নবায়ণযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সৌর বিদ্যুতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি দেশ। দ্রুত পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ রয়েছে আন্তর্জাতিক মহল থেকে। এরমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ৩১টি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা দেয়ায় সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিগত সরকারের আমলে বেশকিছু সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মেনে হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই প্রকল্পগুলো স্থগিত করা হয়েছে; তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এরমধ্যে গুরুতর অভিযোগ হলো- বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অনুবিভাগ থেকে এমন কিছু প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যেগুলো সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের প্রধান কয়েকটি শর্ত পূরণ করেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অনেকগুলো প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে যেগুলোতে কৃষি জমিকে শ্রেণী পরিবর্তন করে অকৃষি জমি দেখানো হয়েছে। এছাড়া, বেশকিছু কেন্দ্রের বিদ্যুতের ট্যারিফ (দর) নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
হঠাৎ সৌর প্রকল্প
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে বিগত সরকারের একটা সময়ে হঠাৎ করে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। এ খাতে বিনিয়োগে বড় অঙ্কের লাভের আশায় ব্যবসায়ীদের অনেকেই সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন পেতে দৌড়ঝাপ শুরু করেন। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগ নানা অযুহাতে অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি করে রাখতো। মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে ব্যবসায়ীদের অনেকেই প্রাথমিক শর্ত পূরণের পরও প্রকল্প স্থাপনের অনুমোদন নিতে পারেননি।
জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা একটি সিন্ডিকেট প্রকল্প অনুমোদন দেয়া ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতো। ওই সিন্ডিকেটের নির্দেশনার বাইরে কেউ প্রকল্পের অনুমোদন পেতেন না। এরমধ্যে, বিশেষ আইনের অধীনে সরকার দলীয় লোকজন কিছু প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন। দলের বাইরে কেউ কেউ মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, অনুমোদন পাওয়ার পরও উদ্যোক্তা অনেকেই কেন্দ্র নির্মাণে জমির ব্যবস্থা ও বিনিয়োগও নিশ্চিত করতে পারেননি। অভিযোগ রয়েছে, কাগজে-কলমে অনেকেই সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন নিতে আগ্রহী ছিলেন। তবে এ খাতে বিনিয়োগের জন্য নয়, কাগজ (অনুমোদান) বিক্রি করার জন্য। তবে চাহিদা অনুযায়ী মূল্য না পাওয়ায় অনেকের কাগজ, বিক্রি হয়নি। প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয়নি।
ফলে বিগত সরকার যে গতিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল, প্রকল্প বাস্তবায়নে সে গতি ধরে রাখতে পারেনি।
বিশেষ আইন
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পরই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেয়া ৩১টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতের বিশেষ আইনের অধীনে নেয়া এসব প্রকল্পের বিপরীতে এরই মধ্যে আগ্রহপত্র (লেটার অব ইনটেন্ট - এলওআই) দেয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিতর্কিত বিশেষ আইনে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকল্পগুলো অনুমোদান দেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের অধিকাংশের মালিকই আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সাবেক ধর্মমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ত্রাণমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা নবায়নযোগ্য প্রকল্পের অনুমোদন নিয়েছেন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি অনুবিভাগ
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘নবায়নযোগ্য খাতটি যিনি দেখভাল করতেন তিনি তো এখন আর এই অনুবিভাগে নেই।’ এর বেশি আর কিছু বলতে চাননি তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অনুবিভাগে দীর্ঘদিন দায়িত্বে ছিলেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নিরোদ চন্ত্র ম-ল। সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেডের (বিআরপিএল) পরিচালকের পদটিও তার দখলে। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৬৩.২০ শতাংশ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের, ১৮.৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এবং অবশিষ্ট ১৮.৪ শতাংশ রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) এর মালিকানায় রয়েছে।
