কুর্মিটোলায় বীরউত্তম এ কে খন্দকার বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের ‘ফিউনারেল প্যারেড’ শেষে বিমানবাহিনী প্রধান -সংবাদ
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বহু শিশুর মৃত্যুর পর চীনের তৈরি ‘এফ-৭ বিজিআই’ যুদ্ধবিমানের নিরাপত্তা ও নির্ভযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও তা মানতে রাজি নন বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান।
মঙ্গলবার,( ২২ জুলাই ২০২৫) কুর্মিটোলায় বীর উত্তম এ কে খন্দকার বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে ওই বিধ্বস্ত বিমানের পাইলট, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের ‘ফিউনারেল প্যারেড’ শেষে সাংবাদিকদের এরকম প্রশ্নে তিনি বলেন, বিমান বাহিনীর বহরে থাকা জঙ্গি বিমানগুলোর বয়স বেশি হলেও ‘লাইফটাইম’ পার হয়ে যায়নি। আর এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে কোনো ‘ছাড় দেয় না’ বিমান বাহিনী।
‘গুজবে’ কান না
দেয়ার পরামর্শ
কারণ জানতে ‘ধৈর্য ধরতে হবে’
দুর্ঘটনায় পড়া ‘এফ-৭ বিজিআই’ যুদ্ধবিমানটি পুরনো হয়ে গিয়েছিল বলে যে কথা উঠেছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, “বিমান সাধারণত সহজে পুরাতন হয় না। প্রত্যেকটা বিমানেরই একটা লাইফটাইম আছে। সুতরাং এই বিমানগুলোর প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত লাইফটাইম আছে। এক যুগ, দুই যুগ কোনো ব্যাপার না, ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা এটাকে ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছি কি-না?
“আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা আমাদের বিমানের কোনো কম্প্রোমাইজ করি না রক্ষণাবেক্ষণে। কেননা, যে দেশ থেকে বিমান কিনি সেদেশ থেকে আমরা রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত প্রযুক্তি এবং দরকার হলে যা যা প্রয়োজন হয়, সেটাও আমরা তাদের সাথে চুক্তি করে নিই। সুতরাং আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ সব ভালো হয় বিমানের, ইঞ্জিনের।”
তবে এই বিমানের প্রযুক্তি যে পুরোনো হয়ে গেছে, সে কথা স্বীকার করে এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেন বলেন, “একটা কথা বলতে পারি, প্রযুক্তিগতভাবে এই বিমানগুলো পুরোনো হয়েছে, এই বিমান পুরোনো না, প্রযুক্তিগতভাবে পুরোনো। নতুন প্রযুক্তির বিমানের জন্য অবশ্যই আমরা চেষ্টা করছি। আপনারা সবাই জানেন, আমরা ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তির বিমান আনব।
“তার মানে, এই না যে, ওইটা অ্যাক্সিডেন্ট হবে না। হইতেই পারে, সেটা হচ্ছে আসল কথা। কিন্তু এই বিমানগুলো আমরা যথাসম্ভব ভালোভাবে মেরামত করি, দেশে-বিদেশে সব জায়গায় আমরা এগুলোকে যা যা রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন হয়, সেগুলো করি।”
সোমবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই জেট ফাইটার।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, স্কুলে মাঠে বিধ্বস্ত হওয়ার পর বিমানটি ছেঁচড়ে গিয়ে ধাক্কা খায় দোতলা একটি অ্যাকাডেমিক ভবনে। অগ্নিগোলকে পরিণত হওয়া সেই বিমানের শিখা স্কুল ভবনটিকেও গ্রাস করে নেয়। হতাহতের ঘটনায় বিমর্ষ পুরো দেশ।
সামনে আসে বেশ কয়েকটি বিষয়। এরকম জনবহুল এলাকায় কেন জঙ্গি বিমান নিয়ে প্রশিক্ষণ চলছিল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। আবার ‘এফ-৭ বিজিআই’ যুদ্ধবিমানের দুর্ঘটনার ইতিহাস এবং নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নগুলো সামনে আনছেন অনেকে।
চীনের তৈরি এ যুদ্ধবিমানকে ‘চেংদু জে-সেভেন’ মডেলের সবচেয়ে আধুনিক সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উড়োজাহাজটি তৈরি করেছে চীনের ‘চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন’। এটি মূলত সোভিয়েত আমলের মিগ-টোয়েন্টিওয়ানের উন্নত চীনা সংস্করণ। ‘মিগ-টোয়েন্টিওয়ান’ এক সময়ের বহুল ব্যবহৃত যুদ্ধবিমানগুলোর একটি।
বাংলদেশ বিমান বাহিনীর মোট ৩৬টি এফ-৭ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই এফ-৭ বিজিআই। এছাড়া এফটি-৭এমবি ও এফ-৭বিজি ভ্যারিয়েন্টও রয়েছে।
২০১১ সালে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে ১৬টি জেট ফাইটার কেনার চুক্তি করে এবং ২০১৩ সালে সেগুলো বিমান বাহিনীর বহরে যুক্ত হয়। ওই বছরই চেংদু এয়ারক্র্যাফ্ট করপোরেশন এই মডেলের উড়োজাহাজের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশে এফ-৭ জঙ্গি বিমান আগেও দুর্ঘটনায় পড়েছে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলের মধুপুরে একটি এফ-৭ বিজি এবং ২০২১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর একটি এফ-৭ এমবি বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয়।
এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ‘প্রতিনিয়ত ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা তুলে ধরে হাসান মাহমুদ খান বলেন, “দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমাদের বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা তৈরি আছে। সারা বিশ্বে যেভাবে হয়, আমরাও সেভাবে করে চলেছি।
“তারপরও দুর্ঘটনা হয়। আপনি উন্নত বিশ্বেও দেখবেন, বড় বড় অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান আছে, সেগুলোও দুর্ঘটনায় পতিত হয়। কিছুদিন আগে এফ-৩৫ জঙ্গি বিমানও দুর্ঘটনায় উপনীত হয়েছে। তো, সেটাতো আর কেউ গ্যারান্টি দেবে না। আমরা অবশ্যই এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নেব, ভবিষ্যতে সেটা প্রতিকার করব ইনশাআল্লাহ।”
বিমানের ইঞ্জিনের অবস্থা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ‘গুজবে’ বিশ্বাস না করার পরামর্শ দিয়ে বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, “গুজব বিশ্বাস কইরেন না, এটা আমার সবার প্রতি অনুরোধ। ইঞ্জিনেও আমরা অনেক বেশি কেয়ারফুল। কেননা আমার একজন পাইলটের একটাই ইঞ্জিন।
“সো, আমরা ইঞ্জিন নিয়ে কখনও কম্প্রোমাইজ করি না। এটা প্রযুক্তিগতভাবে পুরোনো। কিন্তু এই ইঞ্জিনের যত ঘণ্টা থাকার কথা, তার এক ঘণ্টাও বেশি ফ্লাই করি না। এবং এটা যা যা মেরামত করার কথা, আমরা সম্পূর্ণভাবে করি। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের মনে কোনো সন্দেহ নাই।
“কিন্তু বিকল যখন হবে, সেটা বলে কয়ে হয় না, সেটা কখন হবে, আমরা সেটা বলতে পারি না। ”
কারণ জানতে ‘ধৈর্য্য ধরতে হবে’
পাইলটের মৃত্যু ও জঙ্গি বিমানটি গুঁড়িয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনার কারণ জানতে ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন হাসান মাহমুদ খান।
তিনি বলেন, “আমি এই মুহূর্তে দেশে ইউনিফর্ম পরা সিনিয়র মোস্ট এয়ারম্যান। তারপরও আমার নিজস্ব কোনো ধারণা এখন বলা উচিত হবে না।
“তবে অবশ্যই এটা একটা সিঙ্গেল ইঞ্জিন বিমানৃ আমাদের এই ইঞ্জিনের অনেক টেকনিক্যাল প্রবলেম হতে পারে, পাখির আঘাত হতে পারে, অন্য কিছু হতে পারে- শেষ মুহূর্তে এত কম সময় ছিলৃ অনেক কিছু বলতে পারতাম, যদি বিমানটা অক্ষত থাকত অথবা পাইলট আমাদের সাথে থাকত- কিন্তু এই দুজনের একটাও নাই আমাদের কাছে।”
তদন্ত করতে ‘একটু সময় লাগবে’ জানিয়ে সে পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানান বিমান বাহিনীর প্রধান।
স্কুলের খালি মাঠে ‘নামানোর চেষ্টা’ করার কারণে পাইলট তৌকির ইসলাম বিমান থেকে অক্ষত অবস্থায় বের হওয়ার সুযোগ পাননি বলে ধারণা বিমানবাহিনী প্রধানের।
তিনি বলেন, “বিমানটা যখন পাইলটের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন সে সর্বোপরি চেষ্টা করেছে বিমানটাকে একটা খালি জায়গায়, বিশেষ করে ওই মাঠটায় গিয়েছিল, যেখানে সে নামানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি বলব।
“কারণ বিমানটা আছড়ে পড়েছিল বিল্ডিংয়ের উপরে। কিন্তু সে সেই নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য, বিমানটাকে দিক-নির্দেশনায় যাওয়ার জন্য যে মূল্যবান সময় দিয়েছে, তার জন্য তার যে ইজেকশন বলি আমরা, বিমান থেকে বের হওয়ার যে পদ্ধতি আমাদের, সেটা বিলম্বিত হয়ে যায় এবং তার ফলে সে তার নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে বা সে আজ আমাদের মাঝে নাই।”
# ‘লুকানোর কিছু নাই, কার কাছ থেকে লুকাব?’
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘লাশ লুকানোর গুজব’ও এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান।
তিনি বলেন, “ক্র্যাশ সাইটে এক ধরনের অশান্তি বিরাজ, এটা খুবই দুঃখজনক। অনেক গুজব চলছে, এই গুজবে কান দেবেন না। যখন আমাদের কাছে যে আপডেট আসছে, আহত-নিহতের, সেটা আমরা সাথে সাথে আইএসপিআরের মাধ্যমে আপনাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি।
“এখানে লুকানোর বা গোপন করার কোনো বিষয়ই নাই। কার কাছ থেকে লুকাব? আপনারা আমাদের দেশের মানুষ, আমরাও এই দেশের মানুষ। দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনাই। আমরা চেষ্টা করছি, এটাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে।”
হাসান মাহমুদ খান বলেন, “সরকারের পাশাপাশি বিমানবাহিনীও সবসময় হতাহতদের পাশে থাকবে এবং থাকছে। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে যা যা করণীয়, আমরা সবকিছু করব। মঙ্গলবারই আমরা উচ্চ পর্যায়ের একটা তদন্ত দল গঠন করে দিয়েছি। তারা অতি শিগগির এই তদন্ত করে বের করবে যে, কী ঘটনা ঘটেছিল।”
বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, “আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে একটা বিশেষ অনুরোধ করতে চাই, সেটা খুব জরুরি আমার জন্য, আপনাদের মাধ্যমে বলা, সেটা হচ্ছে- দয়া করে আপনারা দেশের এই বিপদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গুজব, ভুল তথ্যে কান দেবেন না।
“একটা শক্তিশালী বিমান বাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অপরিহার্য। দয়া করে, গুজব ছড়িয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের এই স্তম্ভকে দুর্বল করে দেবেন না।”
মাইলস্টোনে বিমান যখন আছড়ে পড়ছিল, তখন তুরস্কের পথে ছিলেন বিমান বাহিনী প্রধান হাসান মাহমুদ খান। ঘটনা শোনার পর তুরস্কের ‘বিমানবন্দর থেকে’ দেশের পথ ধরার কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে, সেটা রিকভার করাই হবে আমাদের মূল কাজ। যদিও জানি, এটা কোনোভাবেই আমরা সম্ভব করতে পারব না।
তিনি বলেন, “আহতদের সুচিকিৎসা, এটাই আমার মনে হয় এখন সবচেয়ে জরুরি, যারা আমাদের মাঝে এখনও অসুস্থ হয়ে আছেন, বা আহত হয়ে আছেন, তাদেরকে আমরা সর্বাত্মক চিকিৎসা প্রদান করব, এবং তারা যাতে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়, সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
কুর্মিটোলায় বীরউত্তম এ কে খন্দকার বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের ‘ফিউনারেল প্যারেড’ শেষে বিমানবাহিনী প্রধান -সংবাদ
মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বহু শিশুর মৃত্যুর পর চীনের তৈরি ‘এফ-৭ বিজিআই’ যুদ্ধবিমানের নিরাপত্তা ও নির্ভযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও তা মানতে রাজি নন বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান।
মঙ্গলবার,( ২২ জুলাই ২০২৫) কুর্মিটোলায় বীর উত্তম এ কে খন্দকার বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে ওই বিধ্বস্ত বিমানের পাইলট, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের ‘ফিউনারেল প্যারেড’ শেষে সাংবাদিকদের এরকম প্রশ্নে তিনি বলেন, বিমান বাহিনীর বহরে থাকা জঙ্গি বিমানগুলোর বয়স বেশি হলেও ‘লাইফটাইম’ পার হয়ে যায়নি। আর এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে কোনো ‘ছাড় দেয় না’ বিমান বাহিনী।
‘গুজবে’ কান না
দেয়ার পরামর্শ
কারণ জানতে ‘ধৈর্য ধরতে হবে’
দুর্ঘটনায় পড়া ‘এফ-৭ বিজিআই’ যুদ্ধবিমানটি পুরনো হয়ে গিয়েছিল বলে যে কথা উঠেছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, “বিমান সাধারণত সহজে পুরাতন হয় না। প্রত্যেকটা বিমানেরই একটা লাইফটাইম আছে। সুতরাং এই বিমানগুলোর প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত লাইফটাইম আছে। এক যুগ, দুই যুগ কোনো ব্যাপার না, ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা এটাকে ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছি কি-না?
“আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা আমাদের বিমানের কোনো কম্প্রোমাইজ করি না রক্ষণাবেক্ষণে। কেননা, যে দেশ থেকে বিমান কিনি সেদেশ থেকে আমরা রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত প্রযুক্তি এবং দরকার হলে যা যা প্রয়োজন হয়, সেটাও আমরা তাদের সাথে চুক্তি করে নিই। সুতরাং আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ সব ভালো হয় বিমানের, ইঞ্জিনের।”
তবে এই বিমানের প্রযুক্তি যে পুরোনো হয়ে গেছে, সে কথা স্বীকার করে এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেন বলেন, “একটা কথা বলতে পারি, প্রযুক্তিগতভাবে এই বিমানগুলো পুরোনো হয়েছে, এই বিমান পুরোনো না, প্রযুক্তিগতভাবে পুরোনো। নতুন প্রযুক্তির বিমানের জন্য অবশ্যই আমরা চেষ্টা করছি। আপনারা সবাই জানেন, আমরা ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তির বিমান আনব।
“তার মানে, এই না যে, ওইটা অ্যাক্সিডেন্ট হবে না। হইতেই পারে, সেটা হচ্ছে আসল কথা। কিন্তু এই বিমানগুলো আমরা যথাসম্ভব ভালোভাবে মেরামত করি, দেশে-বিদেশে সব জায়গায় আমরা এগুলোকে যা যা রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন হয়, সেগুলো করি।”
সোমবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই জেট ফাইটার।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, স্কুলে মাঠে বিধ্বস্ত হওয়ার পর বিমানটি ছেঁচড়ে গিয়ে ধাক্কা খায় দোতলা একটি অ্যাকাডেমিক ভবনে। অগ্নিগোলকে পরিণত হওয়া সেই বিমানের শিখা স্কুল ভবনটিকেও গ্রাস করে নেয়। হতাহতের ঘটনায় বিমর্ষ পুরো দেশ।
সামনে আসে বেশ কয়েকটি বিষয়। এরকম জনবহুল এলাকায় কেন জঙ্গি বিমান নিয়ে প্রশিক্ষণ চলছিল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। আবার ‘এফ-৭ বিজিআই’ যুদ্ধবিমানের দুর্ঘটনার ইতিহাস এবং নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নগুলো সামনে আনছেন অনেকে।
চীনের তৈরি এ যুদ্ধবিমানকে ‘চেংদু জে-সেভেন’ মডেলের সবচেয়ে আধুনিক সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উড়োজাহাজটি তৈরি করেছে চীনের ‘চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন’। এটি মূলত সোভিয়েত আমলের মিগ-টোয়েন্টিওয়ানের উন্নত চীনা সংস্করণ। ‘মিগ-টোয়েন্টিওয়ান’ এক সময়ের বহুল ব্যবহৃত যুদ্ধবিমানগুলোর একটি।
বাংলদেশ বিমান বাহিনীর মোট ৩৬টি এফ-৭ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই এফ-৭ বিজিআই। এছাড়া এফটি-৭এমবি ও এফ-৭বিজি ভ্যারিয়েন্টও রয়েছে।
২০১১ সালে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে ১৬টি জেট ফাইটার কেনার চুক্তি করে এবং ২০১৩ সালে সেগুলো বিমান বাহিনীর বহরে যুক্ত হয়। ওই বছরই চেংদু এয়ারক্র্যাফ্ট করপোরেশন এই মডেলের উড়োজাহাজের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশে এফ-৭ জঙ্গি বিমান আগেও দুর্ঘটনায় পড়েছে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলের মধুপুরে একটি এফ-৭ বিজি এবং ২০২১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর একটি এফ-৭ এমবি বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয়।
এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ‘প্রতিনিয়ত ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা তুলে ধরে হাসান মাহমুদ খান বলেন, “দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমাদের বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা তৈরি আছে। সারা বিশ্বে যেভাবে হয়, আমরাও সেভাবে করে চলেছি।
“তারপরও দুর্ঘটনা হয়। আপনি উন্নত বিশ্বেও দেখবেন, বড় বড় অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান আছে, সেগুলোও দুর্ঘটনায় পতিত হয়। কিছুদিন আগে এফ-৩৫ জঙ্গি বিমানও দুর্ঘটনায় উপনীত হয়েছে। তো, সেটাতো আর কেউ গ্যারান্টি দেবে না। আমরা অবশ্যই এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নেব, ভবিষ্যতে সেটা প্রতিকার করব ইনশাআল্লাহ।”
বিমানের ইঞ্জিনের অবস্থা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ‘গুজবে’ বিশ্বাস না করার পরামর্শ দিয়ে বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, “গুজব বিশ্বাস কইরেন না, এটা আমার সবার প্রতি অনুরোধ। ইঞ্জিনেও আমরা অনেক বেশি কেয়ারফুল। কেননা আমার একজন পাইলটের একটাই ইঞ্জিন।
“সো, আমরা ইঞ্জিন নিয়ে কখনও কম্প্রোমাইজ করি না। এটা প্রযুক্তিগতভাবে পুরোনো। কিন্তু এই ইঞ্জিনের যত ঘণ্টা থাকার কথা, তার এক ঘণ্টাও বেশি ফ্লাই করি না। এবং এটা যা যা মেরামত করার কথা, আমরা সম্পূর্ণভাবে করি। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের মনে কোনো সন্দেহ নাই।
“কিন্তু বিকল যখন হবে, সেটা বলে কয়ে হয় না, সেটা কখন হবে, আমরা সেটা বলতে পারি না। ”
কারণ জানতে ‘ধৈর্য্য ধরতে হবে’
পাইলটের মৃত্যু ও জঙ্গি বিমানটি গুঁড়িয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনার কারণ জানতে ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন হাসান মাহমুদ খান।
তিনি বলেন, “আমি এই মুহূর্তে দেশে ইউনিফর্ম পরা সিনিয়র মোস্ট এয়ারম্যান। তারপরও আমার নিজস্ব কোনো ধারণা এখন বলা উচিত হবে না।
“তবে অবশ্যই এটা একটা সিঙ্গেল ইঞ্জিন বিমানৃ আমাদের এই ইঞ্জিনের অনেক টেকনিক্যাল প্রবলেম হতে পারে, পাখির আঘাত হতে পারে, অন্য কিছু হতে পারে- শেষ মুহূর্তে এত কম সময় ছিলৃ অনেক কিছু বলতে পারতাম, যদি বিমানটা অক্ষত থাকত অথবা পাইলট আমাদের সাথে থাকত- কিন্তু এই দুজনের একটাও নাই আমাদের কাছে।”
তদন্ত করতে ‘একটু সময় লাগবে’ জানিয়ে সে পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানান বিমান বাহিনীর প্রধান।
স্কুলের খালি মাঠে ‘নামানোর চেষ্টা’ করার কারণে পাইলট তৌকির ইসলাম বিমান থেকে অক্ষত অবস্থায় বের হওয়ার সুযোগ পাননি বলে ধারণা বিমানবাহিনী প্রধানের।
তিনি বলেন, “বিমানটা যখন পাইলটের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন সে সর্বোপরি চেষ্টা করেছে বিমানটাকে একটা খালি জায়গায়, বিশেষ করে ওই মাঠটায় গিয়েছিল, যেখানে সে নামানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি বলব।
“কারণ বিমানটা আছড়ে পড়েছিল বিল্ডিংয়ের উপরে। কিন্তু সে সেই নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য, বিমানটাকে দিক-নির্দেশনায় যাওয়ার জন্য যে মূল্যবান সময় দিয়েছে, তার জন্য তার যে ইজেকশন বলি আমরা, বিমান থেকে বের হওয়ার যে পদ্ধতি আমাদের, সেটা বিলম্বিত হয়ে যায় এবং তার ফলে সে তার নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে বা সে আজ আমাদের মাঝে নাই।”
# ‘লুকানোর কিছু নাই, কার কাছ থেকে লুকাব?’
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘লাশ লুকানোর গুজব’ও এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান।
তিনি বলেন, “ক্র্যাশ সাইটে এক ধরনের অশান্তি বিরাজ, এটা খুবই দুঃখজনক। অনেক গুজব চলছে, এই গুজবে কান দেবেন না। যখন আমাদের কাছে যে আপডেট আসছে, আহত-নিহতের, সেটা আমরা সাথে সাথে আইএসপিআরের মাধ্যমে আপনাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি।
“এখানে লুকানোর বা গোপন করার কোনো বিষয়ই নাই। কার কাছ থেকে লুকাব? আপনারা আমাদের দেশের মানুষ, আমরাও এই দেশের মানুষ। দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনাই। আমরা চেষ্টা করছি, এটাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে।”
হাসান মাহমুদ খান বলেন, “সরকারের পাশাপাশি বিমানবাহিনীও সবসময় হতাহতদের পাশে থাকবে এবং থাকছে। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে যা যা করণীয়, আমরা সবকিছু করব। মঙ্গলবারই আমরা উচ্চ পর্যায়ের একটা তদন্ত দল গঠন করে দিয়েছি। তারা অতি শিগগির এই তদন্ত করে বের করবে যে, কী ঘটনা ঘটেছিল।”
বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, “আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে একটা বিশেষ অনুরোধ করতে চাই, সেটা খুব জরুরি আমার জন্য, আপনাদের মাধ্যমে বলা, সেটা হচ্ছে- দয়া করে আপনারা দেশের এই বিপদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গুজব, ভুল তথ্যে কান দেবেন না।
“একটা শক্তিশালী বিমান বাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অপরিহার্য। দয়া করে, গুজব ছড়িয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের এই স্তম্ভকে দুর্বল করে দেবেন না।”
মাইলস্টোনে বিমান যখন আছড়ে পড়ছিল, তখন তুরস্কের পথে ছিলেন বিমান বাহিনী প্রধান হাসান মাহমুদ খান। ঘটনা শোনার পর তুরস্কের ‘বিমানবন্দর থেকে’ দেশের পথ ধরার কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে, সেটা রিকভার করাই হবে আমাদের মূল কাজ। যদিও জানি, এটা কোনোভাবেই আমরা সম্ভব করতে পারব না।
তিনি বলেন, “আহতদের সুচিকিৎসা, এটাই আমার মনে হয় এখন সবচেয়ে জরুরি, যারা আমাদের মাঝে এখনও অসুস্থ হয়ে আছেন, বা আহত হয়ে আছেন, তাদেরকে আমরা সর্বাত্মক চিকিৎসা প্রদান করব, এবং তারা যাতে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়, সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”