
একই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আফরা এন্টারপ্রাইজ ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩০০ টাকা দর দেখিয়ে কাজ পেয়েছিল। ভ্যাট ও আয়কর বাদে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৫১২ টাকার চেক পায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষকে এড়িয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে দেয়া চেক পাস হয় ভিসির স্বাক্ষরে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী চেকে কোষাধ্যক্ষের স্বাক্ষর থাকার বিধান রয়েছে।
জানা যায়, কোটেশন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবুল কালাম মো. ফজলুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে এ কমিটির সভা কবে হয়েছে, সে তারিখ উপস্থিতি-কাগজে উল্লেখ ছিল না। এছাড়া তিন সদস্যবিশিষ্ট ওই উন্মুক্তকরণ কমিটির সভায় চেয়ারম্যান ছাড়া বাকি দুজনই অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে সেই উপস্থিতি-কাগজে কমিটির চেয়ারম্যান ছাড়া সদস্য সচিব ও সদস্যের কোনো স্বাক্ষরও নেই।
২ লাখ ৯৯ হাজার ২৫০ টাকার সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে উদয়ন অফসেট প্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ১৯ হাজার কপি ‘পরীক্ষার মূল উত্তরপত্র’ সরবরাহ করার জন্য চলতি বছরের ৩ জুলাই কার্যাদেশ দেয়া হয়। এ-সংক্রান্ত কাগজপত্রে দেখা গেছে, ৩ জুলাই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। তবে সাত সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটির সভায় কেবল ভিসি ও রেজিস্ট্রার উপস্থিত ছিলেন। বাকি সদস্যদের মধ্যে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. বদরুল ইসলাম, এমসি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌফিক এজদানী চৌধুরী, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক প্রেমানন্দ দাস, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আহমদ চৌধুরী এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আরিফ আহমদ অনুপস্থিত ছিলেন।
ভিসির বিরুদ্ধে এমন অসংখ্য অভিযোগের ভিত্তিতে বক্তব্য জানতে সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে তার ব্যক্তিগত নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি। শেষ পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারকে ফোন দিলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।