# দশম-দ্বাদশ : ৩টি সংসদ নির্বাচন জনআস্থা ধ্বংস করেছে- পর্যবেক্ষণ
# তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরার পথে বাধা কমলো- বলছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা
# তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাটা যখন কোর্ট বলছে অবৈধ, দ্যাট মিনস ইন আদার ওয়ার্ডস, তত্ত্বাবধায়ক সিস্টেম বৈধ। এটা হচ্ছে একটা ইন্টারপ্রিটেশন-- অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান
# বড় বাধা দূর হলো। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না; কারণ, সেটা বাতিল হয়েছিল আদালতের রায় ও সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। এ বিষয়ে আপিল বিভাগে করা রিভিউ আবেদনের শুনানি জানুয়ারিতে হবে। সেটা আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে-- আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া
# সংবিধানে জাতির জনক, সাতই মার্চসহ কয়েকটি ধারা ভবিষ্যত সংসদের জন্য ‘রেখে দিয়েছে’ আদালত-- সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নবম জাতীয় সংসদে পাশ করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ৫টি অনুচ্ছেদ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট; যার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে করা সংশোধনীও রয়েছে। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) এ সংক্রান্ত রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেয়।
২০১১ সালে নবম সংসদ চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে এবং সংবিধানে জাতীয় চার মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনে। একই সঙ্গে তখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে অন্যান্য ধর্মের সমমর্যাদা নিশ্চিত করার বিধান আনা হয়। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের ভাষণ, ছাব্বিশে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে।
২০২১ সালে একাদশ সংসদ চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে আরও কিছু ধারা যুক্ত করে। এরমধ্যে রয়েছে- অবৈধ ক্ষমতা দখল করলে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা ও সংরক্ষিত নারী আসন ৫০-এ উন্নীত করা এবং জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বীকৃতি।
মঙ্গলবার দুটি পৃথক রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানী শেষে হাইকোর্টের রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়।
পাশপাশি, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা ‘অসাংবিধানিক পন্থায়’ সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ ‘রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত’ করার মত বিভিন্ন অপরাধকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ সাব্যস্ত করার ৭(ক) এবং সংবিধানের কিছু ধারাকে সংশোধনঅযোগ্য করার ৭(খ) অনুচ্ছেদকেও বাতিল করে হাইকোর্ট।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পর যুক্ত করা ৭(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়, এই সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে; কিংবা, এই সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে’, তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হবে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের জন্য এই অনুচ্ছেদে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোকে ‘ভেইক টার্ম’ (অস্পষ্ট পরিভাষা) হিসাবে বর্ণনা করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘এরূপ বিধান মানুষের বেঁচে থাকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতির পরিপন্থি।’
৪৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোনো আদালতকে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওই সব বা এর যেকোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করতে পারবে। রায়ে এই অনুচ্ছেদটি বাতিল ঘোষণা করা হয়।
রায়ে আদালত বলে, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো।
*আইনজীবীদের মতামত*
অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাটা যখন কোর্ট বলছে অবৈধ, দ্যাট মিনস ইন আদার ওয়ার্ডস, তত্ত্বাবধায়ক সিস্টেম বৈধ। এটা হচ্ছে একটা ইন্টারপ্রিটেশন।’
রায়ের পর আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দূর হলো। তবে সেটা এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না; কারণ, সেটা বাতিল করা হয়েছিল দুইভাবে। আদালতের রায় ও সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে।’
তিনি বলেন, ‘বদিউল আলম মজুমদার ও আরও চারজন এ বিষয়ে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেছেন। জানুয়ারিতে শুনানি হবে। সেটা আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে।’
এই রায়কে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে উল্লেখ করেছেন।’ হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকবে, এমন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বহাল থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেউ বাদ দিতে পারবে না।
সংবিধানে জাতির জনক, সাতই মার্চসহ কয়েকটি ধারা যে সংসদের জন্য আদালত ‘রেখে দিয়েছেন’ তা জানিয়ে সুজন সম্পাদক বলেন, ‘আদালত বিষয়টি রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত।’
*আদালতের পর্যবেক্ষণ*
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, দশম থেকে দ্বাদশ সংসদ, বিগত এই তিনটি জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করেছে’।
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়।
এর মধ্যে দশম ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল। তাদের বর্জনের ফলে দশম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান। সেই সংসদকে ‘বিনা ভোটের সংসদ’ আখ্যা দেয় ভোট বর্জন করা বিএনপি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে শরিক ও বিরোধীদল জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সঙ্গে দলের বিদ্রোহীদের। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীরা মাত্র সাতটি আসনে জয় পায়। বিএনপিসহ বিরোধীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরোধিতা করে এলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাতে সাড়া দেয়নি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনাবসানের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ফেরানোর উদ্যোগ হিসেবে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে’ জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন গড়ে ওঠার কথা বলেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা হারানোর প্রেক্ষাপটে হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে; হাজার হাজার মানুষ আজীবনের জন্য শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।’
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ‘অপরিহার্য’ বিবেচনা করে রায়ের পর্যবেক্ষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত’ বলা হয়েছে।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের এই পর্যবেক্ষণের বিষয়ে জামায়াতের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, গণতন্ত্র হল আমাদের সংবিধানে মৌলিক কাঠামো। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বলেছেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে। কেন? কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় না। আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় না, গণতন্ত্র নিশ্চিত করা যায় না। এজন্য তিনি বলছেন, কেয়ারটেকার গভার্নমেন্ট সিস্টেম ইজ দ্য বেসিক স্ট্রাকচার অব দি কনস্টিটিউশন।’
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। সেই সংশোধনীর অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায় এবং পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে ‘বৈপরীত্য’ (কনট্রাডিকশন) থাকার কথাও রায়ের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেন এই বিচারপতি। তিনি বলেন, সংক্ষিপ্ত রায়ে আরও দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হলেও পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা ছিল না।
রায় ঘোষণার পর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনকে সবকিছুর মূলে রেখেছে আমাদের সংবিধান। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোকে কেন্দ্রে রেখে আজকের রায় দিয়েছি।’ আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ আবেদনের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যাতে না হয়, সেদিকেও নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
*রিট আবেদন*
পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেয়। পঞ্চদশ সংশোধনী কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
পরে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি সংগঠন এবং কয়েকজন ব্যক্তি এ রিট মামলায় পক্ষভুক্ত হয়, তাদের পক্ষে আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন। গত ৩০ অক্টোবর শুনানির পর নভেম্বরে ৯ দিন (৬ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর, ১০ নভেম্বর, ১৩ নভেম্বর, ১৪ নভেম্বর, ২০ নভেম্বর, ২৫ নভেম্বর, ২৭ ও ২৮ নভেম্বর) এবং ১ ডিসেম্বর ও বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রুলের ওপর শুনানি হয়।
এদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর ১৭টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন গত অক্টোবরে একটি রিট আবেদন করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেয়। রুলে আইনের ওই ধারাগুলো কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পরে সেই রুলের ওপর শুনানি হয়।
মঙ্গলবার রায়ের দিন রাষ্ট্রপক্ষে আদালতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন। রিটকারী বদিউল আলমের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল।
জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী।
* সম্পূর্ণ বাতিল চাওয়া হয়েছিল *
রায়ের পর রিটকারীর আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, রিটকারীরা পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল চেয়েছিলেন। আদালত বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল করলেও অন্যগুলো বাতিল করেনি। আদালত বলেছে, বাকিগুলোর বৈধতাও আদালত দিচ্ছে না। সেগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছে। ভবিষ্যৎ সংসদ জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো রাখতে পারে অথবা বাতিল করতে পারে।
রিটকারীর এই আইনজীবী বলেন, ‘মাননীয় আদালত বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি অংশ। যেহেতু নির্বাচন, গণতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামো, যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করেছে, সেহেতু এটি সংবিধানের একটি মূল কাঠামো। এটা ঐতিহাসিক রায়।’
*তত্ত্বাবধায়ক সরকার*
সংবিধানে আনা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকারের অধীনে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন হলেও তখন বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করা হয়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে বিএনপি।
আদালতের এক রায়ের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত করা হয়। হাইকোর্ট মঙ্গলবার ওই সংশোধনীর আংশিক অবৈধ ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে বৈধতা দেয়।
মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
# দশম-দ্বাদশ : ৩টি সংসদ নির্বাচন জনআস্থা ধ্বংস করেছে- পর্যবেক্ষণ
# তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরার পথে বাধা কমলো- বলছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা
# তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাটা যখন কোর্ট বলছে অবৈধ, দ্যাট মিনস ইন আদার ওয়ার্ডস, তত্ত্বাবধায়ক সিস্টেম বৈধ। এটা হচ্ছে একটা ইন্টারপ্রিটেশন-- অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান
# বড় বাধা দূর হলো। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না; কারণ, সেটা বাতিল হয়েছিল আদালতের রায় ও সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। এ বিষয়ে আপিল বিভাগে করা রিভিউ আবেদনের শুনানি জানুয়ারিতে হবে। সেটা আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে-- আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া
# সংবিধানে জাতির জনক, সাতই মার্চসহ কয়েকটি ধারা ভবিষ্যত সংসদের জন্য ‘রেখে দিয়েছে’ আদালত-- সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নবম জাতীয় সংসদে পাশ করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ৫টি অনুচ্ছেদ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট; যার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে করা সংশোধনীও রয়েছে। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) এ সংক্রান্ত রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেয়।
২০১১ সালে নবম সংসদ চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে এবং সংবিধানে জাতীয় চার মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনে। একই সঙ্গে তখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে অন্যান্য ধর্মের সমমর্যাদা নিশ্চিত করার বিধান আনা হয়। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের ভাষণ, ছাব্বিশে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে।
২০২১ সালে একাদশ সংসদ চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে আরও কিছু ধারা যুক্ত করে। এরমধ্যে রয়েছে- অবৈধ ক্ষমতা দখল করলে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা ও সংরক্ষিত নারী আসন ৫০-এ উন্নীত করা এবং জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বীকৃতি।
মঙ্গলবার দুটি পৃথক রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানী শেষে হাইকোর্টের রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়।
পাশপাশি, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা ‘অসাংবিধানিক পন্থায়’ সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ ‘রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত’ করার মত বিভিন্ন অপরাধকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ সাব্যস্ত করার ৭(ক) এবং সংবিধানের কিছু ধারাকে সংশোধনঅযোগ্য করার ৭(খ) অনুচ্ছেদকেও বাতিল করে হাইকোর্ট।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পর যুক্ত করা ৭(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়, এই সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে; কিংবা, এই সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে’, তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হবে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের জন্য এই অনুচ্ছেদে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোকে ‘ভেইক টার্ম’ (অস্পষ্ট পরিভাষা) হিসাবে বর্ণনা করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘এরূপ বিধান মানুষের বেঁচে থাকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতির পরিপন্থি।’
৪৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোনো আদালতকে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওই সব বা এর যেকোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করতে পারবে। রায়ে এই অনুচ্ছেদটি বাতিল ঘোষণা করা হয়।
রায়ে আদালত বলে, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো।
*আইনজীবীদের মতামত*
অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাটা যখন কোর্ট বলছে অবৈধ, দ্যাট মিনস ইন আদার ওয়ার্ডস, তত্ত্বাবধায়ক সিস্টেম বৈধ। এটা হচ্ছে একটা ইন্টারপ্রিটেশন।’
রায়ের পর আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দূর হলো। তবে সেটা এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না; কারণ, সেটা বাতিল করা হয়েছিল দুইভাবে। আদালতের রায় ও সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে।’
তিনি বলেন, ‘বদিউল আলম মজুমদার ও আরও চারজন এ বিষয়ে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেছেন। জানুয়ারিতে শুনানি হবে। সেটা আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে।’
এই রায়কে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে উল্লেখ করেছেন।’ হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকবে, এমন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বহাল থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেউ বাদ দিতে পারবে না।
সংবিধানে জাতির জনক, সাতই মার্চসহ কয়েকটি ধারা যে সংসদের জন্য আদালত ‘রেখে দিয়েছেন’ তা জানিয়ে সুজন সম্পাদক বলেন, ‘আদালত বিষয়টি রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত।’
*আদালতের পর্যবেক্ষণ*
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, দশম থেকে দ্বাদশ সংসদ, বিগত এই তিনটি জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করেছে’।
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়।
