alt

জাতীয়

কপ২৯ এর প্রেক্ষাপট : সামগ্রিক মূল্যায়ন এবং জলবায়ু অর্থায়ন

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

: সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৯) একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এবারও হতাশাজনক ফলাফল নিয়ে শেষ হয়েছে কপ২৯ সম্মেলন। দীর্ঘ তেত্রিশ ঘণ্টার আলোচনার পর ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করেছে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। জাতিসংঘ জলবায়ু সংস্থার প্রধান সাইমন স্টেইল একে ‘কঠিন যাত্রা’ বলেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো এই অঙ্গীকারকে দুর্বল পদক্ষেপ মনে করে হতাশা প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, ঝুঁকি মোকাবিলায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সম্মেলনের প্রথম দিনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আশা করা হয়েছিল। প্যারিস চুক্তির আওতায় জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন এবং বৈশ্বিক মূল্যায়নে গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রায় ২০০ দেশের নেতারা দরিদ্র দেশগুলোকে আরও অর্থসহায়তা প্রদানের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইউএনইপি রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর দৈনিক ১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, তারা পাচ্ছে মাত্র ৭৫ মিলিয়ন ডলার।

সম্মেলন শেষে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড, নতুন যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য (এনসিকিউজি) ইত্যাদির মতো বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তহবিল বরাদ্দ ও তহবিলের কাঠামো নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোগ করে যে, ধনী দেশগুলো তাদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন থেকে পিছু হটেছে, ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। পাশাপাশি, কপ২৯-এ তহবিলের খসড়া প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যাত হয়।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একে সংকট উল্লেখ করেন এবং দ্রুত অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট মুখতার বাবায়েভ কপ ২৯-কে ‘প্যারিস চুক্তির সত্যের মুহূর্ত’ বলেন। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিয়েল জলবায়ু সংকটে দুর্বল দেশগুলোর ক্ষতির কথা তুলে ধরেন। কপ ২৯-এ নতুন বৈশ্বিক আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ এবং কার্বন বাজারের নিয়ম চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সিভিল সোসাইটি গ্রুপগুলো কার্বন বাজারের ট্রেডিং প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করেছে। তারা মনে করেছিল, এই প্রক্রিয়া দক্ষিণের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। গ্লোবাল উইটনেসের তথ্যমতে, ২০২২ সালে তেল ও গ্যাস শিল্প ৪ ট্রিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছিল, যা জলবায়ু ক্ষতির বার্ষিক ব্যয়ের ১০ গুণ। জাতিসংঘের লস এন্ড ড্যামেজ তহবিলে মাত্র ০.২% এরও কম বরাদ্দ হয়েছিল। মার্কিন দূত জন পোডেস্টা দাবি করেছিলেন, ডনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু নীতি মন্থর করলেও তা স্থগিত করা যাবে না। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আইআরএ আইন ক্লিন এনার্জি খাতে বিনিয়োগ চালিয়ে যাবে।

ইউএনএইচসিআরের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু সংকটের কারণে বাস্তুচ্যুত ১২০ মিলিয়ন মানুষের দুর্দশা প্রকাশিত হয়। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ২০৩৫ সালের মধ্যে ৮১% কার্বন নির্গমন কমানোর ঘোষণা দেন। কাজাখস্তান ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেয়। মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের জলবায়ু সংকটের অগ্রাধিকার চূড়ান্ত ঘোষণায় অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রচেষ্টা চালান।

কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলনের তৃতীয় দিনে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ২০২৪ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গমন ২০১৫ সালের তুলনায় ৮% বেশি হবে। ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে এখনও সুযোগ আছে, তবে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি।

এ সময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতারা জলবায়ু তহবিল বাড়িয়ে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার করার প্রস্তাব দেন। সুইডেন লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলে ২০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয়। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ২০৩৫ সালের মধ্যে ৮১% নির্গমন কমানোর লক্ষ্য ঘোষণা করেন এবং ১০০% ক্লিন এনার্জি সরবরাহ নিশ্চিতের পরিকল্পনা করেন।

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ভোগবিলাস কমিয়ে একটি নতুন সংস্কৃতির আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দরিদ্র দেশগুলোকে অর্থ চাইতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা অপমানজনক। পাকিস্তান এবং ইরানের নেতারাও তার বক্তব্য সমর্থন করেন। মুহাম্মদ ইউনূস জলবায়ু সমস্যার সমাধানে পানির সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেন। তিনি নেপাল ও ভুটানের জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে একটি দক্ষিণ এশিয়া গ্রিড তৈরির আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি তিন শূন্য নীতির মাধ্যমে নতুন সভ্যতা তৈরির কথা বলেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস বলেন, ২০২৪ সাল সবচেয়ে উষ্ণ বছর হতে পারে, তবে ক্লিন এনার্জির বিপ্লব থামবে না।

২৬তম গ্লাসগো সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড কার্যকর করার আলোচনা শুরু হলেও ২৯তম কপ সম্মেলনেও তা বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এবারের কপকে ‘ক্লাইমেট ফাইন্যান্স কপ’ নামে অভিহিত করা হলেও উন্নত দেশগুলো ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল নিয়ে একমত হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো নতুন ও অতিরিক্ত তহবিল, ঋণের বদলে অনুদান এবং সুস্পষ্ট ফান্ড সংজ্ঞার দাবি করলেও সেগুলো উপেক্ষিত রয়ে গেছে।

আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই জলবায়ু সংকটকে ‘সমাজতান্ত্রিক মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করে কপ২৯ থেকে তার প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করে নেয়, যা আর্জেন্টিনার বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ফ্রান্সকে নিয়ে আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতির মন্তব্যের পর ফ্রান্সের পরিবেশ মন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দেননি।

কপ২৯-এ আর্থিক আলোচনা ধীরগতিতে এগিয়েছে, যা ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি প্রতিস্থাপনে ব্যর্থ। জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা নবায়নযোগ্য শক্তির অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে। অথচ কপ২৯ এর প্রধান লক্ষ্য ছিল লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠন, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া। জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলো এই সম্মেলনে বেশি প্রভাব ফেলেছে, এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণের সম্ভাবনা কমে গেছে।

পরবর্তী সম্মেলনে, ধনী দেশগুলো লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে অর্থায়ন করবে কিনা- তা এখন বড় প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন শুধু সেই দেশগুলোতে হওয়া উচিত, যারা জীবাশ্ম জ্বালানি লবিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়।

কপ২৯-এ ৮৫,০০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করলেও, জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের উপস্থিতি ব্যাপক ছিল। ১৩২টি জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির প্রতিনিধিকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। জীবাশ্ম জ্বালানি সংশ্লিষ্ট প্রায় ১,৭৭৩ জন লবিস্ট সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোর জন্য প্রতি বছর ১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, যার এক-তৃতীয়াংশ ধনী দেশগুলির কাছ থেকে আসা উচিত। কিছু অর্থনীতিবিদ জলবায়ু তহবিল সংগ্রহের জন্য নতুন উৎস যেমন- প্লাস্টিক উৎপাদনে শুল্ক বা সম্পদ কর প্রস্তাব করেছেন।

দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব জনসংখ্যার ১৫% ধারণ করলেও বায়ুম-লে প্রায় ৬০% কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনে অবদান রেখেছে।

জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনা থেকে বোঝা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এখনও অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। বিশেষত, কার্বন বাজারের আর্টিকেল ৬-এর অধীনে নির্গমন হ্রাসের নিয়ম প্রণয়নে স্বচ্ছতার অভাব এবং কার্যকর জবাবদিহিতার ঘাটতি ছিল স্পষ্ট।

প্যারিস চুক্তি সত্ত্বেও উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতার অভাব এবং জলবায়ু অর্থায়নে অগ্রগতির ধীরগতি, সম্মেলনের সফলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২০২৩ সালে ৫৭.৪ গিগাটন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের তথ্য জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট করেছে। এর ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশসহ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা ও জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তি প্রয়োজনের কথা জানিয়েছে।

সার্বিকভাবে, কপ২৯ সম্মেলন কিছু প্রস্তাবনায় অগ্রগতি আনলেও কার্যকর পরিবর্তনের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে এই সংকট মোকাবিলা করা অসম্ভব।

অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়

ছবি

শ্রমিক অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, শ্রম আইন সংশোধনে বাংলাদেশের উদ্যোগ

ছবি

মাতারবাড়ী প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ, প্রকল্প পরিচালকের পলায়ন

ছবি

সারাদেশে দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসজনিত রোগে ভুগছে ৬৫ লাখ মানুষ

‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান’-এর আহ্বায়ক মোস্তফা পুলিশ হেফাজতে

দশ মাসে নির্যাতনের শিকার ১৩০০ নারী-শিশু

ছবি

পত্রিকা বন্ধের জন্য চাপ প্রয়োগ সহ্য করা হবে না : নাহিদ

ছবি

ট্রাইব্যুনালের সংশোধিত আইনে যুদ্ধাপরাধের বিচারও চলবে

ছবি

ঢাকা মহানগরে ব্যাটারিচালিত রিকশা আপাতত চলাচল করতে পারবে

ছবি

মানুষের হৃদয় স্পর্শ করার ট্রেনিং কতটুকু পাচ্ছি : স্বাস্থ্য উপদেষ্টা

ছবি

ফের আগারগাঁওয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সড়ক অবরোধ

ছবি

ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে অটোরিকশাচালকরা

ছবি

আহমদুল কবির ছিলেন মেহনতি মানুষের জন্য নিবেদিত আদর্শবান মানুষ

ছবি

নির্বাচনের ঘোষণা হবে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে, বাকিদের কথা ব্যক্তিগত: প্রেস উইং

ছবি

জোড়া লাগানো নূহা ও নাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে

সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিখোঁজ ইসরায়েলি নাগরিকের মরদেহ উদ্ধার, ইসরায়েলের নিন্দা

ছবি

ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় ১১ মৃত্যু, চলতি বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড

ছবি

পাঁচ বিসিএসে নিয়োগ হবে ১৮ হাজারের বেশি কর্মকর্তা

ছবি

সিইসি ও চার কমিশনার শপথ নিলেন

ছবি

নূরুল কবিরকে হয়রানির ঘটনায় তদন্ত শুরু

ছবি

প্রেস ক্লাবে হাজারো ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক, যান চলাচল বন্ধ

ছবি

অবশেষে দরিদ্র দেশগুলোকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি

ছবি

নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ইসিদের শপথ দুপুরে

ছবি

বিমানবন্দরে হয়রানির অভিযোগ: তদন্তের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

ছবি

বিদেশে স্বাস্থ্য সেবা নিতে প্রতিবছর ব্যয় হচ্ছে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি: ডিসিসিআই সেমিনারে বক্তারা

ছবি

জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের আত্নমর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছে: নাহিদ ইসলাম

ছবি

ডেঙ্গুতে একদিনে ১০ জনের মৃত্যু

ছবি

ভারতের কোনও যুক্তিই নেই আমাদের পানি না দেওয়ার: অর্থ উপদেষ্টা

ছবি

দুর্ঘটনায় অক্টোবর মাসে ৫৭৫ জন হারিয়েছে প্রাণ

ছবি

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হওয়া উচিত: তোফায়েল আহমেদ

ছবি

সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব, বিবেচনার আশ্বাস বদিউলের

ছবি

বিদেশে উচ্চ বেতনের চাকরির ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশিদের জিম্মি হওয়ার ঘটনা, সতর্কতা জারি করেছে দূতাবাস

ছবি

আসন সংরক্ষণ ও আলাদা নির্বাচনব্যবস্থার দাবি হিন্দু মহাজোটের

ছবি

নতুন সিইসি-ইসিদের শপথ রোববার

ছবি

সশস্ত্র বাহিনী দিবসে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানদের সাক্ষাৎ

ছবি

দায়ীদের বিচারের পরই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে: ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ছবি

যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশের মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকুক: পররাষ্ট্র দপ্তর

tab

জাতীয়

কপ২৯ এর প্রেক্ষাপট : সামগ্রিক মূল্যায়ন এবং জলবায়ু অর্থায়ন

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৯) একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এবারও হতাশাজনক ফলাফল নিয়ে শেষ হয়েছে কপ২৯ সম্মেলন। দীর্ঘ তেত্রিশ ঘণ্টার আলোচনার পর ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করেছে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। জাতিসংঘ জলবায়ু সংস্থার প্রধান সাইমন স্টেইল একে ‘কঠিন যাত্রা’ বলেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো এই অঙ্গীকারকে দুর্বল পদক্ষেপ মনে করে হতাশা প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, ঝুঁকি মোকাবিলায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সম্মেলনের প্রথম দিনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আশা করা হয়েছিল। প্যারিস চুক্তির আওতায় জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন এবং বৈশ্বিক মূল্যায়নে গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রায় ২০০ দেশের নেতারা দরিদ্র দেশগুলোকে আরও অর্থসহায়তা প্রদানের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইউএনইপি রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর দৈনিক ১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, তারা পাচ্ছে মাত্র ৭৫ মিলিয়ন ডলার।

সম্মেলন শেষে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড, নতুন যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য (এনসিকিউজি) ইত্যাদির মতো বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তহবিল বরাদ্দ ও তহবিলের কাঠামো নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোগ করে যে, ধনী দেশগুলো তাদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন থেকে পিছু হটেছে, ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। পাশাপাশি, কপ২৯-এ তহবিলের খসড়া প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যাত হয়।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একে সংকট উল্লেখ করেন এবং দ্রুত অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট মুখতার বাবায়েভ কপ ২৯-কে ‘প্যারিস চুক্তির সত্যের মুহূর্ত’ বলেন। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিয়েল জলবায়ু সংকটে দুর্বল দেশগুলোর ক্ষতির কথা তুলে ধরেন। কপ ২৯-এ নতুন বৈশ্বিক আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ এবং কার্বন বাজারের নিয়ম চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সিভিল সোসাইটি গ্রুপগুলো কার্বন বাজারের ট্রেডিং প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করেছে। তারা মনে করেছিল, এই প্রক্রিয়া দক্ষিণের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। গ্লোবাল উইটনেসের তথ্যমতে, ২০২২ সালে তেল ও গ্যাস শিল্প ৪ ট্রিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছিল, যা জলবায়ু ক্ষতির বার্ষিক ব্যয়ের ১০ গুণ। জাতিসংঘের লস এন্ড ড্যামেজ তহবিলে মাত্র ০.২% এরও কম বরাদ্দ হয়েছিল। মার্কিন দূত জন পোডেস্টা দাবি করেছিলেন, ডনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু নীতি মন্থর করলেও তা স্থগিত করা যাবে না। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আইআরএ আইন ক্লিন এনার্জি খাতে বিনিয়োগ চালিয়ে যাবে।

ইউএনএইচসিআরের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু সংকটের কারণে বাস্তুচ্যুত ১২০ মিলিয়ন মানুষের দুর্দশা প্রকাশিত হয়। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ২০৩৫ সালের মধ্যে ৮১% কার্বন নির্গমন কমানোর ঘোষণা দেন। কাজাখস্তান ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেয়। মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের জলবায়ু সংকটের অগ্রাধিকার চূড়ান্ত ঘোষণায় অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রচেষ্টা চালান।

কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলনের তৃতীয় দিনে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ২০২৪ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গমন ২০১৫ সালের তুলনায় ৮% বেশি হবে। ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে এখনও সুযোগ আছে, তবে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি।

এ সময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতারা জলবায়ু তহবিল বাড়িয়ে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার করার প্রস্তাব দেন। সুইডেন লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলে ২০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয়। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ২০৩৫ সালের মধ্যে ৮১% নির্গমন কমানোর লক্ষ্য ঘোষণা করেন এবং ১০০% ক্লিন এনার্জি সরবরাহ নিশ্চিতের পরিকল্পনা করেন।

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ভোগবিলাস কমিয়ে একটি নতুন সংস্কৃতির আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দরিদ্র দেশগুলোকে অর্থ চাইতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা অপমানজনক। পাকিস্তান এবং ইরানের নেতারাও তার বক্তব্য সমর্থন করেন। মুহাম্মদ ইউনূস জলবায়ু সমস্যার সমাধানে পানির সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেন। তিনি নেপাল ও ভুটানের জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে একটি দক্ষিণ এশিয়া গ্রিড তৈরির আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি তিন শূন্য নীতির মাধ্যমে নতুন সভ্যতা তৈরির কথা বলেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস বলেন, ২০২৪ সাল সবচেয়ে উষ্ণ বছর হতে পারে, তবে ক্লিন এনার্জির বিপ্লব থামবে না।

২৬তম গ্লাসগো সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড কার্যকর করার আলোচনা শুরু হলেও ২৯তম কপ সম্মেলনেও তা বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এবারের কপকে ‘ক্লাইমেট ফাইন্যান্স কপ’ নামে অভিহিত করা হলেও উন্নত দেশগুলো ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল নিয়ে একমত হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো নতুন ও অতিরিক্ত তহবিল, ঋণের বদলে অনুদান এবং সুস্পষ্ট ফান্ড সংজ্ঞার দাবি করলেও সেগুলো উপেক্ষিত রয়ে গেছে।

আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই জলবায়ু সংকটকে ‘সমাজতান্ত্রিক মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করে কপ২৯ থেকে তার প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করে নেয়, যা আর্জেন্টিনার বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ফ্রান্সকে নিয়ে আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতির মন্তব্যের পর ফ্রান্সের পরিবেশ মন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দেননি।

কপ২৯-এ আর্থিক আলোচনা ধীরগতিতে এগিয়েছে, যা ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি প্রতিস্থাপনে ব্যর্থ। জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা নবায়নযোগ্য শক্তির অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে। অথচ কপ২৯ এর প্রধান লক্ষ্য ছিল লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠন, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া। জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলো এই সম্মেলনে বেশি প্রভাব ফেলেছে, এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণের সম্ভাবনা কমে গেছে।

পরবর্তী সম্মেলনে, ধনী দেশগুলো লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে অর্থায়ন করবে কিনা- তা এখন বড় প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন শুধু সেই দেশগুলোতে হওয়া উচিত, যারা জীবাশ্ম জ্বালানি লবিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়।

কপ২৯-এ ৮৫,০০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করলেও, জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের উপস্থিতি ব্যাপক ছিল। ১৩২টি জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির প্রতিনিধিকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। জীবাশ্ম জ্বালানি সংশ্লিষ্ট প্রায় ১,৭৭৩ জন লবিস্ট সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোর জন্য প্রতি বছর ১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, যার এক-তৃতীয়াংশ ধনী দেশগুলির কাছ থেকে আসা উচিত। কিছু অর্থনীতিবিদ জলবায়ু তহবিল সংগ্রহের জন্য নতুন উৎস যেমন- প্লাস্টিক উৎপাদনে শুল্ক বা সম্পদ কর প্রস্তাব করেছেন।

দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব জনসংখ্যার ১৫% ধারণ করলেও বায়ুম-লে প্রায় ৬০% কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনে অবদান রেখেছে।

জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনা থেকে বোঝা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এখনও অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। বিশেষত, কার্বন বাজারের আর্টিকেল ৬-এর অধীনে নির্গমন হ্রাসের নিয়ম প্রণয়নে স্বচ্ছতার অভাব এবং কার্যকর জবাবদিহিতার ঘাটতি ছিল স্পষ্ট।

প্যারিস চুক্তি সত্ত্বেও উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতার অভাব এবং জলবায়ু অর্থায়নে অগ্রগতির ধীরগতি, সম্মেলনের সফলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২০২৩ সালে ৫৭.৪ গিগাটন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের তথ্য জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট করেছে। এর ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশসহ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা ও জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তি প্রয়োজনের কথা জানিয়েছে।

সার্বিকভাবে, কপ২৯ সম্মেলন কিছু প্রস্তাবনায় অগ্রগতি আনলেও কার্যকর পরিবর্তনের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে এই সংকট মোকাবিলা করা অসম্ভব।

অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়

back to top