চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে সারবোঝাই জাহাজে চঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফানকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় চাঁদপুরের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ফারহান সাদিক এই রিমান্ড দেন।
এর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। তার বিরুদ্ধে জিআর ১৬৬/২৪ এর মামলায় আদালতে ১০ দিন রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাঁদপুর সদরের হরিণা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. কালাম খা। এ বিষয়ে মো. কালাম খা জানান, আদালতে আমি ইরফানের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
জামিন শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন চাঁদপুর জেলা জজ কোর্টের এপিপি শরীফ মাহমুদ সায়েম, এপিপি মাসুদ প্রধানীয়া, এপিপি ইয়াসিন আরাফাত ইকরাম, এপিপি অ্যাডভোকেট শাহজাহান খান, আইনজীবী শামিম হোসেন, মিল্টন, তোফায়েল। আসামের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
এর আগে ২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিনগত রাতে আসামি আকাশ মন্ডল ইরফানকে র্যাব-৬ এর সহায়তায় র্যাব-১১ কুমিল্লায় অভিযান চালিয়ে বাগেরহাট জেলার চিতলমারী থেকে গ্রেপ্তার করে এবং দুপুরে তাকে কুমিল্লায় নিয়ে আসে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শরীফ মাহমুদ সায়েম বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা আশা করি, এই আসামিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসবাদের মাধ্যমে আসামির সঙ্গে অন্য কেউ সংশ্লিষ্ট আছে কিনা এবং রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার জন্য কেউ জড়িত আছে কিনা তা বেরিয়ে আসবে।
এর আগে বিকেলে র্যাব-১১ এর একটি দল আসামি আকাশ মন্ডলকে নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চল এর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে হস্তান্তর করেন।
ঘটনার রহস্য উন্মোচনে শ্রম মন্ত্রণালয় ৫ সদস্যে, জেলা প্রশাসনে ৪ সদস্যের এবং জেলা পুলিশ তিন সদস্যের আলাদা তদন্ত দল গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। আর জাহাজ মালিক মাহবুব মোর্শেদ মঙ্গলবার রাতেই হাইমচর থানায় ৩৯৬/৩৯৭ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন জাহাজের মালিক মাহাবুব মোর্শেদ। মামলা নম্বর (১৭ / ১৬৬)।
কুমিল্লা কার্যালয়ে র্যাবের প্রেস ব্রিফিং
বেতন আটকে রাখাসহ নানা বৈষম্য এবং এমভি-আল বাখেরা জাহাজের মাস্টারের দুর্ব্যবহার থেকে ক্ষোভের কারণেই লস্কর ইরফান প্রথমে জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ হত্যার সাক্ষী না রাখতে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আরও ৬ জনকে হত্যা করা হয়। এর আগে ইরফান রান্না করা তরকারির সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে দেয়। রাতের খাবার খেয়ে তারা সবাইকে অচেতন হয়ে পড়ে।
বুধবার দুপুরে কুমিল্লায় প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানায় র্যাব। তাদের দাবি, দেশের আলোচিত এই সাত খুনের ‘মাস্টার মাইন্ড’ জাহাজের লস্কর আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফানের জবানন্দির ভিত্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। র্যাব জানায়, তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় বাগেরহাটের চিতলমারী এলাকা থেকে র্যাব-১১ এর একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে বুধবার কুমিল্লায় নিয়ে আসে।
র্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জের উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন কুমিল্লা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রেস ব্রিফিংয়ে আরও জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইরফান জানায় সে প্রায় আট মাস ধরে ওই জাহাজে চাকরি করে আসছে। জাহাজের কর্মচারীরা বেতন-বোনাস ও ছুটি সময়মতো পেতো না। বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে মাস্টার গোলাম কিবরিয়া একাই ভোগ করতো, বিনা কারণে কর্মচারীদের গালমন্দসহ জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতো। বকেয়া বেতন দিতো না। এ বিষয়ে কেউ মাস্টারের ভয়ে প্রতিবাদ করতে সাহস পেতো না। এসব কারণে মাস্টারের প্রতি তার প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৮ ডিসেম্বর ৩ পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে নিজের কাছে রাখে এবং ঘটনার রাতে রান্না করা তরকারির মধ্যে ওই ৩ পাতার ৩০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। ওই রাতে ইরফান ও আহত জুয়েল ছাড়া সবাই খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে সাহারা বিকন এলাকায় আরও ৮-১০টি জাহাজের সঙ্গে সুকানি জুয়েল এবং ইরফান তাদের জাহাজটি নোঙর করে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাত সাড়ে ৩টায় প্রথমে মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে জাহাজে থাকা চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় কোনো সাক্ষী না রাখতে সে অন্যদের কুপিয়ে হত্যা করে এবং জুয়েলকে আহত করে মৃত ভেবে ফেলে রাখে। পরে সে ভোর সাড়ে পাঁচটায় জাহাজটি আবার ছাড়ে। একপর্যায়ে মাঝিরচর এলাকায় জাহাজটি আটকা পড়লে বাজার করার কথা বলে একটি চলন্ত ট্রলারে উঠে ইরফান বাগেরহাটের চিতলমারি এলাকায় আত্মগোপন করে।
আটক করার পর ইরফানের কাছ থেকে একটি হ্যান্ড গ্লাভস, ১টি লোটো ব্যাগ, ঘুমের ওষুধের খালি পাতা, নিহতদের ব্যবহৃত ৫টি ও তার ২টিসহ মোট ৭টি মোবাইল ফোন এবং রক্তমাখা একটি জিন্স প্যান্ট উদ্ধার করা হয়।
এ সময় র্যাবের কুমিল্লা কার্যালয়ের এএসপি মিঠুন কুমার কুণ্ডুসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। শেষে ইরফানকে চাঁদপুরের হাইমচর থানায় পাঠানো হয়।
গত ২২ ডিসেম্বর সকালে এমভি-আল বাখেরা জাহাজে ৭২০ টন ইউরিয়া সার নিয়ে চট্টগ্রাম হতে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুরের হাইমচরের মাঝিরচর এলাকায় ওই জাহাজে ৭ জনকে হত্যা ও এক জনকে গুরুতর জখম করার ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া (৬০), গ্রিজার মো. সজিবুল ইসলাম (২৯), লস্কর মাজেদুল ইসলাম (১৭), শেখ সবুজ (৩৫), আমিনুর মুন্সী (৪১), ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিন (৪০) ও বাবুর্চি রানা কাজী (৩৮)। এ ছাড়া আহত ব্যক্তি হলেন- সুকানি জুয়েল (২৮)। পরদিনই জাহাজের মালিক মাহবুব মোর্শেদ চাঁদপুরের হাইমচর থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে মামলা করেন। ঘটনাটি প্রথমে ডাকাতি বলে ধারণা করা হয়। এরপর থেকে ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ জড়িতদের গ্রেপ্তারে র্যাবের অভিযান শুরু হয়।
র্যাব তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার করে মঙ্গলবার রাতে বাগেরহাটের চিতলমারি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জাহাজের লস্কর আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে (২৬) গ্রেপ্তার করে। সে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের জগদীশ ম-লের ছেলে।
ইরফানের সোজা স্বীকারোক্তি
সাত জনকে ‘নৃশংসভাবে’ হত্যার ঘটনায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইরফান জানায়, পরিবার ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যারা আসে অধিকাংশ ছোট জাহাজে ছোট পদে ১০-১২ হাজার টাকা বেতন পেতো। এতে খোরাকির (খাবার) জন্য ৪ হাজার টাকা কেটে রাখা হতো। বাকি বেতনের টাকাও সময়মতো দেয়া হতো না। কারো কারো ৪-৫ মাস বাকি থাকতো। চাকরি যাওয়ার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতো না। আর প্রতিবাদ করলেই জাহাজ থেকে নামিয়ে দিয়ে বলা হতো বিকাশে টাকা চলে যাবে। আমার জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া নিয়মিত খারাপ ব্যবহার করতেন, গালাগালি করতেন এবং বেতন আটকে রাখতেন।
ইরফান বলেন, আমাদের মতো শ্রমিকদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে, পরে বাড়ি থেকে মাসের পর মাস মোবাইলে মালিককে কল করা হলে বিজি আছে বলে লাইন কেটে দিতেন। বলতেন মাস্টার বেতন দিবে। আমাদের স্ত্রী সন্তানরা কিনা খেয়ে মরবে। ১শ’ জন শ্রমিকের বকেয়া বেতনের মধ্যে অন্তত ৮০ জন বকেয়া বেতন আর পেতেন না। জাহাজের মাস্টারই শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ভাতা মেরে দিতেন।
তিনি বলেন, মেরিন জগত দুর্নীতিতে ভরে গেছে। তাই চিন্তা করেছি আমার জেল হোক, ফাঁসি হোক, আমি জেনে বুঝেই মাস্টারকে প্রথম এবং পরে অন্যদের একে একে খুন করি। আমি এ দুর্নীতির খবর দেশবাসী ও মিডিয়াকে জানালাম।
