জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞানে বুধবারের মারামারি
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে জুলাই আন্দোলনে আহত এবং চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে হাসপাতালের কর্মচারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় চিকিৎসক, কর্মচারীদের অনেকে আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক চিকিৎসক জানে আলম।
বুধবার,(২৮ মে ২০২৫) দুপুর দুইটায় সংবাদ মাধ্যমকে তিনি জানান, বেলা ১১টার দিকে এই সংঘর্ষ শুরু হয়। দুপুর দেড়টার দিকে সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
পরে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা এখন ‘বন্ধ’ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদন লেখার সময়ও বন্ধ ছিল হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা।
ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জানে আলম বলেন, ‘সংঘর্ষের সময় জুলাইয়ে আহত এবং রোগীর স্বজনদের হামলায় আমাদের চিকিৎসক, কর্মচারীদের অনেকে আহত হয়েছেন। সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর এখন উনারা হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়া চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের উদ্ধার করার কাজ করছেন।’
হাসপাতালের এক চিকিৎসক সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, জুলাইয়ের আহতরা হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের আবাসিক ভবনেও হামলা চালায় এবং কর্মচারীদের শাস্তির দাবিতে তারা সেখানে স্লোগানও দিয়েছেন।
গতকাল মঙ্গলবার হাসপাতালের পরিচালককে অবরুদ্ধ করে রাখা, জুলাইয়ে আহতদের ‘আত্মহত্যার চেষ্টা’র পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার দাবিতে বুধবার সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন কর্মচারীরা।
এ অবস্থায় হাসপাতালের কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় জুলাইয়ে আহতরা। পরে আহতদের সঙ্গে যোগ দেন বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক চিকিৎসক খায়ের আহমেদ চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘হাসপাতালের খুবই বাজে অবস্থা। আমি আসলে কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় নাই। আজ (বুধবার) আমি দায়িত্বেও নাই। গতকালের ঘটনার পর ছুটিতে আছি।’
পরিস্থিতি তুলে ধরে চিকিৎসক খায়ের বলেন, ‘আমাদের কর্মচারী, রোগী সব ম্যাসাকার করে ফেলছে হাসপাতালে। একজন আরেকজনের সঙ্গে মারামারি করছে, কর্মচারীদের তারা আগে মারছে। আন্দোলনে আহতদের সঙ্গে তিন দিন আগে ওদের মারামারি হয়েছে, আমি থামিয়েছি। কালকের পর থেকে কর্মচারীরা ইনসিকিউরড ফিল করায় কর্মবিরতি পালন করছে। ওটা নিয়েই সূত্রপাত, কর্মচারীদের সঙ্গে রোগীদের, আহতদের মারামারি। তারা কর্মচারীদের বাসা ভাঙচুর করেছে।’
হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বেলা পৌনে একটার দিকে ঘটনাস্থল থেকে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কর্মচারী ও নার্সদের কর্মবিরতির কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা না দেয়ায় তাদের সঙ্গে মারামারি হয় জুলাই আন্দোলনে আহতদের। এরপর তাদের সঙ্গে আউটডোরে আসা রোগীর স্বজনরাও যোগ দেয় বলে জানিয়েছেন ওই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে আহতরা চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীদের পিটিয়েছে। এছাড়া তারা কর্মচারীদের শাস্তির দাবিতে নানা স্লোগান দিচ্ছেন। চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীদের অনেকে আত্মগোপনে আছেন।’
হাসপাতালের ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন, পুলিশ এসেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না। ‘পরে সাড়ে বারোটার দিকে সেখানে কোস্টগার্ড সদস্যরা আসেন।’
জুলাইয়ে আহতরা হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের আবাসিক ভবনেও হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সেখানকার একজন চিকিৎসক। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘তারা আমাদের কোয়ার্টারে হামলা করেছে। আমি বারান্দায় ছিলাম। মোবাইলে ছবি তুলতে গেলে তেড়ে আসে। পরে আমি বাসার ভেতরে চলে আসি।’
বিকেল সোয়া ৪টার পর সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল নাজিম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আসার পর দেখি, মারামারি হচ্ছে। এরপর সেম ডিসটেন্সে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে একজনের সঙ্গে আরেকজনের মারামারি না হয়। কে যে কোন গ্রুপ আইডিন্টিফাই করা ডিফিকাল্ট ছিল।’
‘জুলাই আন্দোলনে আহত কিছু ক্রিটিক্যল প্যাশেন্টও আছে। এখন আমরা শুনতে পেরেছি কিছু ডক্টর, কিছু জেনারেল প্যাশেন্ট, কিছু স্টাফ সম্ভবত ভিতরে ভয়ে আছেন বা জিম্মি অবস্থায় আছেন বলে দাবি করেছেন আমাদের কাছে। এখন যারা আন্দোলন করছিলেন, আমাদের আহত ভাইয়েরা যারা আছেন ওনাদের রিকোয়েস্ট করেছি আপনাদের বিষয়গুলো আমরা শুনবো। তার আগে কাইন্ডলি যারা জিম্মি অবস্থায় আছেন তাদের আগে বের করবো। ওনারা শুনেছেন আমাদের কথা, রাজিও হয়েছেন। তারপর ওনাদের যৌক্তিক দাবিগুলো শুনবো, কনসার্ন অথরিটি যারা আছেন তাদের কাছে পেশ করবো, যাতে অথরিটি এসে বিষয়গুলো সমাধান করার চেষ্টা করবেন। এটা ছিল আজ (বুধবার) সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।’
পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এসে দেখলাম, দুই গ্রুপে মারামারি করছে। দুই গ্রুপের হাতে কারও কাছে লাঠি কারও কাছে রড। কাউকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। কোনো ডিসিপ্লিন নেই, কোনো কন্ট্রোল নেই। ওনাদের নিবৃত করতে হয়েছে, যাতে বড় ধরনের ক্ষতি না হয়ে যায়। আমরা শুনেছি সম্ভবত একজন স্টাফের মাথা ফেটে গেছে ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় দেখেছি।’
জিম্মির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অলরেডি ৫টা পরিবার বের হয়েছে। আপনারা (হাত ইশারায় দেখিয়ে দেন) দেখতে পাচ্ছেন ওনারা চলে যাচ্ছেন। আর এখন আমরা প্রত্যেকটা ফ্লোর চেক করে দেখবো।’
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তারা নিরাপত্তা দিয়ে ৪-৫টি প্রাইভেটকার গেট পার করে দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এর আগে নানা দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয়ে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে জুলাই আন্দোলনে আহতদের একটা অংশ। এ সময় প্রায় দেড় ঘণ্টা পরিচালককে তার কার্যালয়ে অবরোধ করে রাখে তারা। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক খায়ের আহমেদ চৌধুরী গত মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, গতকাল মঙ্গলবার দুপুর সোয়া দুইটার দিকে জুলাই আন্দোলনে আহতদের একটা অংশ তার কার্যালয়ে আসেন। গত রোববার আত্মহত্যার চেষ্টা করে হাসপাতালে ভর্তি চারজনও তাদের সঙ্গে ছিলেন।
‘সুইসাইড করতে চেয়েছিল এমন চারজন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। সে অবস্থায়ই গতকাল মঙ্গলবার তারা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসে। এরসঙ্গে যোগ দেয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাই আন্দোলনের কয়েকজন। তাদের নিজেদের মধ্যেও অনেক ধরনের কোন্দল আছে, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ করে। তাদের ৪০ থেকে ৫০ জন আমার রুমে আসে। সেখানে তারা নিজেদের মধ্যে গোলমাল করছিল, একজন আরেকজনকে ব্লেইম করছিল যে একদল অনুদান এনেছে তাদের দেয় নাই।’
চিকিৎসক খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, তার বিরুদ্ধে একপক্ষের হয়ে কাজ করার অভিযোগ তোলে আন্দোলনে আহতরা। পরিস্থিতি খারাপ হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি জানিয়েছেন তিনি। ‘তাদের দেয়া তালিকা অনুযায়ী নাকি আমি বিদেশে পাঠানোর নামের তালিকা করি। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা নয়। এখানে বিশেষজ্ঞ কমিটি আছে তারাই নির্ধারণ করে তারা বিদেশে যাবে। তো এসব বিষয় নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল, তাদের মধ্যে আকতার হোসেন নামে একজন আবার পেট্রোল নিয়ে এসেছিল। যে কারণে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে যাই, কোনো দুর্ঘটনা ঘটায় কিনা। বিষয়টি আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাই। এরপর সেনাবাহিনীর সদস্যরা এলে তারা সরে যায়। এর আগেই আমি আহতদের একটা অংশের সহায়তায় কক্ষ থেকে বের হয়ে আসি।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার ইবনে মিজান সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘তারা কেরোসিন পেট্রোল নিজেদের গায়ে ঢেলে আগুন লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় আমরা গিয়ে তাদের কাছ থেকে বোতলগুলো নিয়ে নেই। পরে সেনাবাহিনী এসে সম্মিলিতভাবে তাদের বোঝানোর পর তারা চলে যায়।’
গত রোববার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত চারজন ‘বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা’ করে বলে জানায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার পর তাদের তাৎক্ষণিক সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় বলে জানিয়েছেন শেরে-বাংলা নগর থানার ওসি ইমাউল হক। চিকিৎসকের বরাতে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। খবর পেয়ে আমরাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা বর্তমানে শঙ্কামুক্ত রয়েছেন।’ বিষপান করা চারজন হলেন- শিমুল, মারুফ, সাগর ও আখতার হোসেন।
ঘটনার সময় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের নতুন সিইও কামাল আকবর। সেখানে হাসপাতাল পরিচালকের সঙ্গে তার বৈঠক চলাকালে বিষপানের ঘটনাটি ঘটে। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই ফাউন্ডেশনের নতুন সিইও জয়েন করেছেন, ওনার সঙ্গে একটা পূর্বনির্ধারিত মিটিং ছিল। ওদের নিয়াই মিটিং, ওদের ক্যাটাগরি, ওদের পুনর্বাসন- বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে একটা লম্বা মিটিং হয় আমার সঙ্গে।
‘মিটিং চলাকালে তারা সিইওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি তাদের বলেন, ‘আমি পরিচালক মহোদয়ের সঙ্গে কথা শেষ করে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব’। এরমধ্যেই এ ঘটনা ঘটে।’ চারজনের মধ্যে একজন সিঙ্গাপুরেও চিকিৎসা নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, তারা মানসিকভাবে সুস্থ না; যারা সুইসাইড অ্যাটেম্পট নেয়, মানসিকভাবে সুস্থ না। আরেকটা ধারণা, এটা সরকারের দৃষ্টিতে আনা; জুলাই ফাউন্ডেশনের নতুন সিইওর দৃষ্টি আকর্ষণ করা।’ তারা চারজনই বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে আছে এবং সুস্থ আছেন বলেও জানান পরিচালক।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞানে বুধবারের মারামারি
বুধবার, ২৮ মে ২০২৫
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে জুলাই আন্দোলনে আহত এবং চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে হাসপাতালের কর্মচারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় চিকিৎসক, কর্মচারীদের অনেকে আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক চিকিৎসক জানে আলম।
বুধবার,(২৮ মে ২০২৫) দুপুর দুইটায় সংবাদ মাধ্যমকে তিনি জানান, বেলা ১১টার দিকে এই সংঘর্ষ শুরু হয়। দুপুর দেড়টার দিকে সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
পরে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা এখন ‘বন্ধ’ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদন লেখার সময়ও বন্ধ ছিল হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা।
ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জানে আলম বলেন, ‘সংঘর্ষের সময় জুলাইয়ে আহত এবং রোগীর স্বজনদের হামলায় আমাদের চিকিৎসক, কর্মচারীদের অনেকে আহত হয়েছেন। সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর এখন উনারা হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়া চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের উদ্ধার করার কাজ করছেন।’
হাসপাতালের এক চিকিৎসক সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, জুলাইয়ের আহতরা হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের আবাসিক ভবনেও হামলা চালায় এবং কর্মচারীদের শাস্তির দাবিতে তারা সেখানে স্লোগানও দিয়েছেন।
গতকাল মঙ্গলবার হাসপাতালের পরিচালককে অবরুদ্ধ করে রাখা, জুলাইয়ে আহতদের ‘আত্মহত্যার চেষ্টা’র পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার দাবিতে বুধবার সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন কর্মচারীরা।
