ভর্তুকির চাপ কমাতে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, তবে বিষয়টি এখন বিইআরসির এখতিয়ারে : জ্বালানি সচিব যেহেতু উৎপাদন খরচ ও বিতরণে (বিক্রি) ফারাক আছে, ভর্তুকির বিষয় আছে। তাই সিদ্ধান্তের আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনার গুরুত্ব আছে। তবে কমিশন সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে: বিইআরসি চেয়ারম্যান শিল্পের বয়লার ও ক্যাপটিভে দাম প্রায় ১৫০% বৃদ্ধি এবং আবাসিকে মাসিক বিল ৩০০ টাকার বেশি বৃদ্ধির প্রস্তাব
ভর্তুকির ‘চাপ কমাতে’ গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাইকারি গ্যাসের দাম বাড়াতে নতুন বছরের শুরুতেই বিইআরসিকে প্রস্তাব দিয়েছে রাষ্ট্রীয় তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এরপর তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ সরকারি ছয়টি বিতরণ কোম্পানি খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে।
আবেদনে শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত বয়লারে এবং শিল্প কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে (জেনারেটর) বা ক্যাপটিভে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম প্রায় দেড়শ’ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বর্তমানে বয়লারে প্রতি ঘনমিটারে দাম ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভে ৩১ টাকা ৫০ পয়সা।
প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর বিয়াম অডিটরিয়ামে ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির’ আয়োজন করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
ভর্তুকির অজুহাত
গ্যাস সংকট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে দুই বছর আগে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। দাম বাড়লেও গ্যাসের সংকট কাটেনি। শিল্প এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপের অভিযোগ রয়েছে শিল্পমালিকদের। বাসাবাড়িতে চুলায় গ্যাস মেলে না এমন অভিযোগ রাজধানীর অনেক এলাকা থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে যুক্তি দেয়া হয়েছে, ‘যদি গ্যাসের দাম না বাড়ানো হয়, তাহলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে গিয়ে চলতি বছরে সরকারকে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হবে।’
যা বললেন জ্বালানি সচিব
জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বিষয়টি কমিশনের (বিইআরসি) অধীনে। কমিশন প্রস্তাব যাচাই-বাছাই, মূল্যায়ন করবে। গণশুনানি করবে। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
সচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে আসছে অর্ধেকের মতো। আর ২৫ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে জোগান দেয়া হচ্ছে। এতে অনেক টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।’ গ্যাস সংকট মোকাবিলায় চলতি বছর ১০১ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনার কথা জানান জ্বালানি সচিব। তিনি বলেন, ‘১০১ কার্গো আমদানি করে বিদ্যমান দরে বিক্রি করলে বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। এক কার্গো এলএনজি আমদানিতে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা খরচ হয়। যা বছরে দাঁড়াবে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা।’ ‘ভর্তুকির চাপ কমাতেই’ শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রস্তাবে যা আছে
পেট্রোবাংলার দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘প্রতি ঘনমিটার এলএনজির বর্তমান আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫ টাকা ৭০ পয়সা। ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে তা দাঁড়ায় ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা। ফলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাসের মূল্যের এ ফারাক কমাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার ঘাটতি হবে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা।’
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, ‘দেশীয় গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুতে সর্বাধিক প্রভাব পড়েছে। চাহিদা পূরণ করতে দেশীয় গ্যাসফিল্ডগুলো থেকে পাওয়া গ্যাসের সঙ্গে ২৫ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করা হচ্ছে। আগামীতে ক্রমান্বয়ে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে এবং এলএনজি আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ২০৩০-৩১ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে ৭৫ শতাংশ।’
পেট্রোবাংলার প্রস্তাব পাওয়ার পর বিইআরসির পক্ষ থেকে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। বিতরণ কোম্পানিগুলো পেট্রোবাংলার প্রস্তাব অনুসরণ করে প্রস্তাব জমা দিয়েছে। বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি) এসব প্রস্তাব বিশ্লেষণ করছে।
আবাসিকে যে সমীকরণ
পাইপলাইনের মিটারবিহীন গ্রাহকরা বাস্তবে যতটুকু গ্যাস ব্যবহার করে বিতরণ কোম্পানিগুলো এরচেয়ে বেশি বিল ধার্য করে রেখেছে, এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিছু এলাকায় গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপনের পর
এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। দেখা যায়, অনেক প্রিপেইড গ্রাহকদের বিল মাসে ৫০০ টাকা আসছে, যেখানে পাইপলাইনে তাদের এক হাজারের বেশি বিল দিতে হতো।
অনেক এলাকায় গ্যাস না পেয়েও নিয়মিত মাসিক বিল দিচ্ছেন মিটারবিহীন গ্রাহকরা। এতে বড় অঙ্কের লাভ গুনছে তিতাস গ্যাস। অন্য কোম্পানিগুলোরও লাভ হচ্ছে। অভিযোগ আছে, লাভ কমে যাওয়ার আশঙ্কায় তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ কয়েকটি বিতরণ কোম্পানি প্রিপেইড মিটার স্থাপন একরকম বন্ধ করে দেয়।
বর্তমানে আবাসিকে পাইপলাইনের মিটারবিহীন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে সিঙ্গেল বার্নারে (একমুখী চুলা) মাসে বিল ৯৯০ টাকা এবং ডাবল বার্নারে (দ্বিমুখী চুলা) ১০৮০ টাকা।
*কম ব্যবহার, বেশি বিল*
সর্বশেষ গণশুনানি করে বিইআরসি গ্যাসের দাম বাড়ানোর আদেশ দেয় ২০২২ সালের ৫ জুন। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পাইপলাইনে গড়ে এক চুলা ৪০ এবং দুই চুলা সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করছে। এই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে পাইপলাইনের এক চুলায় ব্যবহার ৫৫ ঘনমিটার এবং দুই চুলায় ব্যবহার ৬০ ঘনমিটার নির্ধারণ করা হয়। বিল নির্ধারণ করা হয় যথাক্রমে ৯৯০ ও ১০৮০ টাকা।
বিইআরসিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর জমা দেয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘সব মিটারবিহীন গ্রাহকের আঙিনায় প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত গ্যাস বিপণন নিয়মাবলি-২০১৪ অনুযায়ী এক চুলা (সিঙ্গেল বার্নার) ও দুই চুলার (ডাবল বার্নার) গ্যাস ভোগ নির্ধারণ করা হলে তা প্রকৃত গ্যাস ব্যবহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।’
ওই নিয়মাবলিতে, এক চুলায় ৭৩ দশমিক ৪১ ঘনমিটার এবং দুই চুলায় ৭৭ দশমিক ৪১ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার ধরে পাইপলাইনের মিটারবিহীন গ্রাহকদের বিল নির্ধারণ করা আছে। বাখরাবাদ ও কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির প্রস্তাব আমলে নেয়া হলে মিটারবিহীন গ্রাহকদের এক ও দুই চুলার বিল যথাক্রমে ১৩২১ ও ১৩৯৩ টাকা হবে।
* মিটারবিহীন গ্রাহক, সমীক্ষা*
মাসিক বিল আরও বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব তিতাস গ্যাস কোম্পানি ২০২৩ সালেই দিয়ে রেখেছে। কোম্পানিটি ২০২৩ সালে বিইআরসিতে জমা দেয়া এক আবেদনে পাইপলাইনে মিটারবিহীন গ্রাহকদের এক চুলায় গ্যাসের ব্যবহার ৭৬ দশমিক ৬৫ ঘনমিটার ও দুই চুলায় গ্যাসের ব্যবহার ৮৮ দশমিক ৪৪ ঘনমিটার করার কথা বলেছে।
বিইআরসি এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘যে কোনো কোম্পানি প্রস্তাব দিতেই পারে। বিইআরসির দায়িত্ব প্রস্তাব মূল্যায়ন করা। পাইপলাইনে মিটারবিহীন গ্রাহক আসলে মাসে কী পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে সমীক্ষা করার উদ্যোগ কমিশনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তিতাস গ্যাসসহ অন্যান্য বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের উপর রিপোর্ট দেবে বিইআরসির টেকনিক্যাল ইভাল্যুয়েশন কমিটি (টিইসি)।’
*‘সিস্টেম লস’*
পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি ও সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি ছাড়া অন্যান্য কোম্পানি ‘সিস্টেম লস’ যৌক্তিক করার আবেদন করেছে। বিইআরসির ২০২২ সালের আদেশে সিস্টেম লস ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বাধিক ‘সিস্টেম লস’ দিয়েছে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। ওই অর্থবছরে কোম্পানিটির সামগ্রিক সিস্টেম লস ছিল ১০.০৬ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে যথাক্রমে তিতাস গ্যাস (৭.৬৭ শতাংশ), কর্ণফুলী (৩.২১ শতাংশ), জালালাবাদ (০.