সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের (কমিশনন্ড) বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন উপদেষ্টা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের কিছু অঞ্চলে নাশকতা, অরাজকতা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার কিছু কর্মকা- ঘটছে।
এসব তৎপরতা রুখে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার ‘সুফল’ জনগণ ভোগ করবে বলে উপদেষ্টারা মনে করছেন।
রাজধানীসহ সারাদেশে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ অর্থাৎ, মঙ্গলবার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। আগামী দুই মাস এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তারা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা বা গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারবেন। এছাড়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা, তল্লাশি পরোয়ানা জারি, অসদাচরণ ও ছোটোখাটো অপরাধের জন্য মুচলেকা আদায়, মুচলেকা থেকে অব্যাহতি, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ, স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বাধা অপসারণ, জনগণের শান্তি বিনষ্ট হতে পারে- এমন কর্মকা- চালানো এবং জনগণের ক্ষতির আশঙ্কা করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৭টি ধারা প্রয়োগের ক্ষমতা পেয়েছেন সেনা কর্মকর্তারা। ধারাগুলো হলো-৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৮৬, ৯৫(২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২।
সিআরপিসির ১৮৯৮-এর ১৭(১) ধারা অনুযায়ী, ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (জেলা প্রশাসক) তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব পালন করবেন বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এটি সারাদেশের জন্য কার্যকর থাকবে।’
আইন উপদেষ্টার ব্যাখ্যা
সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়ার বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
তিনি বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে কিছু কিছু অঞ্চলে বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলগুলোতে নাশকতা, অরাজকতা এবং দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার মতো কিছু কর্মকা- ঘটছে বলে তারা লক্ষ্য করছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়েছে এ পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য। এসব অপতৎপরতা রুখে দেয়ার জন্য, মোকাবিলা করার জন্য।
আইন উপদেষ্টা বলেন, তারা বিশ্বাস করেন সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এর কোনো অপপ্রয়োগ ঘটবে না। তারা আশা করছেন পরিস্থিতির উন্নয়ন হলে সেনাবাহিনীর এই দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।
সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার সুফল ভোগ করবে জনগণ
সেনাবাহিনীর অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার সুফল জনগণ ভোগ করবে বলে মনে করছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
তিনি বুধবার গাজীপুরের সফিপুরে আনসার ও ভিডিপি একাডেমিতে বাহিনীটির ৪০তম বিসিএস (আনসার) ক্যাডার কর্মকর্তা এবং ২৫তম ব্যাচ (পুরুষ) রিক্রুট সিপাহির মৌলিক প্রশিক্ষণের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।
সেনাবাহিনী অনেকদিন ধরে মাঠে থেকে জনগণের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, জনসেবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোতে ‘জনবলের স্বল্পতা’ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেটা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করছে সেনাবাহিনী। মানুষ আরও নিরাপদ বোধ করবে-জনপ্রশাসন সচিব
মানুষ যেন আরও ‘জনবান্ধব পরিবেশে’ চলাচল করতে পারে এবং আরও নিরাপদ বোধ করে সে কারণে সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান। তিনি বুধবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে সব পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে কাজ করছে উল্লেখ করে সিনিয়র সচিব বলেন, মানুষ যাতে আরও জনবান্ধব পরিবেশে চলাচল করতে পারে, নিরাপদ বোধ করে, মানুষের মধ্যে যাতে আস্থা থাকে- এজন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সব বাহিনী একই সঙ্গে একই ছাতার নিচে কাজ করছে, এই ‘ম্যাসেজটার’ জন্যই এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘সরকার মনে করেছে বিস্তৃত পর্যায়ে মাঠের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের সেনাবাহিনী কাজ করছে। তারা মনে করেছে, এটা হলে জনগণ আরও নিরাপদ বোধ করবে। এই মুহূর্তে মনে হয়েছে এটা দরকার। টার্গেট বলে দেয়া হয়েছে মাত্র ৬০ দিন।’
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা আছে, এক্ষেত্রে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে কিনা-জানতে চাইলে সিনিয়র সচিব বলেন, ‘এটা কোনো ক্যাডারের ক্ষমতা না, এটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা। কোনো দ্বন্দ্ব হবে না। এক রাষ্ট্র, এক জনগণ, এক সরকার। জনস্বার্থে আপনি কাজ করেন, আমি কাজ করি। এটা (সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা) ভালো ফল দেবে।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আলী ইমাম মজুমদার একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিরাজমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘শুধুমাত্র’ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাদের হাতে এই ক্ষমতা থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কোনো কোনো জায়গায় তাৎক্ষণিক বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য দুই মাসের জন্য সেনাবাহিনীকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাদের বিচারিক ক্ষমতা নেই। তারা শুধু গ্রেপ্তার করতে পারবে। তিনি এটিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।
