কৃষি উৎপাদন হ্রাস ঠেকাতে গবেষণা ও প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি
খরা, অতিবৃষ্টি, লবণাক্ততা ও বন্যার কারণে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধানে গবেষণা ও প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি বলে মনেকরেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, ‘নিরাপদ ও অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। এজন্য নিরাপদ খাদ্যের মেলা আয়োজন জরুরি। কীটনাশক ব্যবহারে সচেতন হতে হবে।’
তবে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে, খাদ্যের অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করেন তিনি।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএআরএফ) আয়োজিত ‘কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সবুজের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কাওসার আজমের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্যাহ মিয়ান। প্রধান আলোচক ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সীড এসোসিয়েশনের মহাসচিব কৃষিবিদ ড. আলী আফজাল। বক্তব্য রাখেন কৃষিবিদ খন্দকার রাশেদ ইকবাল ও শেখ ফজলুল হক মনি।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, কৃষিকে পানি থেকে বা পানিকে কৃষি থেকে আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। বরং একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি দেশের মানুষের প্রধান চাহিদাই হচ্ছে খাদ্য। করোনায় মানুষ বা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী স্থান থেকে অস্থিরতা শুরু হলো ধান কাটবে কে, শ্রমিক কোথায় পাওয়া যাবে। এখন যেহেতু সংবিধান সংস্কার কমিশন কাজ করতে তাদের কাছে এ দাবি তুলতে হবে- খাদ্যের অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার।
তিনি বলেন, আমরা হাইব্রিড যুগে পৌঁছে গেছি। খাদ্য বলেন আর যা কিছু বলেন আমাদের সবকিছু বেশি করে উৎপাদন করতে হবে। রাষ্ট্রও অধিক পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনে পুশ করছে। আমাদের অধিক খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনেও মনোযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশে আগে প্রতি হেক্টরে ৮.৫ কেজি কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ব্যবহার করা হতো বর্তমানে তা ৭০০ কেজিতে পৌঁছেছে। এটি একটি ভয়ংকর অবস্থা। ২০০৫ সালে ১২ হাজার মেট্রিক টন কীটনাশক আমদানি করা হয়েছিল কিন্তু ২০২০ সালে তা ২৭ হাজারে টনে উন্নীত হয়। অর্থাৎ আমরা দ্বিগুণের বেশি কীটনাশক আমদানি করছি।
‘এসব কীটনাশক আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের প্রতি হেক্টর জমিতে যেখানে ৯৮ টাকার কীটনাশক লাগার কথা থাকলেও বর্তমানে তা লাগছে ৮৮২ টাকার। এর সবকিছু খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আমাদের শরীরে যাচ্ছে। তাই শুধু খাদ্য ফলালাম এটাতে হবে না বরং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে।’
তিনি বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষা আইন সহ বেশকিছু নীতিমালা চুড়ান্ত হওয়ার পথে। এগুলো চাড়ান্ত হলে আমরা আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারবো।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, জলবায়ুর বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায় জলবায়ু সহিঞ্চু জাত যেমন ব্রী ধান ৫২, বীনা ১১ ধানের জাত উৎপাদন করা হচ্ছে। স্মার্ট প্রযুক্তি, যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে এর প্রভাব মোকাবেলা করার উদ্যোগ বাস্তবায়ণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরাা খামারি নামের একটি অ্যাপ তৈরি করছি। যেখানে জমির পরিমান অনুযায়ী মাটির উর্বরতা বিবেচনায় নিয়ে কোন ফসল ভালো ফলবে, কতটুকু সার লাগবে, কি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে এবং সর্বোপরি আবহাওয়া উপযোগী একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে চাষাবাদের ক্ষেত্রে। দ্রুতই এই অ্যাপটির কার্যক্রম শুরু হবে।
তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ এত ব্যপক, সারাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব যে মন্ত্রণালয়ের হাতে, তাদের জন্য প্রতি বছর যে বরাদ্দ থাকে সেটা অনেক বড় একক প্রকল্পের চেয়েও কম। এই জায়গায় পরিবর্তন দরকার।
সারের মজুদের বিষয়ে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত সার রয়েছে। কোন কোন কৃষক হয়তো একসঙ্গে পুরো মৌসুমের সার কিনতে চাচ্ছে, সেখানে কিছুটা গ্যাপ হচ্ছে।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, একেক দেশে কৃষি উৎপাদনের প্যাটার্ন একেকরকম। উন্নয়নশীল দেশে উৎপাদনে যারা জড়িত তারা নিজের জন্য খাবার রাখেন। আমাদের দেশেও। বাকীটা বিক্রি করেন। অধিকাংশ ফার্মার শিক্ষিত নন। কৃষিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। এটা আবহাওয়া ও বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। একারণে প্রাচীন পদ্ধতিতে তারা চাষাবাদ করেন। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে চান না। তারা সাহস করেন না।
কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবছর ০.৪ শতাংশ হারে জমি কমছে। আরও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একারণে সব অংশীদার মিলে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিক কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি মাটির স্বাস্থ্যও ধরে রাখতে হবে। উৎপাদন দুইভাবে বাড়ানো যায়। এক হলো জমি বাড়ানো। আর অন্যটি হলো উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। জমি বাড়ানোর যেহেতু সুযোগ কম একারণে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ সীড এসোসিয়েশনের মহাসচিব ড. আলী আফজাল কি-নোট পেপার উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের যে সকল সমস্যায় প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হচ্ছে তা হলো বনাঞ্চল উজার, লবণাক্ততা, পানি দূষণ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, জমির অবক্ষয়, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পয়ঃনিষ্কাশন ও শিল্পবর্জর পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষিতে ক্রমাগত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ সকল চ্যালেঞ্জ দেশের কৃষি, অর্থনীতি এবং জনগণের জীবিকার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট তীব্র হওয়ার সাথে সাথে এই সমস্যাগুলি আরও গুরুতর হয়ে উঠছে, যা দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং দেশের উন্নয়নকে প্রভাবিত করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন উপকূলীয় অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে লবনাক্ততা বৃদ্ধি, খরা, হঠাৎ বন্যার মত সংকটগুলো প্রকট হয়ে উঠছে। বাংলদেশে মাটির লবণাক্ততা, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের অত্যন্ত ভয়ংকরভাবে বাড়তে থাকা পরিবেশগত সমস্যা। বর্তমানে প্রায় ১২ লক্ষ হেক্টর বা ৩০% এরও বেশি উপকূলীয় ভূমি লবণাক্ততা দ্বারা প্রভাবিত। মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ফসলের ধানের ফলনের প্রায় ২০-৩০% পর্যন্ত হ্রাস করেছে। ফলে বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৩৮৪০ থেকে ৫৭৬০ কোটি টাকা।
রাজশাহী, রংপুর এবং দিনাজপুরসহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, পানির সংকট, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত দীর্ঘ সময়ের খরা এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্র্রাস এবং উল্লেখযোগ্যভাবে কৃষি উৎপাদনকে ব্যাপক ভাবে ক্ষতি সাধন করছে। খরা প্রবণ এলাকাগুলোতে ফসলের ফলন বিশেষ করে ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে, কারণধান মূলত পানি-নির্ভর শস্য। ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরার কারণে কৃষি উৎপাদনে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, খরার তীব্রতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ক্ষতির পরিমাণ বছরে ১১০০ কোটি টাকা।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই আগ্রাসনের প্রভাব আমরা সম্প্রতিই টের পেয়েছি। এবছরই দক্ষিন-পুর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলা ভয়ংকরভাবে হঠাৎ বন্যায় ডুবে গিয়েছিল। এ বন্যায় প্রায় ৫৮ লক্ষেরও বেশি মানুষকে মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলো। এই ভয়াল বন্যায় ৩,৩৪,৪৩৪ টি বাড়ি ধ্বংস, ৮২ জনের মৃত্যু এবং ৩,৩৯,৩৮২ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ রূপে বিনষ্ট হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। যার ১৫.৬ কোটি মার্কিন ডলার ছিল গবাদি পশু এবং মৎস্য সম্পদের ক্ষতি। সবচেয়ে বড় খেসারত দিতে হয়েছে ধানের উৎপাদনে। আউশ ও আমনের প্রায় ১১ লাখ মে টন চালের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে এর প্রভাবে। যে কারণে এখনো কিন্তু চালের বাজার স্থিতিশীল হয়নি, সারাদেশের মানুষ এখনো চালের দামের কারণে কষ্টে আছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থার মধ্যে দিয়েই দেশের উৎপাদন স্থিতিশীল এবং বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে না পারলে বাংলাদেশকে প্রতিটি দুর্যোগের পরই সংকটের মধ্যে সংকটে পড়তে হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ‘কান্ট্রি ক্লাইমেট এন্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’এর তথ্য অনুযায়ী সাইক্লোনের প্রভাবে বাংলাদেশকে প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এই রিপোর্টে প্রক্ষেপন করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পরিবেশগত ঝুঁকি এবং হঠাৎ বন্যা, সাইক্লোনের মত ভয়াবহ নানা দুর্যোগের প্রভাবে কৃষি জিডিপি-র এক তৃতীয়াংশ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ১৩.৩ মিলিয়ন মানুষ এই ভয়াবহতার প্রভাবে আগামী ৩০ বছরে দেশের মধ্যেই মাইগ্রেট করতে হতে পারে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই ক্ষতি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশে কমপক্ষে ১২.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন শুধুমাত্র মিড টার্ম পদক্ষেপ বাস্তবায়নে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর তথ্য মতে, দেশের এখনো ৪০ ভাগ কর্মসংস্থান হয় এই কৃষি খাতে। কিন্তু এই খাতটি যদি এত ভয়াবহতার মধ্যে দিয়ে যায়, তাহলে দেশের খাদ্য উৎপাদনের অবস্থা এবং এই ৪০ ভাগ মানুষের আয়ের রাস্তা ঝুকির মধ্যে। এই অবস্থা মোকাবেলায় খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সরকারের দৃশ্যমান বরাদ্দ এবং ব্যবস্থাপনা খুবই অপ্রতুল।
ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার এন্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের অসম বন্টন, উচ্চ তাপমাত্রার আবির্ভাব, বন্যা ও আকষ্মিক বন্যার কারণে শস্য বিন্যাসের উপর প্রতিনিয়ত প্রভাব পড়ছে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার দীর্ঘসূত্রিতা যেখানে তিন ফসল হওয়ার কথা বা চার ফসল হওয়ার কথা সেখানে দুই ফসল বা তিন ফসল হচ্ছে। এছাড়া ফসলে পোকামাকড় ও রোগের প্রাদুর্ভাবের প্রতিনিয়ত স্বরূপ পরিবর্তন হচ্ছে।
কৃষি উৎপাদন হ্রাস ঠেকাতে গবেষণা ও প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি
বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
খরা, অতিবৃষ্টি, লবণাক্ততা ও বন্যার কারণে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধানে গবেষণা ও প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি বলে মনেকরেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, ‘নিরাপদ ও অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। এজন্য নিরাপদ খাদ্যের মেলা আয়োজন জরুরি। কীটনাশক ব্যবহারে সচেতন হতে হবে।’
তবে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে, খাদ্যের অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করেন তিনি।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএআরএফ) আয়োজিত ‘কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সবুজের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কাওসার আজমের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্যাহ মিয়ান। প্রধান আলোচক ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সীড এসোসিয়েশনের মহাসচিব কৃষিবিদ ড. আলী আফজাল। বক্তব্য রাখেন কৃষিবিদ খন্দকার রাশেদ ইকবাল ও শেখ ফজলুল হক মনি।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, কৃষিকে পানি থেকে বা পানিকে কৃষি থেকে আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। বরং একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি দেশের মানুষের প্রধান চাহিদাই হচ্ছে খাদ্য। করোনায় মানুষ বা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী স্থান থেকে অস্থিরতা শুরু হলো ধান কাটবে কে, শ্রমিক কোথায় পাওয়া যাবে। এখন যেহেতু সংবিধান সংস্কার কমিশন কাজ করতে তাদের কাছে এ দাবি তুলতে হবে- খাদ্যের অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার।
তিনি বলেন, আমরা হাইব্রিড যুগে পৌঁছে গেছি। খাদ্য বলেন আর যা কিছু বলেন আমাদের সবকিছু বেশি করে উৎপাদন করতে হবে। রাষ্ট্রও অধিক পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনে পুশ করছে। আমাদের অধিক খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনেও মনোযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশে আগে প্রতি হেক্টরে ৮.৫ কেজি কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ব্যবহার করা হতো বর্তমানে তা ৭০০ কেজিতে পৌঁছেছে। এটি একটি ভয়ংকর অবস্থা। ২০০৫ সালে ১২ হাজার মেট্রিক টন কীটনাশক আমদানি করা হয়েছিল কিন্তু ২০২০ সালে তা ২৭ হাজারে টনে উন্নীত হয়। অর্থাৎ আমরা দ্বিগুণের বেশি কীটনাশক আমদানি করছি।
‘এসব কীটনাশক আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের প্রতি হেক্টর জমিতে যেখানে ৯৮ টাকার কীটনাশক লাগার কথা থাকলেও বর্তমানে তা লাগছে ৮৮২ টাকার। এর সবকিছু খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আমাদের শরীরে যাচ্ছে। তাই শুধু খাদ্য ফলালাম এটাতে হবে না বরং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে।’
তিনি বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষা আইন সহ বেশকিছু নীতিমালা চুড়ান্ত হওয়ার পথে। এগুলো চাড়ান্ত হলে আমরা আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারবো।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, জলবায়ুর বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায় জলবায়ু সহিঞ্চু জাত যেমন ব্রী ধান ৫২, বীনা ১১ ধানের জাত উৎপাদন করা হচ্ছে। স্মার্ট প্রযুক্তি, যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে এর প্রভাব মোকাবেলা করার উদ্যোগ বাস্তবায়ণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরাা খামারি নামের একটি অ্যাপ তৈরি করছি। যেখানে জমির পরিমান অনুযায়ী মাটির উর্বরতা বিবেচনায় নিয়ে কোন ফসল ভালো ফলবে, কতটুকু সার লাগবে, কি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে এবং সর্বোপরি আবহাওয়া উপযোগী একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে চাষাবাদের ক্ষেত্রে। দ্রুতই এই অ্যাপটির কার্যক্রম শুরু হবে।
তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ এত ব্যপক, সারাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব যে মন্ত্রণালয়ের হাতে, তাদের জন্য প্রতি বছর যে বরাদ্দ থাকে সেটা অনেক বড় একক প্রকল্পের চেয়েও কম। এই জায়গায় পরিবর্তন দরকার।
সারের মজুদের বিষয়ে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত সার রয়েছে। কোন কোন কৃষক হয়তো একসঙ্গে পুরো মৌসুমের সার কিনতে চাচ্ছে, সেখানে কিছুটা গ্যাপ হচ্ছে।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, একেক দেশে কৃষি উৎপাদনের প্যাটার্ন একেকরকম। উন্নয়নশীল দেশে উৎপাদনে যারা জড়িত তারা নিজের জন্য খাবার রাখেন। আমাদের দেশেও। বাকীটা বিক্রি করেন। অধিকাংশ ফার্মার শিক্ষিত নন। কৃষিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। এটা আবহাওয়া ও বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। একারণে প্রাচীন পদ্ধতিতে তারা চাষাবাদ করেন। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে চান না। তারা সাহস করেন না।
কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবছর ০.৪ শতাংশ হারে জমি কমছে। আরও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একারণে সব অংশীদার মিলে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিক কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি মাটির স্বাস্থ্যও ধরে রাখতে হবে। উৎপাদন দুইভাবে বাড়ানো যায়। এক হলো জমি বাড়ানো। আর অন্যটি হলো উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। জমি বাড়ানোর যেহেতু সুযোগ কম একারণে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ সীড এসোসিয়েশনের মহাসচিব ড. আলী আফজাল কি-নোট পেপার উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের যে সকল সমস্যায় প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হচ্ছে তা হলো বনাঞ্চল উজার, লবণাক্ততা, পানি দূষণ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, জমির অবক্ষয়, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পয়ঃনিষ্কাশন ও শিল্পবর্জর পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষিতে ক্রমাগত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ সকল চ্যালেঞ্জ দেশের কৃষি, অর্থনীতি এবং জনগণের জীবিকার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট তীব্র হওয়ার সাথে সাথে এই সমস্যাগুলি আরও গুরুতর হয়ে উঠছে, যা দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং দেশের উন্নয়নকে প্রভাবিত করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন উপকূলীয় অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে লবনাক্ততা বৃদ্ধি, খরা, হঠাৎ বন্যার মত সংকটগুলো প্রকট হয়ে উঠছে। বাংলদেশে মাটির লবণাক্ততা, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের অত্যন্ত ভয়ংকরভাবে বাড়তে থাকা পরিবেশগত সমস্যা। বর্তমানে প্রায় ১২ লক্ষ হেক্টর বা ৩০% এরও বেশি উপকূলীয় ভূমি লবণাক্ততা দ্বারা প্রভাবিত। মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ফসলের ধানের ফলনের প্রায় ২০-৩০% পর্যন্ত হ্রাস করেছে। ফলে বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৩৮৪০ থেকে ৫৭৬০ কোটি টাকা।
রাজশাহী, রংপুর এবং দিনাজপুরসহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, পানির সংকট, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত দীর্ঘ সময়ের খরা এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্র্রাস এবং উল্লেখযোগ্যভাবে কৃষি উৎপাদনকে ব্যাপক ভাবে ক্ষতি সাধন করছে। খরা প্রবণ এলাকাগুলোতে ফসলের ফলন বিশেষ করে ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে, কারণধান মূলত পানি-নির্ভর শস্য। ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরার কারণে কৃষি উৎপাদনে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, খরার তীব্রতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ক্ষতির পরিমাণ বছরে ১১০০ কোটি টাকা।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই আগ্রাসনের প্রভাব আমরা সম্প্রতিই টের পেয়েছি। এবছরই দক্ষিন-পুর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলা ভয়ংকরভাবে হঠাৎ বন্যায় ডুবে গিয়েছিল। এ বন্যায় প্রায় ৫৮ লক্ষেরও বেশি মানুষকে মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলো। এই ভয়াল বন্যায় ৩,৩৪,৪৩৪ টি বাড়ি ধ্বংস, ৮২ জনের মৃত্যু এবং ৩,৩৯,৩৮২ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ রূপে বিনষ্ট হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। যার ১৫.৬ কোটি মার্কিন ডলার ছিল গবাদি পশু এবং মৎস্য সম্পদের ক্ষতি। সবচেয়ে বড় খেসারত দিতে হয়েছে ধানের উৎপাদনে। আউশ ও আমনের প্রায় ১১ লাখ মে টন চালের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে এর প্রভাবে। যে কারণে এখনো কিন্তু চালের বাজার স্থিতিশীল হয়নি, সারাদেশের মানুষ এখনো চালের দামের কারণে কষ্টে আছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থার মধ্যে দিয়েই দেশের উৎপাদন স্থিতিশীল এবং বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে না পারলে বাংলাদেশকে প্রতিটি দুর্যোগের পরই সংকটের মধ্যে সংকটে পড়তে হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ‘কান্ট্রি ক্লাইমেট এন্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’এর তথ্য অনুযায়ী সাইক্লোনের প্রভাবে বাংলাদেশকে প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এই রিপোর্টে প্রক্ষেপন করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পরিবেশগত ঝুঁকি এবং হঠাৎ বন্যা, সাইক্লোনের মত ভয়াবহ নানা দুর্যোগের প্রভাবে কৃষি জিডিপি-র এক তৃতীয়াংশ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ১৩.৩ মিলিয়ন মানুষ এই ভয়াবহতার প্রভাবে আগামী ৩০ বছরে দেশের মধ্যেই মাইগ্রেট করতে হতে পারে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই ক্ষতি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশে কমপক্ষে ১২.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন শুধুমাত্র মিড টার্ম পদক্ষেপ বাস্তবায়নে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর তথ্য মতে, দেশের এখনো ৪০ ভাগ কর্মসংস্থান হয় এই কৃষি খাতে। কিন্তু এই খাতটি যদি এত ভয়াবহতার মধ্যে দিয়ে যায়, তাহলে দেশের খাদ্য উৎপাদনের অবস্থা এবং এই ৪০ ভাগ মানুষের আয়ের রাস্তা ঝুকির মধ্যে। এই অবস্থা মোকাবেলায় খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সরকারের দৃশ্যমান বরাদ্দ এবং ব্যবস্থাপনা খুবই অপ্রতুল।
ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার এন্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের অসম বন্টন, উচ্চ তাপমাত্রার আবির্ভাব, বন্যা ও আকষ্মিক বন্যার কারণে শস্য বিন্যাসের উপর প্রতিনিয়ত প্রভাব পড়ছে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার দীর্ঘসূত্রিতা যেখানে তিন ফসল হওয়ার কথা বা চার ফসল হওয়ার কথা সেখানে দুই ফসল বা তিন ফসল হচ্ছে। এছাড়া ফসলে পোকামাকড় ও রোগের প্রাদুর্ভাবের প্রতিনিয়ত স্বরূপ পরিবর্তন হচ্ছে।