alt

জাতীয়

পাঠ্যবই মুদ্রণ: কাগজ আমদানি নিয়ে ‘ত্রিমুখী’ অবস্থান

রাকিব উদ্দিন : রোববার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫

শুল্কমুক্ত সুবিধায় পাঠ্যবই ছাপার কাগজ আমদানির সুযোগ চান ‘মুদ্রণ শিল্প সমিতির’ নেতারা। পাঠ্যবই ছাপার দায়িত্বে থাকা এনসিটিবির কর্মকর্তারাও দেশীয় কাগজের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি দরপত্রে কাগজ ব্যবহারে ‘বিশেষ’ কিছু শর্ত চাপানোর চেষ্টা করছে, দেশের মাত্র দু’তিনটি প্রতিষ্ঠান সেই মানের কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে।

শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানির আবেদন মুদ্রণ শিল্প সমিতির

চীন থেকে কাগজ এনে বিপাকে আমদানিকারক

পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশনের দাবি কাগজের সংকট কৃত্রিম, আমদানির কাগজ খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে

একাধিক কাগজ মিলের মালিক সংবাদকে জানিয়েছেন, সরকারের পাঠ্যবই ছাপতে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন কাগজ প্রয়োজন হয়। আর সারাদেশের ১২০টির মতো পেপার মিলের বছরে অন্তত পাঁচ লাখ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এ জন্য বিদেশ থেকে কাগজ আমদানির সুযোগ ‘অবারিত’ করলে দেশীয় কাগজ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

যদিও মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা বলেছেন, প্রতিবছর পাঠ্যবই ছাপার মৌসুমে ‘ইচ্ছেমতো’ দাম বাড়িয়ে দেয় কাগজ মিলমালিকরা। তখন ‘চড়া’ দামে কাগজ না কিনলে বাজারে কাগজের ‘কৃত্রিম’ সংকট সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানির সুযোগ থাকলে মিলমালিকরা সেই সুযোগ পাবে না।

শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশন’র সচিব নওশের আলম সংবাদকে বলেন, ‘কিছু প্রিন্টার্স আছে, তারা এগুলো করতে চায়। আসলে দেশে কাগজের কোনো সংকট নেই। সংকট তৈরি করা হয়।’

প্রতিবছরই একটি ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ তৈরি করে বাজারে কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা দাবি করে তিনি বলেন, ‘এর পর প্রিন্টার্সরা কমদামে নিম্নমানের কাগজ কিনতে চান। তখন কেউই এনসিটিবির টেন্ডার অনুযায়ী কাগজে বই ছাপতে চান না। এক পর্যায়ে পাল্পবিহীন কাগজে বই ছাপায়। তখন এনসিটিবির কিছুই করার থাকে না।’

নওশের আলম জানান, বর্তমানে বিদেশ থেকে কাগজ আনতে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্প পরিশোধ করতে হয়। এর সঙ্গে আরও কিছু ব্যয় রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যয় হয়। কিন্তু এবার একটি প্রতিষ্ঠান পাঠ্যবই ছাপার নামে কাগজ আমদানি করেছে। এখন এই কাগজ খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে।

শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ

আমদানির আবেদন:

‘শুল্কমুক্ত কাগজ’ আমদানির সুযোগ চেয়ে গত ২০ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে ‘বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির’ পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেয়া হয়।

চিঠিতে ‘শুল্কমুক্ত কাগজ, আট কার্ড আমদানির সুবিধা প্রদান’ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘এনসিটিবির প্রত্যায়নের ভিত্তিতে শুধু কার্যাদেশপ্রাপ্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো এবং যে সব মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সরাসরি মুদ্রণ কাগজ আমদানি করতে পারে না তাদের জন্য এনসিটিবির তত্ত্বাবধানে আমদানিকারক নিযুক্ত করে শুল্কমুক্ত কাগজ ও আট কার্ড আমদানি করে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপার সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা রাখার বিনীত অনুরোধ করছি।’

সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাউসার-উজ-জামানের সই করা চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘২০২৫ শিক্ষাবর্ষের ন্যায় ২০২৬ শিক্ষাবর্ষেও আমদানিকারকদের পাশাপাশি এনসিটিবির কার্যাদেশপ্রাপ্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের জন্য শুল্কমুক্ত কাগজ ও আর্ট কার্ড আমদানি সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা রাখা উচিত বলে আমরা মনে করি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউসার-উজ-জামান সংবাদকে বলেন, প্রতি বছরই দেখা যায়, পাঠ্যবই ছাপার সময় আসলে কাগজের দাম বেড়ে যায়। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার সময় এলেই প্রতি টন কাগজের মূল্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়। এতে প্রিন্টার্সরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই ধরনের ‘অপ্রয়োজনীয়’ দাম বৃদ্ধি ঠেকাতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানির সুযোগ চাওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমদানির সুযোগ থাকলে বাজারে কাগজের চাহিদারও সংকট হবে না; দামও বাড়বে না।’

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী সংবাদকে বলেছেন, পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হলে কাগজের ‘সংকট’ হয়। এজন্য এবার কিছু কাগজ আমদানি করা হয়েছে। তবে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার সময় সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে কিনা, সেই বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

জানা গেছে, এনসিটিবি কাগজের ‘কৃত্রিম’ সংকট সামাল দিতে বিগত

সময়ে প্রতিবছরই ১০ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন কাগজ কিনে নিজেদের গুদামে রেখে দিত। তখন ওইসব কাগজসহ পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র আহ্বান করতো সংস্থাটি। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে এনসিটিবি নিজেরা কাগজ কেনা বন্ধ রেখেছে।

কাগজ আমদানি করে বিপাকে আমদানিকারক:

২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপতে চলতি বছর শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্রায় আট হাজার মেট্রিক টন কাগজ আমদানি করা হয় চীন থেকে। কার্যাদেশ পাওয়া ছাপাখানা মালিক (প্রিন্টার্স), এনসিটিবি এবং আমদানিকারক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (ইউনিয়ন এ্যাসোসিয়েটস) মধ্যে ‘ত্রিপক্ষীয়’ চুক্তির আওতায় ওই আমদানি করা হয়।

কিন্তু কিছুটা ‘দেরিতে’ আমদানি হওয়ায় প্রায় অর্ধেক কাগজই গ্রহণ করেনি ছাপাখানা মালিকরা। তখন এনসিটিবির শীর্ষ কর্মকর্তারাও এই দায় এড়িয়ে যান। এরপর খোলাবাজারে আমদানি করা কাগজ ‘বিক্রির’ অভিযোগ ওঠে।

গত ২০ মার্চ এনসিটিবির চেয়ারম্যান একেএম রিয়াজুল হাসানকে (বর্তমানে অবসরে) ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস’র পক্ষ থেকে দেয়া এক চিঠিতে বলা হয়, ‘এনসিটিবি মনোনীত প্রিন্টার্সদের জন্য ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস কর্তৃক মোট এক হাজার ৬০০ মেট্রিক টন আর্ট কার্ড এবং সাত হাজার ৭৫০ টন মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজ আমদানি করা হয়। বর্তমানে ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস এক হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন আর্ট কার্ড এবং ছয় হাজার মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজ প্রিন্টার্সদের মধ্যে বিতরণ নিশ্চিত করেছে। আর্ট কার্ডের মোট বকেয়া অর্থ তিন কোটি ৬৬ লাখ ২৭ হাজার ৩০৪ টাকা।

বর্তমানে এক হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজের মধ্যে ৮০০ মেট্রিক টন ইতোমধ্যে অর্থ পাওয়া সাপেক্ষে বন্দর থেকে ছাড় করার প্রস্তুতি চলছে। অবশিষ্ট ৯৫০ মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজ মোট ৯ জন প্রিন্টার্স অর্থের অপ্রতুলতা এবং বিল পাওয়া সাপেক্ষে পরিশোধ করবে বলে সম্মত হয়েছে।

বর্তমানে এক হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজ ব্যাংক থেকে ডকুমেন্ট ছাড় করন, বন্দর খরচ, কাস্টমস শুল্কায়ন ইত্যাদি খরচ নগদ টাকা প্রদান সাপেক্ষে সম্ভব। অন্যথায় এই সম্পূর্ণ পরিমাণ মুদ্রণ কাগজ নিলাম হওয়া ছাড়া গণন্তর নেই। এই সমস্ত প্রটোকল ও নিয়মকানুন সমাধা কল্পে সমাধান করার জন্য মোট ২০ কোটি টাকা ন্যূনতম প্রয়োজন হবে।

বর্তমানে এক হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজের দৈনন্দিন পোর্ট (বন্দর) ডেমারেজ বাবদ মোট ৯ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এজন্য ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস এর বকেয়া অর্থ জরুরি ভিত্তিতে প্রিন্টার্সদের মাধ্যমে পরিশোধের ব্যবস্থা করতে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন জানানো হয়।

ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটসের আমদানি করা কাগজ গ্রহণ না করার বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান সম্প্রতি সংবাদকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ‘সময়মতো’ প্রিন্টার্সদের সব কাগজ সরবরাহ করতে পারেনি। আবার এনসিটিবি ও সরকারের পক্ষ থেকে তাগাদা ছিল যেভাবেই হোক তাড়াতাড়ি বই ছাপার কাজ শেষ করতে। এজন্য এ বিষয়ে প্রিন্টার্সদের কিছুই করার ছিল না।

এ বিষয়ে এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান ‘ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব’ কাগজ আমদানিতে সহযোগিতা করেছেন। তবে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই মুদ্রণের দরপত্রের শর্তানুযায়ী, কাগজ কেনার দায়িত্ব প্রিন্টার্সদেরই ছিল।

ছবি

৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত, অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার

ছবি

টঙ্গীতে কারখানা বন্ধ ঘোষণায় শ্রমিক বিক্ষোভ

রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি ১৮ মে

ছবি

শিক্ষার্থীদের নিয়ে থানার কার্যক্রম পরিদর্শন

ঐকমত্যের বাইরে সংস্কারের প্রয়োজন নেই: আমীর খসরু

ছবি

আড়াই মাসেও অপহৃত লিখনের সন্ধান মেলেনি

নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার অনন্তলোকে

ছবি

২১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন, বাদ শেখ হাসিনা ও পরিবারের সদস্যদের নাম

ছবি

ওষুধ কেনার অর্থ নেই মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের

ছবি

বিমান বাহিনীর বার্ষিক মহড়া চলছে

ছবি

শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার শুরু

ধর্ষণের শিকার জুলাই আন্দোলনে নিহতের কন্যার আত্মহত্যা

১৭ হাজার ৭৭৭ জন মালয়েশিয়া যেতে না পারার ‘সব দায়’ রিক্রুটিং এজেন্সির

ছবি

আরেক হত্যা মামলা : হাসিনার সঙ্গে অভিনেতা, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ আসামি ৪০৭

আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার সমাধান চায় বাংলাদেশ

আইএমএফের ঋণে অনিশ্চয়তা, ‘আর্থিক’ সংকট না হলেও ‘ইমেজ’ সংকটের আশঙ্কা

ছবি

পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস

ছবি

বাংলাদেশ চায় ভারত-পাকিস্তান সমস্যার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হোক : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

গুজরাটে বাংলাদেশিদের গ্রেপ্তার নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কিছু জানায়নি

ছবি

দক্ষিণাঞ্চলের গ্রিড বিপর্যয়ে আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

ছবি

জনগণের কাছে গিয়ে দ্বিমতের সমাধান খুঁজতে হবে: জোনায়েদ সাকি

ছবি

জয়কে অপহরণ-হত্যাচেষ্টা মামলা: শফিক রেহমানের খালাসে রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তি নেই

ছবি

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা: রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানি ৪ মে

ছবি

পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে রোম ছেড়েছেন অধ্যাপক ইউনূস

ছবি

পটুয়াখালীতে ধর্ষণের শিকার শহীদকন্যার ঢাকায় আত্মহত্যা

ছবি

‘ভিত্তিমূল্য’ নির্ধারণ করে পুনর্মূল্যায়ন হবে বিদ্যুতের দাম: উপদেষ্টা

ছবি

আন্দোলনের মধ্যে ইউআইইউতে ভিসিসহ ১২ জনের পদত্যাগ

রাজধানীতে অপহরণের মামলায় গ্রেপ্তার বাসার নিরাপত্তাকর্মী

শাহজালালে পোশাকে লেপ্টে ৫ কোটি টাকার স্বর্ণ পাচারে যুবক গ্রেপ্তার

ছবি

কেমন আছেন সিলেট অঞ্চলে খাসিয়ারা

ঝটিকা মিছিল: ৭ দিনে ছাত্রলীগ ও আ’লীগের ৫৬ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার

ছবি

সিনহা হত্যার বিচার দ্রুত সম্পন্নের দাবি সাবেকদের

এবতেদায়ী মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির ‘ঘোষণা’ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি

ছবি

চাহিদার চেয়ে চালের উৎপাদন বেশি, তবুও দাম আকাশছোঁয়া, কারণ কী?

ছবি

রাঙামাটিতে পিকআপ ও অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত ৬

‘উন্নত চিকিৎসার নামে নাপা ট্যাবলেট দেয়া হচ্ছে’

tab

জাতীয়

পাঠ্যবই মুদ্রণ: কাগজ আমদানি নিয়ে ‘ত্রিমুখী’ অবস্থান

রাকিব উদ্দিন

রোববার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫

শুল্কমুক্ত সুবিধায় পাঠ্যবই ছাপার কাগজ আমদানির সুযোগ চান ‘মুদ্রণ শিল্প সমিতির’ নেতারা। পাঠ্যবই ছাপার দায়িত্বে থাকা এনসিটিবির কর্মকর্তারাও দেশীয় কাগজের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি দরপত্রে কাগজ ব্যবহারে ‘বিশেষ’ কিছু শর্ত চাপানোর চেষ্টা করছে, দেশের মাত্র দু’তিনটি প্রতিষ্ঠান সেই মানের কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে।

শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানির আবেদন মুদ্রণ শিল্প সমিতির

চীন থেকে কাগজ এনে বিপাকে আমদানিকারক

পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশনের দাবি কাগজের সংকট কৃত্রিম, আমদানির কাগজ খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে

একাধিক কাগজ মিলের মালিক সংবাদকে জানিয়েছেন, সরকারের পাঠ্যবই ছাপতে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন কাগজ প্রয়োজন হয়। আর সারাদেশের ১২০টির মতো পেপার মিলের বছরে অন্তত পাঁচ লাখ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এ জন্য বিদেশ থেকে কাগজ আমদানির সুযোগ ‘অবারিত’ করলে দেশীয় কাগজ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

যদিও মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা বলেছেন, প্রতিবছর পাঠ্যবই ছাপার মৌসুমে ‘ইচ্ছেমতো’ দাম বাড়িয়ে দেয় কাগজ মিলমালিকরা। তখন ‘চড়া’ দামে কাগজ না কিনলে বাজারে কাগজের ‘কৃত্রিম’ সংকট সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানির সুযোগ থাকলে মিলমালিকরা সেই সুযোগ পাবে না।

শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশন’র সচিব নওশের আলম সংবাদকে বলেন, ‘কিছু প্রিন্টার্স আছে, তারা এগুলো করতে চায়। আসলে দেশে কাগজের কোনো সংকট নেই। সংকট তৈরি করা হয়।’

প্রতিবছরই একটি ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ তৈরি করে বাজারে কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা দাবি করে তিনি বলেন, ‘এর পর প্রিন্টার্সরা কমদামে নিম্নমানের কাগজ কিনতে চান। তখন কেউই এনসিটিবির টেন্ডার অনুযায়ী কাগজে বই ছাপতে চান না। এক পর্যায়ে পাল্পবিহীন কাগজে বই ছাপায়। তখন এনসিটিবির কিছুই করার থাকে না।’

নওশের আলম জানান, বর্তমানে বিদেশ থেকে কাগজ আনতে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্প পরিশোধ করতে হয়। এর সঙ্গে আরও কিছু ব্যয় রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যয় হয়। কিন্তু এবার একটি প্রতিষ্ঠান পাঠ্যবই ছাপার নামে কাগজ আমদানি করেছে। এখন এই কাগজ খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে।

শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ

আমদানির আবেদন:

‘শুল্কমুক্ত কাগজ’ আমদানির সুযোগ চেয়ে গত ২০ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে ‘বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির’ পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেয়া হয়।

চিঠিতে ‘শুল্কমুক্ত কাগজ, আট কার্ড আমদানির সুবিধা প্রদান’ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘এনসিটিবির প্রত্যায়নের ভিত্তিতে শুধু কার্যাদেশপ্রাপ্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো এবং যে সব মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সরাসরি মুদ্রণ কাগজ আমদানি করতে পারে না তাদের জন্য এনসিটিবির তত্ত্বাবধানে আমদানিকারক নিযুক্ত করে শুল্কমুক্ত কাগজ ও আট কার্ড আমদানি করে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপার সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা রাখার বিনীত অনুরোধ করছি।’

সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাউসার-উজ-জামানের সই করা চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘২০২৫ শিক্ষাবর্ষের ন্যায় ২০২৬ শিক্ষাবর্ষেও আমদানিকারকদের পাশাপাশি এনসিটিবির কার্যাদেশপ্রাপ্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের জন্য শুল্কমুক্ত কাগজ ও আর্ট কার্ড আমদানি সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা রাখা উচিত বলে আমরা মনে করি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউসার-উজ-জামান সংবাদকে বলেন, প্রতি বছরই দেখা যায়, পাঠ্যবই ছাপার সময় আসলে কাগজের দাম বেড়ে যায়। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার সময় এলেই প্রতি টন কাগজের মূল্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়। এতে প্রিন্টার্সরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই ধরনের ‘অপ্রয়োজনীয়’ দাম বৃদ্ধি ঠেকাতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানির সুযোগ চাওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমদানির সুযোগ থাকলে বাজারে কাগজের চাহিদারও সংকট হবে না; দামও বাড়বে না।’

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী সংবাদকে বলেছেন, পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হলে কাগজের ‘সংকট’ হয়। এজন্য এবার কিছু কাগজ আমদানি করা হয়েছে। তবে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার সময় সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে কিনা, সেই বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

জানা গেছে, এনসিটিবি কাগজের ‘কৃত্রিম’ সংকট সামাল দিতে বিগত

সময়ে প্রতিবছরই ১০ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন কাগজ কিনে নিজেদের গুদামে রেখে দিত। তখন ওইসব কাগজসহ পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র আহ্বান করতো সংস্থাটি। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে এনসিটিবি নিজেরা কাগজ কেনা বন্ধ রেখেছে।

কাগজ আমদানি করে বিপাকে আমদানিকারক:

২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপতে চলতি বছর শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্রায় আট হাজার মেট্রিক টন কাগজ আমদানি করা হয় চীন থেকে। কার্যাদেশ পাওয়া ছাপাখানা মালিক (প্রিন্টার্স), এনসিটিবি এবং আমদানিকারক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (ইউনিয়ন এ্যাসোসিয়েটস) মধ্যে ‘ত্রিপক্ষীয়’ চুক্তির আওতায় ওই আমদানি করা হয়।

কিন্তু কিছুটা ‘দেরিতে’ আমদানি হওয়ায় প্রায় অর্ধেক কাগজই গ্রহণ করেনি ছাপাখানা মালিকরা। তখন এনসিটিবির শীর্ষ কর্মকর্তারাও এই দায় এড়িয়ে যান। এরপর খোলাবাজারে আমদানি করা কাগজ ‘বিক্রির’ অভিযোগ ওঠে।

গত ২০ মার্চ এনসিটিবির চেয়ারম্যান একেএম রিয়াজুল হাসানকে (বর্তমানে অবসরে) ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস’র পক্ষ থেকে দেয়া এক চিঠিতে বলা হয়, ‘এনসিটিবি মনোনীত প্রিন্টার্সদের জন্য ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস কর্তৃক মোট এক হাজার ৬০০ মেট্রিক টন আর্ট কার্ড এবং সাত হাজার ৭৫০ টন মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজ আমদানি করা হয়। বর্তমানে ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস এক হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন আর্ট কার্ড এবং ছয় হাজার মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজ প্রিন্টার্সদের মধ্যে বিতরণ নিশ্চিত করেছে। আর্ট কার্ডের মোট বকেয়া অর্থ তিন কোটি ৬৬ লাখ ২৭ হাজার ৩০৪ টাকা।

বর্তমানে এক হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজের মধ্যে ৮০০ মেট্রিক টন ইতোমধ্যে অর্থ পাওয়া সাপেক্ষে বন্দর থেকে ছাড় করার প্রস্তুতি চলছে। অবশিষ্ট ৯৫০ মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজ মোট ৯ জন প্রিন্টার্স অর্থের অপ্রতুলতা এবং বিল পাওয়া সাপেক্ষে পরিশোধ করবে বলে সম্মত হয়েছে।

বর্তমানে এক হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজ ব্যাংক থেকে ডকুমেন্ট ছাড় করন, বন্দর খরচ, কাস্টমস শুল্কায়ন ইত্যাদি খরচ নগদ টাকা প্রদান সাপেক্ষে সম্ভব। অন্যথায় এই সম্পূর্ণ পরিমাণ মুদ্রণ কাগজ নিলাম হওয়া ছাড়া গণন্তর নেই। এই সমস্ত প্রটোকল ও নিয়মকানুন সমাধা কল্পে সমাধান করার জন্য মোট ২০ কোটি টাকা ন্যূনতম প্রয়োজন হবে।

বর্তমানে এক হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজের দৈনন্দিন পোর্ট (বন্দর) ডেমারেজ বাবদ মোট ৯ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এজন্য ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস এর বকেয়া অর্থ জরুরি ভিত্তিতে প্রিন্টার্সদের মাধ্যমে পরিশোধের ব্যবস্থা করতে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন জানানো হয়।

ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটসের আমদানি করা কাগজ গ্রহণ না করার বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান সম্প্রতি সংবাদকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ‘সময়মতো’ প্রিন্টার্সদের সব কাগজ সরবরাহ করতে পারেনি। আবার এনসিটিবি ও সরকারের পক্ষ থেকে তাগাদা ছিল যেভাবেই হোক তাড়াতাড়ি বই ছাপার কাজ শেষ করতে। এজন্য এ বিষয়ে প্রিন্টার্সদের কিছুই করার ছিল না।

এ বিষয়ে এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান ‘ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব’ কাগজ আমদানিতে সহযোগিতা করেছেন। তবে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই মুদ্রণের দরপত্রের শর্তানুযায়ী, কাগজ কেনার দায়িত্ব প্রিন্টার্সদেরই ছিল।

back to top