মায়ানমার থেকে যখন-তখন বাংলাদেশে বেআইনিভাবে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে নানা ধরনের ‘অনিয়ম ও দুর্নীতির’ কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়টি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। রোববার (২২ ডিসেম্বর) পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি দুর্নীতির কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব না হওয়ার কথা তুলে ধরলেন।
থাইল্যান্ডের ব্যাংককে গত বৃহস্পতিবার মায়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে ছয় দেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে অংশ নিয়ে ঢাকায় ফিরে সে বিষয়ে কথা বলতে রোববার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে দুর্নীতির কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই দুর্নীতির কারণে স্থল, জলসীমাসহ সীমান্তের নানা রুট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আটকানো খুব কঠিন হচ্ছে।
সীমান্তে দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আর একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রচুর দুর্নীতি আছে সীমান্তে। এটা সত্যি। এটা অস্বীকার করার কোনো অর্থ নেই। দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর ঢুকে যাচ্ছে (রোহিঙ্গারা)। নৌকা নিয়ে ঢুকছে। তবে একটা সীমান্ত দিয়ে যে ঢুকছে বিষয়টা এমন নয়। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে যে ঢুকছে এটা আটকানো খুব কঠিন হচ্ছে। তবে আমি মনে করি না আর একটি ঢল আসবে। যদিও অনেকে আশঙ্কা করছেন। এই আশঙ্কা আমাদেরও আছে। তবে সেই ঢলকে আটকানোর ব্যবস্থা করতে হবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়েই।’
গত দুই মাসে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে নতুন করে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের নীতিগতভাবে অবস্থান ছিল আর কোনো রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেব না। তবে পরিস্থিতি কখনো কখনো এমন দাঁড়ায় যে আমাদের কিছু আর করার থাকে না। সে রকম পরিস্থিতিতে আমরা ৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দিয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে যে তাদের ঢুকতে দিয়েছি, তা-ও নয়, তারা বিভিন্ন পথে ঢুকেছেন।’
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পুরো অঞ্চলে কীভাবে অশনিসংকেত সৃষ্টি করছে, তা জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এখন বয়স্ক যেসব রোহিঙ্গা আছেন, তারা হয়তো পরিস্থিতি মেনে নেবেন। তবে আগামী ৫ বছর পর যেসব তরুণ রোহিঙ্গার বয়স ২০ বছর হবে, তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবেন। তখন আমাদের সমস্যা বেশি হবে ঠিকই, তবে সেই সমস্যা প্রত্যেকেরই হবে। এর মধ্যেই নৌকায় রোহিঙ্গারা অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন।’
ব্যাংককে মায়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান সোয়ের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘তাকে (থান সোয়ে) বলেছি মায়ানমার সীমান্তে তো তোমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সীমান্ত তো রাষ্ট্রবহির্ভূত শক্তির (নন-স্টেট অ্যাক্টর) নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। রাষ্ট্র হিসেবে তো আমরা নন-স্টেট অ্যাক্টরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি না। কাজেই তাদের দেখতে হবে কোন পদ্ধতিতে সীমান্ত ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
মায়ানমার সীমান্তবর্তী স্ক্যাম সেন্টারের অনেকটি চীন নষ্ট করে দিয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। এখন স্ক্যাম সেন্টারগুলো মূলত থাইল্যান্ড ও লাওসের সীমান্তে আছে বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘এসব সেন্টারে অনেক বাঙালি আটকে পড়েছেন। সবাই যে পাচারের মাধ্যমে গেছেন, তা কিন্তু নয়। অনেকেই লোভে পড়ে সেখানে গেছেন।’ তৌহিদ হোসেন বলেছেন, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে নেয়া নন-স্টেট অ্যাক্টরের (আরাকান আর্মি) সঙ্গে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দর কষাকষি করতে পারে না।
ওই আলোচনা সভার বিষয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘মূল বিষয় ছিল তিনটা। সীমান্ত, মাদক ও অস্ত্র, মানব পাচার। আর মায়ানমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও বর্তামান অবস্থা নিয়ে। একেবারে সবাই মায়ানমারকে সমর্থন করতে চায়। তারা (মায়ানমার) যদি সমস্যা মিটিয়ে ফেলে তাহলে তাদের জন্য একটা পথ ঠিক করুন। একজন অবশ্য বলেছেন, একটা ফেডারেল স্ট্রাকচার প্রত্যাশিত। কেউ বিশ্বাস করেন না যে, মায়ানমারে আজকে তিন বছর বা পাঁচ বছর আগে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় ফিরে যাবে।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘যদি প্রত্যাশা করত এই আলোচনার দরকার ছিল না। সবাই বলেছে, আমরা মায়ানমারকে সমর্থন করব, তারা যদি করতে চায় (ফেডারেল স্ট্রাকচার) আমরা হস্তক্ষেপ করব না। কিন্তু আমরা চাই সমাধান হোক।’
সীমান্ত ইস্যুতে আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, সীমান্তের ব্যাপারে প্রধানত, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ সীমান্ত নিয়ে বেশি কথা হয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিমের সীমান্ত, যেখানে আমাদের স্বার্থ আছে। স্ক্যাম সেন্টার কতগুলো গড়ে উঠেছে, যেটায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হয়; সেই অপরাধ নিয়ে তারা খুব উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া মাদক তো আছেই। অপরাধ এবং বর্ডার ইস্যুতে বলা হয়েছে, মায়ানমার যেন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়।
মায়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ার পর থেকে কক্সবাজার ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশ আর প্লাস্টিকের খুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। এরপর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মায়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। আগের সরকারের আমলে কয়েক দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নথিপত্র চালাচালি হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উপরন্তু মায়ানমারে গৃহযুদ্ধ সব ভেস্তে দিয়েছে। রাখাইনে তীব্র যুদ্ধের তীব্রতায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ চলার মধ্যে আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা দেয়, আর কোনো রোহিঙ্গাকে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
২০১৭ সালের মতো আবারও রোহিঙ্গাদের ঢল নামতে পারে, এমন আশঙ্কার বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি এখনও মনে করি না যে, আরেকটা ঢলের মত কিছু আসবে। যদিও অনেকে এ রকম আশঙ্কা করছেন।’
তিনি বলেন, ‘আশঙ্কা আমাদের আছে, কিন্তু সেই ঢলটা ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে আমাদেরকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি তাদেরকে এটাও বলেছি যে, এখানে যে রোহিঙ্গা যারা আছে, তাদের ডেমোগ্রাফিক প্যাটার্ন দেখতে হবে, তাদের একটি বড় অংশ হচ্ছে এখনও শিশু, অনেকে টিনএজার এবং বিশের দশকে বয়স বেশিরভাগেরই।’
তিনি বলেন, ‘এই মানুষগুলির সামনে যদি আপনারা আশা দেখাতে না পারেন, টানেলের ওপারে আলো দেখাতে না পারেন, তারা ডেসপারেট থাকবে এবং ডেসপারেট লোকজন ডেসপারেট কার্যকলাপ করবেই; এটা আপনারা পছন্দ করুন বা না করুন। এটা আমি তাদেরকে স্পষ্ট করে বলেছি।’
থাইল্যান্ডে ছয় জাতি মতবিনিময়ের আগে মায়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথক বৈঠকে আলোচনার প্রসঙ্গে তৌহিদে হোসেন বলেন, ‘মায়ানমারের পক্ষ থেকে যখন আমার সঙ্গে কথা হয়েছে, তখন বলেছে, নাগরিকত্ব দীর্ঘ ইস্যু, অনেক আলোচনার বিষয় আছে।
