বাংলাদেশের ‘পুনর্গঠন ও সংস্কার’ এবং পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়া হলে তারা ‘সার্বিক সহযোগিতা করতে আগ্রহী’ বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠকে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এমন আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কার নিয়ে সরকারের ধারণা ও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এতে যুক্ত হতে পারে, তা নিয়ে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাধারণ আলোচনা হয়েছে।
এসব আলোচনায় প্রতিনিধি দলের সদস্যরা জানায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে প্রায় ২০ কোটি ডলার উন্নয়ন সহায়তা দেয়ার একটি চুক্তি সই হয়েছে।
রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তোহিদ হোসেন, অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক
সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রোববার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় রোববার সকালে এ সাক্ষাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এসব তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তার সরকার স্বৈরশাসনের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজদের অর্থ দেশে ফেরত আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা দুর্নীতির সাগরে ছিলাম।
অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা প্রতিনিধি দলকে জানান, তার প্রশাসন অর্থনীতি সংস্কার এবং পুনরায় সচল করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। আর্থিক খাতে সংস্কার এবং বিচার বিভাগ ও পুলিশের মতো প্রতিষ্ঠানকে ঠিক করার উদ্যোগ নিয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের কথা তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তার সরকার দায়িত্ব নেয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই ভোট জালিয়াতি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগ, পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসন, দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা এবং সংবিধান সংশোধনের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
সাক্ষাতে মার্কিন প্রতিনিধিদলের প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, এ সংস্কার এজেন্ডায় সহায়তা করতে পারলে ওয়াশিংটন খুশি হবে। এ সাক্ষাতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু-সহ অন্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন, তাদের দেশ অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া সংস্কার উদ্যোগে প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা দিতে আগ্রহী।
ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রমিক ইস্যু, রোহিঙ্গা সংকট এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন নিউইয়র্ক সফর নিয়ে আলোচনা হয়।
অর্থ ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক
এর আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেন।
বৈঠকের বিষয়ে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস এক বার্তায় জানায়, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে ভালো লেগেছে। আমরা আমাদের অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকা- সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বৈঠকে প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস তাদের অফিসিয়াল ফেইসবুক পেজে এ বার্তায় বলেছে, ‘আমরা আমাদের অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং জলবায়ু ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
দ্বিপক্ষীয় বৈঠক
দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বৈঠকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্য সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন পররাষ্ট্র সচিব। তিনি জানান, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি বিশেষ অগ্রাধিকারে রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কার নিয়ে সরকারের ধারণা ও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এতে যুক্ত হতে পারে, তা নিয়ে ঢাকা সফররত উচ্চপর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাধারণ আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেগুলোর বিষয়ে প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়েছে। সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানতে চেয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বলে তাদের জানানো হয়েছে। আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা সংকটসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
কোন কোন খাতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, জানতে চাইলে জসীম উদ্দীন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এক মাসের কিছুটা বেশি। আজ বৈঠকে পরিবর্তিত যে পরিস্থিতি ও সরকারের সংস্কার বিষয়ে যে ধ্যানধারণা এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, তা নিয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য এই সফর একটি ভিত্তি। সামনে আমরা এই আলোচনাকে বিভিন্ন পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাব।’
পাচার হওয়া টাকা ফেরত নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমরা বড় আকারে আর্থিক খাতে সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছি এবং পাচার হওয়া অর্থসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশেষায়িত জ্ঞান রয়েছে, সেটি হয়তো আমরা ব্যবহার করব, কিন্তু আলাপ-আলোচনা সবে শুরু হয়েছে। এর চূড়ান্ত রূপ পেতে কিছুটা সময় লাগবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাস
পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, প্রতিনিধিদলের এই সফরে প্রথম যে আশ্বাস, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করতে চায়। সেটারই প্রতিফলন হিসেবে সরকার গঠনের দ্বিতীয় মাসেই যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক সংস্কারের যেসব খাত চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সব কটি খাতে তারা সার্বিকভাবে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। শ্রম আইন নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলো তাদের জানানো হয়েছে এবং এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকায় আসার আগে দিল্লি সফর করেছেন। এই সফরে ভারত থেকে কোনো বার্তা নিয়ে এসেছেন কিনা, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘এ বিষয়ে আজ কোনো আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশন আছে এবং ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশন আছে। আমরা যদি দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই, এগুলো আমাদের জন্য প্ল্যাটফর্ম।’
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেছি। ছাত্র-জনতার চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে সূচিত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সরকার ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেসব পদক্ষেপ সম্পর্কে আমরা প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি।
সচিব জানান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানার আগ্রহ জানিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বিবেচনায় রয়েছে।
তিনি বলেন, আর্থিক ও রাজস্ব খাতে সংস্কারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি। শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা ইস্যু, মানবিক সহায়তাসহ নানা বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
শ্রম আইন নিয়ে কী আলোচনা
শ্রম আইন নিয়ে বৈঠক আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, এ বিষয়ে আমরা যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছি সেগুলো তাদের জানিয়েছি। তারা পদক্ষেপ সম্পর্কে নোট নিয়েছেন। এগুলোকে তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে স্বীকৃতি দেন। এক্ষেত্রে এ আলোচনাটা কনটিনিউ করবে।
তৈরি পোশাক খাতে যে অস্থিরতা চলছে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আছে কিনা এবং জিএসপি প্লাস ফিরে পাওয়া নিয়ে আলোচনার প্রশ্নে জসীম উদ্দিন বলেন, বৈঠকে এ ধরণের কোনো কথা হয়নি। জিএসপি নিয়ে একটা সাধারণ আলোচনা হয়েছে। এটার যে প্রক্রিয়া এ সম্পর্কে কথা হয়েছে।
প্রতিরক্ষা ক্রয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়নি উল্লেখ করে সচিব বলেন, ডেভলমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) থেকে অর্থায়ন পাওয়া নিয়ে একটা সাধারণ আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়নি।
র্যাবের সংস্কার নিয়ে করা কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা একটা চলমান আলোচনা। নির্বাচন নিয়ে কোনো সহায়তা চাওয়া হয়নি। বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি ইস্যু। এটার সমাধান হওয়া উচিত।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র-সচিব জানান, সাধারণত জাতিসংঘ অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন না। এখন পর্যন্ত সেটা আমরা জানি। যদি দুই পক্ষের সময়সূচি মিলে তাহলে অন্য কোনো উপায়ে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বাড়ানোসহ অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। দলের নেতৃত্বে রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান। এ ছাড়া রয়েছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
প্রতিনিধিদল রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে। পরে বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গেও বৈঠক করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
প্রতিনিধিদলকে গ্রাফিতি আঁকা আর্টবুক দিলেন ইউনূস
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় আঁকা বিভিন্ন গ্রাফিতি নিয়ে একটি আর্টবুক উপহার দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তার সঙ্গে দেখা করার পর সফররত মার্কিন প্রতিনিধিদলকে গ্রাফিতি আঁকা আর্ট বইটি উপহার দেন। আর্ট বইটিতে ঢাকা ও অন্যান্য শহর এবং শহরের দেয়ালে জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময় আঁকা কিছু সেরা শিল্পকর্মের ছবি রয়েছে।
গ্রাফিতিগুলোর ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসব গ্রাফিতি ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার শাসন এবং তার নৃশংস বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী ছাত্র এবং তরুণদের আবেগ, আশা এবং আকাক্সক্ষা ফুটে উঠেছে।
ড. ইউনূস বলেন, আপনাদের ঢাকার দেয়ালের দিকে তাকানোর অনুরোধ করবো। এ গ্রাফিতিগুলো এখনও আছে। শুধু বিপ্লবের পরেই আঁকা হয়নি। জুলাই মাসে বিক্ষোভের সময় ছাত্ররা গ্রাফিতি আঁকার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে, শেখ হাসিনার শাসন ও তার বাহিনীকে অস্বীকার করেছিল।
এসব গ্রাফিতি আঁকার রং-তুলি কীভাবে জোগাড় হয়েছিল সে কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, তাদের কাছে রং ও ব্রাশ কেনার টাকা ছিল না। সাধারণ জনতা বিভিন্নভাবে তাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল।
সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশের ‘পুনর্গঠন ও সংস্কার’ এবং পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়া হলে তারা ‘সার্বিক সহযোগিতা করতে আগ্রহী’ বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠকে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এমন আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কার নিয়ে সরকারের ধারণা ও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এতে যুক্ত হতে পারে, তা নিয়ে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাধারণ আলোচনা হয়েছে।
এসব আলোচনায় প্রতিনিধি দলের সদস্যরা জানায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে প্রায় ২০ কোটি ডলার উন্নয়ন সহায়তা দেয়ার একটি চুক্তি সই হয়েছে।
রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তোহিদ হোসেন, অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক
সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রোববার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় রোববার সকালে এ সাক্ষাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এসব তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তার সরকার স্বৈরশাসনের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজদের অর্থ দেশে ফেরত আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা দুর্নীতির সাগরে ছিলাম।
অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা প্রতিনিধি দলকে জানান, তার প্রশাসন অর্থনীতি সংস্কার এবং পুনরায় সচল করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। আর্থিক খাতে সংস্কার এবং বিচার বিভাগ ও পুলিশের মতো প্রতিষ্ঠানকে ঠিক করার উদ্যোগ নিয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের কথা তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তার সরকার দায়িত্ব নেয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই ভোট জালিয়াতি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগ, পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসন, দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা এবং সংবিধান সংশোধনের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
সাক্ষাতে মার্কিন প্রতিনিধিদলের প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, এ সংস্কার এজেন্ডায় সহায়তা করতে পারলে ওয়াশিংটন খুশি হবে। এ সাক্ষাতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু-সহ অন্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন, তাদের দেশ অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া সংস্কার উদ্যোগে প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা দিতে আগ্রহী।
ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রমিক ইস্যু, রোহিঙ্গা সংকট এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন নিউইয়র্ক সফর নিয়ে আলোচনা হয়।
অর্থ ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক
এর আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেন।
বৈঠকের বিষয়ে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস এক বার্তায় জানায়, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে ভালো লেগেছে। আমরা আমাদের অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকা- সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বৈঠকে প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস তাদের অফিসিয়াল ফেইসবুক পেজে এ বার্তায় বলেছে, ‘আমরা আমাদের অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং জলবায়ু ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
দ্বিপক্ষীয় বৈঠক
দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বৈঠকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্য সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন পররাষ্ট্র সচিব। তিনি জানান, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি বিশেষ অগ্রাধিকারে রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কার নিয়ে সরকারের ধারণা ও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এতে যুক্ত হতে পারে, তা নিয়ে ঢাকা সফররত উচ্চপর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাধারণ আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেগুলোর বিষয়ে প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়েছে। সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানতে চেয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বলে তাদের জানানো হয়েছে। আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা সংকটসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
কোন কোন খাতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, জানতে চাইলে জসীম উদ্দীন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এক মাসের কিছুটা বেশি। আজ বৈঠকে পরিবর্তিত যে পরিস্থিতি ও সরকারের সংস্কার বিষয়ে যে ধ্যানধারণা এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, তা নিয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য এই সফর একটি ভিত্তি। সামনে আমরা এই আলোচনাকে বিভিন্ন পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাব।’
পাচার হওয়া টাকা ফেরত নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমরা বড় আকারে আর্থিক খাতে সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছি এবং পাচার হওয়া অর্থসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশেষায়িত জ্ঞান রয়েছে, সেটি হয়তো আমরা ব্যবহার করব, কিন্তু আলাপ-আলোচনা সবে শুরু হয়েছে। এর চূড়ান্ত রূপ পেতে কিছুটা সময় লাগবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাস
পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, প্রতিনিধিদলের এই সফরে প্রথম যে আশ্বাস, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করতে চায়। সেটারই প্রতিফলন হিসেবে সরকার গঠনের দ্বিতীয় মাসেই যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক সংস্কারের যেসব খাত চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সব কটি খাতে তারা সার্বিকভাবে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। শ্রম আইন নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলো তাদের জানানো হয়েছে এবং এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকায় আসার আগে দিল্লি সফর করেছেন। এই সফরে ভারত থেকে কোনো বার্তা নিয়ে এসেছেন কিনা, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘এ বিষয়ে আজ কোনো আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশন আছে এবং ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশন আছে। আমরা যদি দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই, এগুলো আমাদের জন্য প্ল্যাটফর্ম।’
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেছি। ছাত্র-জনতার চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে সূচিত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সরকার ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেসব পদক্ষেপ সম্পর্কে আমরা প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি।
সচিব জানান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানার আগ্রহ জানিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বিবেচনায় রয়েছে।
তিনি বলেন, আর্থিক ও রাজস্ব খাতে সংস্কারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি। শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা ইস্যু, মানবিক সহায়তাসহ নানা বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
শ্রম আইন নিয়ে কী আলোচনা
শ্রম আইন নিয়ে বৈঠক আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, এ বিষয়ে আমরা যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছি সেগুলো তাদের জানিয়েছি। তারা পদক্ষেপ সম্পর্কে নোট নিয়েছেন। এগুলোকে তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে স্বীকৃতি দেন। এক্ষেত্রে এ আলোচনাটা কনটিনিউ করবে।
তৈরি পোশাক খাতে যে অস্থিরতা চলছে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আছে কিনা এবং জিএসপি প্লাস ফিরে পাওয়া নিয়ে আলোচনার প্রশ্নে জসীম উদ্দিন বলেন, বৈঠকে এ ধরণের কোনো কথা হয়নি। জিএসপি নিয়ে একটা সাধারণ আলোচনা হয়েছে। এটার যে প্রক্রিয়া এ সম্পর্কে কথা হয়েছে।
প্রতিরক্ষা ক্রয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়নি উল্লেখ করে সচিব বলেন, ডেভলমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) থেকে অর্থায়ন পাওয়া নিয়ে একটা সাধারণ আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়নি।
র্যাবের সংস্কার নিয়ে করা কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা একটা চলমান আলোচনা। নির্বাচন নিয়ে কোনো সহায়তা চাওয়া হয়নি। বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি ইস্যু। এটার সমাধান হওয়া উচিত।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র-সচিব জানান, সাধারণত জাতিসংঘ অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন না। এখন পর্যন্ত সেটা আমরা জানি। যদি দুই পক্ষের সময়সূচি মিলে তাহলে অন্য কোনো উপায়ে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বাড়ানোসহ অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। দলের নেতৃত্বে রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান। এ ছাড়া রয়েছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
প্রতিনিধিদল রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে। পরে বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গেও বৈঠক করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
প্রতিনিধিদলকে গ্রাফিতি আঁকা আর্টবুক দিলেন ইউনূস
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় আঁকা বিভিন্ন গ্রাফিতি নিয়ে একটি আর্টবুক উপহার দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তার সঙ্গে দেখা করার পর সফররত মার্কিন প্রতিনিধিদলকে গ্রাফিতি আঁকা আর্ট বইটি উপহার দেন। আর্ট বইটিতে ঢাকা ও অন্যান্য শহর এবং শহরের দেয়ালে জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময় আঁকা কিছু সেরা শিল্পকর্মের ছবি রয়েছে।
গ্রাফিতিগুলোর ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসব গ্রাফিতি ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার শাসন এবং তার নৃশংস বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী ছাত্র এবং তরুণদের আবেগ, আশা এবং আকাক্সক্ষা ফুটে উঠেছে।
ড. ইউনূস বলেন, আপনাদের ঢাকার দেয়ালের দিকে তাকানোর অনুরোধ করবো। এ গ্রাফিতিগুলো এখনও আছে। শুধু বিপ্লবের পরেই আঁকা হয়নি। জুলাই মাসে বিক্ষোভের সময় ছাত্ররা গ্রাফিতি আঁকার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে, শেখ হাসিনার শাসন ও তার বাহিনীকে অস্বীকার করেছিল।
এসব গ্রাফিতি আঁকার রং-তুলি কীভাবে জোগাড় হয়েছিল সে কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, তাদের কাছে রং ও ব্রাশ কেনার টাকা ছিল না। সাধারণ জনতা বিভিন্নভাবে তাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল।