বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে স্কুলে আসে তার ব্যাগ নিতে, উৎসুক মানুষ ঠেকাতে হিমশিম
‘ঘটনার পরপর দুইবার স্কুলে এসেছি। এখানে এলেই বিমানের বিকট শব্দ কানে আসছে আর কলিজাটা কেঁপে উঠছে। বিমানের শব্দ শুনলেই মনে হচ্ছে মাথায় এসে পড়বে, মনে হচ্ছে পালাই। মাইলস্টোনে পড়লেও এ ক্যাম্পাসে (দিয়াবাড়ি শাখা) আর থাকবো না। অন্য জায়গায় ট্রান্সফার নিতে চাই।’ ভয়-আতঙ্কের মাত্রা বোঝাতে এভাবেই নিজের অনুভূতি জানাচ্ছিল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র সাহিদ সাবির। গত ২১ জুলাই দুপুরে যখন হায়দার আলী অ্যাকাডেমিক ভবনে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়, তখন সে ওই ভবনেই ছিল।
রোববার সাবির বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে স্কুলে এসেছে তার ব্যাগ নিতে। স্কুল কর্তৃপক্ষ অক্ষত থাকা ব্যাগগুলোতে শিক্ষার্থীদের নাম-পরিচয় লিখে একটি কক্ষে রেখেছে। সেখান থেকে সবাই নিজের ব্যাগ সংগ্রহ করছে। সাবিরও তার ব্যাগ খুঁজে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে আসে। ক্যাম্পাসের কাউন্সেলিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় সাহিদ সাবির, তার বড় ভাই মাইলস্টোনের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাজিদ সাহিক ও বাবা হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম সোহেলের সঙ্গে।
সাহিদ সাবির বলে, ‘স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল। আমার ক্লাসরুম হায়দার আলী ভবনে ঢুকে বামদিকে। স্কুল ছুটির পর কোচিং ক্লাস ছিল ডানদিকে (যেখানে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে)। সেখানে এসে ব্যাগ রেখে আবার বাম পাশের কোণার দিকে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তখনই বিমান এসে পড়ে।’ ‘প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি, ভাবছিলাম ট্রান্সমিটার ব্লাস্ট হয়েছে। পরে দেখি না আগুন বেশি...অন্য কিছু। আমরা বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে পড়ি। কিন্তু এত ধোঁয়া যে তাকানো যাচ্ছিল না, দম নেয়া যাচ্ছিল না। আমরা তখন জানালার দিকে গিয়ে দাঁড়াই। সেখান থেকে আমাদের কিছু বড় ভাইয়ে আমাদের দেখে ওখানেই দাঁড়াতে বলে। পরে তারাই গ্রিল ভেঙে বামদিক দিয়ে আমাদের বের করে ৬ নম্বর ভবনে নিয়ে যায়।’
সাবিরের বাবা রবিউর ইসলাম সোহেল বলেন, ‘গত ২৮ জুনে ওদের মা মারা গেছে। আমার বড় ছেলেটাও মাইলস্টোনে দশম শ্রেণীতে পড়ে। দুই ছেলেই স্কুলে ছিল। সাবিরের ভবনে দুর্ঘটনা ঘটেছে। অফিসের একটি কনফারেন্সে আমি কক্সবাজার ছিলাম। ওদের স্কুলে স্কলারশিপ গ্রুপে ওইদিন দুপুরে কল আসে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও কল আসে। ব্যস্ততার কারণে আমি গ্রুপ কলে অ্যাটেন্ড করিনি।’
‘পরক্ষণে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। রিসিভ করতেই শুনি সাবিরের কণ্ঠ বাবা, আমি সাবির। আমাদের স্কুলে বিমান ব্লাস্ট
হয়েছে। আমার মাথার চুল, জুতা পুড়ে গেছে। আমি ৬ নম্বর বিল্ডিংয়ে লাইব্রেরিতে আছি। তুমি কোথায় আছো, এখনই এসো...।’ রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ছেলের এমন আকুতি শুনে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। কারণ ক’দিন আগেই ওদের মা মারা গেছে। স্কুলে এসে ও খুব কাঁদে। তখন মাহেরীন ম্যাডাম ওকে দেখে রাখতেন, কান্না থামাতেন। অন্য ম্যাডামরাও ওকে অনেক আদর করেন, দেখে রাখেন।’
ছেলে সাবির ভয়-আতঙ্কে মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে আর পড়তে চায় না। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর করা হলে বাবা রবিউল বলেন, ‘ছেলে যেহেতু চায় না, বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দেখবো। যদি সম্ভব হয় অন্য শাখায় নেয়ার চেষ্টা করবো।’
উৎসুক মানুষ ঠেকাতে হিমশিম
বিমান বিধ্বস্তের সপ্তম দিনেও ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভিড় করছেন উৎসুক মানুষ। অনেকে সপরিবারে ঘটনাস্থল দেখতে আসছেন। কেউ কেউ ঘটনাস্থলে এসে ভিডিওকলে পরিবার-পরিজনদের দেখাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও আশপাশের পরিস্থিতি। উৎসুক জনতার এ ভিড়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে পারছেন না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। ফলে ক্লাস শুরু বা শিক্ষা কার্যক্রমে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন তারা।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনার তৃতীয় দিন থেকে তারা ক্যাম্পাসে সাধারণ মানুষের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রোববার থেকে নবম-একাদশ শ্রেণীর ক্লাস চালুর ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে মানুষের উপচেপড়া ভিড় ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। কবে নাগাদ ক্লাস শুরু করা যাবে, তা নিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
রোববার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, দলবেঁধে একের পর এক মানুষ প্রবেশ করছেন। তারা পুরো ক্যাম্পাস ঘুরছেন। ঘুরে ঘুরে সব খুঁটিনাটি দেখছেন। সবচেয়ে বেশি ভিড় মূল ঘটনাস্থল হায়দার আলী ভবনের সামনে। সেখানে সকাল থেকে জটলা। কেউ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। সেজন্য সেখানে সিকিউরিটি গার্ড বসানো হয়েছে। এখন চলছে পুরো এলাকাটি ঘিরে দেয়ার কাজ।
শুধু যে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে জটলা করছেন তা নয়, অনেকে খুঁজছেন পাইলট তৌকির কোথায় পড়েছিলেন, সেই জায়গাও। দীর্ঘসময় ক্যাম্পাসে অবস্থান করায় অনেকেই আবার শিক্ষার্থীদের হোস্টেল, অ্যাকাডেমিক ভবনের টয়লেটে ঢুকে পড়ছেন। এ নিয়ে পুলিশ ও সিকিউরিটি গার্ডদের সঙ্গে অনেককে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তেও দেখা যায়। মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা শফিকুল ইসলাম বলেন, ভোরে ফজরের নামাজের পর থেকে দলবেঁধে মানুষ আসছেন। তাদের ঠেকালে অনেকে বলেন ভেতরে লাশ গুম করার জন্য আটকে রাখছেন? এ ধরনের কথাবার্তার কারণে কর্তৃপক্ষ সবাইকে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে। সবাই ঘুরে দেখে যাক যে, এখানে কিছু নেই।
দিনে আনুমানিক কত মানুষ আসছে? এমন প্রশ্নে প্রহরী শফিকুল বলেন, সেভাবে তো হিসাব করা হচ্ছে না। তবে দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ তো আসছে-যাচ্ছেই। স্কুলের স্টাফ আব্দুল মান্নান বলেন, স্কুল চালু করলে সকাল ৭টার আগে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। ৭টার পর শুধু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা প্রবেশ করে। তাছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীরা আসেন। ক্লাস শুরু করলেই তো গেট পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। তখন আবার গুজব ছড়াবে। সেজন্য ক্লাস শুরুর সিদ্ধান্ত কিছুটা পেছানো হয়েছে।
শ্বশুর-শাশুড়ি, ৪ বছর বয়সী ছেলে, ৭ বছর বয়সী মেয়ে ও কলেজ পড়ুয়া ছোট বোনকে সঙ্গে করে রোববার মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে এসেছেন রোমানা আক্তার। কেন এসেছেন? জানতে চাইলে রোমানা বলেন, এটা কোনো প্রশ্ন হলো! এতবড় একটা ঘটনা দেখতে আসবো না? আগেও দু-দিন এসেছি। তখন সঙ্গে মেয়ে ও ছেলে আসছিল। আজ শ্বশুর-শাশুড়ি ও গ্রাম থেকে আসা ছোটবোনকে নিয়ে এসেছি। বহিরাগতদের স্কুলে প্রবেশ নিষেধ। সেখানে আপনারা প্রবেশ করছেন কেন? এমন প্রশ্নে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, সব জায়গায় তো আর বিমান পড়ে না। এমন ঘটনাও দেশে খুব কম ঘটে। আমাদের বাসা মিরপুর সাড়ে ১১-তে। কাছাকাছিই তো সবারই তো ঘটনা নিজ চোখে দেখতে ইচ্ছে করে, তাই না! সেজন্য এসেছি। স্কুলে তো ক্লাস হচ্ছে না। আটকে রাখারও তো কোনো কারণ নেই।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাসুদ আলম বলেন, আমরা রোববার থেকে ক্লাস শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মানুষের এত চাপ যে, ক্যাম্পাসের পরিবেশ স্বাভাবিক করা সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্য রোববার-আজও বন্ধ রেখেছি। আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু করা যায় কিনা, তা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। উৎসুক মানুষ ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাধা দিলে মানুষজন বিভিন্নভাবে চারদিকে জড়ো হয়ে আরও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। বহু গুজব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সেজন্য আপাতত বহিরাগতদের প্রবেশে বাধা দেয়া হচ্ছে না। তবে দ্রুতই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
গত ২১ জুলাই উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৪ জন নিহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে সরকর। দগ্ধদের অনেকেই এখনও চিকিৎসাধীন। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মেহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, বার্নে ৩৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। সিবিআর ক্যাটাগরিতে ৯ জন। বাকিরা অন্য ওয়ার্ডে ভর্তি।
বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে স্কুলে আসে তার ব্যাগ নিতে, উৎসুক মানুষ ঠেকাতে হিমশিম
সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫
‘ঘটনার পরপর দুইবার স্কুলে এসেছি। এখানে এলেই বিমানের বিকট শব্দ কানে আসছে আর কলিজাটা কেঁপে উঠছে। বিমানের শব্দ শুনলেই মনে হচ্ছে মাথায় এসে পড়বে, মনে হচ্ছে পালাই। মাইলস্টোনে পড়লেও এ ক্যাম্পাসে (দিয়াবাড়ি শাখা) আর থাকবো না। অন্য জায়গায় ট্রান্সফার নিতে চাই।’ ভয়-আতঙ্কের মাত্রা বোঝাতে এভাবেই নিজের অনুভূতি জানাচ্ছিল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র সাহিদ সাবির। গত ২১ জুলাই দুপুরে যখন হায়দার আলী অ্যাকাডেমিক ভবনে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়, তখন সে ওই ভবনেই ছিল।
রোববার সাবির বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে স্কুলে এসেছে তার ব্যাগ নিতে। স্কুল কর্তৃপক্ষ অক্ষত থাকা ব্যাগগুলোতে শিক্ষার্থীদের নাম-পরিচয় লিখে একটি কক্ষে রেখেছে। সেখান থেকে সবাই নিজের ব্যাগ সংগ্রহ করছে। সাবিরও তার ব্যাগ খুঁজে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে আসে। ক্যাম্পাসের কাউন্সেলিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় সাহিদ সাবির, তার বড় ভাই মাইলস্টোনের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাজিদ সাহিক ও বাবা হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম সোহেলের সঙ্গে।
সাহিদ সাবির বলে, ‘স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল। আমার ক্লাসরুম হায়দার আলী ভবনে ঢুকে বামদিকে। স্কুল ছুটির পর কোচিং ক্লাস ছিল ডানদিকে (যেখানে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে)। সেখানে এসে ব্যাগ রেখে আবার বাম পাশের কোণার দিকে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তখনই বিমান এসে পড়ে।’ ‘প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি, ভাবছিলাম ট্রান্সমিটার ব্লাস্ট হয়েছে। পরে দেখি না আগুন বেশি...অন্য কিছু। আমরা বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে পড়ি। কিন্তু এত ধোঁয়া যে তাকানো যাচ্ছিল না, দম নেয়া যাচ্ছিল না। আমরা তখন জানালার দিকে গিয়ে দাঁড়াই। সেখান থেকে আমাদের কিছু বড় ভাইয়ে আমাদের দেখে ওখানেই দাঁড়াতে বলে। পরে তারাই গ্রিল ভেঙে বামদিক দিয়ে আমাদের বের করে ৬ নম্বর ভবনে নিয়ে যায়।’
সাবিরের বাবা রবিউর ইসলাম সোহেল বলেন, ‘গত ২৮ জুনে ওদের মা মারা গেছে। আমার বড় ছেলেটাও মাইলস্টোনে দশম শ্রেণীতে পড়ে। দুই ছেলেই স্কুলে ছিল। সাবিরের ভবনে দুর্ঘটনা ঘটেছে। অফিসের একটি কনফারেন্সে আমি কক্সবাজার ছিলাম। ওদের স্কুলে স্কলারশিপ গ্রুপে ওইদিন দুপুরে কল আসে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও কল আসে। ব্যস্ততার কারণে আমি গ্রুপ কলে অ্যাটেন্ড করিনি।’
‘পরক্ষণে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। রিসিভ করতেই শুনি সাবিরের কণ্ঠ বাবা, আমি সাবির। আমাদের স্কুলে বিমান ব্লাস্ট
হয়েছে। আমার মাথার চুল, জুতা পুড়ে গেছে। আমি ৬ নম্বর বিল্ডিংয়ে লাইব্রেরিতে আছি। তুমি কোথায় আছো, এখনই এসো...।’ রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ছেলের এমন আকুতি শুনে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। কারণ ক’দিন আগেই ওদের মা মারা গেছে। স্কুলে এসে ও খুব কাঁদে। তখন মাহেরীন ম্যাডাম ওকে দেখে রাখতেন, কান্না থামাতেন। অন্য ম্যাডামরাও ওকে অনেক আদর করেন, দেখে রাখেন।’
ছেলে সাবির ভয়-আতঙ্কে মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে আর পড়তে চায় না। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর করা হলে বাবা রবিউল বলেন, ‘ছেলে যেহেতু চায় না, বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দেখবো। যদি সম্ভব হয় অন্য শাখায় নেয়ার চেষ্টা করবো।’
উৎসুক মানুষ ঠেকাতে হিমশিম
বিমান বিধ্বস্তের সপ্তম দিনেও ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভিড় করছেন উৎসুক মানুষ। অনেকে সপরিবারে ঘটনাস্থল দেখতে আসছেন। কেউ কেউ ঘটনাস্থলে এসে ভিডিওকলে পরিবার-পরিজনদের দেখাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও আশপাশের পরিস্থিতি। উৎসুক জনতার এ ভিড়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে পারছেন না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। ফলে ক্লাস শুরু বা শিক্ষা কার্যক্রমে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন তারা।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনার তৃতীয় দিন থেকে তারা ক্যাম্পাসে সাধারণ মানুষের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রোববার থেকে নবম-একাদশ শ্রেণীর ক্লাস চালুর ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে মানুষের উপচেপড়া ভিড় ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। কবে নাগাদ ক্লাস শুরু করা যাবে, তা নিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
রোববার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, দলবেঁধে একের পর এক মানুষ প্রবেশ করছেন। তারা পুরো ক্যাম্পাস ঘুরছেন। ঘুরে ঘুরে সব খুঁটিনাটি দেখছেন। সবচেয়ে বেশি ভিড় মূল ঘটনাস্থল হায়দার আলী ভবনের সামনে। সেখানে সকাল থেকে জটলা। কেউ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। সেজন্য সেখানে সিকিউরিটি গার্ড বসানো হয়েছে। এখন চলছে পুরো এলাকাটি ঘিরে দেয়ার কাজ।
শুধু যে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে জটলা করছেন তা নয়, অনেকে খুঁজছেন পাইলট তৌকির কোথায় পড়েছিলেন, সেই জায়গাও। দীর্ঘসময় ক্যাম্পাসে অবস্থান করায় অনেকেই আবার শিক্ষার্থীদের হোস্টেল, অ্যাকাডেমিক ভবনের টয়লেটে ঢুকে পড়ছেন। এ নিয়ে পুলিশ ও সিকিউরিটি গার্ডদের সঙ্গে অনেককে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তেও দেখা যায়। মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা শফিকুল ইসলাম বলেন, ভোরে ফজরের নামাজের পর থেকে দলবেঁধে মানুষ আসছেন। তাদের ঠেকালে অনেকে বলেন ভেতরে লাশ গুম করার জন্য আটকে রাখছেন? এ ধরনের কথাবার্তার কারণে কর্তৃপক্ষ সবাইকে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে। সবাই ঘুরে দেখে যাক যে, এখানে কিছু নেই।
দিনে আনুমানিক কত মানুষ আসছে? এমন প্রশ্নে প্রহরী শফিকুল বলেন, সেভাবে তো হিসাব করা হচ্ছে না। তবে দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ তো আসছে-যাচ্ছেই। স্কুলের স্টাফ আব্দুল মান্নান বলেন, স্কুল চালু করলে সকাল ৭টার আগে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। ৭টার পর শুধু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা প্রবেশ করে। তাছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীরা আসেন। ক্লাস শুরু করলেই তো গেট পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। তখন আবার গুজব ছড়াবে। সেজন্য ক্লাস শুরুর সিদ্ধান্ত কিছুটা পেছানো হয়েছে।
শ্বশুর-শাশুড়ি, ৪ বছর বয়সী ছেলে, ৭ বছর বয়সী মেয়ে ও কলেজ পড়ুয়া ছোট বোনকে সঙ্গে করে রোববার মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে এসেছেন রোমানা আক্তার। কেন এসেছেন? জানতে চাইলে রোমানা বলেন, এটা কোনো প্রশ্ন হলো! এতবড় একটা ঘটনা দেখতে আসবো না? আগেও দু-দিন এসেছি। তখন সঙ্গে মেয়ে ও ছেলে আসছিল। আজ শ্বশুর-শাশুড়ি ও গ্রাম থেকে আসা ছোটবোনকে নিয়ে এসেছি। বহিরাগতদের স্কুলে প্রবেশ নিষেধ। সেখানে আপনারা প্রবেশ করছেন কেন? এমন প্রশ্নে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, সব জায়গায় তো আর বিমান পড়ে না। এমন ঘটনাও দেশে খুব কম ঘটে। আমাদের বাসা মিরপুর সাড়ে ১১-তে। কাছাকাছিই তো সবারই তো ঘটনা নিজ চোখে দেখতে ইচ্ছে করে, তাই না! সেজন্য এসেছি। স্কুলে তো ক্লাস হচ্ছে না। আটকে রাখারও তো কোনো কারণ নেই।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাসুদ আলম বলেন, আমরা রোববার থেকে ক্লাস শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মানুষের এত চাপ যে, ক্যাম্পাসের পরিবেশ স্বাভাবিক করা সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্য রোববার-আজও বন্ধ রেখেছি। আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু করা যায় কিনা, তা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। উৎসুক মানুষ ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাধা দিলে মানুষজন বিভিন্নভাবে চারদিকে জড়ো হয়ে আরও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। বহু গুজব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সেজন্য আপাতত বহিরাগতদের প্রবেশে বাধা দেয়া হচ্ছে না। তবে দ্রুতই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
গত ২১ জুলাই উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৪ জন নিহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে সরকর। দগ্ধদের অনেকেই এখনও চিকিৎসাধীন। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মেহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, বার্নে ৩৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। সিবিআর ক্যাটাগরিতে ৯ জন। বাকিরা অন্য ওয়ার্ডে ভর্তি।