গত বছর জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

যে পাঁচ অভিযোগ

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল রোববার,(১ জুন ২০২৫) এই আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এ মামলায় কারাগারে থাকা আরেক আসামি, অভ্যুত্থানের সময় আইজিপির (পুলিশের মহাপরিদর্শক) দায়িত্বে থাকা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ১৬ জুন ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে গ্রেপ্তার করা গেল কিনা, সেদিন প্রসিকিউশনকে সে বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালে এ মামলা উপস্থাপন করা হয়েছে ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম আসামি শেখ হাসিনা গং’ মামলা হিসেবে।

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রোববার ১৩৪ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। এই বিচারকাজ সারা বিশ্বকে দেখাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালের শুনানি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়।

আদালত অভিযোগ আমলে নেয়ায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম কোনো মামলার বিচার প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। আর তা শুরু হলো সেই আদালতে, যে আদালত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল।

গত ১২ মে এই মামলায় চিফ

প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিল ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে জুলাই-আগস্টের নৃশংসতার ‘মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রথমে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর চিফ প্রসিকিউটর সেই তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেন এবং আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আকারে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন।

*৫ অভিযোগ*

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বলছে, তদন্তকালে আসামি শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগ ছাড়াও সুনির্দিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের ‘প্রাথমিক সত্যতা; পাওয়া গেছে।

অপরাধ-১: গণভবনে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য প্রদান এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায়’ তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্য ও সশস্ত্র ‘আওয়ামী সন্ত্রাসী’ কর্তৃক ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ; যা আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত।

অপরাধ-২: আসামি শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্র জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’ এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন কর্তৃক শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অধীনস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর করার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে।

অপরাধ-৩: রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে সরাসরি নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের ‘বুক লক্ষ্য করে বিনা উসকানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে’ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, এবং ষড়যন্ত্র অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

অপরাধ-৪: ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

অপরাধ-৫: ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে ৫ জনের মৃতদেহ এবং ১ জনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার অপরাধ, যা আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে। ওই ঘটনায় হত্যা, নির্যাতন, মৃত ও জীবিত অবস্থায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে অমানবিক আচরণ করার অপরাধসমূহ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।

*প্রসিকিউশনের বক্তব্য*

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বলছে, ‘বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ‘নিজেদের লোক দিয়ে আগুন লাগিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানোর নির্দেশনা’ দেয়া হয়েছিল, সেই টেলিফোনিক নির্দেশ তদন্ত সংস্থার হস্তগত হয়েছে।

প্রসিকিউশন বলছে, বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ‘নিজেদের লোক দিয়ে আগুন লাগিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানোর নির্দেশনা’ দেয়া হয়েছিল, সেই টেলিফোনিক নির্দেশ তদন্ত সংস্থার হস্তগত হয়েছে।’

*চিফ প্রসিকিউটর যা বললেন*

সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব যা ‘মনসুন রেভুল্যুশন’ বা ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামেও পরিচিত, তা সংঘটিত হয়েছিল দেড় দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার হরণ ও রাজনৈতিক উগ্রপন্থার মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে।’ তিনি বলেন, ‘চব্বিশের এই আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ও সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য ‘নিরীহ, নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষ’ নির্বিচার হত্যাকা- ও ভয়াবহ সহিংতার শিকার হন। আসামিদের নির্দেশে ও তাদের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গ সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয় হত্যা, অঙ্গহানি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম, চিকিৎসা প্রদানে বাধা এবং মৃত ও জীবিত মানুষকে একত্রে পুড়িয়ে দেয়ার মতো ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো।’

তিনি বলেন, ‘উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, এটি ছিল একটি কো-অর্ডিনেটেড এক্সটারমিনেশন প্ল্যান, যা ছিল বিস্তৃত ও সিসটেম্যাটিক। রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, অন্যান্য বাহিনীসমূহ এবং সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাদের অধীনস্ত সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহ এই পরিকল্পিত হত্যাকা- ও নির্যাতনে অংশগ্রহণ করে।’

তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয়, বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন’, ‘রোম স্ট্যাটিউট অব দি আইসিসি’ এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য।’

তিনি বলেন, ‘এ মামলা বিচারের জন্য প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিক্টিমদের সাক্ষ্য, অপরাধ সংগঠনের সময় ধারণ করা ভিডিও, ড্রোন ও সিসিটিভি ভিডিও, আসামিদের টেলিফোন সংলাপের অডিও ক্লিপ, ডিজিটাল এভিডেন্সগুলোর ফরেনসিক রিপোর্ট, আসামিগণের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য, ছবি এবং ভিডিও, জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রস্তুত করা রিপোর্ট এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে পাওয়া ‘অফিসিয়াল ডকুমেন্টস’ ট্রাইব্যুনালে জমা দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এ বিচার হোক নিরপেক্ষ, প্রমাণনির্ভর এবং ন্যায়ভিত্তিক। আমরা চাই এ বিচার শুধু বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে সৃষ্ট গভীর ক্ষত মুছে না দিক, বরং এটি হোক এক আত্মাভিমানী জাতির ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণ।’

*আইন সংশোধন*

জুলাই-আগস্টের দমন-পীড়নে ভূমিকার জন্য দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের জন্যও ইতোমধ্যে আইন সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার শেষ করার দাবি জানিয়ে আসছে।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সম্প্রতি এক ফেইসবুক পোস্টে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলেই এ বিচার শেষ হবে বলে তিনি আশা করছেন।

*পটপরিবর্তন*

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সে সময় জামায়াত নেতাদের আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন আইনজীবী মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর এই ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এখন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের দায়িত্বে আছেন।

পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলো। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় একটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অপর মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।

অভিযোগ দাখিলের পর প্রসিকিউশনের আবেদনে গত বছর ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দেশত্যাগের পর থেকেই ভারতে অবস্থান করছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।