৬৮ শতাংশ)। আর ‘সিস্টেম গেইন’ করেছে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে বিতরণের দায়িত্বে থাকা পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটি বিদায়ী অর্থবছরে ১.৯৬ শতাংশ সিস্টেম গেইন করেছে।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সভা, সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, দেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে শিল্পোৎপাদন তথা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই প্রেক্ষাপটে, এখনই গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ না নিতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে যে গ্যাস মজুদ রয়েছে এই গ্যাস উত্তোলনের বড় কোনো পরিকল্পনা নেই। আগের সরকার এলএনজি বিশেষত স্পট মার্কেটের এলএনজি কেনায় বেশি আগ্রহী ছিল, এই সরকারও তাই করছে। জ্বালানি নিরাপত্তা সংহত করতে হলে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হবে।’
*পেট্রোবাংলা ও ৬ বিতরণ কোম্পানি*
বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে পেট্রোবাংলার পাইকারি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হবে। এরপর ছয় বিতরণ কোম্পানি- তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল), কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল), জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (জেজিটিডিসিএল), বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (বিজিডিসিএল), পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল) এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিসিএল) প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হবে। গণশুনানি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি, ভোক্তাসহ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
*বিইআরসি চেয়ারম্যানের বক্তব্য*
গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, উৎপাদন খরচ ও সরবরাহের (বিক্রি) মধ্যে যেহেতু একটা ফারাক রয়েছে, সরকার কী পরিমাণ ভর্তুকি দেবে, সেটা জানার বিষয়ও আছে। তাই মূল্য সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার গুরুত্বও আছে। তবে জালাল আহমেদ বলেছেন, কমিশন সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে’।
ভর্তুকির চাপ কমাতে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, তবে বিষয়টি এখন বিইআরসির এখতিয়ারে : জ্বালানি সচিব যেহেতু উৎপাদন খরচ ও বিতরণে (বিক্রি) ফারাক আছে, ভর্তুকির বিষয় আছে। তাই সিদ্ধান্তের আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনার গুরুত্ব আছে। তবে কমিশন সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে: বিইআরসি চেয়ারম্যান শিল্পের বয়লার ও ক্যাপটিভে দাম প্রায় ১৫০% বৃদ্ধি এবং আবাসিকে মাসিক বিল ৩০০ টাকার বেশি বৃদ্ধির প্রস্তাব
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
ভর্তুকির ‘চাপ কমাতে’ গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাইকারি গ্যাসের দাম বাড়াতে নতুন বছরের শুরুতেই বিইআরসিকে প্রস্তাব দিয়েছে রাষ্ট্রীয় তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এরপর তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ সরকারি ছয়টি বিতরণ কোম্পানি খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে।
আবেদনে শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত বয়লারে এবং শিল্প কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে (জেনারেটর) বা ক্যাপটিভে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম প্রায় দেড়শ’ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বর্তমানে বয়লারে প্রতি ঘনমিটারে দাম ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভে ৩১ টাকা ৫০ পয়সা।
প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর বিয়াম অডিটরিয়ামে ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির’ আয়োজন করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
ভর্তুকির অজুহাত
গ্যাস সংকট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে দুই বছর আগে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। দাম বাড়লেও গ্যাসের সংকট কাটেনি। শিল্প এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপের অভিযোগ রয়েছে শিল্পমালিকদের। বাসাবাড়িতে চুলায় গ্যাস মেলে না এমন অভিযোগ রাজধানীর অনেক এলাকা থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে যুক্তি দেয়া হয়েছে, ‘যদি গ্যাসের দাম না বাড়ানো হয়, তাহলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে গিয়ে চলতি বছরে সরকারকে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হবে।’
যা বললেন জ্বালানি সচিব
জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বিষয়টি কমিশনের (বিইআরসি) অধীনে। কমিশন প্রস্তাব যাচাই-বাছাই, মূল্যায়ন করবে। গণশুনানি করবে। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
সচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে আসছে অর্ধেকের মতো। আর ২৫ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে জোগান দেয়া হচ্ছে। এতে অনেক টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।’ গ্যাস সংকট মোকাবিলায় চলতি বছর ১০১ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনার কথা জানান জ্বালানি সচিব। তিনি বলেন, ‘১০১ কার্গো আমদানি করে বিদ্যমান দরে বিক্রি করলে বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। এক কার্গো এলএনজি আমদানিতে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা খরচ হয়। যা বছরে দাঁড়াবে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা।’ ‘ভর্তুকির চাপ কমাতেই’ শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রস্তাবে যা আছে
পেট্রোবাংলার দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘প্রতি ঘনমিটার এলএনজির বর্তমান আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫ টাকা ৭০ পয়সা। ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে তা দাঁড়ায় ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা। ফলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাসের মূল্যের এ ফারাক কমাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার ঘাটতি হবে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা।’
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, ‘দেশীয় গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুতে সর্বাধিক প্রভাব পড়েছে। চাহিদা পূরণ করতে দেশীয় গ্যাসফিল্ডগুলো থেকে পাওয়া গ্যাসের সঙ্গে ২৫ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করা হচ্ছে। আগামীতে ক্রমান্বয়ে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে এবং এলএনজি আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ২০৩০-৩১ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে ৭৫ শতাংশ।’
পেট্রোবাংলার প্রস্তাব পাওয়ার পর বিইআরসির পক্ষ থেকে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। বিতরণ কোম্পানিগুলো পেট্রোবাংলার প্রস্তাব অনুসরণ করে প্রস্তাব জমা দিয়েছে। বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি) এসব প্রস্তাব বিশ্লেষণ করছে।
আবাসিকে যে সমীকরণ
পাইপলাইনের মিটারবিহীন গ্রাহকরা বাস্তবে যতটুকু গ্যাস ব্যবহার করে বিতরণ কোম্পানিগুলো এরচেয়ে বেশি বিল ধার্য করে রেখেছে, এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিছু এলাকায় গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপনের পর
এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। দেখা যায়, অনেক প্রিপেইড গ্রাহকদের বিল মাসে ৫০০ টাকা আসছে, যেখানে পাইপলাইনে তাদের এক হাজারের বেশি বিল দিতে হতো।
অনেক এলাকায় গ্যাস না পেয়েও নিয়মিত মাসিক বিল দিচ্ছেন মিটারবিহীন গ্রাহকরা। এতে বড় অঙ্কের লাভ গুনছে তিতাস গ্যাস। অন্য কোম্পানিগুলোরও লাভ হচ্ছে। অভিযোগ আছে, লাভ কমে যাওয়ার আশঙ্কায় তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ কয়েকটি বিতরণ কোম্পানি প্রিপেইড মিটার স্থাপন একরকম বন্ধ করে দেয়।
বর্তমানে আবাসিকে পাইপলাইনের মিটারবিহীন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে সিঙ্গেল বার্নারে (একমুখী চুলা) মাসে বিল ৯৯০ টাকা এবং ডাবল বার্নারে (দ্বিমুখী চুলা) ১০৮০ টাকা।
*কম ব্যবহার, বেশি বিল*
সর্বশেষ গণশুনানি করে বিইআরসি গ্যাসের দাম বাড়ানোর আদেশ দেয় ২০২২ সালের ৫ জুন। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পাইপলাইনে গড়ে এক চুলা ৪০ এবং দুই চুলা সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করছে। এই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে পাইপলাইনের এক চুলায় ব্যবহার ৫৫ ঘনমিটার এবং দুই চুলায় ব্যবহার ৬০ ঘনমিটার নির্ধারণ করা হয়। বিল নির্ধারণ করা হয় যথাক্রমে ৯৯০ ও ১০৮০ টাকা।
বিইআরসিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর জমা দেয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘সব মিটারবিহীন গ্রাহকের আঙিনায় প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত গ্যাস বিপণন নিয়মাবলি-২০১৪ অনুযায়ী এক চুলা (সিঙ্গেল বার্নার) ও দুই চুলার (ডাবল বার্নার) গ্যাস ভোগ নির্ধারণ করা হলে তা প্রকৃত গ্যাস ব্যবহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।’
ওই নিয়মাবলিতে, এক চুলায় ৭৩ দশমিক ৪১ ঘনমিটার এবং দুই চুলায় ৭৭ দশমিক ৪১ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার ধরে পাইপলাইনের মিটারবিহীন গ্রাহকদের বিল নির্ধারণ করা আছে। বাখরাবাদ ও কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির প্রস্তাব আমলে নেয়া হলে মিটারবিহীন গ্রাহকদের এক ও দুই চুলার বিল যথাক্রমে ১৩২১ ও ১৩৯৩ টাকা হবে।
* মিটারবিহীন গ্রাহক, সমীক্ষা*
মাসিক বিল আরও বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব তিতাস গ্যাস কোম্পানি ২০২৩ সালেই দিয়ে রেখেছে। কোম্পানিটি ২০২৩ সালে বিইআরসিতে জমা দেয়া এক আবেদনে পাইপলাইনে মিটারবিহীন গ্রাহকদের এক চুলায় গ্যাসের ব্যবহার ৭৬ দশমিক ৬৫ ঘনমিটার ও দুই চুলায় গ্যাসের ব্যবহার ৮৮ দশমিক ৪৪ ঘনমিটার করার কথা বলেছে।
বিইআরসি এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘যে কোনো কোম্পানি প্রস্তাব দিতেই পারে। বিইআরসির দায়িত্ব প্রস্তাব মূল্যায়ন করা। পাইপলাইনে মিটারবিহীন গ্রাহক আসলে মাসে কী পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে সমীক্ষা করার উদ্যোগ কমিশনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তিতাস গ্যাসসহ অন্যান্য বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের উপর রিপোর্ট দেবে বিইআরসির টেকনিক্যাল ইভাল্যুয়েশন কমিটি (টিইসি)।’
*‘সিস্টেম লস’*
পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি ও সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি ছাড়া অন্যান্য কোম্পানি ‘সিস্টেম লস’ যৌক্তিক করার আবেদন করেছে। বিইআরসির ২০২২ সালের আদেশে সিস্টেম লস ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বাধিক ‘সিস্টেম লস’ দিয়েছে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। ওই অর্থবছরে কোম্পানিটির সামগ্রিক সিস্টেম লস ছিল ১০.০৬ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে যথাক্রমে তিতাস গ্যাস (৭.৬৭ শতাংশ), কর্ণফুলী (৩.২১ শতাংশ), জালালাবাদ (০.৬৮ শতাংশ)। আর ‘সিস্টেম গেইন’ করেছে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে বিতরণের দায়িত্বে থাকা পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটি বিদায়ী অর্থবছরে ১.৯৬ শতাংশ সিস্টেম গেইন করেছে।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সভা, সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, দেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে শিল্পোৎপাদন তথা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই প্রেক্ষাপটে, এখনই গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ না নিতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে যে গ্যাস মজুদ রয়েছে এই গ্যাস উত্তোলনের বড় কোনো পরিকল্পনা নেই। আগের সরকার এলএনজি বিশেষত স্পট মার্কেটের এলএনজি কেনায় বেশি আগ্রহী ছিল, এই সরকারও তাই করছে। জ্বালানি নিরাপত্তা সংহত করতে হলে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হবে।’
*পেট্রোবাংলা ও ৬ বিতরণ কোম্পানি*
বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে পেট্রোবাংলার পাইকারি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হবে। এরপর ছয় বিতরণ কোম্পানি- তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল), কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল), জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (জেজিটিডিসিএল), বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (বিজিডিসিএল), পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল) এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিসিএল) প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হবে। গণশুনানি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি, ভোক্তাসহ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
*বিইআরসি চেয়ারম্যানের বক্তব্য*
গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, উৎপাদন খরচ ও সরবরাহের (বিক্রি) মধ্যে যেহেতু একটা ফারাক রয়েছে, সরকার কী পরিমাণ ভর্তুকি দেবে, সেটা জানার বিষয়ও আছে। তাই মূল্য সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার গুরুত্বও আছে। তবে জালাল আহমেদ বলেছেন, কমিশন সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে’।