alt

জাতীয়

‘অর্থ পাচার’: যেভাবে ‘শুকিয়ে ফেলা হয়’ একটি দেশের অর্থনীতি

নিউইয়র্ক টাইমস : বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

রাজধানীতে মেট্রোরেলের একটি পিলারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকৃত ম্যুরাল-নিউইয়র্ক টাইমস

গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এই হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের। তবে অন্যান্য অর্থনীতিবিদের হিসাবে, এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ ঠিক কত- তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।

বিভিন্ন ধরনের আর্থিক হিসাব-নিকাশ করে আহসান মনসুর বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে তার সহযোগীরা বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ অর্থ লুট করেছে, তা কার্যত পৃথিবীর আর্থিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

মার্কিন এই সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সাক্ষাৎকার কবে নেয়া হয়েছে তা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়নি। তবে চলতি সপ্তাহে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি-বিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি বলেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে সার্বিকভাবে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে।

আহসান মনসুর সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছিল, লুটপাট করার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে ব্যাংক। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো শত শত কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছে, যে কোম্পানিগুলোর অনেকগুলোর অস্তিত্বই নেই। এই টাকাও কখনো সম্ভবত ব্যাংকে ফিরে আসবে না; এই অর্থের একটি বড় অংশ দেশ থেকে অবৈধভাবে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার আগে ২৭ বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করছেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের পুরো পরিচালনা পর্ষদ হাইজ্যাক করা হয়েছিল। তার ভাষ্য, বিশ্বের অন্য কোনো দেশে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এভাবে গুণ্ডা-মস্তানদের সহযোগিতায় পুরো ব্যাংক খাতে এমন পদ্ধতিগতভাবে ডাকাতি করেছে, এমন ঘটনা তিনি আর কোথাও দেখেননি।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে এখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পালা চলছে, গণসহিংসতাও দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতি প্রসঙ্গে আহসান মনসুর বলেন, ‘আগামী বছর অর্থনীতি আরও খারাপ হতে পারে; এরপর অর্থনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করবে।’ শেখ হাসিনা ভারতের পালিয়ে গেছেন। তার ভাগ্যে কী আছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, তাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান।

সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে এখনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। তবে আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, ‘হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ‘উইচ হান্ট’ করা হচ্ছে, তিনি তার বাইরে নন।’

নিউইয়র্ক টাইমস শেখ হাসিনা ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকায় আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় শূন্য পড়ে আছে। এরপর তারা শেখ হাসিনার মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হয়নি।

ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল মান্নানের পদত্যাগের ঘটনা সবিস্তারে তুলে ধরেছে নিউইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি আর দশটা সাধারণ দিনের মতো আবদুল মান্নান কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তিনি একটি ফোন কল পান। কলটি করেছিলেন সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান। তাকে বলা হয়, গাড়ির গন্তব্য দিক পরিবর্তন করে তিনি যেন সংস্থাটির সদর দপ্তরে চলে আসেন।

গত অক্টোবর মাসে আবদুল মান্নান নিউইয়র্ক টাইমসকে সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। কার্যালয়ে যাওয়ার পর সামরিক গোয়েন্দারা আবদুল মান্নানের ফোন, ঘড়ি ও ওয়ালেট রেখে দেন। এরপর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আবদুল মান্নানের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের বিবরণ দেন; বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে তিনি যে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন, সে জন্য তার প্রশংসা করেন।

আবদুল মান্নান ভাবেছিলেন, তার সময়টা বোধহয় বৃথা যাচ্ছে। কিন্তু এরপরই তাকে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগের চিঠিতে সই করতে বলা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তাকে বলেন, এই আদেশ দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে এসেছে, অর্থাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রথমে পদত্যাগ পত্রে সই করতে রাজি হননি। তখন ইসলামের খলিফা ওসমানের কথা মনে হচ্ছিল তার। সপ্তম শতাব্দীতে ঘাতকের আক্রমণের মুখে তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন।

কিন্তু এই পর্যায়ে এসে আবদুল মান্নান আর বলতে পারলেন না। প্রথমত তিনি বলেন, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে মৌখিকভাবে রাজি করানোর চেষ্টা করেছেন। এরপর তাকে গোয়েন্দা প্রধানের কার্যালয় থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমি যে ধরনের মানুষ, তাতে ওই সময়ে আমাকে যে অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছিল, তার বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়।’ এরপর তিনি সময়ের হিসাব ভুলে যান এবং একপর্যায়ে জানতে পারেন, দুপুরের আগে আগে তিনি পদত্যাগপত্রে সই করেছেন। এরপর তাকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং পরবর্তী আট বছর তিনি নির্বাসনে ছিলেন; এখন তিনি আবার একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছেন।

আবদুল মান্নান ও আহসান মনসুর একই সুরে বলেন, ওই ঘটনার পর এস আলম গোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল আলম ট্রেডার হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বিশেষ করে শেখ হাসিনার আমলে জ্বালানি, আবাসন খাতসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দাবি, এস আলম গোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত শূন্য করে দেয়ার চক্রান্ত করেছিল।

হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএফআইইউ’র নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান। ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক এস আলম গোষ্ঠীর হাতে যাওয়ার পর নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ দেয়া হয়েছে, যে ঋণের বড় অংশ আর ফেরত আসেনি। ফলে সেগুলো খেলাপি হয়ে গেছে।

এদিকে এস আলম গ্রুপও বসে নেই। তারা আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন ইমানুয়েলের মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। বলেছে, দেশের একটি মাত্র ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং সেটা ইসলামী ব্যাংক নয়। তাদের অভিযোগ, আহসান এইচ মনসুর এস আলম গোষ্ঠীর সঙ্গে নিপীড়নমূলক আচরণ করছেন; এমনকি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না।

বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক এখন লাইফ সাপোর্টে আছে বলে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি যেসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারাও সেভাবে ঋণ দিতে পারছে না, এমনকি আমানতকারীদের টাকা সব সময় ফেরত দিতে পারছে না। আমানতকারীদের তারা মাঝেমধ্যে টাকা তোলার সুযোগ দিচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে যে টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শেখ হাসিনার দলের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা করা হয়েছে, যে অর্থ মূলত আমদানি রপ্তানির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে।

এর মাধ্যমে যে কেবল কিছু মানুষের পকেট ভারী হয়েছে তা নয়, এতে বাংলাদেশের মুদ্রার দরপতনও হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশ থেকে এই অর্থ পাচারের গতি বাড়তে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের মুদ্রার বড় ধরনের দরপতন হয়। আমদানি মূল্য অনেকটা বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের লোডশেডিংয়ের মুখে পড়ে বাংলাদেশ।

অনেক ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পুরো বেতন তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমনকি যেদিন বেতন দেয়া হয়, সেদিন তারা পুরো টাকা তুলতে পারেননি, এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে।

ওষুধ কোম্পানি টেকনো ড্রাগ কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এই কোম্পানির সহমহাব্যবস্থাপক মাজেদুল করিম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, নিম্ন আয়ের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কর্মীরা তার কাছে অভিযোগ করেছেন, ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না, সে কারণে কোম্পানি বাধ্য হয়ে নগদ অর্থে মজুরি পরিশোধ করছে। তিনি আরও বলেন, নিজের ডেবিট কার্ড দিয়েও টাকা তোলা যাচ্ছে না।

আহসান মনসুর বলেন, এ বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বছর নয়, যদিও মূল্যস্ফীতির হার কমে আসছে ও প্রবাসী আয়প্রবাহ বাড়ছে। তিনি আশাবাদী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বাংলাদেশের মুদ্রা স্থিতিশীল করতে আরও তিন বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলার সহায়তা দেবে। ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।

ছবি

অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে না: হাইকোর্ট

ছবি

১ ঘণ্টার আল্টিমেটাম, দেড়টায় সচিবালয় অভিমুখে পদযাত্রার ঘোষণা

ছবি

বায়ুদূষণের শীর্ষে মঙ্গোলিয়ার উলানবাটার, ঢাকা দ্বিতীয়

কমিশনের সামগ্রিক মনোযোগ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে : ইসি

ভ্যাট বাড়লেও সাধারণ মানুষের ওপর খুব প্রভাব পড়বে না : প্রেস সচিব

টিউলিপের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অনুসন্ধান প্রয়োজন: সানডে টাইমসকে ড. ইউনূস

গণঅভ্যুত্থানের পর ২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার শিক্ষক ‘অবাঞ্ছিত’

ছবি

অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় শুল্ক ও কর বৃদ্ধি

ছবি

দুর্নীতি ও অর্থপাচার অভিযোগে সমালোচনার মুখে ব্রিটিশ এশিয়ান ট্রাস্টের চেয়ারম্যান

ছাদ বাগান বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি কার্যকর সমাধান : পরিবেশ উপদেষ্টা

গুলি চালানোর ঘটনায় কনস্টেবল কারাগারে

ছবি

সীমান্তে অপরাধ দমনে বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতা: প্রণয় ভার্মা

ছবি

শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান দীর্ঘায়িত হওয়া উচিত: মণি শঙ্কর আইয়ার

ছবি

সীমান্তে উত্তেজনা: ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব

ছবি

জাতীয় নির্বাচন আগে করার পক্ষে নির্বাচন কমিশন

ছবি

দেশে একজনের শরীরে এইচএমপিভি শনাক্ত

ছবি

‘ডাকাতি’, টিউলিপ সিদ্দিকের ক্ষমা চাওয়া উচিত: ইউনূস

ছবি

বিজিবির শক্ত অবস্থানে ভারত বেড়া নির্মাণ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

আমাদের মূল ফোকাস জাতীয় নির্বাচন: ইসি সানাউল্লাহ

ছবি

প্রধান উপদেষ্টার কথামত নির্বাচন করতে কাজ করছে কমিশন : সিইসি

ছবি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ

ছবি

বিআরটিএর পারফরম্যান্সে উন্নতি না হলে বিলুপ্তির হুঁশিয়ারি

ছবি

‘রাজনৈতিক কারণেই’ সংখ্যালঘুদের ওপর ‘অধিকাংশ’ সহিংসতার অভিযোগ, পুলিশের ‘অনুসন্ধানের’ বরাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

ট্রাম্পের ‘ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্টে’ তারেকসহ বিএনপির তিন নেতাকে আমন্ত্রণ

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম বাতিল: আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ আদেশ প্রকাশিত

ছবি

আমাদের লক্ষ্য একটা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য আমাদের অবশ্যই ভালো কাজ করতে হবে : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

আওয়ামী লীগের ভোটে থাকা নিয়ে তফসিল পর্যন্ত অপেক্ষায় রাখলেন সিইসি

ছবি

দেশে একদিনে ডেঙ্গুতে ১৯ জন হাসপাতালে ভর্তি

ছবি

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রিওভাইরাস শনাক্ত

ছবি

শৈত্যপ্রবাহ আজ ৯ জেলায়, তাপমাত্রা বাড়তে পারে কাল থেকে

ছবি

বহু পণ্য ও সেবায় বাড়লো শুল্ক ও ভ্যাট, খরচ বাড়বে মানুষের

ছবি

অস্থায়ী আদালতে আগুন, বকশীবাজারে হলো না শুনানি

ছবি

জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আলোচনায় বসছে অন্তর্বর্তী সরকার

ছবি

বিডিআর সদস্যদের মুক্তির দাবিতে জেলায় মানববন্ধনের ঘোষণা, ঢাকা ছাড়ছেন স্বজনরা

ছবি

মাজার ও গানের আসরে হামলায় কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিলেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম

tab

জাতীয়

‘অর্থ পাচার’: যেভাবে ‘শুকিয়ে ফেলা হয়’ একটি দেশের অর্থনীতি

নিউইয়র্ক টাইমস

রাজধানীতে মেট্রোরেলের একটি পিলারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকৃত ম্যুরাল-নিউইয়র্ক টাইমস

বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এই হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের। তবে অন্যান্য অর্থনীতিবিদের হিসাবে, এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ ঠিক কত- তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।

বিভিন্ন ধরনের আর্থিক হিসাব-নিকাশ করে আহসান মনসুর বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে তার সহযোগীরা বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ অর্থ লুট করেছে, তা কার্যত পৃথিবীর আর্থিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

মার্কিন এই সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সাক্ষাৎকার কবে নেয়া হয়েছে তা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়নি। তবে চলতি সপ্তাহে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি-বিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি বলেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে সার্বিকভাবে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে।

আহসান মনসুর সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছিল, লুটপাট করার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে ব্যাংক। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো শত শত কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছে, যে কোম্পানিগুলোর অনেকগুলোর অস্তিত্বই নেই। এই টাকাও কখনো সম্ভবত ব্যাংকে ফিরে আসবে না; এই অর্থের একটি বড় অংশ দেশ থেকে অবৈধভাবে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার আগে ২৭ বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করছেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের পুরো পরিচালনা পর্ষদ হাইজ্যাক করা হয়েছিল। তার ভাষ্য, বিশ্বের অন্য কোনো দেশে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এভাবে গুণ্ডা-মস্তানদের সহযোগিতায় পুরো ব্যাংক খাতে এমন পদ্ধতিগতভাবে ডাকাতি করেছে, এমন ঘটনা তিনি আর কোথাও দেখেননি।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে এখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পালা চলছে, গণসহিংসতাও দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতি প্রসঙ্গে আহসান মনসুর বলেন, ‘আগামী বছর অর্থনীতি আরও খারাপ হতে পারে; এরপর অর্থনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করবে।’ শেখ হাসিনা ভারতের পালিয়ে গেছেন। তার ভাগ্যে কী আছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, তাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান।

সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে এখনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। তবে আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, ‘হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ‘উইচ হান্ট’ করা হচ্ছে, তিনি তার বাইরে নন।’

নিউইয়র্ক টাইমস শেখ হাসিনা ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকায় আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় শূন্য পড়ে আছে। এরপর তারা শেখ হাসিনার মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হয়নি।

ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল মান্নানের পদত্যাগের ঘটনা সবিস্তারে তুলে ধরেছে নিউইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি আর দশটা সাধারণ দিনের মতো আবদুল মান্নান কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তিনি একটি ফোন কল পান। কলটি করেছিলেন সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান। তাকে বলা হয়, গাড়ির গন্তব্য দিক পরিবর্তন করে তিনি যেন সংস্থাটির সদর দপ্তরে চলে আসেন।

গত অক্টোবর মাসে আবদুল মান্নান নিউইয়র্ক টাইমসকে সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। কার্যালয়ে যাওয়ার পর সামরিক গোয়েন্দারা আবদুল মান্নানের ফোন, ঘড়ি ও ওয়ালেট রেখে দেন। এরপর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আবদুল মান্নানের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের বিবরণ দেন; বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে তিনি যে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন, সে জন্য তার প্রশংসা করেন।

আবদুল মান্নান ভাবেছিলেন, তার সময়টা বোধহয় বৃথা যাচ্ছে। কিন্তু এরপরই তাকে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগের চিঠিতে সই করতে বলা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তাকে বলেন, এই আদেশ দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে এসেছে, অর্থাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রথমে পদত্যাগ পত্রে সই করতে রাজি হননি। তখন ইসলামের খলিফা ওসমানের কথা মনে হচ্ছিল তার। সপ্তম শতাব্দীতে ঘাতকের আক্রমণের মুখে তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন।

কিন্তু এই পর্যায়ে এসে আবদুল মান্নান আর বলতে পারলেন না। প্রথমত তিনি বলেন, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে মৌখিকভাবে রাজি করানোর চেষ্টা করেছেন। এরপর তাকে গোয়েন্দা প্রধানের কার্যালয় থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমি যে ধরনের মানুষ, তাতে ওই সময়ে আমাকে যে অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছিল, তার বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়।’ এরপর তিনি সময়ের হিসাব ভুলে যান এবং একপর্যায়ে জানতে পারেন, দুপুরের আগে আগে তিনি পদত্যাগপত্রে সই করেছেন। এরপর তাকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং পরবর্তী আট বছর তিনি নির্বাসনে ছিলেন; এখন তিনি আবার একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছেন।

আবদুল মান্নান ও আহসান মনসুর একই সুরে বলেন, ওই ঘটনার পর এস আলম গোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল আলম ট্রেডার হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বিশেষ করে শেখ হাসিনার আমলে জ্বালানি, আবাসন খাতসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দাবি, এস আলম গোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত শূন্য করে দেয়ার চক্রান্ত করেছিল।

হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএফআইইউ’র নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান। ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক এস আলম গোষ্ঠীর হাতে যাওয়ার পর নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ দেয়া হয়েছে, যে ঋণের বড় অংশ আর ফেরত আসেনি। ফলে সেগুলো খেলাপি হয়ে গেছে।

এদিকে এস আলম গ্রুপও বসে নেই। তারা আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন ইমানুয়েলের মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। বলেছে, দেশের একটি মাত্র ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং সেটা ইসলামী ব্যাংক নয়। তাদের অভিযোগ, আহসান এইচ মনসুর এস আলম গোষ্ঠীর সঙ্গে নিপীড়নমূলক আচরণ করছেন; এমনকি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না।

বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক এখন লাইফ সাপোর্টে আছে বলে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি যেসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারাও সেভাবে ঋণ দিতে পারছে না, এমনকি আমানতকারীদের টাকা সব সময় ফেরত দিতে পারছে না। আমানতকারীদের তারা মাঝেমধ্যে টাকা তোলার সুযোগ দিচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে যে টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শেখ হাসিনার দলের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা করা হয়েছে, যে অর্থ মূলত আমদানি রপ্তানির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে।

এর মাধ্যমে যে কেবল কিছু মানুষের পকেট ভারী হয়েছে তা নয়, এতে বাংলাদেশের মুদ্রার দরপতনও হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশ থেকে এই অর্থ পাচারের গতি বাড়তে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের মুদ্রার বড় ধরনের দরপতন হয়। আমদানি মূল্য অনেকটা বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের লোডশেডিংয়ের মুখে পড়ে বাংলাদেশ।

অনেক ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পুরো বেতন তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমনকি যেদিন বেতন দেয়া হয়, সেদিন তারা পুরো টাকা তুলতে পারেননি, এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে।

ওষুধ কোম্পানি টেকনো ড্রাগ কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এই কোম্পানির সহমহাব্যবস্থাপক মাজেদুল করিম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, নিম্ন আয়ের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কর্মীরা তার কাছে অভিযোগ করেছেন, ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না, সে কারণে কোম্পানি বাধ্য হয়ে নগদ অর্থে মজুরি পরিশোধ করছে। তিনি আরও বলেন, নিজের ডেবিট কার্ড দিয়েও টাকা তোলা যাচ্ছে না।

আহসান মনসুর বলেন, এ বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বছর নয়, যদিও মূল্যস্ফীতির হার কমে আসছে ও প্রবাসী আয়প্রবাহ বাড়ছে। তিনি আশাবাদী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বাংলাদেশের মুদ্রা স্থিতিশীল করতে আরও তিন বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলার সহায়তা দেবে। ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।

back to top