নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জে ৬ হাজার ১৫০ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠছে পূর্বাচল নতুন শহর
পূর্বাচলে ২০০৬ সালে একটি প্লটটি কিনেছিলেন ডেটা ইন্টারন্যাশনাল লিমেটেডের ডিরেক্টর এস এম আজিজুর রহমান। প্রায় ২০ বছর হয়ে গেলেও সেখানে কোনো নাগরিক সুবিধা না পাওয়ার কারণে এখনও বাড়ি করতে পারেননি তিনি। তার অভিযোগ সেখানে বসবাস করার মতো কোনো নাগরিক সুবিধাই নেই।
রাজউকের ‘অদক্ষতা’ ও ‘চরম অব্যবস্থাপনার’ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের
সব নাগরিক ও ইউটিলিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার সুবিধার তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে পূর্বাচলকে বাসযোগ্য করে তোলা এখন সময়ের দাবি: আইএবি সভাপতি স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ
১৫ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত সব সুযোগ-সুবিধা দিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে: রাজউক চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম
প্রকল্প এলাকায় জননিরাপত্তা জন্য পুলিশের বিভাগ সৃষ্টি করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে চিঠি
আজিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘একটা জায়গায় বসবাস করতে গেলে যে তিন-চারটা জিনিস লাগে: আমার একটা রোড নেটওয়ার্ক থাকতে হবে, আমার ইলেকট্রিসিটি, পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধাটা থাকবে। এসব বেসিক জিনিসের মধ্যে শুধু রাস্তাটা তারা কোনো রকমে করেছে, সেটাও সব জায়গায় নয়। বাকি দুইটার কথা বাদই দিলাম।’
তার আরও অভিযোগ, ‘আমার প্লটের সামনে ইলেকট্রিসিটির লাইনও যায় নাই, পানি-পয়ঃতো হয়ই নাই। এক দুই তিন ছাড়া বাকি ৩০টা সেক্টরের কোনোটাই হয় নাই। এই তিনটা বেসিক জিনিস ছাড়া আমরা সেখানে কেমনে গিয়ে থাকবো। আর আমার নিরাপত্তা কী থাকবে। আমি একটা ওয়াল দিয়ে গেইট করেছি সেই গেইট পরের দিনেই চুরি হয়ে গিয়েছে। এই যে নিরাপত্তার অভাব এটার কোনো ব্যবস্থাই তো রাজউক নেয় নাই। আর এই কয়েকটি বেসিক জিনিসের কারণে আমরা ওখানে যেতে পারছি না।’
আরেক প্লট মালিক মাকসুদুল আলম সংবাদকে বলেন, ‘এখানে জরুরিভাবে দরকার থানা, পুলিশ ফাঁড়ি। বিদ্যুতের সমস্যা আছে।’
তিনি বলেন, ‘আশপাশে মানুষ থাকে না, সেখানে খুঁটি দিয়ে রাখছে অথচ আমি বাঁশ দিয়ে বৈদ্যুতিক লাইন এনেছি ’২৩ সালে, এখন ’২৫ সাল চলছে। ’২৪ সালে অ্যাপ্লিকেশন করলাম এখনও দুইটা খুঁটি পেলাম না। চোরে ডিস্টার্ব করে, কারেন্টের তার চোরে নিয়ে গেছে কয়েকবার। বিদ্যুৎ বিভাগকে জানালেও সুরাহা হয়নি, খোঁজ নিতেও আসেনি কেউ।’
একই রকম অভিযোগ সদরুদ্দিন আহমেদ, গোলজার হোসেন, শাওন ভূইয়া, আবু সাদেক, নিয়াজ মোহাম্মদ, জমিরউদ্দিনসহ অনেক প্লট মালিকের। পূর্বাচলে বাড়ি বানাতে না পারার কারণ হিসেবে তারা প্রকল্পকাজে ধীরগতি, অব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় সুবিধাহীনতার কথা উল্লেখ করেন।
তাদের আরও অভিযোগ, রাজউক তাদের কথা শুনছে তবে ‘কাজ করতে’ ইচ্ছুক নয়। ডেসকোর কাছে কোনো কিছু জানতে চাইলে তারা কন্ট্রাকটর নেই বলে অপারগতা দেখায়। পয়ঃনিষ্কাশন ও পানির বিষয়ে কথা বলতে গেলে ‘আলাপ-আলোচনা চলছে’ বলে পাশ কাটায়।
নিরাপত্তার দিক থেকেও রয়েছে বড় ঘাটতি। প্রকল্প এলাকায় কোনো
পূর্ণাঙ্গ থানা নেই, নেই কোনো স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি। ফলে প্লট মালিক বা অল্পসংখ্যক বসবাসকারী সবাই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
পূর্বাচল নিউটাউন সোসাইটির সভাপতি ও সাবেক সচিব ড. এ ওয়াই এম একরামুল হক সংবাদকে বলেন, ‘পূর্বাচলে যে স্বপ্ন নিয়ে মানুষ প্লট কিনেছিল সেটা স্বপ্নই থেকে গেছে। এই জায়গাটি এখন অন্ধকার বিরান ভূমি। ৩০০ ফুট আধুনিক সড়কের চোখ ঝলমলে আলোর পাশেই নিকোশ অন্ধকার রাজ্য।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘সরকার আসে সরকার যায়, পূর্বাচলের কোনো উন্নতি হয় না! রাজউক সৃষ্ট পূর্বাচল আজ চূড়ান্ত বৈষম্যের শিকার। পূর্বাচল নতুন শহরে সব নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করা, সার্বিক উন্নয়ন ও নিরাপওা ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য আমরা অবিলম্বে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ আইএবির সভাপতি স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে পূর্বাচলের সংযোগ এক্সপ্রেসওয়ে বানানো হলো কিন্তু পূর্বাচলকে বাসযোগ্য করার সব সুযোগ-সুবিধা আজও নির্মাণ করা শেষ হলো না।’
তিনি বলেন, ‘রাজউকের এই অদূরদর্শিতা, অদক্ষতা ও চরম অব্যবস্থাপনার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ শুধু বাড়ছে, কাজ শেষ হচ্ছে না। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের চরিত্র পাল্টে নতুন নতুন প্লট করা হবে। পার্ক ও মাঠসহ বড় প্লট ছোট করে সুবিধাদি বিপন্ন করবে। তাই সব নাগরিক ও ইউটিলিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার সুবিধাসমূহ অতিসত্বর সম্পন্ন করে পূর্বাচলকে বাসযোগ্য করা এখন সময়ের দাবি।’
ইতোমধ্যে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় জননিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগ সৃষ্টিসহ জনবলের মঞ্জুরি দিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে আইজিপি বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে।
চিঠিতে সেখানকার বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডিএমপি একটি সমন্বিত নিরাপত্তা জোন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে: একটি নতুন অপরাধ বিভাগ; একটি গোয়েন্দা শাখা; একটি ট্রাফিক বিভাগ; একটি জনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা বিভাগ; একটি পরিবহন বিভাগ; একটি পুলিশ লাইন; দুইটি অপরাধ জোন; চারটি ট্রাফিক জোন; চারটি থানা; পাঁচটি পুলিশ ফাঁড়ি ও ৩০টি পুলিশ বক্স।
***** ৩০ বছর: এখনও স্বপ্নেই পূর্বাচল:
রাজধানীতে জনসংখ্যার চাপ কমাতে ১৯৯৫ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) হাতে নেয় পূর্বাচল নতুন শহর নামের মেগা প্রকল্প। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জের ৬ হাজার ১৫০ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠছে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি আজও কেবল ‘স্বপ্নেই নগরী’ হয়েই রয়ে গেছে।
আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লট রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় মৌলিক নাগরিক সুবিধার অভাব, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও দীর্ঘসূত্রতায় বিপর্যস্ত প্রকল্পটি এখন চরম হতাশায় ফেলেছে প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের। রাজউকও যেন এর সমাধানে ব্যর্থ। সেখানে এখনও বসতি গড়ে ওঠেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে বারবার পরিবর্তন এসেছে নকশায়। এ পর্যন্ত মোট ৫ বার নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি ৭ দফা বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ, যার সর্বশেষ সময়সীমা ধরা হয়েছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। সেখানে একটি পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব, আবাসিক-বাণিজ্যিক শহর গড়ে তোলার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো-প্রশস্ত সড়ক, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পার্ক ও অফিস এলাকা না থাকায় বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি।
প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তি, রাজউকের প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং নগরপরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাসযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থতার পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। প্রকল্পের অভ্যন্তরীণ সড়ক নির্মাণে ধীরগতি, অধিকাংশ এলাকায় এখনও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সুপেয় পানির সংযোগ না থাকা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা। এছাড়া, থানা বা পুলিশ ফাঁড়ি না থাকার কারণে চোরের উৎপাত।
রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘আমরা ব্যাপক প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। ইতোমধ্যে চার নম্বর সেক্টর পর্যন্ত ফুল পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও রাস্তাঘাট সব কমপ্লিট করেছি। এজন্য আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছি। আর ১৫ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত সব সুযোগ-সুবিধা দিতে আমাদের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা দুই প্রস্তাব পাঠিয়েছি। রাস্তা-ঘাট, পানি, বিদ্যুৎ ও পয়ঃনিষ্কাশন এগুলোতো রাজউক দেখে না। অলরেডি আমরা বিদ্যুতের জন্য ডেসকোর নিকট হ্যান্ডওভার করছি। তারা সাবস্টেশন ও অনান্য কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমরা আর্মি ডেপ্লেয়ড করেছি। নিরাপত্তার জন্য আরও ১০০ আনসার নিয়োগ করেছি। বাতির জন্য টেন্ডার করেছি। পুলিশের জন্য আমরা পুলিশের সঙ্গে রেগুলার মিটিং করছি। তাদের চারটা থানা এরিয়া করার জন্য।’
সেখানকার প্লট মালিকরা জানান, পূর্বাচলে এখনও পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। পূর্বাচলে এখনও কোনো উন্নতমানের হাসপাতাল বা আধুনিক ক্লিনিক গড়ে ওঠেনি। ফলে বাসিন্দারা শিক্ষা ও জরুরি চিকিৎসার জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ওপর নির্ভরশীল।
রাজউকের তথ্যানুযায়ী, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের আবাসিক প্লট মোট ২৬ হাজার ২১৩টি। যার মধ্যে তিন কাঠা আয়তনের ১১ হাজার ২০৯টি, পাঁচ কাঠা আয়তনের ১০হাজার ৩৬১টি, ৭ দশমিক ৫ কাঠা আয়তনের দুই হাজার ৬১৮টি, ১০ কাঠা আয়তনের প্লট দুই হাজার ২৫টি। এছাড়া অন্যান্য প্লট আছে তিন হাজার ৫৬৩টি। এর মধ্যে কম-বেশি আয়তনের ১৫টি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক, প্রশাসনিক ৪৭২টি, বাণিজ্যিক এক হাজার ৩৩টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আরবান ফ্যাসিলিটিস প্লট দুই হাজার ৪৩টি। আদি অধিবাসী ও ক্ষতিগ্রস্তদের বরাদ্দ দেয়া প্লটের সংখ্যা সাত হাজার ৮৬৪টি।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জে ৬ হাজার ১৫০ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠছে পূর্বাচল নতুন শহর
শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
পূর্বাচলে ২০০৬ সালে একটি প্লটটি কিনেছিলেন ডেটা ইন্টারন্যাশনাল লিমেটেডের ডিরেক্টর এস এম আজিজুর রহমান। প্রায় ২০ বছর হয়ে গেলেও সেখানে কোনো নাগরিক সুবিধা না পাওয়ার কারণে এখনও বাড়ি করতে পারেননি তিনি। তার অভিযোগ সেখানে বসবাস করার মতো কোনো নাগরিক সুবিধাই নেই।
রাজউকের ‘অদক্ষতা’ ও ‘চরম অব্যবস্থাপনার’ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের
সব নাগরিক ও ইউটিলিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার সুবিধার তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে পূর্বাচলকে বাসযোগ্য করে তোলা এখন সময়ের দাবি: আইএবি সভাপতি স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ
১৫ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত সব সুযোগ-সুবিধা দিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে: রাজউক চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম
প্রকল্প এলাকায় জননিরাপত্তা জন্য পুলিশের বিভাগ সৃষ্টি করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে চিঠি
আজিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘একটা জায়গায় বসবাস করতে গেলে যে তিন-চারটা জিনিস লাগে: আমার একটা রোড নেটওয়ার্ক থাকতে হবে, আমার ইলেকট্রিসিটি, পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধাটা থাকবে। এসব বেসিক জিনিসের মধ্যে শুধু রাস্তাটা তারা কোনো রকমে করেছে, সেটাও সব জায়গায় নয়। বাকি দুইটার কথা বাদই দিলাম।’
তার আরও অভিযোগ, ‘আমার প্লটের সামনে ইলেকট্রিসিটির লাইনও যায় নাই, পানি-পয়ঃতো হয়ই নাই। এক দুই তিন ছাড়া বাকি ৩০টা সেক্টরের কোনোটাই হয় নাই। এই তিনটা বেসিক জিনিস ছাড়া আমরা সেখানে কেমনে গিয়ে থাকবো। আর আমার নিরাপত্তা কী থাকবে। আমি একটা ওয়াল দিয়ে গেইট করেছি সেই গেইট পরের দিনেই চুরি হয়ে গিয়েছে। এই যে নিরাপত্তার অভাব এটার কোনো ব্যবস্থাই তো রাজউক নেয় নাই। আর এই কয়েকটি বেসিক জিনিসের কারণে আমরা ওখানে যেতে পারছি না।’
আরেক প্লট মালিক মাকসুদুল আলম সংবাদকে বলেন, ‘এখানে জরুরিভাবে দরকার থানা, পুলিশ ফাঁড়ি। বিদ্যুতের সমস্যা আছে।’
তিনি বলেন, ‘আশপাশে মানুষ থাকে না, সেখানে খুঁটি দিয়ে রাখছে অথচ আমি বাঁশ দিয়ে বৈদ্যুতিক লাইন এনেছি ’২৩ সালে, এখন ’২৫ সাল চলছে। ’২৪ সালে অ্যাপ্লিকেশন করলাম এখনও দুইটা খুঁটি পেলাম না। চোরে ডিস্টার্ব করে, কারেন্টের তার চোরে নিয়ে গেছে কয়েকবার। বিদ্যুৎ বিভাগকে জানালেও সুরাহা হয়নি, খোঁজ নিতেও আসেনি কেউ।’
একই রকম অভিযোগ সদরুদ্দিন আহমেদ, গোলজার হোসেন, শাওন ভূইয়া, আবু সাদেক, নিয়াজ মোহাম্মদ, জমিরউদ্দিনসহ অনেক প্লট মালিকের। পূর্বাচলে বাড়ি বানাতে না পারার কারণ হিসেবে তারা প্রকল্পকাজে ধীরগতি, অব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় সুবিধাহীনতার কথা উল্লেখ করেন।
তাদের আরও অভিযোগ, রাজউক তাদের কথা শুনছে তবে ‘কাজ করতে’ ইচ্ছুক নয়। ডেসকোর কাছে কোনো কিছু জানতে চাইলে তারা কন্ট্রাকটর নেই বলে অপারগতা দেখায়। পয়ঃনিষ্কাশন ও পানির বিষয়ে কথা বলতে গেলে ‘আলাপ-আলোচনা চলছে’ বলে পাশ কাটায়।
নিরাপত্তার দিক থেকেও রয়েছে বড় ঘাটতি। প্রকল্প এলাকায় কোনো
পূর্ণাঙ্গ থানা নেই, নেই কোনো স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি। ফলে প্লট মালিক বা অল্পসংখ্যক বসবাসকারী সবাই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
পূর্বাচল নিউটাউন সোসাইটির সভাপতি ও সাবেক সচিব ড. এ ওয়াই এম একরামুল হক সংবাদকে বলেন, ‘পূর্বাচলে যে স্বপ্ন নিয়ে মানুষ প্লট কিনেছিল সেটা স্বপ্নই থেকে গেছে। এই জায়গাটি এখন অন্ধকার বিরান ভূমি। ৩০০ ফুট আধুনিক সড়কের চোখ ঝলমলে আলোর পাশেই নিকোশ অন্ধকার রাজ্য।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘সরকার আসে সরকার যায়, পূর্বাচলের কোনো উন্নতি হয় না! রাজউক সৃষ্ট পূর্বাচল আজ চূড়ান্ত বৈষম্যের শিকার। পূর্বাচল নতুন শহরে সব নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করা, সার্বিক উন্নয়ন ও নিরাপওা ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য আমরা অবিলম্বে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ আইএবির সভাপতি স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে পূর্বাচলের সংযোগ এক্সপ্রেসওয়ে বানানো হলো কিন্তু পূর্বাচলকে বাসযোগ্য করার সব সুযোগ-সুবিধা আজও নির্মাণ করা শেষ হলো না।’
তিনি বলেন, ‘রাজউকের এই অদূরদর্শিতা, অদক্ষতা ও চরম অব্যবস্থাপনার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ শুধু বাড়ছে, কাজ শেষ হচ্ছে না। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের চরিত্র পাল্টে নতুন নতুন প্লট করা হবে। পার্ক ও মাঠসহ বড় প্লট ছোট করে সুবিধাদি বিপন্ন করবে। তাই সব নাগরিক ও ইউটিলিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার সুবিধাসমূহ অতিসত্বর সম্পন্ন করে পূর্বাচলকে বাসযোগ্য করা এখন সময়ের দাবি।’
ইতোমধ্যে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় জননিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগ সৃষ্টিসহ জনবলের মঞ্জুরি দিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে আইজিপি বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে।
চিঠিতে সেখানকার বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডিএমপি একটি সমন্বিত নিরাপত্তা জোন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে: একটি নতুন অপরাধ বিভাগ; একটি গোয়েন্দা শাখা; একটি ট্রাফিক বিভাগ; একটি জনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা বিভাগ; একটি পরিবহন বিভাগ; একটি পুলিশ লাইন; দুইটি অপরাধ জোন; চারটি ট্রাফিক জোন; চারটি থানা; পাঁচটি পুলিশ ফাঁড়ি ও ৩০টি পুলিশ বক্স।
***** ৩০ বছর: এখনও স্বপ্নেই পূর্বাচল:
রাজধানীতে জনসংখ্যার চাপ কমাতে ১৯৯৫ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) হাতে নেয় পূর্বাচল নতুন শহর নামের মেগা প্রকল্প। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জের ৬ হাজার ১৫০ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠছে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি আজও কেবল ‘স্বপ্নেই নগরী’ হয়েই রয়ে গেছে।
আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লট রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় মৌলিক নাগরিক সুবিধার অভাব, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও দীর্ঘসূত্রতায় বিপর্যস্ত প্রকল্পটি এখন চরম হতাশায় ফেলেছে প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের। রাজউকও যেন এর সমাধানে ব্যর্থ। সেখানে এখনও বসতি গড়ে ওঠেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে বারবার পরিবর্তন এসেছে নকশায়। এ পর্যন্ত মোট ৫ বার নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি ৭ দফা বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ, যার সর্বশেষ সময়সীমা ধরা হয়েছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। সেখানে একটি পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব, আবাসিক-বাণিজ্যিক শহর গড়ে তোলার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো-প্রশস্ত সড়ক, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পার্ক ও অফিস এলাকা না থাকায় বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি।
প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তি, রাজউকের প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং নগরপরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাসযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থতার পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। প্রকল্পের অভ্যন্তরীণ সড়ক নির্মাণে ধীরগতি, অধিকাংশ এলাকায় এখনও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সুপেয় পানির সংযোগ না থাকা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা। এছাড়া, থানা বা পুলিশ ফাঁড়ি না থাকার কারণে চোরের উৎপাত।
রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘আমরা ব্যাপক প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। ইতোমধ্যে চার নম্বর সেক্টর পর্যন্ত ফুল পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও রাস্তাঘাট সব কমপ্লিট করেছি। এজন্য আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছি। আর ১৫ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত সব সুযোগ-সুবিধা দিতে আমাদের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা দুই প্রস্তাব পাঠিয়েছি। রাস্তা-ঘাট, পানি, বিদ্যুৎ ও পয়ঃনিষ্কাশন এগুলোতো রাজউক দেখে না। অলরেডি আমরা বিদ্যুতের জন্য ডেসকোর নিকট হ্যান্ডওভার করছি। তারা সাবস্টেশন ও অনান্য কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমরা আর্মি ডেপ্লেয়ড করেছি। নিরাপত্তার জন্য আরও ১০০ আনসার নিয়োগ করেছি। বাতির জন্য টেন্ডার করেছি। পুলিশের জন্য আমরা পুলিশের সঙ্গে রেগুলার মিটিং করছি। তাদের চারটা থানা এরিয়া করার জন্য।’
সেখানকার প্লট মালিকরা জানান, পূর্বাচলে এখনও পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। পূর্বাচলে এখনও কোনো উন্নতমানের হাসপাতাল বা আধুনিক ক্লিনিক গড়ে ওঠেনি। ফলে বাসিন্দারা শিক্ষা ও জরুরি চিকিৎসার জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ওপর নির্ভরশীল।
রাজউকের তথ্যানুযায়ী, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের আবাসিক প্লট মোট ২৬ হাজার ২১৩টি। যার মধ্যে তিন কাঠা আয়তনের ১১ হাজার ২০৯টি, পাঁচ কাঠা আয়তনের ১০হাজার ৩৬১টি, ৭ দশমিক ৫ কাঠা আয়তনের দুই হাজার ৬১৮টি, ১০ কাঠা আয়তনের প্লট দুই হাজার ২৫টি। এছাড়া অন্যান্য প্লট আছে তিন হাজার ৫৬৩টি। এর মধ্যে কম-বেশি আয়তনের ১৫টি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক, প্রশাসনিক ৪৭২টি, বাণিজ্যিক এক হাজার ৩৩টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আরবান ফ্যাসিলিটিস প্লট দুই হাজার ৪৩টি। আদি অধিবাসী ও ক্ষতিগ্রস্তদের বরাদ্দ দেয়া প্লটের সংখ্যা সাত হাজার ৮৬৪টি।