টানা বৃষ্টিতে পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। মঙ্গলবার শহরের মনসাবাড়ি থেকে তোলা -সংবাদ
টানা বর্ষণের ফলে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল গুলো তলিয়ে গেছে। অনেক স্থানে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি।
পটুয়াখালী শহরে জলাবদ্ধতা, উপকূলে ডুবেছে বীজতলা
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, গত পাঁচদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও গতকাল সোমবার সন্ধ্যা থেকে টানা বর্ষণে পটুয়াখালী শহরের নিম্নাঞ্চল গুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সড়কে পানি ঢুকে পড়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন পৌরবাসী।
টানা বর্ষণের প্রভাবে জেলার উপকূলীয় রাঙ্গাবালী উপজেলাসহ নিম্নাঞ্চল গুলোতেও সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। অধিকাংশ খাল ভরাট, স্লুইস গেট ও জলকপাট অকেজো এবং পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় কৃষিজমি তলিয়ে যাচ্ছে। ডুবে গেছে আমন বীজতলা, পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন নিচু এলাকার মানুষ।
পটুয়াখালী আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গতকাল সোমবার দুপুর ১২টা থেকে মঙ্গলবার,(০৮ জুলাই ২০২৫) দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২২৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মাহাবুবা খুশী জানান, আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের নতুন বাজার, সদর রোড, চরপাড়া, জুবিলী স্কুল সড়ক, মহিলা কলেজ, কালেক্টরেট স্কুল, কলেজ রোড, এসডিও রোড, পোস্ট অফিস সড়ক, সবুজবাগ, তিতাস সিনেমা হলসংলগ্ন এলাকা ও পুরান বাজারে হাঁটুসমান পানি জমে আছে।
জলাবদ্ধতার কারণে শেরেবাংলা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
পোস্ট অফিস সড়কের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সুমন কুমার বলেন, ‘শহর রক্ষা বাঁধের কারণে পানি দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে দোকানে পানি ঢুকে ক্ষতি হচ্ছে। আমরা দারুণ ভোগান্তিতে আছি।’
বৃষ্টির কারণে শহরের রাস্তাঘাটে যান চলাচলও অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে রিকশাচালক ও দিনমজুররা প্রচ- দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন।
পটুয়াখালী পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেন পরিষ্কার ও পানি নিষ্কাশনের কাজ করছেন। পৌর কর্তৃপক্ষ জানায়, টানা ভারী বৃষ্টির কারণে পানি সরতে সময় লাগছে, তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছে।
রাঙ্গাবালীর কোড়ালিয়া, নয়াভাঙ্গুনী, সাজিরহাওলা, ফুলখালীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও হাঁটুপানির মধ্যে চলাচল করতে হচ্ছে।
নয়াভাঙ্গুনী গ্রামের বাসিন্দা জাকারিয়া জীবন বলেন, ‘সরকারি খালগুলো স্থানীয়রা বাঁধ দিয়ে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করছে। এ কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে
গেছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই ঘরবাড়ি ডুবে যাচ্ছে। এসব বাঁধ না কাটলে ভোগান্তির শেষ নেই।’
স্থানীয় বাসিন্দা মো. সেলিম জানান, ‘রান্নাঘরও পানিতে তলিয়ে গেছে। আমাদের এলাকায় নদীর পাড়ে স্লুইসগেট নেই, তাই পানি বের হতে পারছে না। আমরা একটি স্থায়ী সমাধান চাই।’
রাঙ্গাবালীর সদর, চালিতাবুনিয়া, মৌডুবি, বড়বাইশদিয়া ও চরেমোন্তজ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের ও একই অবস্থা বিরাজ করছে। বীজতলা ডুবে যাওয়ায় কৃষকরা শঙ্কায় রয়েছেন।
রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, ‘টানা বৃষ্টিতে প্রায় ৫০০ হেক্টর আমন বীজতলা ডুবে গেছে। খালগুলো অনেক আগেই ভরাট বা বাঁধ দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া জোয়ারের চাপও রয়েছে। কৃষকদের সহায়তায় আমরা মাঠে কাজ করছি।’
রাঙ্গাবালী ছাড়াও জেলার অন্য উপজেলাগুলোর নিম্নাঞ্চলের ও একইভাবে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। কৃষকরা আমন বীজতলার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে উদ্বেগে আছেন।
পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক এইচ এম শামীম বলেন, ‘এ মৌসুমে জেলায় এক লাখ ৯০ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ লক্ষ্যমাত্রা। এর জন্য ১৩ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বীজতলা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর বীজতলা তৈরি হয়েছে। জলাবদ্ধতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে বীজতলার ক্ষতি হতে পারে।’
তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ‘বৃষ্টির পানি দ্রুত সরে গেলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে না।’
বেতাগীতে টানা ভারী বর্ষণে জনজীবন বিপর্যস্ত, দুর্ভোগে নিম্নাঞ্চলের মানুষ
প্রতিনিধি, বেতাগী (বরগুনা) জানান, উপকূলীয় বরগুনার বেতাগী উপজেলায় গত দুই দিন (গতকাল সোমবার ও মঙ্গলবার) ধরে টানা ভারী বর্ষণে জনজীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে, যার ফলে চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ভারী বর্ষণের কারণে উপজেলার নিম্নাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে এবং অনেক ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়েছে।
বিশেষ করে বেতাগী পৌরসভার বাজার এলাকায় জোয়ারের সময় পুরো এলাকা পানির নিচে চলে যাচ্ছে, ফলে ব্যবসায়ীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
বরিশাল আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলে আরও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ভারী বর্ষণের কারণে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেতে পারে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাজার এলাকার বিভিন্ন স্থানে ঘরের ভেতর পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। অনেকেই রান্নাবান্না বন্ধ রেখে পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। শহরের প্রধান সড়ক ও গলিপথে হাঁটুপানি জমে থাকায় মানুষ এবং যানবাহন চলাচলে মারাত্মক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কার না হওয়ায় ভারী বৃষ্টিপাত হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পানিনিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় দুই দিনের বৃষ্টিতেই শহরের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে।
বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকা: বেতাগী পৌরসভার বাজার এলাকা, পুরাতন থানা এলাকা, হাসপাতাল এলাকা, বদনিখালী, জলিশা বাজার, বটতলা, ছোট মোকামিয়া, চরখালী, কুমড়াখালী, সরিষামুড়ির নিম্নাঞ্চল, জোয়ারে বাজার তলিয়ে যাচ্ছে পৌর শহরের মাছ ও সবজি বাজারগুলো জোয়ারের সময় বিষখালী নদীর পানিতে তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় পানি সরে যায়।
বন্দর ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম আহ্বায়ক সায়েদ মল্লিক বলেন, ‘বর্ষাকালে জোয়ারের সময় বিষখালী নদীর পানিতে বাজারের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। এ সময় ব্যবসায়ীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।’
মোকামিয়া ইউনিয়নের বটতলা গ্রামের শিক্ষক সুশান্ত কুমার গাইন বলেন, ‘প্রবল বর্ষণে সবজির ফসল তলিয়ে গেছে। এছাড়া আমন ধানের বীজতলাও পানির নিচে রয়েছে।’
বেতাগী পৌরসভার একজন কর্মকর্তা জানান, জরুরি ভিত্তিতে ড্রেন পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়েছে এবং পানি নিষ্কাশনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
পৌর প্রশাসক মো. বশির গাজী বলেন, ‘প্রবল বর্ষণে কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা, তদন্ত করা হচ্ছে। সঠিক তদন্তের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
মহম্মদপুর খাদ্যগুদাম সড়ক,
বৃষ্টি হলেই সড়ক যেন পুকুর
মহম্মদপুর (মাগুরা) প্রতিনিধি জানান,
মাগুরার মহম্মদপুর খাদ্যগুদাম সড়কটি হালকা বৃষ্টি হলেই সড়কটি যেন পুকুরে পরিণত হয়। উপজেলা সদরের কৃষি ব্যাংকের সামনে থেকে সরকারি খাদ্যগুদামের গেট পর্যন্ত প্রায় পাঁচশত মিটার পাকা সড়কের অবস্থা শোচনীয় রূপ নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটির পিচঢালাই উঠে বড় বড় গর্ত আর খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।
সড়কটির পাশে উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার সাধারণ জনগণ সেবা নিতে এই সড়কটি ব্যবহার করে। এছাড়াও ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও মহম্মদপুর বাজারে হাজার হাজার সাধারণ জনগণ আসা-যাওয়া করে। কিন্তু সড়কটি দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ার কারণে সবাই ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়ছেন। আবার সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে প্রচুর পানি জমে থাকায় যাতায়াতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, সরকারি খাদ্যগুদাম ও ইউনিয়ন পরিষদের অফিস ওই সড়কে পাশে হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করে। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি সংস্কার না করার কারণে সবাই ভোগান্তিতে পড়েছেন। এছাড়া প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন, প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সব মিলিয়ে বেহাল এই সড়কটি নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মানুষ। এ অবস্থায় সড়কটি দ্রুত সংস্কার করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কটির ইট-বালু, সুরকি, পাথর ও বিটুমিন উঠে গিয়ে পুরোটাই গর্ত ও নালা সৃষ্টি হয়েছে।
মহম্মদপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান নওশের আলী জানান, বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি জমে থাকে মনে হয় এ যেন বড় একটি পুকুর। তখন হেঁটেও চলাচল করা যায় না। জুতা হাতে নিয়েই চলাচল করতে হয়। আবার বৃষ্টি না থাকলে ধুলাবালিতে একাকার হয়ে যায় সড়কটি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী নায়েব আলী জানান, আমি একজন কসমেটিক ব্যবসায়ী, এই সড়কের পাশেই আমার দোকান। সড়কটি এতটাই খারাপ হয়েছে যে, কোনো কাস্টমার আসতে পারে না। এই সড়কের পাশের ব্যবসায়ীদের কাস্টমারের অভাবে বেচাকেনা না হওয়ায় অনেক ক্ষতির মধ্যে পড়ে গেছি। আমরা সড়কটি দ্রুত সংস্থারের দাবি জানাচ্ছি।
ইজিবাইকচালক এরশাদ জানান, সড়কের অবস্থা ভয়াবহ। সড়কে গাড়ি নিয়ে নামলে মনে হয় পুকুরে নামলাম। এই সড়ক গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যেই ইজিবাইক উল্টে যায়। আবার অনেক সময় গর্তে পড়ে গাড়ি বিকল হয়ে যায়।
কয়েক শিক্ষার্থী বলেন, এই সড়কটি দিয়ে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা যাতায়াত করে। প্রতি দিন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছি।
উপজেলা প্রকৌশলী গোলজার হোসেন বলেন, খাদ্যগুদাম সড়কটির বিষয়ে আমরা অবগত হয়েছি। সড়কটি সংস্কারের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহীনুর আক্তার বলেন, সড়কটি সংস্কারের জন্য এলজিইডির প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলেছি। সড়কটি দ্রুত সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে।
টানা বৃষ্টিতে পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। মঙ্গলবার শহরের মনসাবাড়ি থেকে তোলা -সংবাদ
মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫
টানা বর্ষণের ফলে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল গুলো তলিয়ে গেছে। অনেক স্থানে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি।
পটুয়াখালী শহরে জলাবদ্ধতা, উপকূলে ডুবেছে বীজতলা
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, গত পাঁচদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও গতকাল সোমবার সন্ধ্যা থেকে টানা বর্ষণে পটুয়াখালী শহরের নিম্নাঞ্চল গুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সড়কে পানি ঢুকে পড়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন পৌরবাসী।
টানা বর্ষণের প্রভাবে জেলার উপকূলীয় রাঙ্গাবালী উপজেলাসহ নিম্নাঞ্চল গুলোতেও সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। অধিকাংশ খাল ভরাট, স্লুইস গেট ও জলকপাট অকেজো এবং পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় কৃষিজমি তলিয়ে যাচ্ছে। ডুবে গেছে আমন বীজতলা, পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন নিচু এলাকার মানুষ।
পটুয়াখালী আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গতকাল সোমবার দুপুর ১২টা থেকে মঙ্গলবার,(০৮ জুলাই ২০২৫) দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২২৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মাহাবুবা খুশী জানান, আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের নতুন বাজার, সদর রোড, চরপাড়া, জুবিলী স্কুল সড়ক, মহিলা কলেজ, কালেক্টরেট স্কুল, কলেজ রোড, এসডিও রোড, পোস্ট অফিস সড়ক, সবুজবাগ, তিতাস সিনেমা হলসংলগ্ন এলাকা ও পুরান বাজারে হাঁটুসমান পানি জমে আছে।
জলাবদ্ধতার কারণে শেরেবাংলা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
পোস্ট অফিস সড়কের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সুমন কুমার বলেন, ‘শহর রক্ষা বাঁধের কারণে পানি দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে দোকানে পানি ঢুকে ক্ষতি হচ্ছে। আমরা দারুণ ভোগান্তিতে আছি।’
বৃষ্টির কারণে শহরের রাস্তাঘাটে যান চলাচলও অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে রিকশাচালক ও দিনমজুররা প্রচ- দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন।
পটুয়াখালী পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেন পরিষ্কার ও পানি নিষ্কাশনের কাজ করছেন। পৌর কর্তৃপক্ষ জানায়, টানা ভারী বৃষ্টির কারণে পানি সরতে সময় লাগছে, তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছে।
রাঙ্গাবালীর কোড়ালিয়া, নয়াভাঙ্গুনী, সাজিরহাওলা, ফুলখালীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও হাঁটুপানির মধ্যে চলাচল করতে হচ্ছে।
নয়াভাঙ্গুনী গ্রামের বাসিন্দা জাকারিয়া জীবন বলেন, ‘সরকারি খালগুলো স্থানীয়রা বাঁধ দিয়ে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করছে। এ কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে
গেছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই ঘরবাড়ি ডুবে যাচ্ছে। এসব বাঁধ না কাটলে ভোগান্তির শেষ নেই।’
স্থানীয় বাসিন্দা মো. সেলিম জানান, ‘রান্নাঘরও পানিতে তলিয়ে গেছে। আমাদের এলাকায় নদীর পাড়ে স্লুইসগেট নেই, তাই পানি বের হতে পারছে না। আমরা একটি স্থায়ী সমাধান চাই।’
রাঙ্গাবালীর সদর, চালিতাবুনিয়া, মৌডুবি, বড়বাইশদিয়া ও চরেমোন্তজ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের ও একই অবস্থা বিরাজ করছে। বীজতলা ডুবে যাওয়ায় কৃষকরা শঙ্কায় রয়েছেন।
রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, ‘টানা বৃষ্টিতে প্রায় ৫০০ হেক্টর আমন বীজতলা ডুবে গেছে। খালগুলো অনেক আগেই ভরাট বা বাঁধ দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া জোয়ারের চাপও রয়েছে। কৃষকদের সহায়তায় আমরা মাঠে কাজ করছি।’
রাঙ্গাবালী ছাড়াও জেলার অন্য উপজেলাগুলোর নিম্নাঞ্চলের ও একইভাবে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। কৃষকরা আমন বীজতলার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে উদ্বেগে আছেন।
পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক এইচ এম শামীম বলেন, ‘এ মৌসুমে জেলায় এক লাখ ৯০ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ লক্ষ্যমাত্রা। এর জন্য ১৩ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বীজতলা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর বীজতলা তৈরি হয়েছে। জলাবদ্ধতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে বীজতলার ক্ষতি হতে পারে।’
তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ‘বৃষ্টির পানি দ্রুত সরে গেলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে না।’
বেতাগীতে টানা ভারী বর্ষণে জনজীবন বিপর্যস্ত, দুর্ভোগে নিম্নাঞ্চলের মানুষ
প্রতিনিধি, বেতাগী (বরগুনা) জানান, উপকূলীয় বরগুনার বেতাগী উপজেলায় গত দুই দিন (গতকাল সোমবার ও মঙ্গলবার) ধরে টানা ভারী বর্ষণে জনজীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে, যার ফলে চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ভারী বর্ষণের কারণে উপজেলার নিম্নাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে এবং অনেক ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়েছে।
বিশেষ করে বেতাগী পৌরসভার বাজার এলাকায় জোয়ারের সময় পুরো এলাকা পানির নিচে চলে যাচ্ছে, ফলে ব্যবসায়ীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
বরিশাল আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলে আরও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ভারী বর্ষণের কারণে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেতে পারে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাজার এলাকার বিভিন্ন স্থানে ঘরের ভেতর পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। অনেকেই রান্নাবান্না বন্ধ রেখে পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। শহরের প্রধান সড়ক ও গলিপথে হাঁটুপানি জমে থাকায় মানুষ এবং যানবাহন চলাচলে মারাত্মক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কার না হওয়ায় ভারী বৃষ্টিপাত হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পানিনিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় দুই দিনের বৃষ্টিতেই শহরের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে।
বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকা: বেতাগী পৌরসভার বাজার এলাকা, পুরাতন থানা এলাকা, হাসপাতাল এলাকা, বদনিখালী, জলিশা বাজার, বটতলা, ছোট মোকামিয়া, চরখালী, কুমড়াখালী, সরিষামুড়ির নিম্নাঞ্চল, জোয়ারে বাজার তলিয়ে যাচ্ছে পৌর শহরের মাছ ও সবজি বাজারগুলো জোয়ারের সময় বিষখালী নদীর পানিতে তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় পানি সরে যায়।
বন্দর ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম আহ্বায়ক সায়েদ মল্লিক বলেন, ‘বর্ষাকালে জোয়ারের সময় বিষখালী নদীর পানিতে বাজারের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। এ সময় ব্যবসায়ীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।’
মোকামিয়া ইউনিয়নের বটতলা গ্রামের শিক্ষক সুশান্ত কুমার গাইন বলেন, ‘প্রবল বর্ষণে সবজির ফসল তলিয়ে গেছে। এছাড়া আমন ধানের বীজতলাও পানির নিচে রয়েছে।’
বেতাগী পৌরসভার একজন কর্মকর্তা জানান, জরুরি ভিত্তিতে ড্রেন পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়েছে এবং পানি নিষ্কাশনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
পৌর প্রশাসক মো. বশির গাজী বলেন, ‘প্রবল বর্ষণে কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা, তদন্ত করা হচ্ছে। সঠিক তদন্তের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
মহম্মদপুর খাদ্যগুদাম সড়ক,
বৃষ্টি হলেই সড়ক যেন পুকুর
মহম্মদপুর (মাগুরা) প্রতিনিধি জানান,
মাগুরার মহম্মদপুর খাদ্যগুদাম সড়কটি হালকা বৃষ্টি হলেই সড়কটি যেন পুকুরে পরিণত হয়। উপজেলা সদরের কৃষি ব্যাংকের সামনে থেকে সরকারি খাদ্যগুদামের গেট পর্যন্ত প্রায় পাঁচশত মিটার পাকা সড়কের অবস্থা শোচনীয় রূপ নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটির পিচঢালাই উঠে বড় বড় গর্ত আর খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।
সড়কটির পাশে উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার সাধারণ জনগণ সেবা নিতে এই সড়কটি ব্যবহার করে। এছাড়াও ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও মহম্মদপুর বাজারে হাজার হাজার সাধারণ জনগণ আসা-যাওয়া করে। কিন্তু সড়কটি দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ার কারণে সবাই ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়ছেন। আবার সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে প্রচুর পানি জমে থাকায় যাতায়াতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, সরকারি খাদ্যগুদাম ও ইউনিয়ন পরিষদের অফিস ওই সড়কে পাশে হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করে। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি সংস্কার না করার কারণে সবাই ভোগান্তিতে পড়েছেন। এছাড়া প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন, প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সব মিলিয়ে বেহাল এই সড়কটি নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মানুষ। এ অবস্থায় সড়কটি দ্রুত সংস্কার করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কটির ইট-বালু, সুরকি, পাথর ও বিটুমিন উঠে গিয়ে পুরোটাই গর্ত ও নালা সৃষ্টি হয়েছে।
মহম্মদপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান নওশের আলী জানান, বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি জমে থাকে মনে হয় এ যেন বড় একটি পুকুর। তখন হেঁটেও চলাচল করা যায় না। জুতা হাতে নিয়েই চলাচল করতে হয়। আবার বৃষ্টি না থাকলে ধুলাবালিতে একাকার হয়ে যায় সড়কটি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী নায়েব আলী জানান, আমি একজন কসমেটিক ব্যবসায়ী, এই সড়কের পাশেই আমার দোকান। সড়কটি এতটাই খারাপ হয়েছে যে, কোনো কাস্টমার আসতে পারে না। এই সড়কের পাশের ব্যবসায়ীদের কাস্টমারের অভাবে বেচাকেনা না হওয়ায় অনেক ক্ষতির মধ্যে পড়ে গেছি। আমরা সড়কটি দ্রুত সংস্থারের দাবি জানাচ্ছি।
ইজিবাইকচালক এরশাদ জানান, সড়কের অবস্থা ভয়াবহ। সড়কে গাড়ি নিয়ে নামলে মনে হয় পুকুরে নামলাম। এই সড়ক গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যেই ইজিবাইক উল্টে যায়। আবার অনেক সময় গর্তে পড়ে গাড়ি বিকল হয়ে যায়।
কয়েক শিক্ষার্থী বলেন, এই সড়কটি দিয়ে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা যাতায়াত করে। প্রতি দিন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছি।
উপজেলা প্রকৌশলী গোলজার হোসেন বলেন, খাদ্যগুদাম সড়কটির বিষয়ে আমরা অবগত হয়েছি। সড়কটি সংস্কারের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহীনুর আক্তার বলেন, সড়কটি সংস্কারের জন্য এলজিইডির প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলেছি। সড়কটি দ্রুত সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে।