দীর্ঘ সময় আতঙ্ক নিয়ে ঘরে বসে থাকায় শিশুর ভয় বাড়তে পারে ডা. হেলাল উদ্দিন , এখনও দূর-দূরান্ত থেকে পোড়া ভবন দেখতে আসছেন লোকজন
তানিসা ও মাসনুম ইসলামকে নিয়ে স্কুলে আসেন মা বাপ্পী ইসলাম। উদ্দেশ্য মেয়ে এবং নিজে কাউন্সেলিং সেবা নেবেন। কারণ তার মেয়ের গত ৮ রাত ঘুম হয় না। সারারাত জেগে থাকে আর বিমান বিধ্বস্তের কথা স্মরণ করে। ওপর দিয়ে বিমান গেলে শব্দে ভয় পায়। বাসা উত্তরা হওয়ায় দিন-রাত অনবরত বিমান যাওয়া আসা করে ওপর দিয়ে। তাই বাসায় থেকেও ভয় পাচ্ছে নবম শ্রেণীতে পড়া মেয়ে ও প্লেতে পড়া ছেলে।
মা বাপ্পী ইসলাম বলেন, ‘চোখের সামনে এত বাচ্চা, শিক্ষক মারা গেল। খুব খারাপ লাগে। এসব বাচ্চাকে দেখে আরও আতঙ্কে রয়েছে আমার দুই ছেলে-মেয়ে। আমাদের বাসার পাশে রানা নামে একজন শিক্ষকের মেয়ে মারা গেছে। আমার মেয়ে আর ওই শিক্ষকের মেয়ে একসঙ্গে স্কুলে আসা-যাওয়া করতো। এখন আমার মেয়ে একা কীভাবে স্কুলে আসবে?’
মাইলস্টোন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিয়ানা। রিয়ানা ও মুশফিকা তাবাসসুম খুব ভালো বন্ধু। ঘটনার ৮ দিন পর দুইজন একসঙ্গে স্কুলে এসেছে। তারা জানান, তখন স্কুল ছুটির সময়। হঠাৎ বিকট শব্দ। আমার কান বন্ধ হয়ে যায়। পেছনে ফিরে দেখি দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে আর কালো ধোঁয়া। হায়দার আলী ভবন পুড়ছে। আগুনে ঝলসে যাওয়ায় স্কুলের মাসুরা মিসের চেহারা দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। তখন যা দেখেছি, সবকিছুই এখনে প্রায় সময় চোখে ভেসে উঠছে। এখনও অনেক ভয় লাগে। বিমানের শব্দ কিংবা বিমান উড়ে যাওয়া দেখলেই মনে হয় আবারও মাটিতে পড়বে।
রিয়ানা বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার স্কুলে এসেছি স্কুলব্যাগ ছাড়া। কাউন্সেলিংয়ের জন্য আসা। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন। সাহস দিয়ে বলেছেন ঠিক হয়ে যাবে।’ রিয়ানার সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে কথা হয় মুশফিকার সঙ্গে। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে কতটা আতঙ্কগ্রস্ত, সেটাও অনুধাবন করা যায় তার কথা শুনে। মুশফিকার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল ঠিক সে সময় মাথার ওপর খুব নিচ দিয়ে একটি বিমান উড়ে যাচ্ছিল। সেটি দেখেই কিছুটা আতঙ্ক ভর করে তার মনে। মুশফিকার কাছে জানতে চাইলে বলে, ‘এখন প্লেনের শব্দ শুনলে মনে হয় আবার মাটিতে পড়বে। অনেক ভয় লাগে।’
গত ২১ জুলাই দুপুরে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে হঠাৎ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় হতাহতদের বাইরে রিয়ানা-মুশফিকার মতো অনেক শিক্ষার্থী এখনও মানসিক ট্রমায় ভুগছে। বিশেষ করে যারা সেদিন সরাসরি সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সাক্ষী হয়েছিল। তাদের মনে সেই আতঙ্ক এখনও কাটেনি। তাদের এই ভয়াবহ ট্রমা কাটাতে মাইলস্টোন স্কুলে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প করেছে বিমানবাহিনী এবং বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। সপ্তাহব্যাপী মেডিকেল ক্যাম্পে বিনামূল্যে সেবা দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও স্কুলে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। মূলত সবাইকে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে।
শিক্ষার্থী মুশফিকা তাবাসসুম বলেন, ‘আমার বন্ধুরা শারীরিকভাবে
আহত হয়নি, এমনি ঠিক আছি। তবে মানসিক অবস্থা আমাদের কারোরই ভালো নেই। আমাদের অনেক বন্ধু, বড় ভাইয়া-আপু ও মিসরা আগুনে পুড়েছেন। এগুলো মনে হলে অনেক ভয় লাগে। ঘুমের মধ্যেও চোখের সামনে ভাসে। আমি দুদিন কাউন্সেলিংয়ে অংশ নিয়েছি। মা নিয়ে এসেছিলেন।’
‘স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাউন্সেলিং করা হচ্ছে
কাউন্সেলিংয়ে কী জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলে মুশফিকা ও রিয়ানা জানায়, সেদিন আমরা কী দেখেছি, কী করছিলাম? এরপর আমাদের ড্রয়িং (ছবি আঁকা) করতে দেয়। কোনো কিছুতে সমস্যা হলে তাদের জানাতে বলেন। খুব সুন্দর করে ম্যামরা আমাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন।
মাইলস্টোনে স্থাপিত অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করছে বিমানবাহিনী। বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার ওয়ালিউল্লাহ খান বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলা এ ক্যাম্পে চিকিৎসা, পরামর্শ ও বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে। গত ২৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ মেডিকেল ক্যাম্প চলবে আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত। মেডিকেল টিমের সাইকোলজিস্ট ও চিকিৎসকসহ ১৭ জন সদস্য রয়েছেন স্কুলে। প্রয়োজনে সদস্য সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। প্রথমদিন সেবা দেয়া হয় ১১৮ জনকে, দ্বিতীয় দিন সেবা নেন ১৮০ জন।’
দীর্ঘ সময় আতঙ্ক নিয়ে ঘরে বসে থাকায় শিশুর ভয় বাড়তে পারে
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-তরুণ ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিশুদের মনে তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের মানসিক চাপ, হতাশা, ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি হয়। এছাড়া ঘুমের সমস্যা হয়। দীর্ঘ যে প্রতিক্রিয়া তা হলো পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার (পিটিএসডি)। এটি ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্ণতা একজন শিশুকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ধাবিত করে।’
তিনি বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে কোনো শিশুর ট্রমা রিলেটেড লক্ষণ দেখা দিলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া উচিত। পারিবারিকভাবে, স্কুলভিত্তিক ও সমাজভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে এখন পরিস্থিতি নিরাপদ, স্বাভাবিক কাজ করো। অর্থাৎ, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। অভিভাবকরা আতঙ্কিত হওয়ায় সেটা শিশুদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে উল্লেখ করে ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘শিশুরা অভিভাবকদের আতঙ্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। শিশুকে তার আগের জায়গা ফিরিয়ে দিতে হবে। দীর্ঘ সময় আতঙ্ক নিয়ে ঘরে বসে থাকায় শিশুর ভয় বাড়তে পারে। এখন সময়-সুযোগ হলেই তাদের বাইরের পরিবেশে নিয়ে স্বাভাবিক করতে হবে।’
দূর-দূরান্ত থেকে পোড়া ভবন দেখতে আসছে মানুষ
কেউ তুলছেন সেলফি, কেউ ভিডিও, কেউ আবার ভিডিও কলে অন্যদের দেখাচ্ছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পুড়ে যাওয়া হায়দার আলী ভবন। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর পুড়ে যাওয়া এ ভবন দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে আসছে মানুষ। শুক্রবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মানুষের ভিড় দেখা গেছে। কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে, কেউ ছোট শিশুদের নিয়ে, আবার কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে দেখতে এসেছেন ভয়াবহ এ দুর্ঘটনাস্থল।
অসুস্থ মাকে নিয়ে কাওলা থেকে এসেছেন নাসরিন বেগম। তিনি জানান, মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে তিনি এসেছেন এখানে। নাসরিন বেগম বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকে মা বলছিলেন এখানে আসবেন। কিন্তু ভিড়ের কথা চিন্তা করে আনা হয়নি। শুক্রবার সময় পেয়ে নিয়ে আসলাম। বিকেল সাড়ে ৪টায় স্কুল গেটের বাইরে রিকশার জট দেখা যায়। চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সপ্তাহ জুড়েই মানুষ আসছে মাইলস্টোন স্কুলটি দেখতে। বেশিরভাগ দর্শনার্থীই উত্তরার বাসিন্দা। তবে দূর থেকেও আসছেন অনেকে।
মিজান নামের এক রিকশাচালক বলেন, এখানে তিনবার আসলাম। এখন আসছি হাউজ বিল্ডিং থেকে। যিনি আসছেন তিনি আমার পরিচিত, পোড়া ভবন দেখেই চলে আসবেন। এজন্য বাইরে অপেক্ষা করছি। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেইন গেইট বাদে বাকি দুটি গেইট বন্ধ রয়েছে। স্কুলের ভেতরে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বসে থাকতে দেখা গেছে। পুড়ে যাওয়া হায়দার আলী ভবনের সামনে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী গেইট। সেই গেইটের তালা খোলা রয়েছে। দর্শনার্থীরা পুড়ে যাওয়া ভবনের কাছে গিয়ে ছবি, ভিডিও নিচ্ছিলেন। এদিন স্কুল কর্তৃপক্ষের কাউকে দেখা যায়নি।
মেইন গেইটে কথা হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নিরাপত্তাকর্মী সম্রাট হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত স্কুল গেইট খোলা রাখা হয়েছে। এলাকাবাসী আবদার করেছে দুর্ঘটনার স্থান দেখবে। এজন্য বাধ্য হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ গেইট খোলা রেখেছে। দুই বন্ধুকে নিয়ে আশুলিয়া থেকে এসেছেন আলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, বিমানটি যে শ্রেণীকক্ষে বিধ্বস্ত হয়েছে সেটি আমরা টেলিভিশনে দেখেছি। অনেক শিশু মারা গেছে। ওই জায়গাটা আমরা নিজ চোখে দেখতে এসেছি। গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৪ জন মারা গেছেন, যাদের অধিকাংশই ওই স্কুলের শিক্ষার্থী।
দীর্ঘ সময় আতঙ্ক নিয়ে ঘরে বসে থাকায় শিশুর ভয় বাড়তে পারে ডা. হেলাল উদ্দিন , এখনও দূর-দূরান্ত থেকে পোড়া ভবন দেখতে আসছেন লোকজন
শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫
তানিসা ও মাসনুম ইসলামকে নিয়ে স্কুলে আসেন মা বাপ্পী ইসলাম। উদ্দেশ্য মেয়ে এবং নিজে কাউন্সেলিং সেবা নেবেন। কারণ তার মেয়ের গত ৮ রাত ঘুম হয় না। সারারাত জেগে থাকে আর বিমান বিধ্বস্তের কথা স্মরণ করে। ওপর দিয়ে বিমান গেলে শব্দে ভয় পায়। বাসা উত্তরা হওয়ায় দিন-রাত অনবরত বিমান যাওয়া আসা করে ওপর দিয়ে। তাই বাসায় থেকেও ভয় পাচ্ছে নবম শ্রেণীতে পড়া মেয়ে ও প্লেতে পড়া ছেলে।
মা বাপ্পী ইসলাম বলেন, ‘চোখের সামনে এত বাচ্চা, শিক্ষক মারা গেল। খুব খারাপ লাগে। এসব বাচ্চাকে দেখে আরও আতঙ্কে রয়েছে আমার দুই ছেলে-মেয়ে। আমাদের বাসার পাশে রানা নামে একজন শিক্ষকের মেয়ে মারা গেছে। আমার মেয়ে আর ওই শিক্ষকের মেয়ে একসঙ্গে স্কুলে আসা-যাওয়া করতো। এখন আমার মেয়ে একা কীভাবে স্কুলে আসবে?’
মাইলস্টোন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিয়ানা। রিয়ানা ও মুশফিকা তাবাসসুম খুব ভালো বন্ধু। ঘটনার ৮ দিন পর দুইজন একসঙ্গে স্কুলে এসেছে। তারা জানান, তখন স্কুল ছুটির সময়। হঠাৎ বিকট শব্দ। আমার কান বন্ধ হয়ে যায়। পেছনে ফিরে দেখি দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে আর কালো ধোঁয়া। হায়দার আলী ভবন পুড়ছে। আগুনে ঝলসে যাওয়ায় স্কুলের মাসুরা মিসের চেহারা দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। তখন যা দেখেছি, সবকিছুই এখনে প্রায় সময় চোখে ভেসে উঠছে। এখনও অনেক ভয় লাগে। বিমানের শব্দ কিংবা বিমান উড়ে যাওয়া দেখলেই মনে হয় আবারও মাটিতে পড়বে।
রিয়ানা বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার স্কুলে এসেছি স্কুলব্যাগ ছাড়া। কাউন্সেলিংয়ের জন্য আসা। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন। সাহস দিয়ে বলেছেন ঠিক হয়ে যাবে।’ রিয়ানার সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে কথা হয় মুশফিকার সঙ্গে। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে কতটা আতঙ্কগ্রস্ত, সেটাও অনুধাবন করা যায় তার কথা শুনে। মুশফিকার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল ঠিক সে সময় মাথার ওপর খুব নিচ দিয়ে একটি বিমান উড়ে যাচ্ছিল। সেটি দেখেই কিছুটা আতঙ্ক ভর করে তার মনে। মুশফিকার কাছে জানতে চাইলে বলে, ‘এখন প্লেনের শব্দ শুনলে মনে হয় আবার মাটিতে পড়বে। অনেক ভয় লাগে।’
গত ২১ জুলাই দুপুরে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে হঠাৎ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় হতাহতদের বাইরে রিয়ানা-মুশফিকার মতো অনেক শিক্ষার্থী এখনও মানসিক ট্রমায় ভুগছে। বিশেষ করে যারা সেদিন সরাসরি সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সাক্ষী হয়েছিল। তাদের মনে সেই আতঙ্ক এখনও কাটেনি। তাদের এই ভয়াবহ ট্রমা কাটাতে মাইলস্টোন স্কুলে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প করেছে বিমানবাহিনী এবং বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। সপ্তাহব্যাপী মেডিকেল ক্যাম্পে বিনামূল্যে সেবা দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও স্কুলে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। মূলত সবাইকে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে।
শিক্ষার্থী মুশফিকা তাবাসসুম বলেন, ‘আমার বন্ধুরা শারীরিকভাবে
আহত হয়নি, এমনি ঠিক আছি। তবে মানসিক অবস্থা আমাদের কারোরই ভালো নেই। আমাদের অনেক বন্ধু, বড় ভাইয়া-আপু ও মিসরা আগুনে পুড়েছেন। এগুলো মনে হলে অনেক ভয় লাগে। ঘুমের মধ্যেও চোখের সামনে ভাসে। আমি দুদিন কাউন্সেলিংয়ে অংশ নিয়েছি। মা নিয়ে এসেছিলেন।’
‘স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাউন্সেলিং করা হচ্ছে
কাউন্সেলিংয়ে কী জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলে মুশফিকা ও রিয়ানা জানায়, সেদিন আমরা কী দেখেছি, কী করছিলাম? এরপর আমাদের ড্রয়িং (ছবি আঁকা) করতে দেয়। কোনো কিছুতে সমস্যা হলে তাদের জানাতে বলেন। খুব সুন্দর করে ম্যামরা আমাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন।
মাইলস্টোনে স্থাপিত অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করছে বিমানবাহিনী। বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার ওয়ালিউল্লাহ খান বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলা এ ক্যাম্পে চিকিৎসা, পরামর্শ ও বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে। গত ২৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ মেডিকেল ক্যাম্প চলবে আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত। মেডিকেল টিমের সাইকোলজিস্ট ও চিকিৎসকসহ ১৭ জন সদস্য রয়েছেন স্কুলে। প্রয়োজনে সদস্য সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। প্রথমদিন সেবা দেয়া হয় ১১৮ জনকে, দ্বিতীয় দিন সেবা নেন ১৮০ জন।’
দীর্ঘ সময় আতঙ্ক নিয়ে ঘরে বসে থাকায় শিশুর ভয় বাড়তে পারে
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-তরুণ ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিশুদের মনে তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের মানসিক চাপ, হতাশা, ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি হয়। এছাড়া ঘুমের সমস্যা হয়। দীর্ঘ যে প্রতিক্রিয়া তা হলো পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার (পিটিএসডি)। এটি ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্ণতা একজন শিশুকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ধাবিত করে।’
তিনি বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে কোনো শিশুর ট্রমা রিলেটেড লক্ষণ দেখা দিলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া উচিত। পারিবারিকভাবে, স্কুলভিত্তিক ও সমাজভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে এখন পরিস্থিতি নিরাপদ, স্বাভাবিক কাজ করো। অর্থাৎ, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। অভিভাবকরা আতঙ্কিত হওয়ায় সেটা শিশুদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে উল্লেখ করে ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘শিশুরা অভিভাবকদের আতঙ্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। শিশুকে তার আগের জায়গা ফিরিয়ে দিতে হবে। দীর্ঘ সময় আতঙ্ক নিয়ে ঘরে বসে থাকায় শিশুর ভয় বাড়তে পারে। এখন সময়-সুযোগ হলেই তাদের বাইরের পরিবেশে নিয়ে স্বাভাবিক করতে হবে।’
দূর-দূরান্ত থেকে পোড়া ভবন দেখতে আসছে মানুষ
কেউ তুলছেন সেলফি, কেউ ভিডিও, কেউ আবার ভিডিও কলে অন্যদের দেখাচ্ছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পুড়ে যাওয়া হায়দার আলী ভবন। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর পুড়ে যাওয়া এ ভবন দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে আসছে মানুষ। শুক্রবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মানুষের ভিড় দেখা গেছে। কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে, কেউ ছোট শিশুদের নিয়ে, আবার কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে দেখতে এসেছেন ভয়াবহ এ দুর্ঘটনাস্থল।
অসুস্থ মাকে নিয়ে কাওলা থেকে এসেছেন নাসরিন বেগম। তিনি জানান, মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে তিনি এসেছেন এখানে। নাসরিন বেগম বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকে মা বলছিলেন এখানে আসবেন। কিন্তু ভিড়ের কথা চিন্তা করে আনা হয়নি। শুক্রবার সময় পেয়ে নিয়ে আসলাম। বিকেল সাড়ে ৪টায় স্কুল গেটের বাইরে রিকশার জট দেখা যায়। চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সপ্তাহ জুড়েই মানুষ আসছে মাইলস্টোন স্কুলটি দেখতে। বেশিরভাগ দর্শনার্থীই উত্তরার বাসিন্দা। তবে দূর থেকেও আসছেন অনেকে।
মিজান নামের এক রিকশাচালক বলেন, এখানে তিনবার আসলাম। এখন আসছি হাউজ বিল্ডিং থেকে। যিনি আসছেন তিনি আমার পরিচিত, পোড়া ভবন দেখেই চলে আসবেন। এজন্য বাইরে অপেক্ষা করছি। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেইন গেইট বাদে বাকি দুটি গেইট বন্ধ রয়েছে। স্কুলের ভেতরে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বসে থাকতে দেখা গেছে। পুড়ে যাওয়া হায়দার আলী ভবনের সামনে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী গেইট। সেই গেইটের তালা খোলা রয়েছে। দর্শনার্থীরা পুড়ে যাওয়া ভবনের কাছে গিয়ে ছবি, ভিডিও নিচ্ছিলেন। এদিন স্কুল কর্তৃপক্ষের কাউকে দেখা যায়নি।
মেইন গেইটে কথা হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নিরাপত্তাকর্মী সম্রাট হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত স্কুল গেইট খোলা রাখা হয়েছে। এলাকাবাসী আবদার করেছে দুর্ঘটনার স্থান দেখবে। এজন্য বাধ্য হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ গেইট খোলা রেখেছে। দুই বন্ধুকে নিয়ে আশুলিয়া থেকে এসেছেন আলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, বিমানটি যে শ্রেণীকক্ষে বিধ্বস্ত হয়েছে সেটি আমরা টেলিভিশনে দেখেছি। অনেক শিশু মারা গেছে। ওই জায়গাটা আমরা নিজ চোখে দেখতে এসেছি। গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৪ জন মারা গেছেন, যাদের অধিকাংশই ওই স্কুলের শিক্ষার্থী।