ছয়টি সংস্কার কমিশনের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সুপারিশের বিষয়ে মতামত চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ‘স্প্রেড শিট’ (পূর্ণাঙ্গ চিত্র) পাঠিয়েছে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোর কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামত পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করবে কমিশন।

জানা গেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজের সই করা চিঠি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বড় দলগুলো কমিশনের এই চিঠি পেয়েছে। চিঠির সঙ্গে ছয়টি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের সারসংক্ষেপ স্প্রেডশিটে ছক আকারে দেয়া হয়েছে।

প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কিনা। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো- ‘একমত’, ‘একমত নই’ এবং ‘আংশিকভাবে একমত’। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ তিনটি বিকল্পের যে কোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে বলা হয়েছে।

দ্বিতীয়তটি হলো, প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ছয়টি ঘর রয়েছে। সেগুলো হলো : সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়ন ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’ ‘নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ এবং ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যে কোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোর ‘মন্তব্য’ দেয়ার একটি জায়গাও রাখা হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের’ সমন্বয়ের কাজ করছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার। তিনি জানান, মতামত চেয়ে বার্তাবাহক মারফত ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে ‘স্প্রেডশিট’ পাঠানো হয়েছে।

শুক্রবার সকালের মধ্যে সবার কাছে স্প্রেডশিট পৌঁছেছে জানিয়ে মনির হায়দার বলেন, আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোকে মতামত দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী শুক্রবার এই সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ।

বিএনপির এক নেতাও জানিয়েছেন, তারা ঐকমত্য কমিশনের চিঠি পেয়েছেন। তারা দলীয় সভায় আলোচনা করে সংস্কার-সংক্রান্ত মতামত জানাবেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যেসব সুপারিশের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতারভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ, দায়িত্ব ও ক্ষমতা এবং স্বার্থের দ্বন্ধ স্পষ্টীকরণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা; স্থায়ী জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানেক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া; প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে সীমিত করা; দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের অযোগ্য করা এবং একই ব্যক্তি একই সঙ্গে যাতে দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা হতে না পারেন তার বিধান করা।

এ ছাড়া ১০০টি আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা; উচ্চকক্ষে আনুপাতিক পদ্ধতিতে আসন বণ্টন; বিরোধী দলকে সংসদের ডেপুটি স্পিকারের পদ দেয়ার বিষয়েও দলগুলোর কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে।

অন্যান্য যেসব বিষয়ে রাজনৈতক দলগুলোর কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে সেগুলো হলো জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা; নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ করা; মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করা, সরাসরি ভোটে ৪০০ প্রতিনিধির সমন্বয়ে সংসদের নিম্নকক্ষ গঠন; যার মধ্যে নিম্নকক্ষের ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা ও সেগুলোতে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সরাসরি ভোট করা; দলনিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান করা; জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষের সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বৃহত্তর নির্বাচকম-লীর ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ইত্যাদি।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে।

এ জন্য সরকার সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন ‘সংস্কার কমিশন’ গঠন করে।

গত ফেব্রুয়ারি এই ছয়টি কমিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব কমিশনের প্রধানদের নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশে একমত হবে, সেগুলোরভিত্তিতে তৈরি হবে ‘জুলাই চার্টার’ বা জুলাই সনদ।