বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একাত্তরের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে বেছে বেছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। তাদেরকে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছিল জামায়াতে ইসলামী ও তার তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সমন্বয়ে গঠিত আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার নামে মিলিশিয়া বাহিনী।
পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংস হত্যকাণ্ডের অন্যতম ১৯৭১ এ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যা। এই বুদ্ধিজীবীদের অত্যন্ত পরিকল্পিভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসই বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হলেও ১৪’ই ডিসেম্বর রাতে একযোগে বহু বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এই ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দেশের সেই সময়কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে ঢাকায় রায়ের বাজারে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্যদিয়ে স্মরণ করবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পুরো ৯ মাস ধরেই পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে গণহত্যা করেছে। তাদের এই গণহত্যা থেকে বাংলাদেশের কেউ রক্ষা পায়নি সাধারণ মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক, চিকিৎসক, শ্রমিক-কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক সব শ্রেণীপেশার মানুষ নির্বিচারে হত্যা করেছে পাকিস্তানিরা।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক পরাজয় বরণ করতে শুরু করে। হানাদার বাহিনী বুঝে ফেলে বাংলাদেশে তাদের দিন শেষ। এরপরই তারা পরিকল্পনা করে বুদ্ধিজীবি হত্যার।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি।
যেসব বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন তাদের তালিকায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী এবং সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকায়, ১৪৯ জন।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, আল-বদর বাহিনী হওয়ার আগেই বিভিন্ন জায়গায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংঘ পুরোপুরি আল-বদরে রূপান্তরিত হয়। তাদের ওপর সুনির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ঢাকা শহরে আল-বদররাই মাইক্রোবাসে করে সবাইকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে।
ঢাকার পতনের পর গভর্নর হাউজ, যেটি এখন বঙ্গভবন নামে পরিচিত, সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারাও ফরমান আলীর একটি ডায়রি পাওয়া যায়। সেখানে অনেক নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা।
জানা গেছে, পাকিস্তানি ব্যবসায়ী আবদুল লতিফ বাওয়ানির বাসা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পর কিছু নথি পাওয়া যায়,যাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর নির্দেশনা পাওয়া যায়।
বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে ২০১৩ সালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদ- দিয়েছে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে বাংলাদেশের যুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী সংগঠন আল-বদর বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। মুঈনুদ্দীন বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের ঘটনার অপারেশন ইনচার্জ এবং আশরাফ ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর (প্রধান বাস্তবায়নকারী)।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ আবাসস্থল থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে সহযোগিতা করার জন্য জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপি প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানপ্রেমী দল ‘শান্তি কমিটি’ ও ‘রাজাকার’ বাহিনী গঠন করেছিল। রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে আনসার বাহিনীকে যুক্ত করে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে এটিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল।
জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে ও নেতৃত্বে শীর্ষ ঘাতক বাহিনী ‘আল-বদর’ গঠন করা হয়েছিল হিটলারের ‘গেস্টাপো’ ও ‘এসডি’র আদলে প্রধানত বুদ্ধিজীবীদের শনাক্ত করে হত্যার জন্য। যে বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলী, চৌধুরী মঈনউদ্দিন, আশরাফ উজ্জামান প্রমুখ। যাদের প্রধান নেতা বা গুরু ছিলেন গোলাম আযম। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘকে রূপান্তর করা হয়েছিল আল-বদর বাহিনীতে।
শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একাত্তরের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে বেছে বেছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। তাদেরকে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছিল জামায়াতে ইসলামী ও তার তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সমন্বয়ে গঠিত আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার নামে মিলিশিয়া বাহিনী।
পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংস হত্যকাণ্ডের অন্যতম ১৯৭১ এ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যা। এই বুদ্ধিজীবীদের অত্যন্ত পরিকল্পিভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসই বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হলেও ১৪’ই ডিসেম্বর রাতে একযোগে বহু বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এই ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দেশের সেই সময়কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে ঢাকায় রায়ের বাজারে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্যদিয়ে স্মরণ করবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পুরো ৯ মাস ধরেই পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে গণহত্যা করেছে। তাদের এই গণহত্যা থেকে বাংলাদেশের কেউ রক্ষা পায়নি সাধারণ মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক, চিকিৎসক, শ্রমিক-কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক সব শ্রেণীপেশার মানুষ নির্বিচারে হত্যা করেছে পাকিস্তানিরা।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক পরাজয় বরণ করতে শুরু করে। হানাদার বাহিনী বুঝে ফেলে বাংলাদেশে তাদের দিন শেষ। এরপরই তারা পরিকল্পনা করে বুদ্ধিজীবি হত্যার।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি।
যেসব বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন তাদের তালিকায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী এবং সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকায়, ১৪৯ জন।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, আল-বদর বাহিনী হওয়ার আগেই বিভিন্ন জায়গায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংঘ পুরোপুরি আল-বদরে রূপান্তরিত হয়। তাদের ওপর সুনির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ঢাকা শহরে আল-বদররাই মাইক্রোবাসে করে সবাইকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে।
ঢাকার পতনের পর গভর্নর হাউজ, যেটি এখন বঙ্গভবন নামে পরিচিত, সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারাও ফরমান আলীর একটি ডায়রি পাওয়া যায়। সেখানে অনেক নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা।
জানা গেছে, পাকিস্তানি ব্যবসায়ী আবদুল লতিফ বাওয়ানির বাসা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পর কিছু নথি পাওয়া যায়,যাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর নির্দেশনা পাওয়া যায়।
বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে ২০১৩ সালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদ- দিয়েছে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে বাংলাদেশের যুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী সংগঠন আল-বদর বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। মুঈনুদ্দীন বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের ঘটনার অপারেশন ইনচার্জ এবং আশরাফ ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর (প্রধান বাস্তবায়নকারী)।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ আবাসস্থল থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে সহযোগিতা করার জন্য জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপি প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানপ্রেমী দল ‘শান্তি কমিটি’ ও ‘রাজাকার’ বাহিনী গঠন করেছিল। রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে আনসার বাহিনীকে যুক্ত করে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে এটিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল।
জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে ও নেতৃত্বে শীর্ষ ঘাতক বাহিনী ‘আল-বদর’ গঠন করা হয়েছিল হিটলারের ‘গেস্টাপো’ ও ‘এসডি’র আদলে প্রধানত বুদ্ধিজীবীদের শনাক্ত করে হত্যার জন্য। যে বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলী, চৌধুরী মঈনউদ্দিন, আশরাফ উজ্জামান প্রমুখ। যাদের প্রধান নেতা বা গুরু ছিলেন গোলাম আযম। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘকে রূপান্তর করা হয়েছিল আল-বদর বাহিনীতে।