এ অবস্থায় হাসপাতালের কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় জুলাইয়ে আহতরা। পরে আহতদের সঙ্গে যোগ দেন বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক চিকিৎসক খায়ের আহমেদ চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘হাসপাতালের খুবই বাজে অবস্থা। আমি আসলে কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় নাই। আজ (বুধবার) আমি দায়িত্বেও নাই। গতকালের ঘটনার পর ছুটিতে আছি।’
পরিস্থিতি তুলে ধরে চিকিৎসক খায়ের বলেন, ‘আমাদের কর্মচারী, রোগী সব ম্যাসাকার করে ফেলছে হাসপাতালে। একজন আরেকজনের সঙ্গে মারামারি করছে, কর্মচারীদের তারা আগে মারছে। আন্দোলনে আহতদের সঙ্গে তিন দিন আগে ওদের মারামারি হয়েছে, আমি থামিয়েছি। কালকের পর থেকে কর্মচারীরা ইনসিকিউরড ফিল করায় কর্মবিরতি পালন করছে। ওটা নিয়েই সূত্রপাত, কর্মচারীদের সঙ্গে রোগীদের, আহতদের মারামারি। তারা কর্মচারীদের বাসা ভাঙচুর করেছে।’
হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বেলা পৌনে একটার দিকে ঘটনাস্থল থেকে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কর্মচারী ও নার্সদের কর্মবিরতির কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা না দেয়ায় তাদের সঙ্গে মারামারি হয় জুলাই আন্দোলনে আহতদের। এরপর তাদের সঙ্গে আউটডোরে আসা রোগীর স্বজনরাও যোগ দেয় বলে জানিয়েছেন ওই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে আহতরা চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীদের পিটিয়েছে। এছাড়া তারা কর্মচারীদের শাস্তির দাবিতে নানা স্লোগান দিচ্ছেন। চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীদের অনেকে আত্মগোপনে আছেন।’
হাসপাতালের ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন, পুলিশ এসেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না। ‘পরে সাড়ে বারোটার দিকে সেখানে কোস্টগার্ড সদস্যরা আসেন।’
জুলাইয়ে আহতরা হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের আবাসিক ভবনেও হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সেখানকার একজন চিকিৎসক। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘তারা আমাদের কোয়ার্টারে হামলা করেছে। আমি বারান্দায় ছিলাম। মোবাইলে ছবি তুলতে গেলে তেড়ে আসে। পরে আমি বাসার ভেতরে চলে আসি।’
বিকেল সোয়া ৪টার পর সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল নাজিম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আসার পর দেখি, মারামারি হচ্ছে। এরপর সেম ডিসটেন্সে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে একজনের সঙ্গে আরেকজনের মারামারি না হয়। কে যে কোন গ্রুপ আইডিন্টিফাই করা ডিফিকাল্ট ছিল।’
‘জুলাই আন্দোলনে আহত কিছু ক্রিটিক্যল প্যাশেন্টও আছে। এখন আমরা শুনতে পেরেছি কিছু ডক্টর, কিছু জেনারেল প্যাশেন্ট, কিছু স্টাফ সম্ভবত ভিতরে ভয়ে আছেন বা জিম্মি অবস্থায় আছেন বলে দাবি করেছেন আমাদের কাছে। এখন যারা আন্দোলন করছিলেন, আমাদের আহত ভাইয়েরা যারা আছেন ওনাদের রিকোয়েস্ট করেছি আপনাদের বিষয়গুলো আমরা শুনবো। তার আগে কাইন্ডলি যারা জিম্মি অবস্থায় আছেন তাদের আগে বের করবো। ওনারা শুনেছেন আমাদের কথা, রাজিও হয়েছেন। তারপর ওনাদের যৌক্তিক দাবিগুলো শুনবো, কনসার্ন অথরিটি যারা আছেন তাদের কাছে পেশ করবো, যাতে অথরিটি এসে বিষয়গুলো সমাধান করার চেষ্টা করবেন। এটা ছিল আজ (বুধবার) সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।’
পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এসে দেখলাম, দুই গ্রুপে মারামারি করছে। দুই গ্রুপের হাতে কারও কাছে লাঠি কারও কাছে রড। কাউকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। কোনো ডিসিপ্লিন নেই, কোনো কন্ট্রোল নেই। ওনাদের নিবৃত করতে হয়েছে, যাতে বড় ধরনের ক্ষতি না হয়ে যায়। আমরা শুনেছি সম্ভবত একজন স্টাফের মাথা ফেটে গেছে ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় দেখেছি।’
জিম্মির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অলরেডি ৫টা পরিবার বের হয়েছে। আপনারা (হাত ইশারায় দেখিয়ে দেন) দেখতে পাচ্ছেন ওনারা চলে যাচ্ছেন। আর এখন আমরা প্রত্যেকটা ফ্লোর চেক করে দেখবো।’
