‘জুলাই ঘোষণাপত্র বা জুলাই সনদের’ খসড়া চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী ৫ আগস্ট বিকেল ৫টায় জাতির সামনে এই সনদ উপস্থাপন করা হবে। শনিবার,(২ আগস্ট ২০২৫) দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টে এমন তথ্য জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
মৌলিক সংস্কারের ১৯টি প্রস্তাবে ৮টি বিষয়ে সব
দল একমত
বাকি ১২টিতে বিভিন্ন
দলের ভিন্নমত বা
মন্তব্যসহ সিদ্ধান্ত
আইনি ভিত্তি না দিলে
সই করবে না জামায়াত, এনসিপি
রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করা যাবে না: সিপিবিসহ কয়েকটি বাম দল
রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলমান সংলাপ শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবে ৮টি বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে। ১২টিতে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত বা মন্তব্যসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
খসড়া ‘জুলাই সনদ’ হাতে পাওয়ার পর দলগুলো বলছে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে তা নিয়ে তৈরি এ সনদে সবার স্বাক্ষর করার কথা। তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়া এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বলছে, এই সনদের সাংবিধানিক অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন নেই। তবে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, সনদের সাংবিধানিক তথা আইনি ভিত্তি না হলে তারা এতে সই করবে না।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ নিয়ে যে প্রশ্ন, সে বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘এ বিষয়ে কমিশন দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেছে। এ ক্ষেত্রে কমিশন অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করবে। এর বাইরেও যতটুকু প্রয়োজন, সবাইকে সমন্বিত করে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। তার আগে জাতীয় সনদকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া দরকার। আগামী কয়েকদিন কমিশন সে কাজ করবে। তারপর বাস্তবায়নের পথ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে।’
গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত বিষয় এই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নিজেরাই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নামে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঘোষণা দেয়া হবে যার নাম হবে ‘জুলাই সনদ’। তবে সনদ ঘোষণায় বিলম্ব হওয়ার কারণে ছাত্রদের গড়া সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অন্তর্বর্তী সরকারকে একাধিকবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে, দ্রুত জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে, অন্যথায় রাজপথে নামবে এনসিপি।
অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি সামনে রেখে সম্প্রতি ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ চূড়ান্ত খসড়া বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-সহ বিভিন্ন দলকে পাঠায় অন্তর্বর্তী সরকার।
ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আলোচনায় যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও ঐকমত্য হয়েছে, দলগুলোর পরামর্শ বা সংশোধনী নিয়ে সেগুলো সমন্বয় করে জুলাই
সনদ খুব দ্রুত চূড়ান্ত করা হবে। এরপর সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর সই নেয়া হবে। এরপর জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেটা নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। এ বিষয়ে আজ ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে জানা গেছে।
ঘোষণাপত্রের খসড়ায় ২৬টি দফা রয়েছে। প্রথম ২১ দফায় মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের মানুষের অতীতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। পরের ৫টি দফায় রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের আকাক্সক্ষা, আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুম-খুন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধের দ্রুত উপযুক্ত বিচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কটিতে একমত হয়েছে, তার তালিকা থাকবে এই সনদে’।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারে যে ১১টি কমিশন গঠন করে, সে সব কমিশনের বিশেষ করে ছয়টি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করছে ঐকমত্য কমিশন। এতে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারসংক্রান্ত মোট ১৬৬টি সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ধারাবাহিক এই আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
এই কমিশন প্রথম পর্বে (২০ মার্চ-১৯ মে) দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করে। প্রস্তাবিত বিভিন্ন সংস্কার পদক্ষেপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ৪৫ দিনের আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে প্রথম পর্বে ৬২টি বিষয়ে ‘ঐকমত্যে’ পৌঁছার কথা বলেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি, এমন ২০টির মতো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত ২ জুন থেকে সব দলকে নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন, যা গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়।
ঐকমত্য কমিশন জানায়, ২৩ দিনের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় মৌলিক সংস্কারের ১৯টি প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৮টি বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে। বাকি ১২টিতে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত বা মন্তব্যসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
*সব দল একমত*
১। সংসদীয় কমিটির সভাপতিত্ব ২। নির্বাচনী এলাকার সীমানা ৩। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান ৪। জরুরি অবস্থা ঘোষণা ৫। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল ৬। নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সম্প্রসারণ ৭। বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ৮। পুলিশ কমিশন গঠন
*ভিন্নমতসহ সিদ্ধান্ত*
১। ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন ২। প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান ৩। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করা ৪। নারী প্রতিনিধিত্ব ৫। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন ৬। উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও উচ্চকক্ষের ক্ষমতা ৭। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ৮। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব ৯। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ১০। রাষ্ট্রের মূলনীতি
*অন্যান্য*
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। (কর্মে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির বিষয়ে ঐকমত্য, তবে বিএনপি ২টি বিকল্প রাখার পক্ষে যা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে রাখবে)
*দলগুলোর প্রতিক্রিয়া*
‘জুলাই সনদে যেসব সুপারিশ থাকবে, সেগুলো দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে বলে সব রাজনৈতিক দল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এটা বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের যেসব সংশোধনী প্রয়োজন হবে, সেগুলো আমরা (বিএনপি) করব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের মতে, সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনা এবং তাতে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ খুবই ইতিবাচক।
তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি কী হবে, এর বাস্তবায়ন কীভাবে ও কখন হবে, এ বিষয়ে বিরাট ফাঁক রয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি। এই সনদ আইনি ভিত্তি না পেলে জামায়াত তাতে সই করবে না বলেও জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির। প্রয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে মামলার হুমকিও দিয়েছেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারাও বলছেন, জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না হলে তারা সনদে সই করবেন না। তাদের অভিযোগ, ‘বিএনপি জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি তথা আইনি ভিত্তি দিতে চাচ্ছে না। যদি আইনি ভিত্তি না দেয়া হয় তাহলে জুলাই সনদে গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে না। এবং এটি এনপিসি কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিম্ন কক্ষের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) বিষয়টি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপে এজেন্ডায় না রাখায় নিন্দা জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে গতকাল শুক্রবার দলটি এক পর্যালোচনা বৈঠক করে। সেখানে দলের একাধিক নেতা সাধারণ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির দাবির বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন এজেন্ডা না রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে পরিবর্তনের প্রস্তাবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদ ও জেএসডি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি পরিবর্তনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদের নেতারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা থেকে ওয়াকআউটও করেছেন। এ দলগুলো জানিয়েছে এই মূলনীতি বাদ দেয়া হলে তারা সনদে সই করবেন না।
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫
‘জুলাই ঘোষণাপত্র বা জুলাই সনদের’ খসড়া চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী ৫ আগস্ট বিকেল ৫টায় জাতির সামনে এই সনদ উপস্থাপন করা হবে। শনিবার,(২ আগস্ট ২০২৫) দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টে এমন তথ্য জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
মৌলিক সংস্কারের ১৯টি প্রস্তাবে ৮টি বিষয়ে সব
দল একমত
বাকি ১২টিতে বিভিন্ন
দলের ভিন্নমত বা
মন্তব্যসহ সিদ্ধান্ত
আইনি ভিত্তি না দিলে
সই করবে না জামায়াত, এনসিপি
রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করা যাবে না: সিপিবিসহ কয়েকটি বাম দল
রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলমান সংলাপ শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবে ৮টি বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে। ১২টিতে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত বা মন্তব্যসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
খসড়া ‘জুলাই সনদ’ হাতে পাওয়ার পর দলগুলো বলছে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে তা নিয়ে তৈরি এ সনদে সবার স্বাক্ষর করার কথা। তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়া এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বলছে, এই সনদের সাংবিধানিক অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন নেই। তবে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, সনদের সাংবিধানিক তথা আইনি ভিত্তি না হলে তারা এতে সই করবে না।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ নিয়ে যে প্রশ্ন, সে বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘এ বিষয়ে কমিশন দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেছে। এ ক্ষেত্রে কমিশন অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করবে। এর বাইরেও যতটুকু প্রয়োজন, সবাইকে সমন্বিত করে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। তার আগে জাতীয় সনদকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া দরকার। আগামী কয়েকদিন কমিশন সে কাজ করবে। তারপর বাস্তবায়নের পথ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে।’
গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত বিষয় এই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নিজেরাই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নামে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঘোষণা দেয়া হবে যার নাম হবে ‘জুলাই সনদ’। তবে সনদ ঘোষণায় বিলম্ব হওয়ার কারণে ছাত্রদের গড়া সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অন্তর্বর্তী সরকারকে একাধিকবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে, দ্রুত জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে, অন্যথায় রাজপথে নামবে এনসিপি।
অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি সামনে রেখে সম্প্রতি ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ চূড়ান্ত খসড়া বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-সহ বিভিন্ন দলকে পাঠায় অন্তর্বর্তী সরকার।
ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আলোচনায় যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও ঐকমত্য হয়েছে, দলগুলোর পরামর্শ বা সংশোধনী নিয়ে সেগুলো সমন্বয় করে জুলাই
সনদ খুব দ্রুত চূড়ান্ত করা হবে। এরপর সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর সই নেয়া হবে। এরপর জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেটা নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। এ বিষয়ে আজ ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে জানা গেছে।
ঘোষণাপত্রের খসড়ায় ২৬টি দফা রয়েছে। প্রথম ২১ দফায় মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের মানুষের অতীতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। পরের ৫টি দফায় রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের আকাক্সক্ষা, আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুম-খুন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধের দ্রুত উপযুক্ত বিচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কটিতে একমত হয়েছে, তার তালিকা থাকবে এই সনদে’।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারে যে ১১টি কমিশন গঠন করে, সে সব কমিশনের বিশেষ করে ছয়টি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করছে ঐকমত্য কমিশন। এতে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারসংক্রান্ত মোট ১৬৬টি সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ধারাবাহিক এই আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
এই কমিশন প্রথম পর্বে (২০ মার্চ-১৯ মে) দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করে। প্রস্তাবিত বিভিন্ন সংস্কার পদক্ষেপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ৪৫ দিনের আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে প্রথম পর্বে ৬২টি বিষয়ে ‘ঐকমত্যে’ পৌঁছার কথা বলেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি, এমন ২০টির মতো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত ২ জুন থেকে সব দলকে নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন, যা গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়।
ঐকমত্য কমিশন জানায়, ২৩ দিনের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় মৌলিক সংস্কারের ১৯টি প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৮টি বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে। বাকি ১২টিতে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত বা মন্তব্যসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
*সব দল একমত*
১। সংসদীয় কমিটির সভাপতিত্ব ২। নির্বাচনী এলাকার সীমানা ৩। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান ৪। জরুরি অবস্থা ঘোষণা ৫। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল ৬। নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সম্প্রসারণ ৭। বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ৮। পুলিশ কমিশন গঠন
*ভিন্নমতসহ সিদ্ধান্ত*
১। ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন ২। প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান ৩। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করা ৪। নারী প্রতিনিধিত্ব ৫। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন ৬। উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও উচ্চকক্ষের ক্ষমতা ৭। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ৮। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব ৯। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ১০। রাষ্ট্রের মূলনীতি
*অন্যান্য*
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। (কর্মে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির বিষয়ে ঐকমত্য, তবে বিএনপি ২টি বিকল্প রাখার পক্ষে যা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে রাখবে)
*দলগুলোর প্রতিক্রিয়া*
‘জুলাই সনদে যেসব সুপারিশ থাকবে, সেগুলো দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে বলে সব রাজনৈতিক দল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এটা বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের যেসব সংশোধনী প্রয়োজন হবে, সেগুলো আমরা (বিএনপি) করব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের মতে, সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনা এবং তাতে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ খুবই ইতিবাচক।
তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি কী হবে, এর বাস্তবায়ন কীভাবে ও কখন হবে, এ বিষয়ে বিরাট ফাঁক রয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি। এই সনদ আইনি ভিত্তি না পেলে জামায়াত তাতে সই করবে না বলেও জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির। প্রয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে মামলার হুমকিও দিয়েছেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারাও বলছেন, জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না হলে তারা সনদে সই করবেন না। তাদের অভিযোগ, ‘বিএনপি জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি তথা আইনি ভিত্তি দিতে চাচ্ছে না। যদি আইনি ভিত্তি না দেয়া হয় তাহলে জুলাই সনদে গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে না। এবং এটি এনপিসি কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিম্ন কক্ষের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) বিষয়টি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপে এজেন্ডায় না রাখায় নিন্দা জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে গতকাল শুক্রবার দলটি এক পর্যালোচনা বৈঠক করে। সেখানে দলের একাধিক নেতা সাধারণ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির দাবির বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন এজেন্ডা না রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে পরিবর্তনের প্রস্তাবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদ ও জেএসডি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি পরিবর্তনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদের নেতারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা থেকে ওয়াকআউটও করেছেন। এ দলগুলো জানিয়েছে এই মূলনীতি বাদ দেয়া হলে তারা সনদে সই করবেন না।
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।