‘আমি বলেছি যে, আমি নাগরিকত্ব নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলছি না, আমার কথা হলো যে, তাদেরকে অধিকার ও নিরাপত্তার সঙ্গে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এটা তোমাদের দায়িত্ব এবং আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বলেছি, আসিয়ানের এ ব্যাপারে সহায়তা চেয়েছি।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের যতটা উদ্বেগ, বাকি দেশগুলোর ক্ষেত্রে তেমন নয়। তাদের বেশি উদ্বেগ ছিল অন্যান্য ইস্যুতে।
তৌহিদ হোসেন বলেণ, ‘আমার সফরের ফলাফল কী? আমি এটুকু বলব যে, যেহেতু এটা ইনফর্মাল কনসালটেশন ছিল, কাজেই আমার পক্ষে সম্ভব ছিল অনেক বেশি কথা, যেটা হয়ত এটা অফিসিয়াল ভিজিট বা অফিসিয়াল মিটিংয়ে হয়ত এটা আমি বলতে পারি না। এই সুযোগটা আমি গ্রহণ করেছি এবং আমাদের অবস্থানটা খুব পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছি তাদের কাছে।’
# সেমিনারে যা বললেন উপদেষ্টা
রোববার রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড র্স্ট্যাটেজিক স্টাডিজে (বিআইআইএসএস) ‘রিকানেক্টিং দ্য বে অব বেঙ্গল রিজিয়ন: এক্সপ্লোরিং দ্য কনভারজেন্স অব ইন্টারেস্ট’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সে সেমিনারে বক্তায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনা উন্মোচনের জন্য মায়ানমারে শান্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, গৃহযুদ্ধ-জর্জরিত প্রতিবেশী দেশটিতে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় এর রাখাইন রাজ্যে টেকসই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অপরিহার্য।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত মায়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত মায়ানমার ও এই অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে মায়ানমারসহ সমুদ্র উপকূলীয় রাজ্যগুলোতে শান্তি ও সম্প্রীতি অপরিহার্য।
সেমিনারে বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। বিআইআইএসএস(বিস)-এর চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস।
সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
মায়ানমার থেকে যখন-তখন বাংলাদেশে বেআইনিভাবে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে নানা ধরনের ‘অনিয়ম ও দুর্নীতির’ কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়টি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। রোববার (২২ ডিসেম্বর) পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি দুর্নীতির কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব না হওয়ার কথা তুলে ধরলেন।
থাইল্যান্ডের ব্যাংককে গত বৃহস্পতিবার মায়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে ছয় দেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে অংশ নিয়ে ঢাকায় ফিরে সে বিষয়ে কথা বলতে রোববার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে দুর্নীতির কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই দুর্নীতির কারণে স্থল, জলসীমাসহ সীমান্তের নানা রুট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আটকানো খুব কঠিন হচ্ছে।
সীমান্তে দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আর একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রচুর দুর্নীতি আছে সীমান্তে। এটা সত্যি। এটা অস্বীকার করার কোনো অর্থ নেই। দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর ঢুকে যাচ্ছে (রোহিঙ্গারা)। নৌকা নিয়ে ঢুকছে। তবে একটা সীমান্ত দিয়ে যে ঢুকছে বিষয়টা এমন নয়। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে যে ঢুকছে এটা আটকানো খুব কঠিন হচ্ছে। তবে আমি মনে করি না আর একটি ঢল আসবে। যদিও অনেকে আশঙ্কা করছেন। এই আশঙ্কা আমাদেরও আছে। তবে সেই ঢলকে আটকানোর ব্যবস্থা করতে হবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়েই।’
