মব সংস্কৃতিকে নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখছেন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতারা। তারা মবের আপদের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘সবাই আজ আতঙ্কিত’। আর সাংবাদিকদের নামে ঢালাও হত্যা মামলা স্বাধীন সাংবাদিকতার ‘পরিপন্থী এবং ভয়ের ব্যাপার’ বলে মত অনেকের।
সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় এমন মন্তব্য করেন বক্তারা। রোববার,(৪ মে ২০২৫) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সম্পাদক ও সাংবাদিকরা।
আমরা কখনোই অন্যায়ভাবে অন্যের মত চাপিয়ে দেয়াকে সমর্থন করব না। আমরা আরেকজনের মতের স্বাধীনতাকে নিশ্চয়ই দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেব: মির্জা ফখরুল
বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা-সংক্রান্ত মামলার কথা উল্লেখ করে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, গণআকারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের আক্রমণ (মামলা) স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী এবং ভয়ের ব্যাপার
যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, সে দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি আমরা: মতিউর রহমান চৌধুরী
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে বিএনপি ‘বরাবরই অবস্থান নিয়েছে, ভবিষ্যতেও থাকবে’ বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। প্রকাশিত কোনো সংবাদ কারও পছন্দ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্য মাধ্যমে তার প্রতিবাদ জানাতে পারে। কিন্তু মব জাস্টিসের নামে সেই প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেয়া কোনো স্বাধীনতার পর্যায়ে পড়ে না।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আগের থেকে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ১৬ ধাপ আমরা এগিয়েছি। সমস্যা দেখা দেয় তখন, যখন দেখি কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে। কোনো কোনো জায়গায় দেখা যায়, কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীও এটার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বলি না যে আমরা একেবারেই ধোয়া তুলসী পাতা। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অনেক বেশি কাজ করেছি। আমাদের সময়েই সংবাদপত্রের এবং সংবাদকর্মীদের ওপর নিপীড়ন তুলনামূলক কম হয়েছে।’
বিএনপিই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা উন্মুক্ত করেছিল দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তার আগে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল ছিল, সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘খুব স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়ভাবে আবারও বলতে চাই, আমরা কখনোই অন্যায়ভাবে অন্যের মতকে চাপিয়ে দেয়াকে সমর্থন করব না। আমরা আরেকজনের মতের স্বাধীনতাকে নিশ্চয়ই দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেব।’
তবে বর্তমানে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে গিয়ে ‘কিছুটা আতঙ্কিত থাকেন’ বলে জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, কোন প্রেস আমার কথাগুলো কীভাবে নেবে। তারপর তারা কীভাবে ছাপবে। অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় কীভাবে এটা উপস্থাপন করবে। এটা আমাদের জন্য, যারা আমরা রাজনীতি করি, সত্যি একটা চিন্তার বিষয়। কারণ, সম্প্রতি চরিত্র হরণ করার যে প্রবণতা বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা দিয়েছে, এটাতে চিন্তিত না হয়ে উপায় নেই।’
দেশে বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা-সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলার কথা জানান সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ
আনাম। তিনি বলেন, ‘গণআকারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের আক্রমণ (মামলা) স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী এবং এটি ভয়ের ব্যাপার।’
তবে গণমাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ ‘আগের তুলনায় অনেকটাই কমে গেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক ও সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সরকারি হস্তক্ষেপ কম ছিল, কিন্তু সামাজিক চাপ ছিল তীব্র। বিশেষ করে কিছু মিডিয়ার বিরুদ্ধে জন-অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল, যা বিশ্লেষণ করা দরকার। আমরা কখনও কোনো গণমাধ্যম বন্ধের পক্ষে নই; বরং গণমাধ্যম যেন স্বাধীনভাবে জনগণের কথা বলতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরিই আমাদের লক্ষ্য।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক আরও ইতিবাচক করার ওপর গুরুত্ব দেন নাহিদ। তিনি অভিযোগ করেন, বিভিন্ন সময় তারা মিস ইনফরমেশনের (ভুল তথ্য) শিকার হয়েছেন। পেশাদারিত্বের ঘাটতির কারণে অনেক সময় তাদের বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তাই গণমাধ্যমের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন বলে মত তার।
#সম্পাদকদের উদ্বেগ#
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘শেখ হাসিনার শাসনামল এত জনধিক্কৃত হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং আরও অনেক আইনের শিকার হয়েছিলাম। তবে বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা-সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলা চলছে। এটা কীভাবে সম্ভব? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ২০০ বা কিছু বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।’
তবে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘এটার অর্থ এই নয় যে কেউ দোষ করেননি। দোষ করে থাকলে সঠিকভাবে মামলা করে শাস্তি দেন এবং আমরা কোনোভাবেই তার পাশে দাঁড়াব না। কিন্তু আজকে ছয় থেকে সাত মাস হয়েছে, তারা এসব মামলায় পড়েছেন। এক কদমও এগোয়নি তদন্তের ব্যাপারে।’
যাদের নামে মামলা হয়েছে, সেসব সাংবাদিক একটা ভয়ের মধ্যে থাকেন উল্লেখ করে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘তারা ‘মব আক্রমণের’ (উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠীর দলবদ্ধ আক্রমণ) ভয়ে থাকেন। এ রকম দু-একটা ঘটনা ঘটেছে।‘
১৩ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘তারা যদি অপরাধ করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তাদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু আজকে সাত মাস, আট মাস ধরে কারাগারে, তারা জামিন পাচ্ছেন না। তাদের আইনি কোনো প্রক্রিয়া চলছে না। বিচার হচ্ছে না। তাহলে এটা কি চলতে থাকবে?’
মামলার প্রবণতার কথা বলতে গিয়ে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, এখন মামলার যে প্রবণতা, তাতে ১০০ জন, ৫০ জন, ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা, তার মধ্যে একজন সাংবাদিকের নাম ঢুকিয়ে দেয়া হলো।
সরকার ও আইন উপদেষ্টার উদ্দেশে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘আইন উপদেষ্টা বলেন, আমাদের কিছু করার নেই, জনগণের অধিকার আছে মামলা করার। মেনে নিলাম মামলা করার অধিকার। কিন্তু কোনো আইনের যদি অপপ্রয়োগ হয়, তাহলে কি সরকার কিছু করবে না? সেখানেই আমার বড় প্রশ্ন।’
মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, সে দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি আমরা। অবাক লাগে, আমি বিস্মিত হই, জানি না, আমি কাকে দায়ী করব? আমি কি সরকারকে দায়ী করব, নাকি মালিককে দায়ী করব, না করব না, সাংবাদিক ইউনিয়ন কী করছে বা আমাদের সম্পাদক পরিষদ, যেটিতে আমি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এখন পর্যন্ত আছি, আমি মনে করি আমরাও ব্যর্থ হয়েছি।’
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ‘বাংলাদেশে আজকের দিনে যখন মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছেন, ঠিক তার এক বছর আগেও সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে এই দিবসটি পালন করেছিলেন। কিন্তু এই দুই দিবসের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য সূচিত হয়েছে। কিংবা পার্থক্য সূচিত হওয়ার লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছে।’
নূরুল কবীর বলেন, ‘সেটা আমরা কতটা ইতিবাচক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারি, এটা কেবল গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নির্ভর করে না, সেটা নির্ভর করে প্রধানত রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, যারা আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তন করেন, তাদের ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে।’
#কী বললেন রাজনীতিকরা#
বিগত সরকারের বিষোদ্গার করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বিদেশে বসে শেখ হাসিনা নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। সেগুলো প্রচার হচ্ছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।’ এগুলো নিয়ন্ত্রণের যোগ্য কিনা জানতে চান তিনি। এসব প্রচার নিয়ন্ত্রণ করা হলে স্বাধীনতা খর্ব হবে কিনা তাও ভাববার বিষয় বলে মনে করেন তিনি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে শর্তহীন স্বাধীনতা নয়। অন্যের স্বাধীনতা ক্ষুণ্য না করে স্বাধীনতার চর্চা না হলে সেটা হবে স্বেচ্ছাচারিতা।’ গণমাধ্যমের একটা নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। তবে সরকার যেন গণমাধ্যমের গলা টিপে না ধরতে পারে সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা ভয়হীন সমাজ গড়তে চাই। রাষ্ট্র এমন আইন করতে পারবে না যাতে সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ হয়।’
আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন, সমকালের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী, সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার করিম প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।
রোববার, ০৪ মে ২০২৫
মব সংস্কৃতিকে নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখছেন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতারা। তারা মবের আপদের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘সবাই আজ আতঙ্কিত’। আর সাংবাদিকদের নামে ঢালাও হত্যা মামলা স্বাধীন সাংবাদিকতার ‘পরিপন্থী এবং ভয়ের ব্যাপার’ বলে মত অনেকের।
সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় এমন মন্তব্য করেন বক্তারা। রোববার,(৪ মে ২০২৫) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সম্পাদক ও সাংবাদিকরা।
আমরা কখনোই অন্যায়ভাবে অন্যের মত চাপিয়ে দেয়াকে সমর্থন করব না। আমরা আরেকজনের মতের স্বাধীনতাকে নিশ্চয়ই দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেব: মির্জা ফখরুল
বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা-সংক্রান্ত মামলার কথা উল্লেখ করে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, গণআকারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের আক্রমণ (মামলা) স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী এবং ভয়ের ব্যাপার
যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, সে দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি আমরা: মতিউর রহমান চৌধুরী
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে বিএনপি ‘বরাবরই অবস্থান নিয়েছে, ভবিষ্যতেও থাকবে’ বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। প্রকাশিত কোনো সংবাদ কারও পছন্দ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্য মাধ্যমে তার প্রতিবাদ জানাতে পারে। কিন্তু মব জাস্টিসের নামে সেই প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেয়া কোনো স্বাধীনতার পর্যায়ে পড়ে না।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আগের থেকে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ১৬ ধাপ আমরা এগিয়েছি। সমস্যা দেখা দেয় তখন, যখন দেখি কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে। কোনো কোনো জায়গায় দেখা যায়, কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীও এটার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বলি না যে আমরা একেবারেই ধোয়া তুলসী পাতা। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অনেক বেশি কাজ করেছি। আমাদের সময়েই সংবাদপত্রের এবং সংবাদকর্মীদের ওপর নিপীড়ন তুলনামূলক কম হয়েছে।’
বিএনপিই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা উন্মুক্ত করেছিল দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তার আগে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল ছিল, সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘খুব স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়ভাবে আবারও বলতে চাই, আমরা কখনোই অন্যায়ভাবে অন্যের মতকে চাপিয়ে দেয়াকে সমর্থন করব না। আমরা আরেকজনের মতের স্বাধীনতাকে নিশ্চয়ই দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেব।’
তবে বর্তমানে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে গিয়ে ‘কিছুটা আতঙ্কিত থাকেন’ বলে জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, কোন প্রেস আমার কথাগুলো কীভাবে নেবে। তারপর তারা কীভাবে ছাপবে। অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় কীভাবে এটা উপস্থাপন করবে। এটা আমাদের জন্য, যারা আমরা রাজনীতি করি, সত্যি একটা চিন্তার বিষয়। কারণ, সম্প্রতি চরিত্র হরণ করার যে প্রবণতা বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা দিয়েছে, এটাতে চিন্তিত না হয়ে উপায় নেই।’
দেশে বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা-সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলার কথা জানান সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ
আনাম। তিনি বলেন, ‘গণআকারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের আক্রমণ (মামলা) স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী এবং এটি ভয়ের ব্যাপার।’
তবে গণমাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ ‘আগের তুলনায় অনেকটাই কমে গেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক ও সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সরকারি হস্তক্ষেপ কম ছিল, কিন্তু সামাজিক চাপ ছিল তীব্র। বিশেষ করে কিছু মিডিয়ার বিরুদ্ধে জন-অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল, যা বিশ্লেষণ করা দরকার। আমরা কখনও কোনো গণমাধ্যম বন্ধের পক্ষে নই; বরং গণমাধ্যম যেন স্বাধীনভাবে জনগণের কথা বলতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরিই আমাদের লক্ষ্য।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক আরও ইতিবাচক করার ওপর গুরুত্ব দেন নাহিদ। তিনি অভিযোগ করেন, বিভিন্ন সময় তারা মিস ইনফরমেশনের (ভুল তথ্য) শিকার হয়েছেন। পেশাদারিত্বের ঘাটতির কারণে অনেক সময় তাদের বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তাই গণমাধ্যমের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন বলে মত তার।
#সম্পাদকদের উদ্বেগ#
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘শেখ হাসিনার শাসনামল এত জনধিক্কৃত হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং আরও অনেক আইনের শিকার হয়েছিলাম। তবে বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা-সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলা চলছে। এটা কীভাবে সম্ভব? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ২০০ বা কিছু বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।’
তবে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘এটার অর্থ এই নয় যে কেউ দোষ করেননি। দোষ করে থাকলে সঠিকভাবে মামলা করে শাস্তি দেন এবং আমরা কোনোভাবেই তার পাশে দাঁড়াব না। কিন্তু আজকে ছয় থেকে সাত মাস হয়েছে, তারা এসব মামলায় পড়েছেন। এক কদমও এগোয়নি তদন্তের ব্যাপারে।’
যাদের নামে মামলা হয়েছে, সেসব সাংবাদিক একটা ভয়ের মধ্যে থাকেন উল্লেখ করে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘তারা ‘মব আক্রমণের’ (উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠীর দলবদ্ধ আক্রমণ) ভয়ে থাকেন। এ রকম দু-একটা ঘটনা ঘটেছে।‘
১৩ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘তারা যদি অপরাধ করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তাদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু আজকে সাত মাস, আট মাস ধরে কারাগারে, তারা জামিন পাচ্ছেন না। তাদের আইনি কোনো প্রক্রিয়া চলছে না। বিচার হচ্ছে না। তাহলে এটা কি চলতে থাকবে?’
মামলার প্রবণতার কথা বলতে গিয়ে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, এখন মামলার যে প্রবণতা, তাতে ১০০ জন, ৫০ জন, ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা, তার মধ্যে একজন সাংবাদিকের নাম ঢুকিয়ে দেয়া হলো।
সরকার ও আইন উপদেষ্টার উদ্দেশে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘আইন উপদেষ্টা বলেন, আমাদের কিছু করার নেই, জনগণের অধিকার আছে মামলা করার। মেনে নিলাম মামলা করার অধিকার। কিন্তু কোনো আইনের যদি অপপ্রয়োগ হয়, তাহলে কি সরকার কিছু করবে না? সেখানেই আমার বড় প্রশ্ন।’
মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, সে দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি আমরা। অবাক লাগে, আমি বিস্মিত হই, জানি না, আমি কাকে দায়ী করব? আমি কি সরকারকে দায়ী করব, নাকি মালিককে দায়ী করব, না করব না, সাংবাদিক ইউনিয়ন কী করছে বা আমাদের সম্পাদক পরিষদ, যেটিতে আমি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এখন পর্যন্ত আছি, আমি মনে করি আমরাও ব্যর্থ হয়েছি।’
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ‘বাংলাদেশে আজকের দিনে যখন মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছেন, ঠিক তার এক বছর আগেও সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে এই দিবসটি পালন করেছিলেন। কিন্তু এই দুই দিবসের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য সূচিত হয়েছে। কিংবা পার্থক্য সূচিত হওয়ার লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছে।’
নূরুল কবীর বলেন, ‘সেটা আমরা কতটা ইতিবাচক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারি, এটা কেবল গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নির্ভর করে না, সেটা নির্ভর করে প্রধানত রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, যারা আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তন করেন, তাদের ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে।’
#কী বললেন রাজনীতিকরা#
বিগত সরকারের বিষোদ্গার করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বিদেশে বসে শেখ হাসিনা নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। সেগুলো প্রচার হচ্ছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।’ এগুলো নিয়ন্ত্রণের যোগ্য কিনা জানতে চান তিনি। এসব প্রচার নিয়ন্ত্রণ করা হলে স্বাধীনতা খর্ব হবে কিনা তাও ভাববার বিষয় বলে মনে করেন তিনি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে শর্তহীন স্বাধীনতা নয়। অন্যের স্বাধীনতা ক্ষুণ্য না করে স্বাধীনতার চর্চা না হলে সেটা হবে স্বেচ্ছাচারিতা।’ গণমাধ্যমের একটা নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। তবে সরকার যেন গণমাধ্যমের গলা টিপে না ধরতে পারে সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা ভয়হীন সমাজ গড়তে চাই। রাষ্ট্র এমন আইন করতে পারবে না যাতে সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ হয়।’
আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন, সমকালের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী, সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার করিম প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।