ফৌজদারি কার্যবিধির ক্ষমতা
সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৭টি ধারা প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এসব ধরায় ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে বলা আছে।
এসব ধারার ভাষ্য হচ্ছে, যখন ম্যাজিস্ট্রেট দেখতে পান, তার সামনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তখন তিনি অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারেন বা গ্রেপ্তারের আদেশ দিতে পারেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন অথবা গ্রেপ্তারের হুকুম দিতে পারেন।
ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ারের বাইরের এলাকায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে সিআরপিসির ৮৪ ধারায়। এই ধারা ভাষ্য হচ্ছে, বাইরের এলাকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার জন্য ওসিসংশ্লিষ্ট এলাকার ম্যাজিস্ট্রেট অথবা উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুমোদন নেবেন। অনুমোদনের পর ধরে নেয়া হবে, যারা অনুমোদন দিয়েছেন, তারা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার আদেশ দিয়েছেন।
কেবল ম্যাজিস্ট্রেটরা ডাক বা টেলিগ্রাম কর্তৃপক্ষকে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে দলিল অর্পণ করতে বলতে পারেন। পাশাপাশি ডাক ও টেলিগ্রাম কর্তৃপক্ষ দ্বারা ওইসব বস্তুর জন্য তল্লাশি পরিচালনা বা আটক করতে পারেন।
সিআরপিসির অন্যান্য ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে তল্লাশির বিধান বর্ণনা করা আছে। নিজের উপস্থিতিতে তল্লাশি করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দিতে পারেন। আবার কেউ বারবার চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, প্রতারণার কাজে লিপ্ত হন, তাদের কাছ থেকে মুচলেকা নিতে পারবেন ম্যাজিস্ট্রেটরা।
সিআরপিসির ১২৭ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশের আদেশে জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গসংক্রান্ত বিধান সর্ম্পকে বলা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অথবা কোনো থানার ওসি কোনো বেআইনি সমাবেশ অথবা সর্বসাধারণের শান্তি বিনষ্ট হওয়ার কারণ ঘটাতে পারে- এমন পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে কোনো সমাবেশ ছত্রভঙ্গ হওয়ার আদেশ দিতে পারেন।
এর পরও যদি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ না হয় সেক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অথবা থানার ওসি বলপূর্বক সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য অগ্রসর হতে পারবেন। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের আটক কিংবা গ্রেপ্তারও করা যাবে।
দুই দশকের বেশি সময় পর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায় সেনাবাহিনী
এর আগে ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করে অপারেশন ‘ক্লিনহার্ট’ নামে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। ওই অভিযানে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু ও ১২ হাজারের মতো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যু হওয়া লোকজনের বেশিরভাগই ছিল বিএনপির নেতাকর্মী।
ওই সময় সেনাবাহিনী ৮৪ দিন অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান শেষে যেদিন থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার শুরু হয়, তাদের আগের দিন ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ-২০০৩’ জারি করা হয়।
পরবর্তীতে গত দুই দশকে দেশের সব জাতীয় নির্বাচনসহ নানা প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলেও তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ছিল না। ২০০১-এর অষ্টম ও ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মাঠে ছিল অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতোই।
গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃতাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। এর পর সম্প্রতি পোশাক খাতসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অসন্তোষ দেখা দেয়। বিভিন্ন এলাকায় মাজার ভাঙচুর করা হয়। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ সারাদেশে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে গত ১৯ জুলাই রাতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করেছিল বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। এর পর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। তখন সারাদেশে প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল পুলিশ। সে সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে মাঠের পরিস্থিতি সামাল দেয় সেনাবাহিনী।
বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের (কমিশনন্ড) বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন উপদেষ্টা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের কিছু অঞ্চলে নাশকতা, অরাজকতা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার কিছু কর্মকা- ঘটছে।
এসব তৎপরতা রুখে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার ‘সুফল’ জনগণ ভোগ করবে বলে উপদেষ্টারা মনে করছেন।
রাজধানীসহ সারাদেশে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ অর্থাৎ, মঙ্গলবার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। আগামী দুই মাস এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তারা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা বা গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারবেন। এছাড়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা, তল্লাশি পরোয়ানা জারি, অসদাচরণ ও ছোটোখাটো অপরাধের জন্য মুচলেকা আদায়, মুচলেকা থেকে অব্যাহতি, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ, স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বাধা অপসারণ, জনগণের শান্তি বিনষ্ট হতে পারে- এমন কর্মকা- চালানো এবং জনগণের ক্ষতির আশঙ্কা করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৭টি ধারা প্রয়োগের ক্ষমতা পেয়েছেন সেনা কর্মকর্তারা। ধারাগুলো হলো-৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৮৬, ৯৫(২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২।
সিআরপিসির ১৮৯৮-এর ১৭(১) ধারা অনুযায়ী, ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (জেলা প্রশাসক) তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব পালন করবেন বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এটি সারাদেশের জন্য কার্যকর থাকবে।’
আইন উপদেষ্টার ব্যাখ্যা
সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়ার বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
তিনি বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে কিছু কিছু অঞ্চলে বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলগুলোতে নাশকতা, অরাজকতা এবং দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার মতো কিছু কর্মকা- ঘটছে বলে তারা লক্ষ্য করছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়েছে এ পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য। এসব অপতৎপরতা রুখে দেয়ার জন্য, মোকাবিলা করার জন্য।
আইন উপদেষ্টা বলেন, তারা বিশ্বাস করেন সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এর কোনো অপপ্রয়োগ ঘটবে না। তারা আশা করছেন পরিস্থিতির উন্নয়ন হলে সেনাবাহিনীর এই দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।
সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার সুফল ভোগ করবে জনগণ
সেনাবাহিনীর অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার সুফল জনগণ ভোগ করবে বলে মনে করছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
তিনি বুধবার গাজীপুরের সফিপুরে আনসার ও ভিডিপি একাডেমিতে বাহিনীটির ৪০তম বিসিএস (আনসার) ক্যাডার কর্মকর্তা এবং ২৫তম ব্যাচ (পুরুষ) রিক্রুট সিপাহির মৌলিক প্রশিক্ষণের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।
সেনাবাহিনী অনেকদিন ধরে মাঠে থেকে জনগণের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, জনসেবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোতে ‘জনবলের স্বল্পতা’ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেটা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করছে সেনাবাহিনী। মানুষ আরও নিরাপদ বোধ করবে-জনপ্রশাসন সচিব
মানুষ যেন আরও ‘জনবান্ধব পরিবেশে’ চলাচল করতে পারে এবং আরও নিরাপদ বোধ করে সে কারণে সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান। তিনি বুধবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে সব পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে কাজ করছে উল্লেখ করে সিনিয়র সচিব বলেন, মানুষ যাতে আরও জনবান্ধব পরিবেশে চলাচল করতে পারে, নিরাপদ বোধ করে, মানুষের মধ্যে যাতে আস্থা থাকে- এজন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সব বাহিনী একই সঙ্গে একই ছাতার নিচে কাজ করছে, এই ‘ম্যাসেজটার’ জন্যই এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘সরকার মনে করেছে বিস্তৃত পর্যায়ে মাঠের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের সেনাবাহিনী কাজ করছে। তারা মনে করেছে, এটা হলে জনগণ আরও নিরাপদ বোধ করবে। এই মুহূর্তে মনে হয়েছে এটা দরকার। টার্গেট বলে দেয়া হয়েছে মাত্র ৬০ দিন।’
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা আছে, এক্ষেত্রে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে কিনা-জানতে চাইলে সিনিয়র সচিব বলেন, ‘এটা কোনো ক্যাডারের ক্ষমতা না, এটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা। কোনো দ্বন্দ্ব হবে না। এক রাষ্ট্র, এক জনগণ, এক সরকার। জনস্বার্থে আপনি কাজ করেন, আমি কাজ করি। এটা (সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা) ভালো ফল দেবে।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আলী ইমাম মজুমদার একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিরাজমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘শুধুমাত্র’ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাদের হাতে এই ক্ষমতা থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কোনো কোনো জায়গায় তাৎক্ষণিক বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য দুই মাসের জন্য সেনাবাহিনীকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাদের বিচারিক ক্ষমতা নেই। তারা শুধু গ্রেপ্তার করতে পারবে। তিনি এটিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।
ফৌজদারি কার্যবিধির ক্ষমতা
সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৭টি ধারা প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এসব ধরায় ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে বলা আছে।
এসব ধারার ভাষ্য হচ্ছে, যখন ম্যাজিস্ট্রেট দেখতে পান, তার সামনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তখন তিনি অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারেন বা গ্রেপ্তারের আদেশ দিতে পারেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন অথবা গ্রেপ্তারের হুকুম দিতে পারেন।
ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ারের বাইরের এলাকায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে সিআরপিসির ৮৪ ধারায়। এই ধারা ভাষ্য হচ্ছে, বাইরের এলাকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার জন্য ওসিসংশ্লিষ্ট এলাকার ম্যাজিস্ট্রেট অথবা উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুমোদন নেবেন। অনুমোদনের পর ধরে নেয়া হবে, যারা অনুমোদন দিয়েছেন, তারা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার আদেশ দিয়েছেন।
কেবল ম্যাজিস্ট্রেটরা ডাক বা টেলিগ্রাম কর্তৃপক্ষকে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে দলিল অর্পণ করতে বলতে পারেন। পাশাপাশি ডাক ও টেলিগ্রাম কর্তৃপক্ষ দ্বারা ওইসব বস্তুর জন্য তল্লাশি পরিচালনা বা আটক করতে পারেন।
সিআরপিসির অন্যান্য ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে তল্লাশির বিধান বর্ণনা করা আছে। নিজের উপস্থিতিতে তল্লাশি করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দিতে পারেন। আবার কেউ বারবার চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, প্রতারণার কাজে লিপ্ত হন, তাদের কাছ থেকে মুচলেকা নিতে পারবেন ম্যাজিস্ট্রেটরা।
সিআরপিসির ১২৭ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশের আদেশে জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গসংক্রান্ত বিধান সর্ম্পকে বলা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অথবা কোনো থানার ওসি কোনো বেআইনি সমাবেশ অথবা সর্বসাধারণের শান্তি বিনষ্ট হওয়ার কারণ ঘটাতে পারে- এমন পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে কোনো সমাবেশ ছত্রভঙ্গ হওয়ার আদেশ দিতে পারেন।
এর পরও যদি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ না হয় সেক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অথবা থানার ওসি বলপূর্বক সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য অগ্রসর হতে পারবেন। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের আটক কিংবা গ্রেপ্তারও করা যাবে।
দুই দশকের বেশি সময় পর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায় সেনাবাহিনী
এর আগে ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করে অপারেশন ‘ক্লিনহার্ট’ নামে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। ওই অভিযানে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু ও ১২ হাজারের মতো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যু হওয়া লোকজনের বেশিরভাগই ছিল বিএনপির নেতাকর্মী।
ওই সময় সেনাবাহিনী ৮৪ দিন অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান শেষে যেদিন থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার শুরু হয়, তাদের আগের দিন ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ-২০০৩’ জারি করা হয়।
পরবর্তীতে গত দুই দশকে দেশের সব জাতীয় নির্বাচনসহ নানা প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলেও তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ছিল না। ২০০১-এর অষ্টম ও ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মাঠে ছিল অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতোই।
গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃতাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। এর পর সম্প্রতি পোশাক খাতসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অসন্তোষ দেখা দেয়। বিভিন্ন এলাকায় মাজার ভাঙচুর করা হয়। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ সারাদেশে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে গত ১৯ জুলাই রাতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করেছিল বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। এর পর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। তখন সারাদেশে প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল পুলিশ। সে সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে মাঠের পরিস্থিতি সামাল দেয় সেনাবাহিনী।