রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, সাংবিধানিক নাম ও কাঠামো বদলের প্রস্তাব
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সংবিধান সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ প্রতিবেদনে রাষ্ট্রের মূলনীতি, সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন এবং সংসদীয় কাঠামো পুনর্গঠনের প্রস্তাব উল্লেখ করা হয়েছে।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। পরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করে সুপারিশগুলোর বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন।
আলী রীয়াজ বলেন, “১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে আমরা নতুন রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সুপারিশ করেছি। এগুলো হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র।”
বর্তমান সংবিধানে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ থাকলেও কমিশন এই নীতিগুলোর পরিবর্তন চায়। তাদের মতে, নতুন নীতিগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতির শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
বর্তমান নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, “গণপ্রজাতন্ত্রী শব্দে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রকৃত ধারণা প্রতিফলিত হয় না। আমরা মনে করি, জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামটি অধিকতর উপযুক্ত।”
কমিশন মৌলিক অধিকারের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি এর সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেছে। অধ্যাপক রীয়াজ জানান, “আমরা একটি সমন্বিত মৌলিক অধিকার সনদ প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছি, যা নাগরিকদের অধিকারের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।”
প্রতিবেদন তৈরিতে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত এবং ৩২ জন গবেষকের কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং বিভিন্ন অংশীজনদের মতামত বিবেচনা করা হয়েছে।
সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তন এনে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব করেছে কমিশন। নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভিত্তিতে এবং উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, “গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ যে একনায়কতন্ত্রের শিকার হয়েছে, তার মূল কারণ হলো ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব। এককভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের সংস্কৃতি বন্ধ করতে দ্বিকক্ষের সংসদ ও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে।”
এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দলীয় নেতা এবং সংসদের স্পিকারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হবে। এতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে বলে কমিশনের মত।
কমিশন প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে সংসদে অনাস্থা ভোটের সুযোগ ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছে। অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, “৭০ অনুচ্ছেদের কিছু পরিবর্তন এনে প্রধানমন্ত্রীর ওপর জবাবদিহিতার কাঠামো তৈরি করা হবে।”
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য একটি বিশেষ নির্বাচকমণ্ডলীর প্রস্তাব করেছে কমিশন। এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের দায়িত্ব জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ওপর অর্পণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিভাগীয় শহরে হাই কোর্টের স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে কমিশন। এটি জনগণের ন্যায়বিচারের অধিকারকে সুগম করবে বলে মনে করেন অধ্যাপক রীয়াজ।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমন্বয় কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশন মনে করে, “শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং ন্যায়বিচার আরও কার্যকর হবে।”
সংবিধান সংস্কারের এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য কামনা করেছেন অধ্যাপক রীয়াজ। তিনি বলেন, “গণআন্দোলনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য অপরিহার্য।”
সংবিধান সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশমালা নতুন বাংলাদেশ গড়ার একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। তবে এসব পরিবর্তন কার্যকর করতে সরকারের সদিচ্ছা এবং রাজনৈতিক দলের ঐক্য একান্ত প্রয়োজন।
রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, সাংবিধানিক নাম ও কাঠামো বদলের প্রস্তাব
বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সংবিধান সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ প্রতিবেদনে রাষ্ট্রের মূলনীতি, সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন এবং সংসদীয় কাঠামো পুনর্গঠনের প্রস্তাব উল্লেখ করা হয়েছে।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। পরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করে সুপারিশগুলোর বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন।
আলী রীয়াজ বলেন, “১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে আমরা নতুন রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সুপারিশ করেছি। এগুলো হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র।”
বর্তমান সংবিধানে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ থাকলেও কমিশন এই নীতিগুলোর পরিবর্তন চায়। তাদের মতে, নতুন নীতিগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতির শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
বর্তমান নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, “গণপ্রজাতন্ত্রী শব্দে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রকৃত ধারণা প্রতিফলিত হয় না। আমরা মনে করি, জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামটি অধিকতর উপযুক্ত।”
কমিশন মৌলিক অধিকারের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি এর সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেছে। অধ্যাপক রীয়াজ জানান, “আমরা একটি সমন্বিত মৌলিক অধিকার সনদ প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছি, যা নাগরিকদের অধিকারের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।”
প্রতিবেদন তৈরিতে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত এবং ৩২ জন গবেষকের কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং বিভিন্ন অংশীজনদের মতামত বিবেচনা করা হয়েছে।
সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তন এনে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব করেছে কমিশন। নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভিত্তিতে এবং উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, “গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ যে একনায়কতন্ত্রের শিকার হয়েছে, তার মূল কারণ হলো ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব। এককভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের সংস্কৃতি বন্ধ করতে দ্বিকক্ষের সংসদ ও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে।”
এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দলীয় নেতা এবং সংসদের স্পিকারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হবে। এতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে বলে কমিশনের মত।
কমিশন প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে সংসদে অনাস্থা ভোটের সুযোগ ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছে। অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, “৭০ অনুচ্ছেদের কিছু পরিবর্তন এনে প্রধানমন্ত্রীর ওপর জবাবদিহিতার কাঠামো তৈরি করা হবে।”
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য একটি বিশেষ নির্বাচকমণ্ডলীর প্রস্তাব করেছে কমিশন। এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের দায়িত্ব জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ওপর অর্পণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিভাগীয় শহরে হাই কোর্টের স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে কমিশন। এটি জনগণের ন্যায়বিচারের অধিকারকে সুগম করবে বলে মনে করেন অধ্যাপক রীয়াজ।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমন্বয় কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশন মনে করে, “শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং ন্যায়বিচার আরও কার্যকর হবে।”
সংবিধান সংস্কারের এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য কামনা করেছেন অধ্যাপক রীয়াজ। তিনি বলেন, “গণআন্দোলনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য অপরিহার্য।”
সংবিধান সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশমালা নতুন বাংলাদেশ গড়ার একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। তবে এসব পরিবর্তন কার্যকর করতে সরকারের সদিচ্ছা এবং রাজনৈতিক দলের ঐক্য একান্ত প্রয়োজন।