এই কোম্পানিটি জামালপুরের মাদারগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করছে, যার অনুমোদন নিরোদ চন্দ্র ম-লের শাখা থেকে হয়েছিল। প্রকল্পটিতে চীনা কোম্পানি সিআরইসি ইন্টারন্যাশনাল রিনিউয়েবলকে ৭০ শতাংশ মালিকানা দেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে কোনো যৌথ বিনিয়োগী প্রকল্পে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ শতাংশের বেশি মালিকানা দেয়ার নজির নেই।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নিরোদ চন্দ্র ম-ল বি-আর পাওয়ারজেনের একটি দামি জিপ গাড়ি ব্যবহার করতেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে নিরোদ চন্দ্র ম-লকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অনুবিভাগ থেকে সরিয়ে দেয়।
***বিদ্যুৎ-জ্বালানি উপদেষ্টার নির্দেশনা***
৩১টি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাতিলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জেষ্ঠ্য একজন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন পেয়েছে সেগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে অনুমোদন দেয়া হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
তিনি বলেন, ‘একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটি সদস্যদের বলা হয়েছে, তারা মূলত প্রকল্পগুলো সঠিক প্রক্রিয়ায় দেয়া হয়েছে কিনা সেগুলো পরীক্ষা করে দেখবেন। অনিয়ম পাওয়া গেলে তা অবহিত করবেন এবং সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবেন।’
তিনি বলেন, ‘দলীয় বিবেচনায় অনুমোদন, কৃষি জমিকে অকৃষি দেখানো, বিদ্যুৎ ক্রয়ে দাম বেশি ধরে সুবিধা দেয়া এবং অনুমোদনের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও অনুসন্ধান করা হবে।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ও বিক্রির দাম কতটা বেশি ধরা হচ্ছে তাও যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের মাননীয় উপদেষ্টা। আমরা দেখছি, বাংলাদেশে ৯ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত ট্যারিফ। ভারতে, পাকিস্তানে কিন্তু আরও কম।’
***তালিকায় যেসব প্রকল্প***
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ৩১ টি প্রকল্পের মধ্যে জামালপুরের মাদারগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে। তালিকায় রয়েছে পাবনা ৬৪ মেগাওয়াট সৌর পার্ক (পিপিএ ও আইএ স্বাক্ষরিত), কুড়িগ্রাম ৪০ মেগাওয়াট। এই দুটি প্রকল্পের তথ্য কারিগরি কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। তালিকায় থাকা বাগেরহাটের রামপাল ৩০০ মেগাওয়াট সৌর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিশেষ আইনের আওতায় রামপালে সৌদি অ্যাকোয়া পাওয়ার এবং দেশি মিডল্যান্ড পাওয়ারকে প্রায় এক হাজার একর জায়গার ৭৫ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে এলওআই ইস্যু করা হয়েছে। পটুয়াখালীর পায়রায় ২৬ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সার সংক্ষেপ অনুমোদন হয়েছে; নেগোসিয়েশন প্রক্রিয়াধীন।
তালিকায় আরও আছে, জেভি অব ইজিসিবি অ্যান্ড মারুবিনি করপোরেশনের সোনাগাজী ফেনী ১৬০ মেগাওয়াট, এএসকে আজান্তা কনসোর্টিয়ামের ডিমলা নীলফামারী ৫০ মেগাওয়াট, কনর্সোটিয়াম অব ডিসিএইচ এল পিটিই প্রাইভেট লিমিটেড পাওয়ারনিটেক এনার্জি লিমিটেডের কক্সবাজারে ১০০ মেগাওয়াট, জেটি নিউ এনার্জি কোম্পানি লিমিটেডের চকরিয়া কক্সবাজার ২২০ মেগাওয়াট, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানিতে ১০০ মেগাওয়াট ফেøাটিং সোলার বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
আরও আছে জেভি অব পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেড অ্যান্ড সুমিটোমা করপোরেশন এর সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র জেভি অব এনার্জন রিউনিব্যাল (বিডি) এবং পিডব্লিউআর। ম্যাক্স-এইচবিজি কনর্সোটিয়ামের জামালপুর ১৬৩ মেগাওয়াট, সোনাগাজী ফেনীতে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
তালিকায় আছে, বিইআইএইচসিএল-বিজেডএইচই-এনাম-এমএনএস কনর্সোটিয়াম এর সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কনসোর্টিয়াম অব ক্যসিওপিএ ফ্যাশন লিমিটেড, জিয়াজি ক্লিন এনার্জি একুইপমেন্ট ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি লিমিটেড কর্তক গৌরীপুর ময়মনসিংহ ১০০ মেগাওয়াট, কেএআই-এলটেক কনসোর্টিয়ামের মাছুয়াখালী কক্সবাজার ১০০ মেগাওয়াট (এসি), রিউপল-বাদল জিটেক কনসোর্টিয়ামের সাবাইল টাঙ্গালাইল ১০০ মেগাওয়াট, সৌদি-জার্মান পাওয়ার প্লান্ট লিমিটেড এর ব্রাঞ্চমবাড়িয়া সোলার, কসবা আখাউড়া, মাধবপুর, ভৈরব পৌরসভার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প, গ্লোবাল গ্রিনজিয়া লিমিটেড এর নোয়াখালী সদর নোয়াখালী ১০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, সাস্টেনেবল এনার্জি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সাতক্ষীরা ১০০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প, প্যারাগন এনার্জি লিমিটেড এর নেত্রকোনায় ৫০ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প।
এছাড়া আছে, জেবি অব এইপিসিএল অ্যান্ড এক্সিয়া কর্তৃক মোংলা বাগেরহাট ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, নিউ টেক সোলার এনার্জি লিমিটেড এর চকরিয়া ৩০ মেগাওয়াট, জেবি অব এনার্গন রিউনিব্যাল এনার্জি লিমিটেড এর ত্রিশাল ময়মনসিংহ ২৪০ মেগাওয়াট, জুলস পাওয়ার লিমিটেড এর কক্সবাজার সদর ৫০ মেগাওয়াট, জেভি অব এনার্গন রিউনিব্যাল এনার্জি লিমিটেড খুলনা ১০০ মেগাওয়াট (এসি), লামা বান্দরবান ৭০ মেগাওয়াট, থিনভু ড্রিম কনসর্টিয়াম কোম্পানির সিলেটের মৌলভীবাজার ১০০ মেগাওয়াট, সিডিটিও এনগ্রিন কোম্পানির রাজবাড়ী ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প।
***পর্যালোচনা***
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘৩১ টি প্রকল্প সরসরি বাতিল বলা যাবে না। এগুলো বিশেষ আইনের অধীনে করা। ফলে স্থগিত রাখা হয়েছে। পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।’ তবে তার মতে, অধিকাংশই প্রকল্পই বাতিল হতে পারে।
পিডিবির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ৩১ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১ হাজার ৩৭৮ মেগাওয়াট; যা মোট সক্ষমতার এর মধ্যে অফ-গ্রিড উৎস থেকে ৩৮০ মেগাওয়াট উৎপাদিত হচ্ছে। বাকি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪
নবায়ণযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সৌর বিদ্যুতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি দেশ। দ্রুত পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ রয়েছে আন্তর্জাতিক মহল থেকে। এরমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ৩১টি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা দেয়ায় সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিগত সরকারের আমলে বেশকিছু সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মেনে হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই প্রকল্পগুলো স্থগিত করা হয়েছে; তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এরমধ্যে গুরুতর অভিযোগ হলো- বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অনুবিভাগ থেকে এমন কিছু প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যেগুলো সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের প্রধান কয়েকটি শর্ত পূরণ করেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অনেকগুলো প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে যেগুলোতে কৃষি জমিকে শ্রেণী পরিবর্তন করে অকৃষি জমি দেখানো হয়েছে। এছাড়া, বেশকিছু কেন্দ্রের বিদ্যুতের ট্যারিফ (দর) নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
হঠাৎ সৌর প্রকল্প
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে বিগত সরকারের একটা সময়ে হঠাৎ করে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। এ খাতে বিনিয়োগে বড় অঙ্কের লাভের আশায় ব্যবসায়ীদের অনেকেই সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন পেতে দৌড়ঝাপ শুরু করেন। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগ নানা অযুহাতে অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি করে রাখতো। মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে ব্যবসায়ীদের অনেকেই প্রাথমিক শর্ত পূরণের পরও প্রকল্প স্থাপনের অনুমোদন নিতে পারেননি।
জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা একটি সিন্ডিকেট প্রকল্প অনুমোদন দেয়া ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতো। ওই সিন্ডিকেটের নির্দেশনার বাইরে কেউ প্রকল্পের অনুমোদন পেতেন না। এরমধ্যে, বিশেষ আইনের অধীনে সরকার দলীয় লোকজন কিছু প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন। দলের বাইরে কেউ কেউ মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, অনুমোদন পাওয়ার পরও উদ্যোক্তা অনেকেই কেন্দ্র নির্মাণে জমির ব্যবস্থা ও বিনিয়োগও নিশ্চিত করতে পারেননি। অভিযোগ রয়েছে, কাগজে-কলমে অনেকেই সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন নিতে আগ্রহী ছিলেন। তবে এ খাতে বিনিয়োগের জন্য নয়, কাগজ (অনুমোদান) বিক্রি করার জন্য। তবে চাহিদা অনুযায়ী মূল্য না পাওয়ায় অনেকের কাগজ, বিক্রি হয়নি। প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয়নি।
ফলে বিগত সরকার যে গতিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল, প্রকল্প বাস্তবায়নে সে গতি ধরে রাখতে পারেনি।
বিশেষ আইন
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পরই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেয়া ৩১টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতের বিশেষ আইনের অধীনে নেয়া এসব প্রকল্পের বিপরীতে এরই মধ্যে আগ্রহপত্র (লেটার অব ইনটেন্ট - এলওআই) দেয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিতর্কিত বিশেষ আইনে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকল্পগুলো অনুমোদান দেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের অধিকাংশের মালিকই আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সাবেক ধর্মমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ত্রাণমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা নবায়নযোগ্য প্রকল্পের অনুমোদন নিয়েছেন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি অনুবিভাগ
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘নবায়নযোগ্য খাতটি যিনি দেখভাল করতেন তিনি তো এখন আর এই অনুবিভাগে নেই।’ এর বেশি আর কিছু বলতে চাননি তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অনুবিভাগে দীর্ঘদিন দায়িত্বে ছিলেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নিরোদ চন্ত্র ম-ল। সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেডের (বিআরপিএল) পরিচালকের পদটিও তার দখলে। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৬৩.২০ শতাংশ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের, ১৮.৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এবং অবশিষ্ট ১৮.৪ শতাংশ রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) এর মালিকানায় রয়েছে।
এই কোম্পানিটি জামালপুরের মাদারগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করছে, যার অনুমোদন নিরোদ চন্দ্র ম-লের শাখা থেকে হয়েছিল। প্রকল্পটিতে চীনা কোম্পানি সিআরইসি ইন্টারন্যাশনাল রিনিউয়েবলকে ৭০ শতাংশ মালিকানা দেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে কোনো যৌথ বিনিয়োগী প্রকল্পে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ শতাংশের বেশি মালিকানা দেয়ার নজির নেই।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নিরোদ চন্দ্র ম-ল বি-আর পাওয়ারজেনের একটি দামি জিপ গাড়ি ব্যবহার করতেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে নিরোদ চন্দ্র ম-লকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অনুবিভাগ থেকে সরিয়ে দেয়।
***বিদ্যুৎ-জ্বালানি উপদেষ্টার নির্দেশনা***
৩১টি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাতিলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জেষ্ঠ্য একজন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন পেয়েছে সেগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে অনুমোদন দেয়া হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
তিনি বলেন, ‘একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটি সদস্যদের বলা হয়েছে, তারা মূলত প্রকল্পগুলো সঠিক প্রক্রিয়ায় দেয়া হয়েছে কিনা সেগুলো পরীক্ষা করে দেখবেন। অনিয়ম পাওয়া গেলে তা অবহিত করবেন এবং সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবেন।’
তিনি বলেন, ‘দলীয় বিবেচনায় অনুমোদন, কৃষি জমিকে অকৃষি দেখানো, বিদ্যুৎ ক্রয়ে দাম বেশি ধরে সুবিধা দেয়া এবং অনুমোদনের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও অনুসন্ধান করা হবে।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ও বিক্রির দাম কতটা বেশি ধরা হচ্ছে তাও যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের মাননীয় উপদেষ্টা। আমরা দেখছি, বাংলাদেশে ৯ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত ট্যারিফ। ভারতে, পাকিস্তানে কিন্তু আরও কম।’