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তারা নিরাপত্তা দিয়ে ৪-৫টি প্রাইভেটকার গেট পার করে দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এর আগে নানা দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয়ে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে জুলাই আন্দোলনে আহতদের একটা অংশ। এ সময় প্রায় দেড় ঘণ্টা পরিচালককে তার কার্যালয়ে অবরোধ করে রাখে তারা। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক খায়ের আহমেদ চৌধুরী গত মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, গতকাল মঙ্গলবার দুপুর সোয়া দুইটার দিকে জুলাই আন্দোলনে আহতদের একটা অংশ তার কার্যালয়ে আসেন। গত রোববার আত্মহত্যার চেষ্টা করে হাসপাতালে ভর্তি চারজনও তাদের সঙ্গে ছিলেন।
‘সুইসাইড করতে চেয়েছিল এমন চারজন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। সে অবস্থায়ই গতকাল মঙ্গলবার তারা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসে। এরসঙ্গে যোগ দেয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাই আন্দোলনের কয়েকজন। তাদের নিজেদের মধ্যেও অনেক ধরনের কোন্দল আছে, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ করে। তাদের ৪০ থেকে ৫০ জন আমার রুমে আসে। সেখানে তারা নিজেদের মধ্যে গোলমাল করছিল, একজন আরেকজনকে ব্লেইম করছিল যে একদল অনুদান এনেছে তাদের দেয় নাই।’
চিকিৎসক খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, তার বিরুদ্ধে একপক্ষের হয়ে কাজ করার অভিযোগ তোলে আন্দোলনে আহতরা। পরিস্থিতি খারাপ হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি জানিয়েছেন তিনি। ‘তাদের দেয়া তালিকা অনুযায়ী নাকি আমি বিদেশে পাঠানোর নামের তালিকা করি। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা নয়। এখানে বিশেষজ্ঞ কমিটি আছে তারাই নির্ধারণ করে তারা বিদেশে যাবে। তো এসব বিষয় নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল, তাদের মধ্যে আকতার হোসেন নামে একজন আবার পেট্রোল নিয়ে এসেছিল। যে কারণে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে যাই, কোনো দুর্ঘটনা ঘটায় কিনা। বিষয়টি আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাই। এরপর সেনাবাহিনীর সদস্যরা এলে তারা সরে যায়। এর আগেই আমি আহতদের একটা অংশের সহায়তায় কক্ষ থেকে বের হয়ে আসি।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার ইবনে মিজান সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘তারা কেরোসিন পেট্রোল নিজেদের গায়ে ঢেলে আগুন লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় আমরা গিয়ে তাদের কাছ থেকে বোতলগুলো নিয়ে নেই। পরে সেনাবাহিনী এসে সম্মিলিতভাবে তাদের বোঝানোর পর তারা চলে যায়।’
গত রোববার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত চারজন ‘বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা’ করে বলে জানায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার পর তাদের তাৎক্ষণিক সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় বলে জানিয়েছেন শেরে-বাংলা নগর থানার ওসি ইমাউল হক। চিকিৎসকের বরাতে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। খবর পেয়ে আমরাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা বর্তমানে শঙ্কামুক্ত রয়েছেন।’ বিষপান করা চারজন হলেন- শিমুল, মারুফ, সাগর ও আখতার হোসেন।
ঘটনার সময় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের নতুন সিইও কামাল আকবর। সেখানে হাসপাতাল পরিচালকের সঙ্গে তার বৈঠক চলাকালে বিষপানের ঘটনাটি ঘটে। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই ফাউন্ডেশনের নতুন সিইও জয়েন করেছেন, ওনার সঙ্গে একটা পূর্বনির্ধারিত মিটিং ছিল। ওদের নিয়াই মিটিং, ওদের ক্যাটাগরি, ওদের পুনর্বাসন- বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে একটা লম্বা মিটিং হয় আমার সঙ্গে।
‘মিটিং চলাকালে তারা সিইওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি তাদের বলেন, ‘আমি পরিচালক মহোদয়ের সঙ্গে কথা শেষ করে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব’। এরমধ্যেই এ ঘটনা ঘটে।’ চারজনের মধ্যে একজন সিঙ্গাপুরেও চিকিৎসা নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, তারা মানসিকভাবে সুস্থ না; যারা সুইসাইড অ্যাটেম্পট নেয়, মানসিকভাবে সুস্থ না। আরেকটা ধারণা, এটা সরকারের দৃষ্টিতে আনা; জুলাই ফাউন্ডেশনের নতুন সিইওর দৃষ্টি আকর্ষণ করা।’ তারা চারজনই বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে আছে এবং সুস্থ আছেন বলেও জানান পরিচালক।