এর মধ্যে দশম ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল। তাদের বর্জনের ফলে দশম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান। সেই সংসদকে ‘বিনা ভোটের সংসদ’ আখ্যা দেয় ভোট বর্জন করা বিএনপি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে শরিক ও বিরোধীদল জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সঙ্গে দলের বিদ্রোহীদের। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীরা মাত্র সাতটি আসনে জয় পায়। বিএনপিসহ বিরোধীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরোধিতা করে এলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাতে সাড়া দেয়নি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনাবসানের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ফেরানোর উদ্যোগ হিসেবে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে’ জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন গড়ে ওঠার কথা বলেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা হারানোর প্রেক্ষাপটে হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে; হাজার হাজার মানুষ আজীবনের জন্য শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।’
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ‘অপরিহার্য’ বিবেচনা করে রায়ের পর্যবেক্ষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত’ বলা হয়েছে।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের এই পর্যবেক্ষণের বিষয়ে জামায়াতের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, গণতন্ত্র হল আমাদের সংবিধানে মৌলিক কাঠামো। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বলেছেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে। কেন? কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় না। আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় না, গণতন্ত্র নিশ্চিত করা যায় না। এজন্য তিনি বলছেন, কেয়ারটেকার গভার্নমেন্ট সিস্টেম ইজ দ্য বেসিক স্ট্রাকচার অব দি কনস্টিটিউশন।’
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। সেই সংশোধনীর অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায় এবং পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে ‘বৈপরীত্য’ (কনট্রাডিকশন) থাকার কথাও রায়ের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেন এই বিচারপতি। তিনি বলেন, সংক্ষিপ্ত রায়ে আরও দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হলেও পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা ছিল না।
রায় ঘোষণার পর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনকে সবকিছুর মূলে রেখেছে আমাদের সংবিধান। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোকে কেন্দ্রে রেখে আজকের রায় দিয়েছি।’ আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ আবেদনের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যাতে না হয়, সেদিকেও নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
*রিট আবেদন*
পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেয়। পঞ্চদশ সংশোধনী কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
পরে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি সংগঠন এবং কয়েকজন ব্যক্তি এ রিট মামলায় পক্ষভুক্ত হয়, তাদের পক্ষে আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন। গত ৩০ অক্টোবর শুনানির পর নভেম্বরে ৯ দিন (৬ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর, ১০ নভেম্বর, ১৩ নভেম্বর, ১৪ নভেম্বর, ২০ নভেম্বর, ২৫ নভেম্বর, ২৭ ও ২৮ নভেম্বর) এবং ১ ডিসেম্বর ও বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রুলের ওপর শুনানি হয়।
এদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর ১৭টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন গত অক্টোবরে একটি রিট আবেদন করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেয়। রুলে আইনের ওই ধারাগুলো কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পরে সেই রুলের ওপর শুনানি হয়।
মঙ্গলবার রায়ের দিন রাষ্ট্রপক্ষে আদালতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন। রিটকারী বদিউল আলমের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল।
জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী।
* সম্পূর্ণ বাতিল চাওয়া হয়েছিল *
রায়ের পর রিটকারীর আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, রিটকারীরা পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল চেয়েছিলেন। আদালত বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল করলেও অন্যগুলো বাতিল করেনি। আদালত বলেছে, বাকিগুলোর বৈধতাও আদালত দিচ্ছে না। সেগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছে। ভবিষ্যৎ সংসদ জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো রাখতে পারে অথবা বাতিল করতে পারে।
রিটকারীর এই আইনজীবী বলেন, ‘মাননীয় আদালত বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি অংশ। যেহেতু নির্বাচন, গণতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামো, যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করেছে, সেহেতু এটি সংবিধানের একটি মূল কাঠামো। এটা ঐতিহাসিক রায়।’
*তত্ত্বাবধায়ক সরকার*
সংবিধানে আনা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকারের অধীনে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন হলেও তখন বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করা হয়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে বিএনপি।
আদালতের এক রায়ের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত করা হয়। হাইকোর্ট মঙ্গলবার ওই সংশোধনীর আংশিক অবৈধ ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে বৈধতা দেয়।