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে সারবোঝাই জাহাজে চঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফানকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় চাঁদপুরের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ফারহান সাদিক এই রিমান্ড দেন।
এর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। তার বিরুদ্ধে জিআর ১৬৬/২৪ এর মামলায় আদালতে ১০ দিন রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাঁদপুর সদরের হরিণা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. কালাম খা। এ বিষয়ে মো. কালাম খা জানান, আদালতে আমি ইরফানের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
জামিন শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন চাঁদপুর জেলা জজ কোর্টের এপিপি শরীফ মাহমুদ সায়েম, এপিপি মাসুদ প্রধানীয়া, এপিপি ইয়াসিন আরাফাত ইকরাম, এপিপি অ্যাডভোকেট শাহজাহান খান, আইনজীবী শামিম হোসেন, মিল্টন, তোফায়েল। আসামের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
এর আগে ২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিনগত রাতে আসামি আকাশ মন্ডল ইরফানকে র্যাব-৬ এর সহায়তায় র্যাব-১১ কুমিল্লায় অভিযান চালিয়ে বাগেরহাট জেলার চিতলমারী থেকে গ্রেপ্তার করে এবং দুপুরে তাকে কুমিল্লায় নিয়ে আসে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শরীফ মাহমুদ সায়েম বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা আশা করি, এই আসামিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসবাদের মাধ্যমে আসামির সঙ্গে অন্য কেউ সংশ্লিষ্ট আছে কিনা এবং রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার জন্য কেউ জড়িত আছে কিনা তা বেরিয়ে আসবে।
এর আগে বিকেলে র্যাব-১১ এর একটি দল আসামি আকাশ মন্ডলকে নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চল এর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে হস্তান্তর করেন।
ঘটনার রহস্য উন্মোচনে শ্রম মন্ত্রণালয় ৫ সদস্যে, জেলা প্রশাসনে ৪ সদস্যের এবং জেলা পুলিশ তিন সদস্যের আলাদা তদন্ত দল গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। আর জাহাজ মালিক মাহবুব মোর্শেদ মঙ্গলবার রাতেই হাইমচর থানায় ৩৯৬/৩৯৭ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন জাহাজের মালিক মাহাবুব মোর্শেদ। মামলা নম্বর (১৭ / ১৬৬)।
কুমিল্লা কার্যালয়ে র্যাবের প্রেস ব্রিফিং
বেতন আটকে রাখাসহ নানা বৈষম্য এবং এমভি-আল বাখেরা জাহাজের মাস্টারের দুর্ব্যবহার থেকে ক্ষোভের কারণেই লস্কর ইরফান প্রথমে জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ হত্যার সাক্ষী না রাখতে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আরও ৬ জনকে হত্যা করা হয়। এর আগে ইরফান রান্না করা তরকারির সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে দেয়। রাতের খাবার খেয়ে তারা সবাইকে অচেতন হয়ে পড়ে।
বুধবার দুপুরে কুমিল্লায় প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানায় র্যাব। তাদের দাবি, দেশের আলোচিত এই সাত খুনের ‘মাস্টার মাইন্ড’ জাহাজের লস্কর আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফানের জবানন্দির ভিত্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। র্যাব জানায়, তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় বাগেরহাটের চিতলমারী এলাকা থেকে র্যাব-১১ এর একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে বুধবার কুমিল্লায় নিয়ে আসে।
র্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জের উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন কুমিল্লা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রেস ব্রিফিংয়ে আরও জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইরফান জানায় সে প্রায় আট মাস ধরে ওই জাহাজে চাকরি করে আসছে। জাহাজের কর্মচারীরা বেতন-বোনাস ও ছুটি সময়মতো পেতো না। বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে মাস্টার গোলাম কিবরিয়া একাই ভোগ করতো, বিনা কারণে কর্মচারীদের গালমন্দসহ জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতো। বকেয়া বেতন দিতো না। এ বিষয়ে কেউ মাস্টারের ভয়ে প্রতিবাদ করতে সাহস পেতো না। এসব কারণে মাস্টারের প্রতি তার প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৮ ডিসেম্বর ৩ পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে নিজের কাছে রাখে এবং ঘটনার রাতে রান্না করা তরকারির মধ্যে ওই ৩ পাতার ৩০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। ওই রাতে ইরফান ও আহত জুয়েল ছাড়া সবাই খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে সাহারা বিকন এলাকায় আরও ৮-১০টি জাহাজের সঙ্গে সুকানি জুয়েল এবং ইরফান তাদের জাহাজটি নোঙর করে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাত সাড়ে ৩টায় প্রথমে মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে জাহাজে থাকা চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় কোনো সাক্ষী না রাখতে সে অন্যদের কুপিয়ে হত্যা করে এবং জুয়েলকে আহত করে মৃত ভেবে ফেলে রাখে। পরে সে ভোর সাড়ে পাঁচটায় জাহাজটি আবার ছাড়ে। একপর্যায়ে মাঝিরচর এলাকায় জাহাজটি আটকা পড়লে বাজার করার কথা বলে একটি চলন্ত ট্রলারে উঠে ইরফান বাগেরহাটের চিতলমারি এলাকায় আত্মগোপন করে।
আটক করার পর ইরফানের কাছ থেকে একটি হ্যান্ড গ্লাভস, ১টি লোটো ব্যাগ, ঘুমের ওষুধের খালি পাতা, নিহতদের ব্যবহৃত ৫টি ও তার ২টিসহ মোট ৭টি মোবাইল ফোন এবং রক্তমাখা একটি জিন্স প্যান্ট উদ্ধার করা হয়।
এ সময় র্যাবের কুমিল্লা কার্যালয়ের এএসপি মিঠুন কুমার কুণ্ডুসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। শেষে ইরফানকে চাঁদপুরের হাইমচর থানায় পাঠানো হয়।
গত ২২ ডিসেম্বর সকালে এমভি-আল বাখেরা জাহাজে ৭২০ টন ইউরিয়া সার নিয়ে চট্টগ্রাম হতে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুরের হাইমচরের মাঝিরচর এলাকায় ওই জাহাজে ৭ জনকে হত্যা ও এক জনকে গুরুতর জখম করার ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া (৬০), গ্রিজার মো. সজিবুল ইসলাম (২৯), লস্কর মাজেদুল ইসলাম (১৭), শেখ সবুজ (৩৫), আমিনুর মুন্সী (৪১), ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিন (৪০) ও বাবুর্চি রানা কাজী (৩৮)। এ ছাড়া আহত ব্যক্তি হলেন- সুকানি জুয়েল (২৮)। পরদিনই জাহাজের মালিক মাহবুব মোর্শেদ চাঁদপুরের হাইমচর থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে মামলা করেন। ঘটনাটি প্রথমে ডাকাতি বলে ধারণা করা হয়। এরপর থেকে ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ জড়িতদের গ্রেপ্তারে র্যাবের অভিযান শুরু হয়।
র্যাব তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার করে মঙ্গলবার রাতে বাগেরহাটের চিতলমারি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জাহাজের লস্কর আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে (২৬) গ্রেপ্তার করে। সে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের জগদীশ ম-লের ছেলে।
ইরফানের সোজা স্বীকারোক্তি
সাত জনকে ‘নৃশংসভাবে’ হত্যার ঘটনায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইরফান জানায়, পরিবার ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যারা আসে অধিকাংশ ছোট জাহাজে ছোট পদে ১০-১২ হাজার টাকা বেতন পেতো। এতে খোরাকির (খাবার) জন্য ৪ হাজার টাকা কেটে রাখা হতো। বাকি বেতনের টাকাও সময়মতো দেয়া হতো না। কারো কারো ৪-৫ মাস বাকি থাকতো। চাকরি যাওয়ার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতো না। আর প্রতিবাদ করলেই জাহাজ থেকে নামিয়ে দিয়ে বলা হতো বিকাশে টাকা চলে যাবে। আমার জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া নিয়মিত খারাপ ব্যবহার করতেন, গালাগালি করতেন এবং বেতন আটকে রাখতেন।
ইরফান বলেন, আমাদের মতো শ্রমিকদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে, পরে বাড়ি থেকে মাসের পর মাস মোবাইলে মালিককে কল করা হলে বিজি আছে বলে লাইন কেটে দিতেন। বলতেন মাস্টার বেতন দিবে। আমাদের স্ত্রী সন্তানরা কিনা খেয়ে মরবে। ১শ’ জন শ্রমিকের বকেয়া বেতনের মধ্যে অন্তত ৮০ জন বকেয়া বেতন আর পেতেন না। জাহাজের মাস্টারই শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ভাতা মেরে দিতেন।
তিনি বলেন, মেরিন জগত দুর্নীতিতে ভরে গেছে। তাই চিন্তা করেছি আমার জেল হোক, ফাঁসি হোক, আমি জেনে বুঝেই মাস্টারকে প্রথম এবং পরে অন্যদের একে একে খুন করি। আমি এ দুর্নীতির খবর দেশবাসী ও মিডিয়াকে জানালাম।