সাগর উত্তাল, ঢেউ আরও বড় হয়ে আঘাত হানছে স্থলে। তাতে ভেঙে পড়ছে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের পাড় -জসিম সিদ্দিকী
বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত লঘুচাপ ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপ দশা পেরিয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে ভারী বৃষ্টিপাতের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। শুক্রবার(২৫-০৭-২০২৫) থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে চট্টগ্রাম পাহাড় ধসের আশঙ্কার কথা জানিয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছে প্রশাসন। একই সঙ্গে অতিবৃষ্টির প্রভাবে উপকুলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চলঞ্চল জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেতে পারে বলেও আভাস দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে হাতিয়ার বিভিন্ন দ্বীপ এলাকার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের প্রভাবে তলিয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
পাহাড় ধস ও নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার সতর্কবার্তা
আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, অতি ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম মহানগরীর কোথাও কোথাও অস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে।
শুক্রবার এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত লঘুচাপ ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট নিম্নচাপে পরিণত হয়ে উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও আশপাশের পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূলীয় এলাকায় অবস্থান করছে। এটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ২৬৫ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ২৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১১০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল । এর প্রভাবে উপকূলীয় জেলাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এর আগে আবহাওয়া অফিস জুলাই মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে ১-৩টি লঘুচাপের আভাস দিয়ে বলেছিল, এর মধ্যে একটি নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, নিম্নচাপের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ু চাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা ও সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে দমকা বা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। এ কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার নৌবন্দরগুলোকে ১ নম্বর সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, অমাবস্যা ও নিম্নচাপের কারণে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ১ থেকে ৩ ফুটের অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা
হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত নিম্নচাপ ও অমাবস্যার ফলে উপকূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। শুক্রবার কেন্দ্রের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় নদীগুলোতে স্বাভাবিক জোয়ার বিরাজমান আছে, তবে অমাবস্যা ও নিম্নচাপের প্রভাবে আগামী একদিন স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৩ ফুটের অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গেল ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগে ভারী বৃষ্টি ঝরেছে; তবে উজানে কোনো উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি। দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত লঘুচাপটি উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও আশপাশের বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগে এবং উজানে ভারতের ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশে আগামী তিন দিন ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। আগামী তিন দিন এসব নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। এই সময়ে ফেনীর মুহরি ও সেলোনিয়া নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে এবং ফেনী জেলায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
এ সময়ে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার ফেনী, হালদা, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, রহমতখালি খাল ও নোয়াখালী খাল নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেয়ে সতর্কসীমায় প্রবাহিত হতে পারে এবং আশপাশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। সিলেট বিভাগের মনু, ধলাই ও খোয়াই নদীর পানিও সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা আগামী তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে।
তলিয়ে গেছে নিঝুম দ্বীপ
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার সকাল থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় নিঝুম দ্বীপসহ হাতিয়ার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। পানিতে অনেক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও সড়ক প্লাবিত হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে হাজারও পরিবার। বিশেষ করে নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যানে বসবাসরত হরিণসহ বন্য প্রাণীগুলোর জন্য সৃষ্ট হয়েছে হুমকি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শুক্রবার দুপুরের পর থেকে জোয়ারের পানি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। ফলে ভেসে গেছে মাছের ঘের। বিভিন্ন এলাকায় পানি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। কিছু পরিবার উঁচু স্থানে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে।
এদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় জননিরাপত্তার স্বার্থে হাতিয়া-চট্টগ্রাম ও হাতিয়া-নোয়াখালী নৌরুটে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ট্রলার চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের বাসিন্দারা সাংবাদিকদের জানান, জোয়ারের ফলে নিঝুমদ্বীপের সব পুকুর, দিঘি ভেসে গেছে। প্রধান সড়কসহ সব সড়ক তলিয়ে গেছে। জোয়ার এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হচ্ছে। মানুষের বসতঘর, কৃষি জমিও তলিয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, প্রতিবছর জোয়ারে ভেসে যায় ঘরবাড়ি, দোকান, গবাদিপশু, ফসলি জমি। ৭ লাখ মানুষের এই দ্বীপে নেই স্থায়ী বেড়িবাঁধ, আছে শুধু নিঃসঙ্গতা আর অবহেলা। কেউ কেউ ত্রাণ নিয়ে আসে, কিন্তু আমরা আর ত্রাণ চাই না। আমরা চাই স্থায়ী সমাধান। আমাদের দাবি নদী ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ ও নিরাপদ জীবন। এটা করুণা নয়, আমাদের অধিকার।
হাতিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আলাউদ্দিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, নদী ও সাগর উত্তাল থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে নৌযোগাযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে পুনরায় চলাচলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। নিঝুমদ্বীপসহ অনেক নিম্নাঞ্চল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আমরা খোঁজ রাখছি। আরও কয়েকদিন এমন পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্তব্যরত আবহাওয়াবিদ জানান, সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১৪ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ভারী বৃষ্টির সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। সতর্কবার্তায় বলা হয়, পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। অতি ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া অমাবস্যা ও নিম্নচাপের কারণে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো এক থেকে তিন ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
৬ নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ
সাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপের কারণে ভোলার চরাঞ্চল উচ্চ জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। এতে ভোলার ফেরিঘাট ডুবে গেছে। শুক্রবার সকাল থেকে দমকা হাওয়া বইছে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সাগর ও মেঘনা নদীতে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত দেখাতে বলায় ভোলার ছয় নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ আছে।
ভোলা আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ায় ভোলাসহ উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টিপাতের সঙ্গে টানা দমকা হাওয়া বইছে। এ কারণে সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ভোলার নদীগুলোকে ১ নম্বর সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, শুক্রবার মেঘনায় জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৭০ মিটার। বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে জোয়ার প্লাবিত হওয়ার কারণে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। ভোলার ইলিশা ফেরিঘাটের হাইওয়াটার ও লোওয়াটার ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে ডুবে যাচ্ছে। এ কারণে ফেরি ওঠানামায় সমস্যায় পড়ছেন যানবাহনের চালকেরা।
সাগর উত্তাল, ঢেউ আরও বড় হয়ে আঘাত হানছে স্থলে। তাতে ভেঙে পড়ছে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের পাড় -জসিম সিদ্দিকী
শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫
বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত লঘুচাপ ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপ দশা পেরিয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে ভারী বৃষ্টিপাতের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। শুক্রবার(২৫-০৭-২০২৫) থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে চট্টগ্রাম পাহাড় ধসের আশঙ্কার কথা জানিয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছে প্রশাসন। একই সঙ্গে অতিবৃষ্টির প্রভাবে উপকুলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চলঞ্চল জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেতে পারে বলেও আভাস দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে হাতিয়ার বিভিন্ন দ্বীপ এলাকার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের প্রভাবে তলিয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
পাহাড় ধস ও নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার সতর্কবার্তা
আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, অতি ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম মহানগরীর কোথাও কোথাও অস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে।
শুক্রবার এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত লঘুচাপ ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট নিম্নচাপে পরিণত হয়ে উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও আশপাশের পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূলীয় এলাকায় অবস্থান করছে। এটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ২৬৫ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ২৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১১০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল । এর প্রভাবে উপকূলীয় জেলাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এর আগে আবহাওয়া অফিস জুলাই মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে ১-৩টি লঘুচাপের আভাস দিয়ে বলেছিল, এর মধ্যে একটি নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, নিম্নচাপের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ু চাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা ও সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে দমকা বা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। এ কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার নৌবন্দরগুলোকে ১ নম্বর সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, অমাবস্যা ও নিম্নচাপের কারণে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ১ থেকে ৩ ফুটের অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা
হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত নিম্নচাপ ও অমাবস্যার ফলে উপকূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। শুক্রবার কেন্দ্রের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় নদীগুলোতে স্বাভাবিক জোয়ার বিরাজমান আছে, তবে অমাবস্যা ও নিম্নচাপের প্রভাবে আগামী একদিন স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৩ ফুটের অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গেল ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগে ভারী বৃষ্টি ঝরেছে; তবে উজানে কোনো উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি। দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত লঘুচাপটি উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও আশপাশের বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগে এবং উজানে ভারতের ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশে আগামী তিন দিন ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। আগামী তিন দিন এসব নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। এই সময়ে ফেনীর মুহরি ও সেলোনিয়া নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে এবং ফেনী জেলায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
এ সময়ে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার ফেনী, হালদা, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, রহমতখালি খাল ও নোয়াখালী খাল নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেয়ে সতর্কসীমায় প্রবাহিত হতে পারে এবং আশপাশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। সিলেট বিভাগের মনু, ধলাই ও খোয়াই নদীর পানিও সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা আগামী তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে।
তলিয়ে গেছে নিঝুম দ্বীপ
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার সকাল থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় নিঝুম দ্বীপসহ হাতিয়ার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। পানিতে অনেক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও সড়ক প্লাবিত হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে হাজারও পরিবার। বিশেষ করে নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যানে বসবাসরত হরিণসহ বন্য প্রাণীগুলোর জন্য সৃষ্ট হয়েছে হুমকি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শুক্রবার দুপুরের পর থেকে জোয়ারের পানি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। ফলে ভেসে গেছে মাছের ঘের। বিভিন্ন এলাকায় পানি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। কিছু পরিবার উঁচু স্থানে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে।
এদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় জননিরাপত্তার স্বার্থে হাতিয়া-চট্টগ্রাম ও হাতিয়া-নোয়াখালী নৌরুটে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ট্রলার চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের বাসিন্দারা সাংবাদিকদের জানান, জোয়ারের ফলে নিঝুমদ্বীপের সব পুকুর, দিঘি ভেসে গেছে। প্রধান সড়কসহ সব সড়ক তলিয়ে গেছে। জোয়ার এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হচ্ছে। মানুষের বসতঘর, কৃষি জমিও তলিয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, প্রতিবছর জোয়ারে ভেসে যায় ঘরবাড়ি, দোকান, গবাদিপশু, ফসলি জমি। ৭ লাখ মানুষের এই দ্বীপে নেই স্থায়ী বেড়িবাঁধ, আছে শুধু নিঃসঙ্গতা আর অবহেলা। কেউ কেউ ত্রাণ নিয়ে আসে, কিন্তু আমরা আর ত্রাণ চাই না। আমরা চাই স্থায়ী সমাধান। আমাদের দাবি নদী ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ ও নিরাপদ জীবন। এটা করুণা নয়, আমাদের অধিকার।
হাতিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আলাউদ্দিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, নদী ও সাগর উত্তাল থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে নৌযোগাযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে পুনরায় চলাচলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। নিঝুমদ্বীপসহ অনেক নিম্নাঞ্চল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আমরা খোঁজ রাখছি। আরও কয়েকদিন এমন পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্তব্যরত আবহাওয়াবিদ জানান, সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১৪ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ভারী বৃষ্টির সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। সতর্কবার্তায় বলা হয়, পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। অতি ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া অমাবস্যা ও নিম্নচাপের কারণে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো এক থেকে তিন ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
৬ নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ
সাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপের কারণে ভোলার চরাঞ্চল উচ্চ জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। এতে ভোলার ফেরিঘাট ডুবে গেছে। শুক্রবার সকাল থেকে দমকা হাওয়া বইছে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সাগর ও মেঘনা নদীতে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত দেখাতে বলায় ভোলার ছয় নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ আছে।
ভোলা আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ায় ভোলাসহ উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টিপাতের সঙ্গে টানা দমকা হাওয়া বইছে। এ কারণে সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ভোলার নদীগুলোকে ১ নম্বর সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, শুক্রবার মেঘনায় জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৭০ মিটার। বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে জোয়ার প্লাবিত হওয়ার কারণে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। ভোলার ইলিশা ফেরিঘাটের হাইওয়াটার ও লোওয়াটার ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে ডুবে যাচ্ছে। এ কারণে ফেরি ওঠানামায় সমস্যায় পড়ছেন যানবাহনের চালকেরা।