বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ঘোষণায় বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশের বিভিন্ন খাত। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে তৈরি পোশাক খাত। কারণ, এই খাত একাই বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশের মতো অংশ দখল করে আছে। এছাড়াও হোম টেক্সটাইল, প্লাস্টিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, সুতা ও কাপড়, তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার, ওষুধ, হস্তশিল্প এবং ছোট আকারের জাহাজ দেশটিতে রপ্তানি হয়। শুল্কারোপের ফলে এই খাতগুলো বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশের মতো অংশ দখল করে আছে তৈরি পোশাক খাত
২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানি ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য
ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার, ছোট আকারের জাহাজ রপ্তানি উদীয়মান খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে
এর মধ্যে ওষুধ, সফটওয়্যার ও ছোট আকারের জাহাজ রপ্তানিকে বাংলাদেশের জন্য উদীয়মান রপ্তানি খাত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। হঠাৎ এই শুল্কারোপের কারণে খাতগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে পারে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, আলোচনা করে বাড়তি শুল্ক কমানো না গেলে রপ্তানি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। সরকারের উচিত, আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এর সমাধান করা।
গত সোমবার পাল্টা ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। আগামী ১ আগস্ট থেকে এই শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। ট্রাম্পের এই ঘোষণায় বাংলাদেশের দুই হাজারের বেশি রপ্তানিকারক দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কারণ বাংলাদেশের এমন ব্যবসায়ীও আছেন যারা শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই পণ্য রপ্তানি করেন। যদি শুল্কের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন তাহলে তার সব প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যাবে। এতে কর্মসংস্থান হারাবেন দেশের বহু স্বল্প আয়ের মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে দেশের যেসব খাত
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি যে খাতগুলোর পণ্য রপ্তানি হয়, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক খাত। টি-শার্ট, প্যান্ট, সোয়েটার, জ্যাকেটসহ বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্টস পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণে রপ্তানি হয়ে থাকে। এই খাত একাই বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশের মতো জুড়ে রয়েছে।
এরপরই রয়েছে হোম টেক্সটাইল খাত। বিছানার চাদর, তোয়ালে, পর্দাসহ নানান ধরনের গৃহস্থালি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়। এ খাতেও সম্প্রতি বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে প্লাস্টিক পণ্য। প্লাস্টিকের হ্যাঙ্গার, প্যাকেজিং সামগ্রী ও অন্যান্য প্লাস্টিকজাত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের সহযোগী পণ্য হিসেবে বেশি রপ্তানি হয়। আবার কোনো কোনো সময় আলাদাভাবেও এই খাত থেকে রপ্তানি হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
চতুর্থ খাত হিসেবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। জুতা, ব্যাগ, বেল্টসহ উচ্চমূল্যের চামড়াজাত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশি চামড়ার গুণগত মানের কারণে এ খাতে বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ রয়েছে। এছাড়া সুতা ও কাপড়ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়, যা মূলত গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল হলেও আলাদাভাবেও রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবেও রপ্তানি হয়। পাটজাত পণ্যও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে স্থান করে নিচ্ছে। পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ, ম্যাট, কার্পেটের চাহিদা দেশটিতে বাড়ছে।
ওষুধ খাতও ধীরে ধীরে রপ্তানির তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠিন বাজারে বাংলাদেশের ওষুধ প্রবেশ করতে শুরু করেছে যা ভবিষ্যতে বড় সাফল্যের সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। হস্তশিল্প ও কুটিরশিল্পের নানা পণ্য যেমন নকশিকাঁথা, কাঠের কারুকাজ ও মাটির তৈরি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে ই-কমার্স বা প্রবাসীদের মাধ্যমে জায়গা করে নিচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার সেবাও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিযোগ্য ও একটি সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সার ও সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপ নির্মাণ ও ডেটা সেবায় অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এখন ছোট আকারের জাহাজও রপ্তানি করছে, যা নৌযান শিল্পকে ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাতে রূপান্তর করতে পারে। তবে সম্প্রতি এই শুল্কারোপ বাংলাদেশের এসব খাতে ঝুঁকি তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ কত?
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশটিতে ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই রপ্তানি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ১০৯ কোটি ডলার বা ১৪ শতাংশ বেশি। দেশটিতে গত অর্থবছরে যে পরিমাণ রপ্তানি বেড়েছে, তা একই সময়ে ১৫৪টি দেশে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির সমান।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ২০১টি দেশ ও অঞ্চলে মোট ৪ হাজার ৬৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানির প্রায় ১৯ শতাংশের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ৭৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারের। তৈরি পোশাক ছাড়া অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১১৭ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের।
মোট রপ্তানি মূল্যের হিসাবে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি বেড়েছে জার্মানিতে। এনবিআরের হিসাবে, জার্মানিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪৩ কোটি ডলার বেড়ে ৫৩২ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। দেশটিতে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি বেড়েছে নেদারল্যান্ডসে। দেশটিতে গত অর্থবছরে রপ্তানি ৪২ কোটি ডলার বেড়ে ২৩৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।
দ্রুত সমস্যার সমাধান চান ব্যবসায়ীরা
এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেছেন, ‘মার্কিন শুল্ক বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ওভারঅল একটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট হবে। আর যারা ঠু মাচ ডিপেন্ড অন ইউএস মার্কেট (যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল), তারা অলমোস্ট দেউলিয়া হয়ে যাবে। আগস্টের এক তারিখ পর্যন্ত সময় থাকায় সরকার এখনও আলোচনার কথা বলছে, দেখা যাক কী হয়। আমরা চাই সরকার দ্রুত এর সমাধান করুক।’
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল সংবাদকে বলেন, ‘এই শুল্কহার থাকলে বাংলাদেশের বহু পোশাকশ্রমিকের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য। বাংলাদেশকে এখনই মার্কিন আমদানিকারকদের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ, উচ্চপর্যায়ের বাণিজ্য আলোচনা ফের শুরু এবং বাংলাদেশি পণ্যের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।’
অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন
এই বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের মূল প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নামাতে পেরেছে, যা আমাদের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। এতে আমাদের তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। বিদেশি ক্রেতারা এই বাড়তি শুল্কের ভার কতটা নিতে চাইবে, তা বলা যায় না। ধারণা করছি, এটা তারা আমাদের রপ্তানিকারকদের ঘাড়ে দিতে চাইবে। কিন্তু এত বড় শুল্ক ব্যবধান নিয়ে প্রতিযোগী সক্ষম থাকা খুবই কঠিন।’
পরবর্তী তিন সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও কী কী প্রস্তাব দেয়া যায় তা ভেবে দেখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই শুল্ক অব্যাহত থাকলে মধ্য মেয়াদে আমাদের পণ্যের ক্রেতারা অন্যত্র চলে যেতে পারে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বড় একটি আমদানিকারক দেশ। সুতরাং তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। ১ আগস্ট থেকে নতুন পাল্টা শুল্ক কার্যকর করার ঘোষণা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তাই পরবর্তী তিন সপ্তাহে আমরা তাদের আরও কী দিতে পারি, তা দেখতে হবে।’
বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ঘোষণায় বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশের বিভিন্ন খাত। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে তৈরি পোশাক খাত। কারণ, এই খাত একাই বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশের মতো অংশ দখল করে আছে। এছাড়াও হোম টেক্সটাইল, প্লাস্টিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, সুতা ও কাপড়, তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার, ওষুধ, হস্তশিল্প এবং ছোট আকারের জাহাজ দেশটিতে রপ্তানি হয়। শুল্কারোপের ফলে এই খাতগুলো বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশের মতো অংশ দখল করে আছে তৈরি পোশাক খাত
২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানি ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য
ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার, ছোট আকারের জাহাজ রপ্তানি উদীয়মান খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে
এর মধ্যে ওষুধ, সফটওয়্যার ও ছোট আকারের জাহাজ রপ্তানিকে বাংলাদেশের জন্য উদীয়মান রপ্তানি খাত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। হঠাৎ এই শুল্কারোপের কারণে খাতগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে পারে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, আলোচনা করে বাড়তি শুল্ক কমানো না গেলে রপ্তানি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। সরকারের উচিত, আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এর সমাধান করা।
গত সোমবার পাল্টা ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। আগামী ১ আগস্ট থেকে এই শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। ট্রাম্পের এই ঘোষণায় বাংলাদেশের দুই হাজারের বেশি রপ্তানিকারক দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কারণ বাংলাদেশের এমন ব্যবসায়ীও আছেন যারা শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই পণ্য রপ্তানি করেন। যদি শুল্কের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন তাহলে তার সব প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যাবে। এতে কর্মসংস্থান হারাবেন দেশের বহু স্বল্প আয়ের মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে দেশের যেসব খাত
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি যে খাতগুলোর পণ্য রপ্তানি হয়, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক খাত। টি-শার্ট, প্যান্ট, সোয়েটার, জ্যাকেটসহ বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্টস পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণে রপ্তানি হয়ে থাকে। এই খাত একাই বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশের মতো জুড়ে রয়েছে।
এরপরই রয়েছে হোম টেক্সটাইল খাত। বিছানার চাদর, তোয়ালে, পর্দাসহ নানান ধরনের গৃহস্থালি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়। এ খাতেও সম্প্রতি বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে প্লাস্টিক পণ্য। প্লাস্টিকের হ্যাঙ্গার, প্যাকেজিং সামগ্রী ও অন্যান্য প্লাস্টিকজাত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের সহযোগী পণ্য হিসেবে বেশি রপ্তানি হয়। আবার কোনো কোনো সময় আলাদাভাবেও এই খাত থেকে রপ্তানি হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
চতুর্থ খাত হিসেবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। জুতা, ব্যাগ, বেল্টসহ উচ্চমূল্যের চামড়াজাত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশি চামড়ার গুণগত মানের কারণে এ খাতে বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ রয়েছে। এছাড়া সুতা ও কাপড়ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়, যা মূলত গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল হলেও আলাদাভাবেও রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবেও রপ্তানি হয়। পাটজাত পণ্যও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে স্থান করে নিচ্ছে। পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ, ম্যাট, কার্পেটের চাহিদা দেশটিতে বাড়ছে।
ওষুধ খাতও ধীরে ধীরে রপ্তানির তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠিন বাজারে বাংলাদেশের ওষুধ প্রবেশ করতে শুরু করেছে যা ভবিষ্যতে বড় সাফল্যের সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। হস্তশিল্প ও কুটিরশিল্পের নানা পণ্য যেমন নকশিকাঁথা, কাঠের কারুকাজ ও মাটির তৈরি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে ই-কমার্স বা প্রবাসীদের মাধ্যমে জায়গা করে নিচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার সেবাও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিযোগ্য ও একটি সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সার ও সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপ নির্মাণ ও ডেটা সেবায় অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এখন ছোট আকারের জাহাজও রপ্তানি করছে, যা নৌযান শিল্পকে ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাতে রূপান্তর করতে পারে। তবে সম্প্রতি এই শুল্কারোপ বাংলাদেশের এসব খাতে ঝুঁকি তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ কত?
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশটিতে ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই রপ্তানি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ১০৯ কোটি ডলার বা ১৪ শতাংশ বেশি। দেশটিতে গত অর্থবছরে যে পরিমাণ রপ্তানি বেড়েছে, তা একই সময়ে ১৫৪টি দেশে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির সমান।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ২০১টি দেশ ও অঞ্চলে মোট ৪ হাজার ৬৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানির প্রায় ১৯ শতাংশের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ৭৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারের। তৈরি পোশাক ছাড়া অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১১৭ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের।
মোট রপ্তানি মূল্যের হিসাবে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি বেড়েছে জার্মানিতে। এনবিআরের হিসাবে, জার্মানিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪৩ কোটি ডলার বেড়ে ৫৩২ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। দেশটিতে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি বেড়েছে নেদারল্যান্ডসে। দেশটিতে গত অর্থবছরে রপ্তানি ৪২ কোটি ডলার বেড়ে ২৩৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।
দ্রুত সমস্যার সমাধান চান ব্যবসায়ীরা
এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেছেন, ‘মার্কিন শুল্ক বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ওভারঅল একটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট হবে। আর যারা ঠু মাচ ডিপেন্ড অন ইউএস মার্কেট (যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল), তারা অলমোস্ট দেউলিয়া হয়ে যাবে। আগস্টের এক তারিখ পর্যন্ত সময় থাকায় সরকার এখনও আলোচনার কথা বলছে, দেখা যাক কী হয়। আমরা চাই সরকার দ্রুত এর সমাধান করুক।’
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল সংবাদকে বলেন, ‘এই শুল্কহার থাকলে বাংলাদেশের বহু পোশাকশ্রমিকের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য। বাংলাদেশকে এখনই মার্কিন আমদানিকারকদের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ, উচ্চপর্যায়ের বাণিজ্য আলোচনা ফের শুরু এবং বাংলাদেশি পণ্যের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।’
অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন
এই বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের মূল প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নামাতে পেরেছে, যা আমাদের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। এতে আমাদের তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। বিদেশি ক্রেতারা এই বাড়তি শুল্কের ভার কতটা নিতে চাইবে, তা বলা যায় না। ধারণা করছি, এটা তারা আমাদের রপ্তানিকারকদের ঘাড়ে দিতে চাইবে। কিন্তু এত বড় শুল্ক ব্যবধান নিয়ে প্রতিযোগী সক্ষম থাকা খুবই কঠিন।’
পরবর্তী তিন সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও কী কী প্রস্তাব দেয়া যায় তা ভেবে দেখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই শুল্ক অব্যাহত থাকলে মধ্য মেয়াদে আমাদের পণ্যের ক্রেতারা অন্যত্র চলে যেতে পারে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বড় একটি আমদানিকারক দেশ। সুতরাং তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। ১ আগস্ট থেকে নতুন পাল্টা শুল্ক কার্যকর করার ঘোষণা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তাই পরবর্তী তিন সপ্তাহে আমরা তাদের আরও কী দিতে পারি, তা দেখতে হবে।’