মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও শুক্রবার(২৫-০৭-২০২৫) ৫ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাদেরকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
৪ হাসপাতালে ভর্তি
মোট ৫০ জন
হাসপাতাল চত্বরেও জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা
এখন মাইলস্টোনে উৎসুক জনতার ভিড়
শুক্রবার বিকেলে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘এই ঘটনায় শুক্রবার পরপর দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এখনও ৪০ জন ভর্তি রয়েছে। এদের মধ্যে ক্রিটিক্যাল অবস্থা ৫ জনের। তাদের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। এদের চেয়ে একটু কম গুরুতর অর্থাৎ সিপিআর ক্যাটাগরিতে রয়েছে ১০ জন। ইন্টারমিডিয়েট ক্যাটাগরিতে পোস্ট অপারেটিভ রয়েছে আরও ১০ জন এবং কেবিনে রয়েছে ১৫ জন।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে কয়জনকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তাদের ভিতর থেকে দুইজনের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তারা নিজে নিজে শ্বাস নিতে পারছেন। এই ৪০ জন রোগীর মধ্যে আগামীকাল (আজ) ৪-৫ জন রোগীকে আমরা ছুটি দিতে পারবো। আজ (শুক্রবার) সিঙ্গাপুর, চীন ও ভারতের চিকিৎসক দল আমাদের সঙ্গে এই সব রোগীদের বিষয়ে মিটিংয়ে বসেছিলেন। তারা চিকিৎসাসেবায় কাজ করছেন, রোগীদের দেখেছেনও। আরও ৪ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে মোট ৫০ জন। যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।’
বিমান দুর্ঘটনার পর থেকেই আর্তনাদ আর আহাজারিতে কাটছে না বার্ন ইনস্টিটিউটের ভর্তি সব স্বজনদের। যাদের শ্বাসনালী পুড়েছে- তাদের সবাই চোখের অথবা হাতের ইশারাতে নিজের যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। যারা কথা বলতে পারছেন, মা মা আর পারছি না, অনেক কষ্ট হচ্ছে, বাবা আমাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাও, এমনসব কথা বলে পোড়ার যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে আর বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। স্বজনরাও কোমলমতি শিশুতের এমন করুণ পরিণতি মানতে পারছেন না। আল্লাহর কাছে চোখের মণি সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে কেউ নফল নামাজ পড়েই যাচ্ছেন, আবার কেউ কান্নায় লুটিয়ে পড়ে বিলাপ করছেন।
শুক্রবার দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটে এমন সব হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখা যায়। আইসিইউ, এফএইচডিইউ ও সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর সামনে স্বজনদের বুকফাঁটা আহাজারি থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। অন্তত যেন প্রাণে বেঁচে থাকে আদরের সন্তান- এই একটিই প্রার্থনা সবার। এরসঙ্গে সন্তানের মৃত্যুর খবর আসার আতংকতো আছেই। কোনো প্রয়োজনে ওয়ার্ড নাম্বার উল্লেখ করে স্বজন খুঁজলেই আতংকে আঁতকে উঠছেন স্বজনরা।
চলে গেলেন মাকিন ও আইমান
যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শুক্রবার জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আরও দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- স্কুলটির ৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আব্দুল মুসাব্বির মাকিন (১৩) ও ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাসনিম আফরোজ আইমান (১০)।
বার্ন ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, ৪ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে মুসাব্বির মাকিন নামে দগ্ধ আরও এক শিশু মারা যায়। বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিল সে। তার বাবার নাম মো. মহসিন। তিনি পেশায় স্যানিটারি ব্যবসায়ী। গ্রামের বাড়ি গাজীপুর সদরের বড়বাড়ি এলাকায়। সেখান থেকেই নিয়মিত দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুলে যাতায়াত করতো দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট মুসাব্বির। মাকিনের মৃত্যু নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান বলেন, মুসাব্বিরের শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।
এর আগে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় তাসনিম আফরোজ আইমান। তার শরীরের ৪৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। সে মা-বাবার সঙ্গে রাজধানীর উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরে থাকত। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। বাবার নাম ইসমাইল হোসেন। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। মাকিন ও আইমানের মৃত্যুতে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বার্ন ইনস্টিটিউটে ১৫ জন মারা গেলেন। এর আগে গত মঙ্গলবার বেলা ১২টা পর্যন্ত দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের হালনাগাদ সংখ্যা প্রকাশ করে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৫ জনে, আর মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। পরের দিন বুধবার রাতে বার্ন ইউনিটে মারা যায় নাফি নামে এক শিক্ষার্থী। গতকাল বৃহস্পতিবার দুই শিক্ষার্থী মারা যায় তারা হলেন- মাহিয়া ও মাহতাব। শুক্রবার আরও দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় তারা হলেন- মাকিন ও আইমান। এ নিয়ে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মৃত্যুও সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৬ জনে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মৃত্যুও ৩৩।
সপ্তম শ্রেণীর মাকিন গত সোমবার স্কুলে যেতে না চাইলেও জোর করে তাকে পাঠিয়েছিলে মা সালেহা নাজনীন, সেই কথা মনে করে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। মাকিনর মৃত্যু কথা শেনো নাজনীনের আহাজারি কোনোভাবেই থামছে না। বারবার বলে উঠছেন, ছেলেটাকে স্কুলে না পাঠালে এই দশা তার হতো না। মাকিনের মা-বাবাকে হাসপাতালের সামনেই খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন অন্য স্বজনরা। এর মধ্যেই সন্তানের নানা স্মৃতি মনে করে তারা ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছিলেন। তাদের সান্তনা দিতে গিয়ে স্বজনরাও কাঁদছিলেন।
মা সালেহা নাজনীন কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘তার (মাকিনের) চুলটা একটু বড় হইছিল। গেলে বকা দিতে পারে বলে স্কুলে যেতে চাইতেছিল না। ছেলেটারে একরকম জোর করে স্কুলে পাঠাইলাম, আর আজকে এই অবস্থা হইলো। দুর্ঘটনার পরই মাকিনকে উত্তরার আধুনিক হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে নেয়া হয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। তার সঙ্গে একই শ্রেণীর শিক্ষার্থী বন্ধু আরিয়ান ও আয়ানকেও একই অ্যাম্বুলেন্সে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয় বলে জানান মাকিনের মামাতো ভাই দুর্জয়। মাকিনের মা-বাবাকে হাসপাতালের সামনেই খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন অন্য স্বজনরা। এর মধ্যেই সন্তানের নানা স্মৃতি মনে করে তারা ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছিলেন। তাদের সান্তনা দিতে গিয়ে স্বজনরাও কাঁদছিলেন।
জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা
এদিকে, হাসপাতাল চত্বরেও জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও বিমানবাহিনী রাখছে কড়া নজরদারি। ডাক্তার, স্টাফ ও রোগীর স্বজন ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। বার্ন ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই মুহূর্তে কোনো ব্লাড বা স্কিন ডোনারের প্রয়োজন নেই। আহতদের চিকিৎসার সব খরচ বহন করবে সরকার।
মাইলস্টোনে উৎসুক জনতার ভিড়
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের পর সেখানে ভিড় জমায় হাজার হাজার মানুষ। উৎসুক জনতার ভিড়েরসঙ্গে যুক্ত হয় অতিরিক্ত স্বেচ্ছাসেবীর যন্ত্রণা। সবমিলিয়ে উদ্ধার অভিযানে বেশ বেগ পেতে হয় সংশ্লিষ্টদের। এরপর উৎসুক জনতার ভিড় কিছুটা কমতে থাকলেও শুক্রবার ছুটির দিনে বিমান বিধ্বস্তস্থলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে সেখানে ভিড় জমায় শত শত মানুষ। কেউ ছবি তুলে, কেউ ভিডিও করে আবার কেউ ফেইসবুক লাইভ করে ভবনের পোড়া ক্ষত ও ভবনের সামনের যেখানে বিমানের সামনের অংশের কারণে গর্ত তৈরি হয়েছে-সেই দৃশ্যগুলো দেখাতে থাকেন। তবে, গণমাধ্যমকর্মীদের সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। শুক্রবার সরজমিনে এমন চিত্র দেখা যায়।
দিয়াবাড়ি এলাকা থেকে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার স্থান দেখতে পরিবারসহ মাইলস্টোন স্কুল ক্যাম্পাসে যান গার্মেন্টসকর্মী শামীম মোল্লা। তিনি বলেন, দেখতে এলাম কোথায় বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। তেমন কিছুই দেখতে পারলাম না। সব সরিয়ে ফেলেছে, শুধু পোড়া দাগ দেখতে পাচ্ছি। মাইলস্টোন স্কুলের অফিস সহকারী মো. সিয়াম জানান, শুক্রবার শুধুমাত্র সাধারণ লোকজনকে প্রবেশ করতে অনুমতি দিয়েচে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। জুমার নামাজের সময়ে আর প্রবেশ দেয়া হবে না, নামাজের পরে কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে আবার প্রবেশ করতে দেয়া হবে সাধারণ লোকজনকে।
গত সোমবার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই সামরিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। পরে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন বাহিনী উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয়। রাত পর্যন্ত চলে অভিযান। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়া হয়। ওইদিন রাতেই ২০ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে বিমানটির পাইলটও ছিলেন। পরে চিকিৎসাধীন অনেকের মৃত্যুতে বাড়তে থাকে নিহতের সংখ্যা। দুর্ঘটনার পরেরদিন গত মঙ্গলবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়।
শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫
মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও শুক্রবার(২৫-০৭-২০২৫) ৫ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাদেরকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
৪ হাসপাতালে ভর্তি
মোট ৫০ জন
হাসপাতাল চত্বরেও জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা
এখন মাইলস্টোনে উৎসুক জনতার ভিড়
শুক্রবার বিকেলে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘এই ঘটনায় শুক্রবার পরপর দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এখনও ৪০ জন ভর্তি রয়েছে। এদের মধ্যে ক্রিটিক্যাল অবস্থা ৫ জনের। তাদের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। এদের চেয়ে একটু কম গুরুতর অর্থাৎ সিপিআর ক্যাটাগরিতে রয়েছে ১০ জন। ইন্টারমিডিয়েট ক্যাটাগরিতে পোস্ট অপারেটিভ রয়েছে আরও ১০ জন এবং কেবিনে রয়েছে ১৫ জন।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে কয়জনকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তাদের ভিতর থেকে দুইজনের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তারা নিজে নিজে শ্বাস নিতে পারছেন। এই ৪০ জন রোগীর মধ্যে আগামীকাল (আজ) ৪-৫ জন রোগীকে আমরা ছুটি দিতে পারবো। আজ (শুক্রবার) সিঙ্গাপুর, চীন ও ভারতের চিকিৎসক দল আমাদের সঙ্গে এই সব রোগীদের বিষয়ে মিটিংয়ে বসেছিলেন। তারা চিকিৎসাসেবায় কাজ করছেন, রোগীদের দেখেছেনও। আরও ৪ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে মোট ৫০ জন। যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।’
বিমান দুর্ঘটনার পর থেকেই আর্তনাদ আর আহাজারিতে কাটছে না বার্ন ইনস্টিটিউটের ভর্তি সব স্বজনদের। যাদের শ্বাসনালী পুড়েছে- তাদের সবাই চোখের অথবা হাতের ইশারাতে নিজের যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। যারা কথা বলতে পারছেন, মা মা আর পারছি না, অনেক কষ্ট হচ্ছে, বাবা আমাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাও, এমনসব কথা বলে পোড়ার যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে আর বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। স্বজনরাও কোমলমতি শিশুতের এমন করুণ পরিণতি মানতে পারছেন না। আল্লাহর কাছে চোখের মণি সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে কেউ নফল নামাজ পড়েই যাচ্ছেন, আবার কেউ কান্নায় লুটিয়ে পড়ে বিলাপ করছেন।
শুক্রবার দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটে এমন সব হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখা যায়। আইসিইউ, এফএইচডিইউ ও সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর সামনে স্বজনদের বুকফাঁটা আহাজারি থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। অন্তত যেন প্রাণে বেঁচে থাকে আদরের সন্তান- এই একটিই প্রার্থনা সবার। এরসঙ্গে সন্তানের মৃত্যুর খবর আসার আতংকতো আছেই। কোনো প্রয়োজনে ওয়ার্ড নাম্বার উল্লেখ করে স্বজন খুঁজলেই আতংকে আঁতকে উঠছেন স্বজনরা।
চলে গেলেন মাকিন ও আইমান
যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শুক্রবার জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আরও দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- স্কুলটির ৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আব্দুল মুসাব্বির মাকিন (১৩) ও ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাসনিম আফরোজ আইমান (১০)।
বার্ন ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, ৪ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে মুসাব্বির মাকিন নামে দগ্ধ আরও এক শিশু মারা যায়। বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিল সে। তার বাবার নাম মো. মহসিন। তিনি পেশায় স্যানিটারি ব্যবসায়ী। গ্রামের বাড়ি গাজীপুর সদরের বড়বাড়ি এলাকায়। সেখান থেকেই নিয়মিত দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুলে যাতায়াত করতো দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট মুসাব্বির। মাকিনের মৃত্যু নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান বলেন, মুসাব্বিরের শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।
এর আগে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় তাসনিম আফরোজ আইমান। তার শরীরের ৪৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। সে মা-বাবার সঙ্গে রাজধানীর উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরে থাকত। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। বাবার নাম ইসমাইল হোসেন। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। মাকিন ও আইমানের মৃত্যুতে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বার্ন ইনস্টিটিউটে ১৫ জন মারা গেলেন। এর আগে গত মঙ্গলবার বেলা ১২টা পর্যন্ত দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের হালনাগাদ সংখ্যা প্রকাশ করে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৫ জনে, আর মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। পরের দিন বুধবার রাতে বার্ন ইউনিটে মারা যায় নাফি নামে এক শিক্ষার্থী। গতকাল বৃহস্পতিবার দুই শিক্ষার্থী মারা যায় তারা হলেন- মাহিয়া ও মাহতাব। শুক্রবার আরও দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় তারা হলেন- মাকিন ও আইমান। এ নিয়ে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মৃত্যুও সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৬ জনে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মৃত্যুও ৩৩।
সপ্তম শ্রেণীর মাকিন গত সোমবার স্কুলে যেতে না চাইলেও জোর করে তাকে পাঠিয়েছিলে মা সালেহা নাজনীন, সেই কথা মনে করে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। মাকিনর মৃত্যু কথা শেনো নাজনীনের আহাজারি কোনোভাবেই থামছে না। বারবার বলে উঠছেন, ছেলেটাকে স্কুলে না পাঠালে এই দশা তার হতো না। মাকিনের মা-বাবাকে হাসপাতালের সামনেই খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন অন্য স্বজনরা। এর মধ্যেই সন্তানের নানা স্মৃতি মনে করে তারা ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছিলেন। তাদের সান্তনা দিতে গিয়ে স্বজনরাও কাঁদছিলেন।
মা সালেহা নাজনীন কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘তার (মাকিনের) চুলটা একটু বড় হইছিল। গেলে বকা দিতে পারে বলে স্কুলে যেতে চাইতেছিল না। ছেলেটারে একরকম জোর করে স্কুলে পাঠাইলাম, আর আজকে এই অবস্থা হইলো। দুর্ঘটনার পরই মাকিনকে উত্তরার আধুনিক হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে নেয়া হয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। তার সঙ্গে একই শ্রেণীর শিক্ষার্থী বন্ধু আরিয়ান ও আয়ানকেও একই অ্যাম্বুলেন্সে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয় বলে জানান মাকিনের মামাতো ভাই দুর্জয়। মাকিনের মা-বাবাকে হাসপাতালের সামনেই খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন অন্য স্বজনরা। এর মধ্যেই সন্তানের নানা স্মৃতি মনে করে তারা ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছিলেন। তাদের সান্তনা দিতে গিয়ে স্বজনরাও কাঁদছিলেন।
জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা
এদিকে, হাসপাতাল চত্বরেও জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও বিমানবাহিনী রাখছে কড়া নজরদারি। ডাক্তার, স্টাফ ও রোগীর স্বজন ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। বার্ন ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই মুহূর্তে কোনো ব্লাড বা স্কিন ডোনারের প্রয়োজন নেই। আহতদের চিকিৎসার সব খরচ বহন করবে সরকার।
মাইলস্টোনে উৎসুক জনতার ভিড়
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের পর সেখানে ভিড় জমায় হাজার হাজার মানুষ। উৎসুক জনতার ভিড়েরসঙ্গে যুক্ত হয় অতিরিক্ত স্বেচ্ছাসেবীর যন্ত্রণা। সবমিলিয়ে উদ্ধার অভিযানে বেশ বেগ পেতে হয় সংশ্লিষ্টদের। এরপর উৎসুক জনতার ভিড় কিছুটা কমতে থাকলেও শুক্রবার ছুটির দিনে বিমান বিধ্বস্তস্থলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে সেখানে ভিড় জমায় শত শত মানুষ। কেউ ছবি তুলে, কেউ ভিডিও করে আবার কেউ ফেইসবুক লাইভ করে ভবনের পোড়া ক্ষত ও ভবনের সামনের যেখানে বিমানের সামনের অংশের কারণে গর্ত তৈরি হয়েছে-সেই দৃশ্যগুলো দেখাতে থাকেন। তবে, গণমাধ্যমকর্মীদের সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। শুক্রবার সরজমিনে এমন চিত্র দেখা যায়।
দিয়াবাড়ি এলাকা থেকে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার স্থান দেখতে পরিবারসহ মাইলস্টোন স্কুল ক্যাম্পাসে যান গার্মেন্টসকর্মী শামীম মোল্লা। তিনি বলেন, দেখতে এলাম কোথায় বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। তেমন কিছুই দেখতে পারলাম না। সব সরিয়ে ফেলেছে, শুধু পোড়া দাগ দেখতে পাচ্ছি। মাইলস্টোন স্কুলের অফিস সহকারী মো. সিয়াম জানান, শুক্রবার শুধুমাত্র সাধারণ লোকজনকে প্রবেশ করতে অনুমতি দিয়েচে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। জুমার নামাজের সময়ে আর প্রবেশ দেয়া হবে না, নামাজের পরে কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে আবার প্রবেশ করতে দেয়া হবে সাধারণ লোকজনকে।
গত সোমবার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই সামরিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। পরে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন বাহিনী উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয়। রাত পর্যন্ত চলে অভিযান। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়া হয়। ওইদিন রাতেই ২০ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে বিমানটির পাইলটও ছিলেন। পরে চিকিৎসাধীন অনেকের মৃত্যুতে বাড়তে থাকে নিহতের সংখ্যা। দুর্ঘটনার পরেরদিন গত মঙ্গলবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়।