গত দুই মাসে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে নতুন করে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের নীতিগতভাবে অবস্থান ছিল আর কোনো রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেব না। তবে পরিস্থিতি কখনো কখনো এমন দাঁড়ায় যে আমাদের কিছু আর করার থাকে না। সে রকম পরিস্থিতিতে আমরা ৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দিয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে যে তাদের ঢুকতে দিয়েছি, তা-ও নয়, তারা বিভিন্ন পথে ঢুকেছেন।’
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পুরো অঞ্চলে কীভাবে অশনিসংকেত সৃষ্টি করছে, তা জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এখন বয়স্ক যেসব রোহিঙ্গা আছেন, তারা হয়তো পরিস্থিতি মেনে নেবেন। তবে আগামী ৫ বছর পর যেসব তরুণ রোহিঙ্গার বয়স ২০ বছর হবে, তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবেন। তখন আমাদের সমস্যা বেশি হবে ঠিকই, তবে সেই সমস্যা প্রত্যেকেরই হবে। এর মধ্যেই নৌকায় রোহিঙ্গারা অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন।’
ব্যাংককে মায়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান সোয়ের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘তাকে (থান সোয়ে) বলেছি মায়ানমার সীমান্তে তো তোমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সীমান্ত তো রাষ্ট্রবহির্ভূত শক্তির (নন-স্টেট অ্যাক্টর) নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। রাষ্ট্র হিসেবে তো আমরা নন-স্টেট অ্যাক্টরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি না। কাজেই তাদের দেখতে হবে কোন পদ্ধতিতে সীমান্ত ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
মায়ানমার সীমান্তবর্তী স্ক্যাম সেন্টারের অনেকটি চীন নষ্ট করে দিয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। এখন স্ক্যাম সেন্টারগুলো মূলত থাইল্যান্ড ও লাওসের সীমান্তে আছে বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘এসব সেন্টারে অনেক বাঙালি আটকে পড়েছেন। সবাই যে পাচারের মাধ্যমে গেছেন, তা কিন্তু নয়। অনেকেই লোভে পড়ে সেখানে গেছেন।’ তৌহিদ হোসেন বলেছেন, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে নেয়া নন-স্টেট অ্যাক্টরের (আরাকান আর্মি) সঙ্গে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দর কষাকষি করতে পারে না।
ওই আলোচনা সভার বিষয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘মূল বিষয় ছিল তিনটা। সীমান্ত, মাদক ও অস্ত্র, মানব পাচার। আর মায়ানমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও বর্তামান অবস্থা নিয়ে। একেবারে সবাই মায়ানমারকে সমর্থন করতে চায়। তারা (মায়ানমার) যদি সমস্যা মিটিয়ে ফেলে তাহলে তাদের জন্য একটা পথ ঠিক করুন। একজন অবশ্য বলেছেন, একটা ফেডারেল স্ট্রাকচার প্রত্যাশিত। কেউ বিশ্বাস করেন না যে, মায়ানমারে আজকে তিন বছর বা পাঁচ বছর আগে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় ফিরে যাবে।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘যদি প্রত্যাশা করত এই আলোচনার দরকার ছিল না। সবাই বলেছে, আমরা মায়ানমারকে সমর্থন করব, তারা যদি করতে চায় (ফেডারেল স্ট্রাকচার) আমরা হস্তক্ষেপ করব না। কিন্তু আমরা চাই সমাধান হোক।’
সীমান্ত ইস্যুতে আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, সীমান্তের ব্যাপারে প্রধানত, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ সীমান্ত নিয়ে বেশি কথা হয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিমের সীমান্ত, যেখানে আমাদের স্বার্থ আছে। স্ক্যাম সেন্টার কতগুলো গড়ে উঠেছে, যেটায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হয়; সেই অপরাধ নিয়ে তারা খুব উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া মাদক তো আছেই। অপরাধ এবং বর্ডার ইস্যুতে বলা হয়েছে, মায়ানমার যেন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়।