***তালিকায় যেসব প্রকল্প***
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ৩১ টি প্রকল্পের মধ্যে জামালপুরের মাদারগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে। তালিকায় রয়েছে পাবনা ৬৪ মেগাওয়াট সৌর পার্ক (পিপিএ ও আইএ স্বাক্ষরিত), কুড়িগ্রাম ৪০ মেগাওয়াট। এই দুটি প্রকল্পের তথ্য কারিগরি কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। তালিকায় থাকা বাগেরহাটের রামপাল ৩০০ মেগাওয়াট সৌর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিশেষ আইনের আওতায় রামপালে সৌদি অ্যাকোয়া পাওয়ার এবং দেশি মিডল্যান্ড পাওয়ারকে প্রায় এক হাজার একর জায়গার ৭৫ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে এলওআই ইস্যু করা হয়েছে। পটুয়াখালীর পায়রায় ২৬ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সার সংক্ষেপ অনুমোদন হয়েছে; নেগোসিয়েশন প্রক্রিয়াধীন।
তালিকায় আরও আছে, জেভি অব ইজিসিবি অ্যান্ড মারুবিনি করপোরেশনের সোনাগাজী ফেনী ১৬০ মেগাওয়াট, এএসকে আজান্তা কনসোর্টিয়ামের ডিমলা নীলফামারী ৫০ মেগাওয়াট, কনর্সোটিয়াম অব ডিসিএইচ এল পিটিই প্রাইভেট লিমিটেড পাওয়ারনিটেক এনার্জি লিমিটেডের কক্সবাজারে ১০০ মেগাওয়াট, জেটি নিউ এনার্জি কোম্পানি লিমিটেডের চকরিয়া কক্সবাজার ২২০ মেগাওয়াট, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানিতে ১০০ মেগাওয়াট ফেøাটিং সোলার বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
আরও আছে জেভি অব পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেড অ্যান্ড সুমিটোমা করপোরেশন এর সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র জেভি অব এনার্জন রিউনিব্যাল (বিডি) এবং পিডব্লিউআর। ম্যাক্স-এইচবিজি কনর্সোটিয়ামের জামালপুর ১৬৩ মেগাওয়াট, সোনাগাজী ফেনীতে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
তালিকায় আছে, বিইআইএইচসিএল-বিজেডএইচই-এনাম-এমএনএস কনর্সোটিয়াম এর সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কনসোর্টিয়াম অব ক্যসিওপিএ ফ্যাশন লিমিটেড, জিয়াজি ক্লিন এনার্জি একুইপমেন্ট ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি লিমিটেড কর্তক গৌরীপুর ময়মনসিংহ ১০০ মেগাওয়াট, কেএআই-এলটেক কনসোর্টিয়ামের মাছুয়াখালী কক্সবাজার ১০০ মেগাওয়াট (এসি), রিউপল-বাদল জিটেক কনসোর্টিয়ামের সাবাইল টাঙ্গালাইল ১০০ মেগাওয়াট, সৌদি-জার্মান পাওয়ার প্লান্ট লিমিটেড এর ব্রাঞ্চমবাড়িয়া সোলার, কসবা আখাউড়া, মাধবপুর, ভৈরব পৌরসভার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প, গ্লোবাল গ্রিনজিয়া লিমিটেড এর নোয়াখালী সদর নোয়াখালী ১০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, সাস্টেনেবল এনার্জি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সাতক্ষীরা ১০০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প, প্যারাগন এনার্জি লিমিটেড এর নেত্রকোনায় ৫০ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প।
এছাড়া আছে, জেবি অব এইপিসিএল অ্যান্ড এক্সিয়া কর্তৃক মোংলা বাগেরহাট ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, নিউ টেক সোলার এনার্জি লিমিটেড এর চকরিয়া ৩০ মেগাওয়াট, জেবি অব এনার্গন রিউনিব্যাল এনার্জি লিমিটেড এর ত্রিশাল ময়মনসিংহ ২৪০ মেগাওয়াট, জুলস পাওয়ার লিমিটেড এর কক্সবাজার সদর ৫০ মেগাওয়াট, জেভি অব এনার্গন রিউনিব্যাল এনার্জি লিমিটেড খুলনা ১০০ মেগাওয়াট (এসি), লামা বান্দরবান ৭০ মেগাওয়াট, থিনভু ড্রিম কনসর্টিয়াম কোম্পানির সিলেটের মৌলভীবাজার ১০০ মেগাওয়াট, সিডিটিও এনগ্রিন কোম্পানির রাজবাড়ী ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প।
***পর্যালোচনা***
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘৩১ টি প্রকল্প সরসরি বাতিল বলা যাবে না। এগুলো বিশেষ আইনের অধীনে করা। ফলে স্থগিত রাখা হয়েছে। পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।’ তবে তার মতে, অধিকাংশই প্রকল্পই বাতিল হতে পারে।
পিডিবির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ৩১ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১ হাজার ৩৭৮ মেগাওয়াট; যা মোট সক্ষমতার এর মধ্যে অফ-গ্রিড উৎস থেকে ৩৮০ মেগাওয়াট উৎপাদিত হচ্ছে। বাকি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে।