জুলাই আন্দোলনে কীভাবে নিজেদের সন্তান হারিয়েছেন, শত শত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে সেই যন্ত্রণার কথা শোনালেন দুই মা। দুইজনেরই মৃত্যু হয় গত ১৯ জুলাই। এদের মধ্যে রাজন গুলিবিদ্ধ হয় ঢাকার মিরপুর এলাকায়, মেহেদী নামের অন্যজনের গুলি লাগে মহাখালীতে।
শনিবার,(২ আগস্ট ২০২৫) ঢাকায় ‘জুলাইয়ের মায়েরা’ শীর্ষক অভিভাবক সমাবেশে রাজনের মা বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে বড় করেছি, ওর বাবা নেই। তিলে তিলে আমার আম্মা আর আমি ওদের মানুষ করেছি। ‘সেদিন (গত ১৯ জুলাই) জুমার নামাজ পড়ে দুধ-কলা দিয়ে ভাত খেয়ে রাজন বাসা থেকে বের হয়। যাওয়ার আগে আমাকে বলে, ‘আম্মু আমার ওপর কোনো দায়-দাবি রেখ না’। আমি বলি, ‘আব্বু, আজ নেট বন্ধ করে দিছে, তুমি বাইরে যেও না, কেন যাও?’
তিনি বলেন, ’পরে ও বের হয়ে যায়। মোবাইলে কথা হয়। পরে কল দিলে কেটে দেয়। পরিবারের সবাইকে বলি, রাজনকে একটু কল দিতে। কিন্তু আর যোগাযোগ করতে পারিনি। আছরের শেষ, মাগরিবের নামাজের আগে ফোন আসে। জানানো হয়, রাজন আর এই জগতে নেই।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সন্তান হারানো এ মা বলেন, ‘জগৎটা এত খারাপ, আমি কখনো ভাবিনি, আমার ছেলে আমাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে। যখন হাসপাতালে নিয়ে যায়, তখন ওকে নিচে রেখে দেয়। আমি লাশ আনতে যেতে পারিনি, আমার মেয়ে গিয়ে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লাশ নিয়ে আসে। ‘মায়ের কাঁধে ছেলে। ছেলে মাকে মাটি দিবে। সেই ছেলেকে মা কাঁধে নিয়ে মাটি দিছে। সবাই ভয় দেখায়ছে, আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। পরে মোবাইলে যা ছিলে, সব ডিলিট করে দেয়।’
এ দিন ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এ অভিভাবক সমাবেশ আয়োজন করা হয়। এর সঙ্গে ‘মাদার্স অব জুলাই’ শীর্ষক চলচ্চিত্র প্রদর্শনীও আয়োজন করে ঢাকা জেলা প্রশাসন।
সমাবেশে ইমাম মেহেদী হাসানের মা কুলসুমা আক্তার বলেন, ‘সেদিন জুমার নামাজ পড়ে ছেলে বাসায় আসে। আমরা একসঙ্গে খাবার-দাবার খাই। এরপর আমরা বসে ছিলাম। সেদিন আমার ইন্স্যুরেন্সের কাজে ডিউটি ছিল। মেহেদী বলে, ‘আম্মু আমি বাইরে যাব’। আমি যেতে বারণ করি। পরে অনুরোধ করে, ‘আম্মু আমি যাই’। আমি না করি। আমি না করে বলি, তুমি বাসায় থাক। আমার কাছে সে ২০ টাকা চায়। আমি ওকে ১০০ টাকা দেই। তখন মেহেদী একটা হাসি দিছে। ওর সেই হাসিটা এখনও চোখে ভাসে।’
তিনি বলেন, ‘কালেকশন করতে করতে একপর্যায়ে আমি মহাখালীর পাগলার পুল এলাকায় চলে যাই। তখন দেখি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করতেছে। আমার মনটা যেন কেমন করছিল। মেহেদীকে ফোন দিয়ে জানতে চাই, কী অবস্থা, ও কোথায় আছে। মেহেদী জানায়, ও পাগলার পুলে আছে। আমাকে বলে, ‘তুমি এখানে আসছ কেন? এখানে অনেক গোলাগুলি হচ্ছে।’ আমাকে বাসায় যেতে বলে। আমি বলি, তুই আয়, আমরা একসঙ্গে যাব। বলে, ‘তুমি দাঁড়াও, আমি আসতেছি’।’
কুলসুমা আক্তার বলেন, ‘অনেকক্ষণ হয়ে যায়, ও আর আসে না। আধা ঘণ্টা পর ওর ফোন থেকে আমার মোবাইলে ফোন আসে। আমি ফোন রিসিভ করি না। আশপাশে তাকিয়ে দেখি মেহেদী কই। কিন্তু মেহেদীকে কোথাও দেখা যায় না। তখন আবার কল ব্যাক করি। ওর বন্ধু ফোন রিসিভ করে। মেহেদী কোথায় জানতে চাই। আমাকে তাড়াতাড়ি সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে যেতে বলে।
‘আমি জিজ্ঞাসা করি, কী হয়েছে মেহেদীর। বলে, মেহেদীর রাবার বুলেট লাগছে। বলে, ‘পরে বলব, আপনি তাড়াতাড়ি আসেন’। পরে আমি মহাখালী রেলগেইট থেকে বাসায় আসি। বাসা থেকে টাকা নিয়ে, মেহেদীর বাবাকে ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে যাই।’ তিনি বলেন, ‘সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ছেলে পেটে হাত দিয়ে, দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। ভুঁড়ির কিছু অংশ পেট থেকে বের হয়ে গেছে। পেছন দিয়ে, সামনে দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। চিৎকার দিয়ে বলি, মেহেদী আমাদের কথা শুনলি না বাবা, আম্মুর কথা শুনলি না।
‘মেহেদী আমাকে সাহস দেয়। বলে, ‘আম্মু আমার কিছু হয় নাই’। আমার গুলি লাগছে, গুলি তো বের হয়ে গেছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে দ্রুত ওটিতে নিয়ে যেতে বলে। ওটিতে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানায়, ওর অনেক রক্ত লাগবে। একজন সিস্টার জানায়, ছাত্রদের জানালে ওরা ম্যানেজ করে দেবে। আমি ওদের গিয়ে বলি, বাবারা, আমার একমাত্র ছেলেটা রক্তের অভাবে মারা যাচ্ছে। ওকে বাঁচাও তোমরা। ওরা চার ব্যাগ রক্ত কালেক্ট করে দেয়।’
এই মা বলতে থাকেন, ‘সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে মেহেদীর অস্ত্রোপচার শুরু হয়। সাড়ে ১০টার দিকে ডাক্তার বের হয়। জানায়, মেহেদী কোমায় চলে গেছে। আমাদের আইসিইউ নাই। অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ওরা ওকে রাখবে না। ‘আমি ঘুরে দেখি অনেক আইসিইউ খালি। সোহ্রাওয়ার্দীতে আর রাখেনি। সাড়ে ১২টা-১টার দিকে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করাই। সারারাত ও ভালোই ছিল। সকাল ১০টার দিকে চোখটা নাড় ছিল। ডাক্তার আমাকে ওর কাছে নিয়ে যায়। ওখানে গেলে মেহেদী আমার কাছে জানতে চায়, তার ফোন কই। আমি বলি আমার কাছে আছে। আমার কাছে ইট চায় পুলিশকে মারার জন্য। আমি ওকে জানাই, ও হাসপাতালে আছে। আমার সঙ্গে ১০-১৫ মিনিট কথা বলে।
‘একপর্যায়ে রক্ত বমি করে। ওর কণ্ঠ কেমন যেন ভারী হয়ে যায়। আমাকে ডাকে। বলে, আম্মু আমি তো শহীদ হয়ে যাব। কে যেন আমাকে ডাকতেছে। আমি বলি, না বাবা একথা বল না। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট করে পালছি। আমি এটা সহ্য করতে পারবো না। বলে, না আম্মু আমি শহীদ হয়ে যাব।’ ইমাম মেহেদী হাসানের নাম শহীদদের তালিকায় ওঠেনি। তার নামটা শহীদদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান তিনি।
শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫
জুলাই আন্দোলনে কীভাবে নিজেদের সন্তান হারিয়েছেন, শত শত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে সেই যন্ত্রণার কথা শোনালেন দুই মা। দুইজনেরই মৃত্যু হয় গত ১৯ জুলাই। এদের মধ্যে রাজন গুলিবিদ্ধ হয় ঢাকার মিরপুর এলাকায়, মেহেদী নামের অন্যজনের গুলি লাগে মহাখালীতে।
শনিবার,(২ আগস্ট ২০২৫) ঢাকায় ‘জুলাইয়ের মায়েরা’ শীর্ষক অভিভাবক সমাবেশে রাজনের মা বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে বড় করেছি, ওর বাবা নেই। তিলে তিলে আমার আম্মা আর আমি ওদের মানুষ করেছি। ‘সেদিন (গত ১৯ জুলাই) জুমার নামাজ পড়ে দুধ-কলা দিয়ে ভাত খেয়ে রাজন বাসা থেকে বের হয়। যাওয়ার আগে আমাকে বলে, ‘আম্মু আমার ওপর কোনো দায়-দাবি রেখ না’। আমি বলি, ‘আব্বু, আজ নেট বন্ধ করে দিছে, তুমি বাইরে যেও না, কেন যাও?’
তিনি বলেন, ’পরে ও বের হয়ে যায়। মোবাইলে কথা হয়। পরে কল দিলে কেটে দেয়। পরিবারের সবাইকে বলি, রাজনকে একটু কল দিতে। কিন্তু আর যোগাযোগ করতে পারিনি। আছরের শেষ, মাগরিবের নামাজের আগে ফোন আসে। জানানো হয়, রাজন আর এই জগতে নেই।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সন্তান হারানো এ মা বলেন, ‘জগৎটা এত খারাপ, আমি কখনো ভাবিনি, আমার ছেলে আমাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে। যখন হাসপাতালে নিয়ে যায়, তখন ওকে নিচে রেখে দেয়। আমি লাশ আনতে যেতে পারিনি, আমার মেয়ে গিয়ে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লাশ নিয়ে আসে। ‘মায়ের কাঁধে ছেলে। ছেলে মাকে মাটি দিবে। সেই ছেলেকে মা কাঁধে নিয়ে মাটি দিছে। সবাই ভয় দেখায়ছে, আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। পরে মোবাইলে যা ছিলে, সব ডিলিট করে দেয়।’
এ দিন ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এ অভিভাবক সমাবেশ আয়োজন করা হয়। এর সঙ্গে ‘মাদার্স অব জুলাই’ শীর্ষক চলচ্চিত্র প্রদর্শনীও আয়োজন করে ঢাকা জেলা প্রশাসন।
সমাবেশে ইমাম মেহেদী হাসানের মা কুলসুমা আক্তার বলেন, ‘সেদিন জুমার নামাজ পড়ে ছেলে বাসায় আসে। আমরা একসঙ্গে খাবার-দাবার খাই। এরপর আমরা বসে ছিলাম। সেদিন আমার ইন্স্যুরেন্সের কাজে ডিউটি ছিল। মেহেদী বলে, ‘আম্মু আমি বাইরে যাব’। আমি যেতে বারণ করি। পরে অনুরোধ করে, ‘আম্মু আমি যাই’। আমি না করি। আমি না করে বলি, তুমি বাসায় থাক। আমার কাছে সে ২০ টাকা চায়। আমি ওকে ১০০ টাকা দেই। তখন মেহেদী একটা হাসি দিছে। ওর সেই হাসিটা এখনও চোখে ভাসে।’
তিনি বলেন, ‘কালেকশন করতে করতে একপর্যায়ে আমি মহাখালীর পাগলার পুল এলাকায় চলে যাই। তখন দেখি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করতেছে। আমার মনটা যেন কেমন করছিল। মেহেদীকে ফোন দিয়ে জানতে চাই, কী অবস্থা, ও কোথায় আছে। মেহেদী জানায়, ও পাগলার পুলে আছে। আমাকে বলে, ‘তুমি এখানে আসছ কেন? এখানে অনেক গোলাগুলি হচ্ছে।’ আমাকে বাসায় যেতে বলে। আমি বলি, তুই আয়, আমরা একসঙ্গে যাব। বলে, ‘তুমি দাঁড়াও, আমি আসতেছি’।’
কুলসুমা আক্তার বলেন, ‘অনেকক্ষণ হয়ে যায়, ও আর আসে না। আধা ঘণ্টা পর ওর ফোন থেকে আমার মোবাইলে ফোন আসে। আমি ফোন রিসিভ করি না। আশপাশে তাকিয়ে দেখি মেহেদী কই। কিন্তু মেহেদীকে কোথাও দেখা যায় না। তখন আবার কল ব্যাক করি। ওর বন্ধু ফোন রিসিভ করে। মেহেদী কোথায় জানতে চাই। আমাকে তাড়াতাড়ি সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে যেতে বলে।
‘আমি জিজ্ঞাসা করি, কী হয়েছে মেহেদীর। বলে, মেহেদীর রাবার বুলেট লাগছে। বলে, ‘পরে বলব, আপনি তাড়াতাড়ি আসেন’। পরে আমি মহাখালী রেলগেইট থেকে বাসায় আসি। বাসা থেকে টাকা নিয়ে, মেহেদীর বাবাকে ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে যাই।’ তিনি বলেন, ‘সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ছেলে পেটে হাত দিয়ে, দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। ভুঁড়ির কিছু অংশ পেট থেকে বের হয়ে গেছে। পেছন দিয়ে, সামনে দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। চিৎকার দিয়ে বলি, মেহেদী আমাদের কথা শুনলি না বাবা, আম্মুর কথা শুনলি না।
‘মেহেদী আমাকে সাহস দেয়। বলে, ‘আম্মু আমার কিছু হয় নাই’। আমার গুলি লাগছে, গুলি তো বের হয়ে গেছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে দ্রুত ওটিতে নিয়ে যেতে বলে। ওটিতে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানায়, ওর অনেক রক্ত লাগবে। একজন সিস্টার জানায়, ছাত্রদের জানালে ওরা ম্যানেজ করে দেবে। আমি ওদের গিয়ে বলি, বাবারা, আমার একমাত্র ছেলেটা রক্তের অভাবে মারা যাচ্ছে। ওকে বাঁচাও তোমরা। ওরা চার ব্যাগ রক্ত কালেক্ট করে দেয়।’
এই মা বলতে থাকেন, ‘সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে মেহেদীর অস্ত্রোপচার শুরু হয়। সাড়ে ১০টার দিকে ডাক্তার বের হয়। জানায়, মেহেদী কোমায় চলে গেছে। আমাদের আইসিইউ নাই। অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ওরা ওকে রাখবে না। ‘আমি ঘুরে দেখি অনেক আইসিইউ খালি। সোহ্রাওয়ার্দীতে আর রাখেনি। সাড়ে ১২টা-১টার দিকে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করাই। সারারাত ও ভালোই ছিল। সকাল ১০টার দিকে চোখটা নাড় ছিল। ডাক্তার আমাকে ওর কাছে নিয়ে যায়। ওখানে গেলে মেহেদী আমার কাছে জানতে চায়, তার ফোন কই। আমি বলি আমার কাছে আছে। আমার কাছে ইট চায় পুলিশকে মারার জন্য। আমি ওকে জানাই, ও হাসপাতালে আছে। আমার সঙ্গে ১০-১৫ মিনিট কথা বলে।
‘একপর্যায়ে রক্ত বমি করে। ওর কণ্ঠ কেমন যেন ভারী হয়ে যায়। আমাকে ডাকে। বলে, আম্মু আমি তো শহীদ হয়ে যাব। কে যেন আমাকে ডাকতেছে। আমি বলি, না বাবা একথা বল না। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট করে পালছি। আমি এটা সহ্য করতে পারবো না। বলে, না আম্মু আমি শহীদ হয়ে যাব।’ ইমাম মেহেদী হাসানের নাম শহীদদের তালিকায় ওঠেনি। তার নামটা শহীদদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান তিনি।