বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের ‘চরম নির্মমতার’ শিকার খোকন চন্দ্র বর্মণ। পুলিশের গুলিতে তার বাম চোখ, মুখ, নাক নষ্ট হয়ে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় দমন-পীড়নের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, তার প্রথম কোনো মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু
শেখ হাসিনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার: অ্যাটর্নি জেনারেল
রোববার,(০৩ আগস্ট ২০২৫) ট্রাইব্যুনাললে নিজের ওপর সংঘটিত নৃশংস আচরণের বর্ণনা দেন তিনি। এ সময় তিনি যাত্রাবাড়ী থানার সামনে মানুষ হত্যার বিবরণও উল্লেখ করেন। এজন্য তিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক এমপি শামীম ওসমান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দায়ী করেন।
সে সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। বেলা সাড়ে ১১টায় বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ শুনানির পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের একথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা শাস্তি চাই আইনি পরিকাঠামোয়। যে উপাদান প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনবে সেগুলো বিশ্লেষণ করে এবং সাক্ষ্য শুনে আগামী প্রজন্মের জন্য ন্যায়বিচার চাই।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিগত আমলে গুম-খুনের পলিটিক্যাল কালচার তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এমন একটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যেখানে খুনের রাজনীতি আর থাকবে না।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও আসামি। এই মামলায় সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন আসামি হলেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন। এখন তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন।
‘বাঁচার আশা’ ছেড়ে
দিয়েছিলেন খোকন
মামলার প্রথম সাক্ষী হিসেবে ২৩ বছর বয়সী খোকন চন্দ্র বর্মণ আদালতে সাক্ষ্য দেন। যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তার বাঁ চোখ নষ্ট হয়ে গেছে এবং নাক-মুখে গুরুতর জখম হয়েছে। দেশে চিকিৎসার পর তাকে রাশিয়ায় পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য।
খোকন ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। পরদিন ফের আন্দোলনে বের হলে ভুঁইঘর থেকে জালকুঁড়ির দিকে যাওয়ার পথে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হন। এরপর থেকেই তিনি নিয়মিত আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ৫ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে সাইনবোর্ড মোড়ে অবস্থান নেন। পরে ঢাকার দিকে মিছিল গেলে দুপুরে যাত্রাবাড়ী পৌঁছালে পুলিশের গুলিতে অনেকেই নিহত ও আহত হন।
খোকনের ভাষ্য, “তারা ‘স্বৈরাচার, ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিচ্ছিলেন। সামনে এগোতেই পুলিশ আবার গুলি চালায়। একজনের মাথা ছেদ করে গুলি বেরিয়ে যায়, আরেকজনও আহত হন।”
তিনি বলেন, ‘পরে সেনাবাহিনী এসে পুলিশকে চলে যেতে বলে এবং সেখানে অবস্থান নেয়। খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, এরপর সেনাবাহিনী চলে যায়। তখন পুলিশ ফের বেরিয়ে এসে ‘পাখির মতো’ গুলি চালায়। ফ্লাইওভারের নিচে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন।’
মুখে গুলি লাগলে তিনি ছটফট করতে থাকেন। এ সময় মুখের মাস্ক সরিয়ে ক্ষতবিক্ষত চেহারা ট্রাইব্যুনালের সামনে তুলে ধরেন।
তিনি জানান, ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মুগদা, ঢাকা মেডিকেল, মিরপুর ডেন্টাল, এরপর বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা হয়। ১০ দিন ছিলেন আইসিইউতে। চিকিৎসা শেষ না হওয়ায় তাকে রাশিয়ায় পাঠানো হয় এবং ৭ এপ্রিল দেশে ফেরেন। আবার ১২ আগস্ট চিকিৎসার জন্য রাশিয়া যাবেন, ১৮ আগস্ট তার অপারেশন।
তিনি শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ওবায়দুল কাদের, শামীম ওসমানের বিচার চান। তাদের বিরুদ্ধে ‘হাজার হাজার মানুষ হত্যার’ অভিযোগ তোলেন।
‘সত্য বলেছি’ বললেন খোকন
সাক্ষ্য শেষে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন তাকে জেরা করেন। তিনি দাবি করেন, পুলিশ গুলি চালায়নি; আন্দোলনকারীরাই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের আহত করেছেন।
খোকন বলেন, ‘এটা সত্য না।’
আইনজীবী আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও অন্যরা দায়ী নন, খোকন সত্য গোপন করে অসত্য জবানবন্দী দিয়েছেন।’
জবাবে খোকন বলেন, ‘সত্য জবানবন্দী দিয়েছি।’
সাক্ষ্য ও জেরা শেষে আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য সোমবার দিন ধার্য করে শুনানি মুলতবি করে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় (সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি)’র এ মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই শেষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জমা দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার রয়েছে। সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন ৮১ জন।
শেখ হাসিনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার: অ্যাটর্নি জেনারেল
রোববার প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য শুরুর আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে শেখ হাসিনার মতো কোনো স্বৈরাচারের জন্ম হয়নি। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার।
সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘আজকের (রোববার) দিনটি ঐতিহাসিক। কোনো স্বৈরাচারকে মিথ্যার ওপর পিএইচডি করতে হলে তাকে শেখ হাসিনার কাছে শিখতে হবে। পৃথিবীর সব স্বৈরশাসকের যদি কোনো সমিতি করা হয়, শেখ হাসিনা হবেন তার সভাপতি। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আমরা স্বৈরাচার ও তার সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল পৃথিবীর কোন স্বৈরাচারের কী পরিণতি হয়েছে, তা ট্রাইব্যুনালের সামনে তুলে ধরেন। জুলাই-আগস্টে গণহত্যার ন্যায়বিচার চেয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্র অনেক এগিয়েছে। আগের ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদ- নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের সামনে যে জুলাই হত্যাকা- ঘটেছে, তার সঠিক বিচার চাই। তবে আমরা অমানবিক বিচার চাই না।’
এ সময় তিনি ইংল্যান্ডের ও লিভার ক্রোমওয়েলের বর্ণনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ন্যায়বিচারের জন্য আমরা এখানে এসেছি। এমন একটি বিচার সম্পন্ন হোক, যে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘গেল ১৬ বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে খুন-চাঁদাবাজি, রাতে ভোট করা, বিদেশে টাকা পাচারসহ সব ধরনের অনিয়ম করা হতো। আর এসবের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলন হয়। টানা ৩৬ দিনের সেই আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনাসহ এমপি-মন্ত্রীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিথ্যা কথার জন্য পিএইচডি করতে হলে হিটলারও শেখ হাসিনার কাছে আসতেন। তবে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষোভ নেই। আমরা অপরাধের বিরুদ্ধে এসেছি। আমরা ন্যায়বিচার চাই, দেশের মানুষের স্বপ্নের বিচার চাই। ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়েই আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি চাইব। যুগ সন্ধিক্ষণে ন্যায়বিচারের জন্য দাঁড়িয়েছি। শুধু রাষ্ট্রপক্ষ নয়, সবাই ন্যায়বিচার পাবেন।’
রোববার, ০৩ আগস্ট ২০২৫
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের ‘চরম নির্মমতার’ শিকার খোকন চন্দ্র বর্মণ। পুলিশের গুলিতে তার বাম চোখ, মুখ, নাক নষ্ট হয়ে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় দমন-পীড়নের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, তার প্রথম কোনো মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু
শেখ হাসিনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার: অ্যাটর্নি জেনারেল
রোববার,(০৩ আগস্ট ২০২৫) ট্রাইব্যুনাললে নিজের ওপর সংঘটিত নৃশংস আচরণের বর্ণনা দেন তিনি। এ সময় তিনি যাত্রাবাড়ী থানার সামনে মানুষ হত্যার বিবরণও উল্লেখ করেন। এজন্য তিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক এমপি শামীম ওসমান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দায়ী করেন।
সে সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। বেলা সাড়ে ১১টায় বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ শুনানির পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের একথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা শাস্তি চাই আইনি পরিকাঠামোয়। যে উপাদান প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনবে সেগুলো বিশ্লেষণ করে এবং সাক্ষ্য শুনে আগামী প্রজন্মের জন্য ন্যায়বিচার চাই।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিগত আমলে গুম-খুনের পলিটিক্যাল কালচার তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এমন একটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যেখানে খুনের রাজনীতি আর থাকবে না।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও আসামি। এই মামলায় সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন আসামি হলেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন। এখন তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন।
‘বাঁচার আশা’ ছেড়ে
দিয়েছিলেন খোকন
মামলার প্রথম সাক্ষী হিসেবে ২৩ বছর বয়সী খোকন চন্দ্র বর্মণ আদালতে সাক্ষ্য দেন। যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তার বাঁ চোখ নষ্ট হয়ে গেছে এবং নাক-মুখে গুরুতর জখম হয়েছে। দেশে চিকিