নতুন নতুন ইস্যু, মত-দ্বিমত, হতাশা আর বিরোধিতা এমন নানা জটিলতায় ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের রাজনীতি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাতেও সংস্কার নিয়ে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি নেই। যার ফলে নির্বাচন নিয়ে সংশয়, সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা বাড়ছে। ইতোমধ্যে জামায়েতসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি দল নতুন নতুন দাবি উত্থাপন করায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে তৈরি সংশয় হয়েছে।
দলগুলোর মতপার্থক্য বা পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে রাজনীতিতে অস্থিরতা এবং নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে
যারা নতুন নতুন দাবি তুলছে, তাদের উদ্দেশ্য হতে পারে নির্বাচন বিলম্বিত করা বা নির্বাচন না হওয়া: সালাহউদ্দিন আহমদ
জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র আদায় করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ: নাহিদ ইসলাম
সনদ ও ঘোষণাপত্র ভিন্ন বিষয়, জুলাই সনদ সংবিধানের অংশ হবে: বদিউল আলম মজুমদার
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপি ও সমমনাদলগুলোর নানা বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও ঐকমত্যের জন্য ছাড় দিয়ে যাচ্ছে তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনাসহ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিতে বিরোধীদলের সদস্যদের সভাপতি করার ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়েছে। ঐক্য হয়েছে প্রধান বিচারপতির নিয়োগ, বিভাগীয় পর্যায়ে উচ্চ আদালতের বেঞ্চ গঠনেও। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের মেয়াদ ১০ বছর করার ক্ষেত্রে সব দলের সমর্থন থাকলেও সমঝোতা হয়নি। কমিশন সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের বিষয়ে কমিশন এখনও ঐকমত্যে পৌঁছায়নি।
তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এমন নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে বিচার ও জুলাই সনদের মতো একাধিক দাবি উত্থাপন করেছে এনসিপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি দল।
অপরদিকে দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি, স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং আনুপাতিক হারে নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলোর সঙ্গে একমত নয়। তারা মনে করে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুযোগ নেই এবং আনুপাতিক হার একটি জটিল প্রক্রিয়া যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়। ফলে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে দলগুলো। এছাড়া সমঝোতা হয়নি সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি গঠন, সরাসরি ভোটে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রস্তাবেও। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, যারা এসব দাবি তুলছে, তাদের উদ্দেশ্য হতে পারে নির্বাচন বিলম্বিত করা বা নির্বাচন না হওয়া।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়েও জটিলতার আশঙ্কা করছেন। ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটি ঐক্যের পথে থাকলেও ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলো এখনও একমত হয়নি। দাবি আছে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ সংবিধানের অংশ করার।
এ অবস্থায় জুলাইয়ের মধ্যে এসব প্রস্তাবে সমঝোতা কঠিন হলেও
আশাবাদী জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, ‘সনদ ও ঘোষণাপত্র ভিন্ন বিষয়। জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ সংবিধানের অংশ হবে। এর জন্য সংশোধন করা হবে সংবিধান।’
ঐকমত্য কমিশনের এই সদস্য আরও বলেন, ‘জুলাই ঘোষণা ওটা আমাদের গণঅভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্য, বিশেষত্ব, তাৎপর্য এবং আমাদের ঐতিহাসিক পেক্ষাপটে। এটা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হবে কী হবে না এটা সরকারের সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত। এটা কিন্তু আমাদের বিষয় নয়।’
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দেশবাসীকে ডাক দিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা প্রস্তুত হন, আগামী ২৩ আগস্ট শহীদ মিনারে দেখা হবে। আমরা জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র আদায় করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। যারা বলে জুলাই কেবল আবেগের বিষয়, যারা বলে জুলাইকে কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি দেয়ার প্রয়োজন নাই, তাদের দেখিয়ে দিতে হবে ২৩ আগস্ট ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জনগণ আবারও মুজিববাদী সংবিধানের বিরুদ্ধে একত্র হবে। যারা জুলাইকে সংবিধানে জায়গা দিতে চায় না, যারা জুলাইকে কোনো আইনি কাঠামোতে জায়গা দিতে চায় না, তারা মুজিববাদে ফেরার রাস্তা তৈরি করতে চায়।’
এনসিপির আহ্বায়ক আরও বলেন, ‘গণহত্যাকারী খুনি হাসিনার বিচার আমরা দেখতে চাই। সংস্কার দেখতে চাই এবং নতুন সংবিধান দেখতে চাই। এই প্রজন্ম বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান এই দেশের মানুষকে উপহার দেবে।’
##### নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ #####
আগের নিয়মেই নির্বাচন হবে নাকি পিআর পদ্ধতিতে হবে, এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিপরীতমুখী অবস্থান ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। যদিও জামায়াত জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই, তবে তারা যেনতেন নির্বাচন চায় না।
বিশ্লেষকরা এই জটিল পরিস্থিতির জন্য সংস্কার নিয়ে সরকারের উচ্চাকাক্সক্ষাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, সংস্কারে যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে, তাকে একটি রূপ দিয়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা জরুরি, অন্যথায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
##### বিএনপির অবস্থান ও ছাড় #####
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বেশিরভাগ সংস্কার প্রস্তাবেই বিএনপি একমত হয়েছে। চারটি কমিশনের মোট ৫৮৭টি প্রস্তাবের মধ্যে ৪৩৬টিতেই দলটি একমত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দুদক সংস্কার কমিশনের ৪৭টি সুপারিশের মধ্যে ৪৬টি, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি সুপারিশের মধ্যে ১৮৭টি, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টি এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাবিষয়ক সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে বিএনপি একমত হয়েছে। এছাড়াও ২৮টি প্রস্তাবে আংশিক একমত পোষণ করেছে দলটি।
পুলিশ সংস্কার কমিশন নিয়ে এখনও চূড়ান্ত আলোচনা হয়নি, তবে র্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে বিএনপি দফাওয়ারি মতামত দিয়েছে এবং অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, জাতীয় সংসদে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধীদলকে দেয়া, আসনসংখ্যার অনুপাতে সভাপতির পদ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে বিএনপি একমত। এছাড়াও, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা বিন্যাসে সংস্কার, উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান পরিবর্তন ও সংশোধনেও বিএনপি একমত।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে তারা কমিশনের প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করছেন। তবে জনগণের নির্বাচিত সংসদ ও সরকারকে দুর্বল করার মতো কোনো প্রস্তাব তারা গ্রহণ করেননি, যা সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন তিনি।
##### ইসলামপন্থি দলগুলোর তৎপরতা #####
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে, বিএনপির বিপরীতে একটি ‘সমঝোতায়’ যাওয়ার তৎপরতা চলছে। তারা সব আসনে একক প্রার্থী দেয়া এবং ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর লক্ষ্য স্থির করেছে। এই দলগুলো এখনই জোট গঠনের ঘোষণা দিতে চাইছে না, তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এটি একটি রূপ নিতে পারে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কতটা যুক্ত হবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়, তবে ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন সংস্কার বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে।
গত ২০ জুন খুলনায় দলীয় এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘দেশের ইসলামি দলগুলোর মধ্যে একধরনের সমঝোতা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর একটি ভোটবাক্স থাকবে।’
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের মতো অনেক দল সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। এর মধ্যে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন নিম্নকক্ষেও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা কমাতে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি গঠনের প্রস্তাবে এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি বদলাতেও একমত। জামায়াত ও এনসিপি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়।
এই দলগুলো মনে করে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে, ফলে ছোট দলগুলোও প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, এই পদ্ধতিতে স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদী হওয়ার সুযোগ নেই।
###### নির্বাচন নিয়ে চলমান অনিশ্চয়তা ######
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারিতে শর্তসাপেক্ষে নির্বাচন প্রশ্নে যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। এরপর বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে এবং ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হচ্ছে। তবে লন্ডন বৈঠকের তিন সপ্তাহ পরও প্রধান উপদেষ্টা বা সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে কোনো ইঙ্গিত বা নির্দেশনা না দেয়ায় বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, তিনি ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার সাক্ষাতে নির্বাচনের সময় নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলগুলোর মতপার্থক্য বা পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে রাজনীতিতে অস্থিরতা এবং নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।
বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
নতুন নতুন ইস্যু, মত-দ্বিমত, হতাশা আর বিরোধিতা এমন নানা জটিলতায় ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের রাজনীতি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাতেও সংস্কার নিয়ে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি নেই। যার ফলে নির্বাচন নিয়ে সংশয়, সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা বাড়ছে। ইতোমধ্যে জামায়েতসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি দল নতুন নতুন দাবি উত্থাপন করায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে তৈরি সংশয় হয়েছে।
দলগুলোর মতপার্থক্য বা পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে রাজনীতিতে অস্থিরতা এবং নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে
যারা নতুন নতুন দাবি তুলছে, তাদের উদ্দেশ্য হতে পারে নির্বাচন বিলম্বিত করা বা নির্বাচন না হওয়া: সালাহউদ্দিন আহমদ
জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র আদায় করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ: নাহিদ ইসলাম
সনদ ও ঘোষণাপত্র ভিন্ন বিষয়, জুলাই সনদ সংবিধানের অংশ হবে: বদিউল আলম মজুমদার
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপি ও সমমনাদলগুলোর নানা বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও ঐকমত্যের জন্য ছাড় দিয়ে যাচ্ছে তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনাসহ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিতে বিরোধীদলের সদস্যদের সভাপতি করার ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়েছে। ঐক্য হয়েছে প্রধান বিচারপতির নিয়োগ, বিভাগীয় পর্যায়ে উচ্চ আদালতের বেঞ্চ গঠনেও। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের মেয়াদ ১০ বছর করার ক্ষেত্রে সব দলের সমর্থন থাকলেও সমঝোতা হয়নি। কমিশন সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের বিষয়ে কমিশন এখনও ঐকমত্যে পৌঁছায়নি।
তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এমন নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে বিচার ও জুলাই সনদের মতো একাধিক দাবি উত্থাপন করেছে এনসিপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি দল।
অপরদিকে দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি, স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং আনুপাতিক হারে নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলোর সঙ্গে একমত নয়। তারা মনে করে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুযোগ নেই এবং আনুপাতিক হার একটি জটিল প্রক্রিয়া যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়। ফলে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে দলগুলো। এছাড়া সমঝোতা হয়নি সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি গঠন, সরাসরি ভোটে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রস্তাবেও। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, যারা এসব দাবি তুলছে, তাদের উদ্দেশ্য হতে পারে নির্বাচন বিলম্বিত করা বা নির্বাচন না হওয়া।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়েও জটিলতার আশঙ্কা করছেন। ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটি ঐক্যের পথে থাকলেও ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলো এখনও একমত হয়নি। দাবি আছে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ সংবিধানের অংশ করার।
এ অবস্থায় জুলাইয়ের মধ্যে এসব প্রস্তাবে সমঝোতা কঠিন হলেও
আশাবাদী জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, ‘সনদ ও ঘোষণাপত্র ভিন্ন বিষয়। জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ সংবিধানের অংশ হবে। এর জন্য সংশোধন করা হবে সংবিধান।’
ঐকমত্য কমিশনের এই সদস্য আরও বলেন, ‘জুলাই ঘোষণা ওটা আমাদের গণঅভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্য, বিশেষত্ব, তাৎপর্য এবং আমাদের ঐতিহাসিক পেক্ষাপটে। এটা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হবে কী হবে না এটা সরকারের সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত। এটা কিন্তু আমাদের বিষয় নয়।’
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দেশবাসীকে ডাক দিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা প্রস্তুত হন, আগামী ২৩ আগস্ট শহীদ মিনারে দেখা হবে। আমরা জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র আদায় করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। যারা বলে জুলাই কেবল আবেগের বিষয়, যারা বলে জুলাইকে কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি দেয়ার প্রয়োজন নাই, তাদের দেখিয়ে দিতে হবে ২৩ আগস্ট ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জনগণ আবারও মুজিববাদী সংবিধানের বিরুদ্ধে একত্র হবে। যারা জুলাইকে সংবিধানে জায়গা দিতে চায় না, যারা জুলাইকে কোনো আইনি কাঠামোতে জায়গা দিতে চায় না, তারা মুজিববাদে ফেরার রাস্তা তৈরি করতে চায়।’
এনসিপির আহ্বায়ক আরও বলেন, ‘গণহত্যাকারী খুনি হাসিনার বিচার আমরা দেখতে চাই। সংস্কার দেখতে চাই এবং নতুন সংবিধান দেখতে চাই। এই প্রজন্ম বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান এই দেশের মানুষকে উপহার দেবে।’
##### নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ #####
আগের নিয়মেই নির্বাচন হবে নাকি পিআর পদ্ধতিতে হবে, এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিপরীতমুখী অবস্থান ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। যদিও জামায়াত জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই, তবে তারা যেনতেন নির্বাচন চায় না।
বিশ্লেষকরা এই জটিল পরিস্থিতির জন্য সংস্কার নিয়ে সরকারের উচ্চাকাক্সক্ষাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, সংস্কারে যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে, তাকে একটি রূপ দিয়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা জরুরি, অন্যথায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
##### বিএনপির অবস্থান ও ছাড় #####
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বেশিরভাগ সংস্কার প্রস্তাবেই বিএনপি একমত হয়েছে। চারটি কমিশনের মোট ৫৮৭টি প্রস্তাবের মধ্যে ৪৩৬টিতেই দলটি একমত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দুদক সংস্কার কমিশনের ৪৭টি সুপারিশের মধ্যে ৪৬টি, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি সুপারিশের মধ্যে ১৮৭টি, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টি এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাবিষয়ক সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে বিএনপি একমত হয়েছে। এছাড়াও ২৮টি প্রস্তাবে আংশিক একমত পোষণ করেছে দলটি।
পুলিশ সংস্কার কমিশন নিয়ে এখনও চূড়ান্ত আলোচনা হয়নি, তবে র্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে বিএনপি দফাওয়ারি মতামত দিয়েছে এবং অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, জাতীয় সংসদে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধীদলকে দেয়া, আসনসংখ্যার অনুপাতে সভাপতির পদ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে বিএনপি একমত। এছাড়াও, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা বিন্যাসে সংস্কার, উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান পরিবর্তন ও সংশোধনেও বিএনপি একমত।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে তারা কমিশনের প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করছেন। তবে জনগণের নির্বাচিত সংসদ ও সরকারকে দুর্বল করার মতো কোনো প্রস্তাব তারা গ্রহণ করেননি, যা সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন তিনি।
##### ইসলামপন্থি দলগুলোর তৎপরতা #####
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে, বিএনপির বিপরীতে একটি ‘সমঝোতায়’ যাওয়ার তৎপরতা চলছে। তারা সব আসনে একক প্রার্থী দেয়া এবং ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর লক্ষ্য স্থির করেছে। এই দলগুলো এখনই জোট গঠনের ঘোষণা দিতে চাইছে না, তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এটি একটি রূপ নিতে পারে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কতটা যুক্ত হবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়, তবে ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন সংস্কার বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে।
গত ২০ জুন খুলনায় দলীয় এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘দেশের ইসলামি দলগুলোর মধ্যে একধরনের সমঝোতা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর একটি ভোটবাক্স থাকবে।’
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের মতো অনেক দল সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। এর মধ্যে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন নিম্নকক্ষেও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা কমাতে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি গঠনের প্রস্তাবে এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি বদলাতেও একমত। জামায়াত ও এনসিপি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়।
এই দলগুলো মনে করে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে, ফলে ছোট দলগুলোও প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, এই পদ্ধতিতে স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদী হওয়ার সুযোগ নেই।
###### নির্বাচন নিয়ে চলমান অনিশ্চয়তা ######
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারিতে শর্তসাপেক্ষে নির্বাচন প্রশ্নে যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। এরপর বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে এবং ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হচ্ছে। তবে লন্ডন বৈঠকের তিন সপ্তাহ পরও প্রধান উপদেষ্টা বা সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে কোনো ইঙ্গিত বা নির্দেশনা না দেয়ায় বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, তিনি ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার সাক্ষাতে নির্বাচনের সময় নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলগুলোর মতপার্থক্য বা পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে রাজনীতিতে অস্থিরতা এবং নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।