শ্রীমঙ্গলের ‘ডিনস্টন সিমেট্রি’ -সংবাদ
দেশ-বিদেশে চায়ের রাজধানী বলে খ্যাত ও পর্যটন নগরী কসমোপলিটান টাউন শ্রীমঙ্গলের আশেপাশের চা-অঞ্চলের পরিচিতি বালিশিরা ভ্যালি। এমন আরও লস্করপুর, লংলা, মনু ধলই, নর্থ সিলেট ভ্যালি নিয়েই ছিলো স্বাধীনতা পূর্ব সুরমা ভ্যালি। দূরে দূরে পাড়া বা পল্লী আছে শুধু বাগানে কাজ চা শ্রমিকদের। মাটির দেয়ালের উপর পুরোনো ঢেউ টিন কী ছনের দোচালা। এর মাঝে হাতে আঁকা আল্পনার দেখা মিলে দেয়ালে কী নিকোনো উঠোনে। আছে বাগান ঘেরা আসাম টাইপের টিনের চালার বাংলো।
এর মাঝে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা মিলে যায় এক সমাধিস্থলের। ছবির মতো ধোপদুরস্ত। দেখেই বুঝা যায়, দেশীয় নয়, চলে যাওয়া সাহেবদের এই সমাধিস্থল বা গ্রাবিয়ার্ড। চা বাগানের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার পাশে, গাছগাছালি ঘেরা। শ্যাওলা বা আগাছাকে সুযোগ দেয়া হয়নি বেড়ে উঠার । যেমনটা হয়েছে শ্রীপুরের কাওরাইদের ব্রাহ্ম সমাধিস্থলে। সেখানে সাপ সরিসৃপের ভয়ে পা ফেলতে হয় অতি সন্তর্পনে। আর এখানে চেহারা দেখে প্রবেশের আগে নিজে থেকেই জুতো খুলে রাখতে হয় দেয়ালের বাইরে।
নানান ওয়েব সাইটে, মানুষের মুখে সর্বত্র এর পরিচিতি ‘ডিনস্টন সিমেট্রি’ ।
নকশাতে দেখানো ৪৩টি সমাধির মাঝে ২ ও ৩৩ নং সমাধি দুটি ফাঁকা। এখন আছে ৪১টি।
কুমিল্লা ময়নামতি ওয়্যার সিমেট্রি- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত মিত্রপক্ষের সৈনিকদের স্মরণে বলার অপেক্ষা রাখে না চা-বাগানের ‘সাহেবদের সমাধি এগুলো। তুলে আনা সমাধি ফলকের ছবি থেকে বিবরণ পাওয়া গেছে ১৯ জনের (নীচে বিবরণসহ তালিকা দেয়া )। তাদের মৃত্যু সাল ১৮৮০ হতে ১৯২২। অর্থাৎ একেবারে শুরুর দিকে আসা সাহেবদের গোর আছে এই সিমেট্রিতে।
সুরমা ভ্যালিতে চা বাগানের শুরু হয় ১৮৬০ সালে। আসাম-সিলেটকে নিয়ে সাহেবদের মাঝে শুরুতেই জন্ম নেয় চা উন্মাদনা বা `tea mania’ র । ‘আসাম’ মানে বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ নিয়ে বৃটিশ ভারতের তৎকালীন ‘আসাম প্রভিন্স’। কেউ আবার একে বলতেন ইন্ডিয়ার কেলাপোর্নিয়া গোল্ড রাশ (California Gold Rush)। সহজে চা-বাগানে প্রচুর মুনাফার প্রচার হতে সৃষ্টি হয়। জাহাজের কাপ্তান অফিসের কেরাণী, সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে চা বাগান করতে। সুরমা ভ্যালির এই এলাকা তখন ছিলো বাঘের বিচরণভূমি আর মশা ভন-ভনের ম্যালেরিয়া উপদ্রুত অরণ্য।
এখানে সৌধ নাই, কিন্তু শ্বেত পাথর খোদাই করা নানান নকশার সমাধিফলক প্রতিটি সমাধিতে। আকারে তেমন বড় সড় কিছু নয়, কিন্তু ফলকের গার্ত্র জুড়ে ধারন করা অসাধারণ শিল্পকর্ম। এমন কাজের একটা কি দুইটা দৃষ্টান্ত আছে শুধু আর্মেনীয় চার্চ প্রাঙ্গনের সমাধিতে।
প্রায় দেড়শো বছর হতে চললো কোন ভাঙাচোরা নেই ফলকগুলোতে। শুধু শিল্পকর্মই নয়, ফলকে ছিটেফোঁটা তথ্য থেকেই উদ্ঘাটিত হলো অনেক কিছু। কুসুমকোমল জীবন ছিলো এদের। অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা জেনেই বিত্তের মোহে বেছে নিতো বিদেশ বিভূঁইয়ের এডভেঞ্চারাস জীবন। মূল্যও দিতে হতো চরম, অনেক ক্ষেত্রেই। প্রমাণ মিলে সমাধি ফলকগুলো পর্যালোচনা করলে।
কয়েক ঘণ্টা, কয়েক মাসের শিশু নয়তো ৩০ হতে পঞ্চাশের মাঝেই মৃত্যু এই সমাধিস্থলে সমাধিস্থদের। সমাধি রয়েছে জনৈক সার্জেন্ট মেজরের মাত্র সাড়ে ন’ মাসের শিশু পুত্র ‘সনি’র।
২৪ বছর বয়সী তরুণ জেমস পিটার রাসেল ১৮৮৮ তে মারা যায় ‘দুর্ঘটনায়’, এই সমাধিস্থলের কাছাকাছিই সিন্দুরখান বাগানে। তখনকার সময়ে এখানে আর গাড়ি ছিলো না । একজনের তরুণী ভার্য্যা
ইমিলি গ্রাহাম (Emily Graham ) মারা যায় ম্যালেরিয়ায়। ১৯ জনের মাঝে তিন জনই শিশু। একজন পৌনে ৩ বৎসরের কৃস্টিনা এ্যানির সমাধি।
আরেকটি চমৎকৃত বিষয়- এই সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ সবাই স্কটিশ।
চা বাগানের সাথে জড়িত আছে শত শত বছর ধরে চা-শ্রমিকদের রয়েছে এক ধরনের বেদনার ইতিহাস। ‘গাছ হিলায়েগা তো পয়সা মিলায়েগা’ বলে এদের ভুলিয়ে ভালিয়ে আনা হয়েছিলো সারা ভারতবর্ষ থেকে। শ্রমিকদের শত শত বৎসর করুণ ইতিহাসের। তারপরও, সুরমা ভ্যালিতে চা-বাগানের শুরু ও প্রসার এই অঞ্চলে তৎকালে ছিলো অনেকটা অর্থনৈতিক বিপ্লবের মতো। এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিলো কাকতালীয়ভাবে স্কটিশদের হাত ধরে।
১৮৬০ এর শুরুর দিকে হুজুগে যারা ব্যবসাতে নামেন, তারা ১০০ টাকার পরিত্যক্ত টিলাটালা কিনে ৩০০ টাকায়। জায়গা বুঝেও পায় অনেক কম। অচিরেই তারা পাততাড়ি গুটায় একে একে। চা-বাগান ব্যবসা যখন ঘুরে দাঁড়ায় কয় বৎসরের মাঝে, তখন মাঠে আসে জেমস ফিনলে কোম্পানি। কালক্রমে ফিনলে’র মালিকানায় আসে এর আগে ১৮৭০ সাল নাগাদ সাহেবদের খোলা সব চা-বাগান ।
জেমস ফিনলে ছিলো স্কটল্যান্ডের গ্রেটেস্ট ওভারসিজ ফার্ম ‘greatest’। জেমস ফিনলের পুত্র কার্কমেন ফিনলে ছিলেন গ্লাসগোর এমপি ও সিটি চেম্বারের প্রেসিডেন্ট। তার তদ্বিরেই ১৮১৩-তে রদ হয় ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ব্যবসা করার একচেটিয়া অধিকারের আইন।
এর পর ফিনলে এক পর্যায়ে পরিণত হয়, বিশ্বের বৃহত্তম ব্যবসা কোম্পানীতে। কোম্পানীর পুরো মালিকানা নিয়ে জেমস ফিনলের নাম হয় ‘ফিনলে মুনির এন্ড কোম্পানি’। তবে মানুষের মুখে এর পরিচিতি থেকে যায় জেমস ফিনলে। এই উন্নতির ভিত ছিলো এই সুরমা ভ্যালির টি এস্টেটে তাদের বিনিয়োগ।
এই যে সমাধির নাম ডিনস্টন সিমেট্রি, ডিনস্টন হচ্ছে স্কটল্যান্ডের ক্ষুদ্র একটি গ্রাম। সেই গ্রামেই সমাধিস্থ আছেন জেমস ফিনলেকে মহিরূহে পরিণত করা জন মুনির। দেউলিয়া হয়ে পড়া বাগানগুলি কেনা ছাড়াও জন মুনিরই বন্দোবস্ত নেন ব্যালিশিরা ভ্যালির বিপুল পতিত জায়গা, ত্রিপুরার মহারাজার কাছ হতে ১৩৬০৯ একর জমি, পুরো এলাকায় খোঁজে খোঁজে কিনে নেয় ব্যক্তি মালিকানার টিলাটালা। সুরমা ভ্যালিতে তারা হয় বৃহত্তম টি-এস্টেট মালিক। ১৮৮৫ নাগাদ শুধু এই ব্যালিশিরা ভ্যালিতেই ফিনলে মালিকানার চা-বাগানের এরিয়া area দাঁড়ায় সিলেটের মোট চা-এলাকার অর্ধেকের চাইতে বেশী।
১৯০০ সাল নাগাদ আসামের সব জেলার মধ্যে সিলেটের চা উৎপাদন পরিমান ছিলো সর্বাধিক। চা বাগানের মালিকদের সিলেটের ঐতিহ্যবাহী অভিজাত জমিদারদের মতোই সম্মানিত করা হত।
ফিনলের দেশীয় নিয়োগের পরিমান ১৯৫০-এ দাঁড়ায় ৭০,০০০ এ। সেই অনুপাতে ছিলো স্কটল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য থেকে পাঠানো সুপারিনটেনডেন্ট, ম্যানেজার এবং সহকারীদের একটি বিশাল কর্মী।
শুধু ফিনলে নয়, আরো একাধিক টি এস্টেট কোম্পানি ছিলো স্কটল্যান্ডের। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই এলাকায় টি-এস্টেটেট গুলিতে চাকুরী করতে আসা সাহেবদের প্রায় সবাই স্কটল্যান্ডের।
জেমস ফিনলে এদেশ ছাড়ে ২০০৬-এ। যাবার সময় তাদের সম্পদ বিক্রি করে যায় Consolidated Tea and Land Company (BD) Limited -এর নিকট।
তবে তাদের রেখে যাওয়া এই সমাধি ক্ষেত্রের প্রায় প্রতিটি ফলক এখনো জন্মস্থল হিসেবে ধারণ করে যাচ্ছে স্কটল্যান্ডের নানান জনপদের নাম। খোদ পুরো সমাধিস্থলটি বহন করছে স্কটল্যান্ডের ক্ষুদ্র এক গ্রামের নাম- ডিনস্টন।
জানা যায়, এখনো পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মাঝে মধ্যেই বিশ্বের নানান প্রান্ত হতে এই সমাধিতে উড়ে আসেন সমাধিস্থদের বংশধরেরা ।
শ্রীমঙ্গলের ‘ডিনস্টন সিমেট্রি’ -সংবাদ
মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫
দেশ-বিদেশে চায়ের রাজধানী বলে খ্যাত ও পর্যটন নগরী কসমোপলিটান টাউন শ্রীমঙ্গলের আশেপাশের চা-অঞ্চলের পরিচিতি বালিশিরা ভ্যালি। এমন আরও লস্করপুর, লংলা, মনু ধলই, নর্থ সিলেট ভ্যালি নিয়েই ছিলো স্বাধীনতা পূর্ব সুরমা ভ্যালি। দূরে দূরে পাড়া বা পল্লী আছে শুধু বাগানে কাজ চা শ্রমিকদের। মাটির দেয়ালের উপর পুরোনো ঢেউ টিন কী ছনের দোচালা। এর মাঝে হাতে আঁকা আল্পনার দেখা মিলে দেয়ালে কী নিকোনো উঠোনে। আছে বাগান ঘেরা আসাম টাইপের টিনের চালার বাংলো।
এর মাঝে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা মিলে যায় এক সমাধিস্থলের। ছবির মতো ধোপদুরস্ত। দেখেই বুঝা যায়, দেশীয় নয়, চলে যাওয়া সাহেবদের এই সমাধিস্থল বা গ্রাবিয়ার্ড। চা বাগানের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার পাশে, গাছগাছালি ঘেরা। শ্যাওলা বা আগাছাকে সুযোগ দেয়া হয়নি বেড়ে উঠার । যেমনটা হয়েছে শ্রীপুরের কাওরাইদের ব্রাহ্ম সমাধিস্থলে। সেখানে সাপ সরিসৃপের ভয়ে পা ফেলতে হয় অতি সন্তর্পনে। আর এখানে চেহারা দেখে প্রবেশের আগে নিজে থেকেই জুতো খুলে রাখতে হয় দেয়ালের বাইরে।
নানান ওয়েব সাইটে, মানুষের মুখে সর্বত্র এর পরিচিতি ‘ডিনস্টন সিমেট্রি’ ।
নকশাতে দেখানো ৪৩টি সমাধির মাঝে ২ ও ৩৩ নং সমাধি দুটি ফাঁকা। এখন আছে ৪১টি।
কুমিল্লা ময়নামতি ওয়্যার সিমেট্রি- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত মিত্রপক্ষের সৈনিকদের স্মরণে বলার অপেক্ষা রাখে না চা-বাগানের ‘সাহেবদের সমাধি এগুলো। তুলে আনা সমাধি ফলকের ছবি থেকে বিবরণ পাওয়া গেছে ১৯ জনের (নীচে বিবরণসহ তালিকা দেয়া )। তাদের মৃত্যু সাল ১৮৮০ হতে ১৯২২। অর্থাৎ একেবারে শুরুর দিকে আসা সাহেবদের গোর আছে এই সিমেট্রিতে।
সুরমা ভ্যালিতে চা বাগানের শুরু হয় ১৮৬০ সালে। আসাম-সিলেটকে নিয়ে সাহেবদের মাঝে শুরুতেই জন্ম নেয় চা উন্মাদনা বা `tea mania’ র । ‘আসাম’ মানে বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ নিয়ে বৃটিশ ভারতের তৎকালীন ‘আসাম প্রভিন্স’। কেউ আবার একে বলতেন ইন্ডিয়ার কেলাপোর্নিয়া গোল্ড রাশ (California Gold Rush)। সহজে চা-বাগানে প্রচুর মুনাফার প্রচার হতে সৃষ্টি হয়। জাহাজের কাপ্তান অফিসের কেরাণী, সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে চা বাগান করতে। সুরমা ভ্যালির এই এলাকা তখন ছিলো বাঘের বিচরণভূমি আর মশা ভন-ভনের ম্যালেরিয়া উপদ্রুত অরণ্য।
এখানে সৌধ নাই, কিন্তু শ্বেত পাথর খোদাই করা নানান নকশার সমাধিফলক প্রতিটি সমাধিতে। আকারে তেমন বড় সড় কিছু নয়, কিন্তু ফলকের গার্ত্র জুড়ে ধারন করা অসাধারণ শিল্পকর্ম। এমন কাজের একটা কি দুইটা দৃষ্টান্ত আছে শুধু আর্মেনীয় চার্চ প্রাঙ্গনের সমাধিতে।
প্রায় দেড়শো বছর হতে চললো কোন ভাঙাচোরা নেই ফলকগুলোতে। শুধু শিল্পকর্মই নয়, ফলকে ছিটেফোঁটা তথ্য থেকেই উদ্ঘাটিত হলো অনেক কিছু। কুসুমকোমল জীবন ছিলো এদের। অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা জেনেই বিত্তের মোহে বেছে নিতো বিদেশ বিভূঁইয়ের এডভেঞ্চারাস জীবন। মূল্যও দিতে হতো চরম, অনেক ক্ষেত্রেই। প্রমাণ মিলে সমাধি ফলকগুলো পর্যালোচনা করলে।
কয়েক ঘণ্টা, কয়েক মাসের শিশু নয়তো ৩০ হতে পঞ্চাশের মাঝেই মৃত্যু এই সমাধিস্থলে সমাধিস্থদের। সমাধি রয়েছে জনৈক সার্জেন্ট মেজরের মাত্র সাড়ে ন’ মাসের শিশু পুত্র ‘সনি’র।
২৪ বছর বয়সী তরুণ জেমস পিটার রাসেল ১৮৮৮ তে মারা যায় ‘দুর্ঘটনায়’, এই সমাধিস্থলের কাছাকাছিই সিন্দুরখান বাগানে। তখনকার সময়ে এখানে আর গাড়ি ছিলো না । একজনের তরুণী ভার্য্যা
ইমিলি গ্রাহাম (Emily Graham ) মারা যায় ম্যালেরিয়ায়। ১৯ জনের মাঝে তিন জনই শিশু। একজন পৌনে ৩ বৎসরের কৃস্টিনা এ্যানির সমাধি।
আরেকটি চমৎকৃত বিষয়- এই সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ সবাই স্কটিশ।
চা বাগানের সাথে জড়িত আছে শত শত বছর ধরে চা-শ্রমিকদের রয়েছে এক ধরনের বেদনার ইতিহাস। ‘গাছ হিলায়েগা তো পয়সা মিলায়েগা’ বলে এদের ভুলিয়ে ভালিয়ে আনা হয়েছিলো সারা ভারতবর্ষ থেকে। শ্রমিকদের শত শত বৎসর করুণ ইতিহাসের। তারপরও, সুরমা ভ্যালিতে চা-বাগানের শুরু ও প্রসার এই অঞ্চলে তৎকালে ছিলো অনেকটা অর্থনৈতিক বিপ্লবের মতো। এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিলো কাকতালীয়ভাবে স্কটিশদের হাত ধরে।
১৮৬০ এর শুরুর দিকে হুজুগে যারা ব্যবসাতে নামেন, তারা ১০০ টাকার পরিত্যক্ত টিলাটালা কিনে ৩০০ টাকায়। জায়গা বুঝেও পায় অনেক কম। অচিরেই তারা পাততাড়ি গুটায় একে একে। চা-বাগান ব্যবসা যখন ঘুরে দাঁড়ায় কয় বৎসরের মাঝে, তখন মাঠে আসে জেমস ফিনলে কোম্পানি। কালক্রমে ফিনলে’র মালিকানায় আসে এর আগে ১৮৭০ সাল নাগাদ সাহেবদের খোলা সব চা-বাগান ।
জেমস ফিনলে ছিলো স্কটল্যান্ডের গ্রেটেস্ট ওভারসিজ ফার্ম ‘greatest’। জেমস ফিনলের পুত্র কার্কমেন ফিনলে ছিলেন গ্লাসগোর এমপি ও সিটি চেম্বারের প্রেসিডেন্ট। তার তদ্বিরেই ১৮১৩-তে রদ হয় ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ব্যবসা করার একচেটিয়া অধিকারের আইন।
এর পর ফিনলে এক পর্যায়ে পরিণত হয়, বিশ্বের বৃহত্তম ব্যবসা কোম্পানীতে। কোম্পানীর পুরো মালিকানা নিয়ে জেমস ফিনলের নাম হয় ‘ফিনলে মুনির এন্ড কোম্পানি’। তবে মানুষের মুখে এর পরিচিতি থেকে যায় জেমস ফিনলে। এই উন্নতির ভিত ছিলো এই সুরমা ভ্যালির টি এস্টেটে তাদের বিনিয়োগ।
এই যে সমাধির নাম ডিনস্টন সিমেট্রি, ডিনস্টন হচ্ছে স্কটল্যান্ডের ক্ষুদ্র একটি গ্রাম। সেই গ্রামেই সমাধিস্থ আছেন জেমস ফিনলেকে মহিরূহে পরিণত করা জন মুনির। দেউলিয়া হয়ে পড়া বাগানগুলি কেনা ছাড়াও জন মুনিরই বন্দোবস্ত নেন ব্যালিশিরা ভ্যালির বিপুল পতিত জায়গা, ত্রিপুরার মহারাজার কাছ হতে ১৩৬০৯ একর জমি, পুরো এলাকায় খোঁজে খোঁজে কিনে নেয় ব্যক্তি মালিকানার টিলাটালা। সুরমা ভ্যালিতে তারা হয় বৃহত্তম টি-এস্টেট মালিক। ১৮৮৫ নাগাদ শুধু এই ব্যালিশিরা ভ্যালিতেই ফিনলে মালিকানার চা-বাগানের এরিয়া area দাঁড়ায় সিলেটের মোট চা-এলাকার অর্ধেকের চাইতে বেশী।
১৯০০ সাল নাগাদ আসামের সব জেলার মধ্যে সিলেটের চা উৎপাদন পরিমান ছিলো সর্বাধিক। চা বাগানের মালিকদের সিলেটের ঐতিহ্যবাহী অভিজাত জমিদারদের মতোই সম্মানিত করা হত।
ফিনলের দেশীয় নিয়োগের পরিমান ১৯৫০-এ দাঁড়ায় ৭০,০০০ এ। সেই অনুপাতে ছিলো স্কটল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য থেকে পাঠানো সুপারিনটেনডেন্ট, ম্যানেজার এবং সহকারীদের একটি বিশাল কর্মী।
শুধু ফিনলে নয়, আরো একাধিক টি এস্টেট কোম্পানি ছিলো স্কটল্যান্ডের। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই এলাকায় টি-এস্টেটেট গুলিতে চাকুরী করতে আসা সাহেবদের প্রায় সবাই স্কটল্যান্ডের।
জেমস ফিনলে এদেশ ছাড়ে ২০০৬-এ। যাবার সময় তাদের সম্পদ বিক্রি করে যায় Consolidated Tea and Land Company (BD) Limited -এর নিকট।
তবে তাদের রেখে যাওয়া এই সমাধি ক্ষেত্রের প্রায় প্রতিটি ফলক এখনো জন্মস্থল হিসেবে ধারণ করে যাচ্ছে স্কটল্যান্ডের নানান জনপদের নাম। খোদ পুরো সমাধিস্থলটি বহন করছে স্কটল্যান্ডের ক্ষুদ্র এক গ্রামের নাম- ডিনস্টন।
জানা যায়, এখনো পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মাঝে মধ্যেই বিশ্বের নানান প্রান্ত হতে এই সমাধিতে উড়ে আসেন সমাধিস্থদের বংশধরেরা ।