মায়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ার পর থেকে কক্সবাজার ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশ আর প্লাস্টিকের খুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। এরপর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মায়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। আগের সরকারের আমলে কয়েক দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নথিপত্র চালাচালি হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উপরন্তু মায়ানমারে গৃহযুদ্ধ সব ভেস্তে দিয়েছে। রাখাইনে তীব্র যুদ্ধের তীব্রতায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ চলার মধ্যে আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা দেয়, আর কোনো রোহিঙ্গাকে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
২০১৭ সালের মতো আবারও রোহিঙ্গাদের ঢল নামতে পারে, এমন আশঙ্কার বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি এখনও মনে করি না যে, আরেকটা ঢলের মত কিছু আসবে। যদিও অনেকে এ রকম আশঙ্কা করছেন।’
তিনি বলেন, ‘আশঙ্কা আমাদের আছে, কিন্তু সেই ঢলটা ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে আমাদেরকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি তাদেরকে এটাও বলেছি যে, এখানে যে রোহিঙ্গা যারা আছে, তাদের ডেমোগ্রাফিক প্যাটার্ন দেখতে হবে, তাদের একটি বড় অংশ হচ্ছে এখনও শিশু, অনেকে টিনএজার এবং বিশের দশকে বয়স বেশিরভাগেরই।’
তিনি বলেন, ‘এই মানুষগুলির সামনে যদি আপনারা আশা দেখাতে না পারেন, টানেলের ওপারে আলো দেখাতে না পারেন, তারা ডেসপারেট থাকবে এবং ডেসপারেট লোকজন ডেসপারেট কার্যকলাপ করবেই; এটা আপনারা পছন্দ করুন বা না করুন। এটা আমি তাদেরকে স্পষ্ট করে বলেছি।’
থাইল্যান্ডে ছয় জাতি মতবিনিময়ের আগে মায়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথক বৈঠকে আলোচনার প্রসঙ্গে তৌহিদে হোসেন বলেন, ‘মায়ানমারের পক্ষ থেকে যখন আমার সঙ্গে কথা হয়েছে, তখন বলেছে, নাগরিকত্ব দীর্ঘ ইস্যু, অনেক আলোচনার বিষয় আছে।
‘আমি বলেছি যে, আমি নাগরিকত্ব নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলছি না, আমার কথা হলো যে, তাদেরকে অধিকার ও নিরাপত্তার সঙ্গে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এটা তোমাদের দায়িত্ব এবং আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বলেছি, আসিয়ানের এ ব্যাপারে সহায়তা চেয়েছি।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের যতটা উদ্বেগ, বাকি দেশগুলোর ক্ষেত্রে তেমন নয়। তাদের বেশি উদ্বেগ ছিল অন্যান্য ইস্যুতে।
তৌহিদ হোসেন বলেণ, ‘আমার সফরের ফলাফল কী? আমি এটুকু বলব যে, যেহেতু এটা ইনফর্মাল কনসালটেশন ছিল, কাজেই আমার পক্ষে সম্ভব ছিল অনেক বেশি কথা, যেটা হয়ত এটা অফিসিয়াল ভিজিট বা অফিসিয়াল মিটিংয়ে হয়ত এটা আমি বলতে পারি না। এই সুযোগটা আমি গ্রহণ করেছি এবং আমাদের অবস্থানটা খুব পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছি তাদের কাছে।’
# সেমিনারে যা বললেন উপদেষ্টা
রোববার রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড র্স্ট্যাটেজিক স্টাডিজে (বিআইআইএসএস) ‘রিকানেক্টিং দ্য বে অব বেঙ্গল রিজিয়ন: এক্সপ্লোরিং দ্য কনভারজেন্স অব ইন্টারেস্ট’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সে সেমিনারে বক্তায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনা উন্মোচনের জন্য মায়ানমারে শান্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, গৃহযুদ্ধ-জর্জরিত প্রতিবেশী দেশটিতে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় এর রাখাইন রাজ্যে টেকসই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অপরিহার্য।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত মায়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত মায়ানমার ও এই অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে মায়ানমারসহ সমুদ্র উপকূলীয় রাজ্যগুলোতে শান্তি ও সম্প্রীতি অপরিহার্য।
সেমিনারে বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। বিআইআইএসএস(বিস)-এর চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস।