২৫ জন গ্রেপ্তার, জানিয়েছে জেলা প্রশাসন, আত্মরক্ষা বলপ্রয়োগ, বলছে আইএসপিআর
গোপালগঞ্জ জেলায় জারি করা কারফিউ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গত ১৬ জুলাই রাত ৮টা থেকে ১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে চলমান কারফিউ আজ সকাল ১১টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
আজ বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ থাকবে না। এরপর দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ চলমান থাকবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। অর্থাৎ, গতকাল বুধবার রাত ৮টায় যে কারফিউ শুরু হয়েছিল, তাতে বিরতি মিলবে ৩৯ ঘণ্টা পর।
জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মীদের হামলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ।
টানা ৫ ঘণ্টার ওই সংঘাতে নিহত হন অন্তত চারজন। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আটকা পড়া এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা পরে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে গোপালগঞ্জ ত্যাগ করেন।
দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পরে অভিযোগ করেন, প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা ‘সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ’ নিলে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারত না।
সহিংসতার প্রেক্ষাপটে গতকাল বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার,(১৭ জুলাই ২০২৫) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছিল। সেই সময় শেষে কারফিউ না তুলে তা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত দিলো সরকার।
কারফিয়ের মধ্যে শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। রাস্তাঘাট, হাট-বাজার জনমানবহীন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। গোপালগঞ্জে দফায় দফায় এনসিপি নেতাদের সঙ্গে হামলা-সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত চারজনের কারোর সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত হয়নি; রাতেই তাদের দাফন ও সৎকার সম্পন্ন হয়েছে।
গতকাল বুধবার দিনভর সংঘর্ষে নিহতরা হলেন শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (৩০), কোটালিপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (১৭), শহরের শানাপাড়ার সোহেল রানা (৩৫) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন।
এর মধ্যে পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহাকে গতকাল বুধবার রাতে পৌর শ্মশানে সৎকার করা হয়। এছাড়া টাইলস মিস্ত্রির সহকারী রমজান কাজীকে গতকাল বুধবার রাতে এশার নামাজের পর এবং মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সোহেল রানা ও ক্রোকারিজ দোকানের কর্মচারী ইমন তালুকদারকে বৃহস্পতিবার সকালে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত নিয়ে মৃতের পরিবারের সদস্যরাও কেউ কোনো কথা বলতে চাচ্ছেন না।
তবে বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গোপালগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করা হয়। সেখানে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিকের কাছে সাংবাদিকরা সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের বিষয়ে জানতে চান।
তখন তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে দেখা হবে।’
এ সময় তিনি আরও বলেন, গোপালগঞ্জের ঘটনায় পুলিশের কারও গাফিলতি আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।
রমজানের চাচা মনিরুজ্জামান গতকাল বুধবার রাতে সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ঘটনার সময় রমজান শহর দিয়ে হেঁটে কাজে যাচ্ছিল। এ সময় সে গুলিবিদ্ধ হয়। সে ছিল টাইলস মিস্ত্রি।’
পরিবার কোটালীপাড়ার হলেও রমজানের জন্ম-কর্ম শহরেই বলে জানান তার চাচা। তিনি বলেন, রাতে মরদেহ হাসপাতাল থেকে স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। পরে শহরের কবরস্থান মসজিদে রমজানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই রাতে তাকে দাফন করা হয়েছে।
দীপ্ত সাহার বাবা সন্তোষ সাহা মারা গেছেন। দুই ভাই শহরের চৌরঙ্গী এলাকায় একটি তৈরি পোশাকের দোকান চালান। সংঘর্ষের মধ্যে দোকান থেকে বাসায় যাওয়ার পথে তিনি গুলিবিদ্ধ হন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুতর অবস্থায় তিনজনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
সংঘাতের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, নিহত চারজনের মৃত্যুর দায় সরকার এড়াতে পারে না। একই সঙ্গে এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার দাবি জানিয়েছে তারা।
বিবৃতিতে আসক বলেছে, জনসাধারণের ওপর বলপ্রয়োগ, গুলি চালানো ও প্রাণহানির ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদ- ও সংবিধান উভয়ের চরম লঙ্ঘন।
আসক বলেছে, নাগরিকের জীবন রক্ষা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। গোপালগঞ্জের ঘটনায় রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালনে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, সেনাবাহিনী আত্মরক্ষা বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বর্তমানে গোপালগঞ্জে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এবং প্রশাসন কর্তৃক জারিকৃত কারফিউ চলমান রয়েছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব এবং প্রশাসনের অন্য সংস্থাগুলো ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় রেখে কাজ করে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চলমান এই রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলায় জেলার জনসাধারণ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে নিজেদের নিবৃত্ত রেখে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছেন।
গোপালগঞ্জে গুলিবিদ্ধদের তিনজন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে হামলা-সংঘর্ষের মধ্যে যারা আহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাতে সুমন বিশ্বাস (২৫), রমজান মুন্সী (২৮) ও আব্বাস আলী সরকার (৩০) নামের এ তিনজনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।
সেখানকার পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, ‘আহত যুবকদের হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’ আহত সুমন বিশ্বাসের মা নিপা বিশ্বাস হাসপাতালে বলেন, সুমন পানি সরবরাহ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সেই কাজে গাড়িতে করে মাল নিয়ে যাওয়ার সময় গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার শিশু বন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ডান কোমরের ওপরে এবং ডান হাতের আঙুলে গুলি লেগেছে।
একইদিনে গোপালগঞ্জ সদরের লঞ্চ ঘাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন রমজান মুন্সী। তার ভাই ইমরান মুন্সী বলেন, রমজান অটোরিকশা চালান। গতকাল বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে অটোরিকশা নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার ডান হাতের কব্জির ওপর এবং ডান বগলে গুলি লেগেছে।
গোপালগঞ্জের লঞ্চঘাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ আরেক অটোরিকশা চালক আব্বাস আলী সরকারকে রাত ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়। আহতের স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, গতকাল বুধবার বিকেল ৪টার দিকে রিকশা চালিয়ে যাওয়ার সময় আব্বাসের বাম পায়ের হাঁটুর ওপরে গুলি লাগে।
গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে গত মঙ্গলবার থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। গতকাল বুধবার এনসিপি নেতাকর্মীরা শহরের পৌর পার্ক মাঠে কর্মসূচি শুরুর আগেই সড়ক অবরোধকে কেন্দ্র করে পুলিশের গাড়িতে আগুন ও ইউএনওর গাড়িতে হামলা হয়। দুপুর দেড়টার দিকে পৌর পার্কের মঞ্চে সমাবেশ শুরুর আগে হামলা হয়।
কিছুক্ষণ বাদে সেখানে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি করে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা পুলিশ ও সেনা পাহারায় মাদারীপুরের দিকে রওনা দিলে লঞ্চঘাট এলাকায় হামলার মুখে পড়েন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও গুলির শব্দে গোটা গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষের পর অন্তত চারজনের লাশ গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে আসে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিকেলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তাতেও কাজ না হলে সন্ধ্যার পর জারি করা হয় কারফিউ। দেশজুড়ে ‘জুলাই পদযাত্রা’র ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে ‘ফ্যাসিস্ট মুজিববাদীরা’ হামলা চালায় বলে এনসিপি নেতারা অভিযোগ করেছেন। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। পাশাপাশি ‘জুলাই পদযাত্রা’র পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিও বহাল রেখেছেন।
২৫ জন গ্রেপ্তার, জানিয়েছে জেলা প্রশাসন, আত্মরক্ষা বলপ্রয়োগ, বলছে আইএসপিআর
বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫
গোপালগঞ্জ জেলায় জারি করা কারফিউ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গত ১৬ জুলাই রাত ৮টা থেকে ১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে চলমান কারফিউ আজ সকাল ১১টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
আজ বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ থাকবে না। এরপর দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ চলমান থাকবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। অর্থাৎ, গতকাল বুধবার রাত ৮টায় যে কারফিউ শুরু হয়েছিল, তাতে বিরতি মিলবে ৩৯ ঘণ্টা পর।
জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মীদের হামলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ।
টানা ৫ ঘণ্টার ওই সংঘাতে নিহত হন অন্তত চারজন। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আটকা পড়া এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা পরে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে গোপালগঞ্জ ত্যাগ করেন।
দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পরে অভিযোগ করেন, প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা ‘সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ’ নিলে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারত না।
সহিংসতার প্রেক্ষাপটে গতকাল বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার,(১৭ জুলাই ২০২৫) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছিল। সেই সময় শেষে কারফিউ না তুলে তা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত দিলো সরকার।
কারফিয়ের মধ্যে শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। রাস্তাঘাট, হাট-বাজার জনমানবহীন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। গোপালগঞ্জে দফায় দফায় এনসিপি নেতাদের সঙ্গে হামলা-সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত চারজনের কারোর সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত হয়নি; রাতেই তাদের দাফন ও সৎকার সম্পন্ন হয়েছে।
গতকাল বুধবার দিনভর সংঘর্ষে নিহতরা হলেন শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (৩০), কোটালিপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (১৭), শহরের শানাপাড়ার সোহেল রানা (৩৫) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন।
এর মধ্যে পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহাকে গতকাল বুধবার রাতে পৌর শ্মশানে সৎকার করা হয়। এছাড়া টাইলস মিস্ত্রির সহকারী রমজান কাজীকে গতকাল বুধবার রাতে এশার নামাজের পর এবং মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সোহেল রানা ও ক্রোকারিজ দোকানের কর্মচারী ইমন তালুকদারকে বৃহস্পতিবার সকালে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত নিয়ে মৃতের পরিবারের সদস্যরাও কেউ কোনো কথা বলতে চাচ্ছেন না।
তবে বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গোপালগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করা হয়। সেখানে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিকের কাছে সাংবাদিকরা সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের বিষয়ে জানতে চান।
তখন তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে দেখা হবে।’
এ সময় তিনি আরও বলেন, গোপালগঞ্জের ঘটনায় পুলিশের কারও গাফিলতি আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।
রমজানের চাচা মনিরুজ্জামান গতকাল বুধবার রাতে সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ঘটনার সময় রমজান শহর দিয়ে হেঁটে কাজে যাচ্ছিল। এ সময় সে গুলিবিদ্ধ হয়। সে ছিল টাইলস মিস্ত্রি।’
পরিবার কোটালীপাড়ার হলেও রমজানের জন্ম-কর্ম শহরেই বলে জানান তার চাচা। তিনি বলেন, রাতে মরদেহ হাসপাতাল থেকে স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। পরে শহরের কবরস্থান মসজিদে রমজানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই রাতে তাকে দাফন করা হয়েছে।
দীপ্ত সাহার বাবা সন্তোষ সাহা মারা গেছেন। দুই ভাই শহরের চৌরঙ্গী এলাকায় একটি তৈরি পোশাকের দোকান চালান। সংঘর্ষের মধ্যে দোকান থেকে বাসায় যাওয়ার পথে তিনি গুলিবিদ্ধ হন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুতর অবস্থায় তিনজনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
সংঘাতের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, নিহত চারজনের মৃত্যুর দায় সরকার এড়াতে পারে না। একই সঙ্গে এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার দাবি জানিয়েছে তারা।
বিবৃতিতে আসক বলেছে, জনসাধারণের ওপর বলপ্রয়োগ, গুলি চালানো ও প্রাণহানির ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদ- ও সংবিধান উভয়ের চরম লঙ্ঘন।
আসক বলেছে, নাগরিকের জীবন রক্ষা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। গোপালগঞ্জের ঘটনায় রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালনে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, সেনাবাহিনী আত্মরক্ষা বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বর্তমানে গোপালগঞ্জে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এবং প্রশাসন কর্তৃক জারিকৃত কারফিউ চলমান রয়েছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব এবং প্রশাসনের অন্য সংস্থাগুলো ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় রেখে কাজ করে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চলমান এই রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলায় জেলার জনসাধারণ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে নিজেদের নিবৃত্ত রেখে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছেন।
গোপালগঞ্জে গুলিবিদ্ধদের তিনজন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে হামলা-সংঘর্ষের মধ্যে যারা আহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাতে সুমন বিশ্বাস (২৫), রমজান মুন্সী (২৮) ও আব্বাস আলী সরকার (৩০) নামের এ তিনজনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।
সেখানকার পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, ‘আহত যুবকদের হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’ আহত সুমন বিশ্বাসের মা নিপা বিশ্বাস হাসপাতালে বলেন, সুমন পানি সরবরাহ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সেই কাজে গাড়িতে করে মাল নিয়ে যাওয়ার সময় গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার শিশু বন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ডান কোমরের ওপরে এবং ডান হাতের আঙুলে গুলি লেগেছে।
একইদিনে গোপালগঞ্জ সদরের লঞ্চ ঘাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন রমজান মুন্সী। তার ভাই ইমরান মুন্সী বলেন, রমজান অটোরিকশা চালান। গতকাল বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে অটোরিকশা নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার ডান হাতের কব্জির ওপর এবং ডান বগলে গুলি লেগেছে।
গোপালগঞ্জের লঞ্চঘাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ আরেক অটোরিকশা চালক আব্বাস আলী সরকারকে রাত ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়। আহতের স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, গতকাল বুধবার বিকেল ৪টার দিকে রিকশা চালিয়ে যাওয়ার সময় আব্বাসের বাম পায়ের হাঁটুর ওপরে গুলি লাগে।
গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে গত মঙ্গলবার থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। গতকাল বুধবার এনসিপি নেতাকর্মীরা শহরের পৌর পার্ক মাঠে কর্মসূচি শুরুর আগেই সড়ক অবরোধকে কেন্দ্র করে পুলিশের গাড়িতে আগুন ও ইউএনওর গাড়িতে হামলা হয়। দুপুর দেড়টার দিকে পৌর পার্কের মঞ্চে সমাবেশ শুরুর আগে হামলা হয়।
কিছুক্ষণ বাদে সেখানে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি করে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা পুলিশ ও সেনা পাহারায় মাদারীপুরের দিকে রওনা দিলে লঞ্চঘাট এলাকায় হামলার মুখে পড়েন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও গুলির শব্দে গোটা গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষের পর অন্তত চারজনের লাশ গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে আসে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিকেলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তাতেও কাজ না হলে সন্ধ্যার পর জারি করা হয় কারফিউ। দেশজুড়ে ‘জুলাই পদযাত্রা’র ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে ‘ফ্যাসিস্ট মুজিববাদীরা’ হামলা চালায় বলে এনসিপি নেতারা অভিযোগ করেছেন। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। পাশাপাশি ‘জুলাই পদযাত্রা’র পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিও বহাল রেখেছেন।