সাংবিধানিক সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর
বাংলাদেশে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্র ও নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলো তাদের সুপারিশমালা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গঠিত এই কমিশনগুলোর মূল লক্ষ্য হলো স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের আকাঙ্ক্ষার আলোকে কমিশন রাষ্ট্রের পাঁচটি নতুন মূলনীতি প্রস্তাব করেছে। এগুলো হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র। বর্তমান সংবিধানের ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ ভিত্তিক মূলনীতির জায়গায় এই প্রস্তাবগুলো আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছি। কারণ, এটি দেশের জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত আইনি কাঠামো আরও শক্তিশালী করার প্রস্তাবও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। আলী রীয়াজের ভাষায়, “আমরা একটি সমন্বিত মৌলিক অধিকার সনদের সুপারিশ করেছি, যা সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত এবং প্রয়োগযোগ্য।”
নতুন কাঠামো: দ্বিকক্ষ সংসদ ও জাতীয় কাউন্সিল
সংবিধানে একটি দ্বিকক্ষ সংসদ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নিম্নকক্ষের প্রতিনিধিত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এবং উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে করার সুপারিশ এসেছে।
ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এই কাউন্সিল প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার একচ্ছত্রতা কমিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করবে।
নির্বাচন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার লক্ষ্যে ১৫০ সুপারিশ:
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রায় ১৫০টি সুপারিশ করেছে, যার লক্ষ্য হলো ভেঙে পড়া নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা। কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে এ সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ।”
কমিশন প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, নির্বাচনী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া সুসংহত করা, এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবের বিষয়টি তুলে ধরে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “দলগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এজন্য আমরা দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছি।”
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর উল্লেখ করে বদিউল আলম বলেন, “যারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছি। বিশেষ করে ২০১৮ সালের মধ্যরাতে ঘটানো অনিয়মের তদন্ত প্রয়োজন।”
সংবিধান সংস্কার কমিশন বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের এখতিয়ার ও মর্যাদাসম্পন্ন আদালত স্থাপনের সুপারিশ করেছে। আলী রীয়াজ বলেন, “ন্যায়বিচার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।”
সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে সমন্বয় কাউন্সিল গঠনের সুপারিশ করেছে। জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে এই সমন্বয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করা হবে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একটি নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই প্রক্রিয়া জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে অর্পণের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন প্রণয়নে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এ উদ্যোগের প্রসঙ্গে বদিউল আলম বলেন, “গ্রামের মানুষের প্রত্যাশা ছিল সংসদ ভবনে কুৎসিত আচরণকারী কেউ যেন প্রবেশ করতে না পারে। এটি আমাদের জন্য ম্যান্ডেট ছিল।”
এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি কার্যকর, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আশা প্রকাশ করেছেন দুই কমিশনের প্রধান।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “এটি আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল। এ কাজের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাবে।”
সাংবিধানিক সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর
বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫
বাংলাদেশে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্র ও নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলো তাদের সুপারিশমালা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গঠিত এই কমিশনগুলোর মূল লক্ষ্য হলো স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের আকাঙ্ক্ষার আলোকে কমিশন রাষ্ট্রের পাঁচটি নতুন মূলনীতি প্রস্তাব করেছে। এগুলো হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র। বর্তমান সংবিধানের ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ ভিত্তিক মূলনীতির জায়গায় এই প্রস্তাবগুলো আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছি। কারণ, এটি দেশের জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত আইনি কাঠামো আরও শক্তিশালী করার প্রস্তাবও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। আলী রীয়াজের ভাষায়, “আমরা একটি সমন্বিত মৌলিক অধিকার সনদের সুপারিশ করেছি, যা সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত এবং প্রয়োগযোগ্য।”
নতুন কাঠামো: দ্বিকক্ষ সংসদ ও জাতীয় কাউন্সিল
সংবিধানে একটি দ্বিকক্ষ সংসদ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নিম্নকক্ষের প্রতিনিধিত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এবং উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে করার সুপারিশ এসেছে।
ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এই কাউন্সিল প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার একচ্ছত্রতা কমিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করবে।
নির্বাচন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার লক্ষ্যে ১৫০ সুপারিশ:
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রায় ১৫০টি সুপারিশ করেছে, যার লক্ষ্য হলো ভেঙে পড়া নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা। কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে এ সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ।”
কমিশন প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, নির্বাচনী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া সুসংহত করা, এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবের বিষয়টি তুলে ধরে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “দলগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এজন্য আমরা দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছি।”
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর উল্লেখ করে বদিউল আলম বলেন, “যারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছি। বিশেষ করে ২০১৮ সালের মধ্যরাতে ঘটানো অনিয়মের তদন্ত প্রয়োজন।”
সংবিধান সংস্কার কমিশন বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের এখতিয়ার ও মর্যাদাসম্পন্ন আদালত স্থাপনের সুপারিশ করেছে। আলী রীয়াজ বলেন, “ন্যায়বিচার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।”
সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে সমন্বয় কাউন্সিল গঠনের সুপারিশ করেছে। জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে এই সমন্বয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করা হবে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একটি নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই প্রক্রিয়া জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে অর্পণের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন প্রণয়নে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এ উদ্যোগের প্রসঙ্গে বদিউল আলম বলেন, “গ্রামের মানুষের প্রত্যাশা ছিল সংসদ ভবনে কুৎসিত আচরণকারী কেউ যেন প্রবেশ করতে না পারে। এটি আমাদের জন্য ম্যান্ডেট ছিল।”
এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি কার্যকর, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আশা প্রকাশ করেছেন দুই কমিশনের প্রধান।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “এটি আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল। এ কাজের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাবে।”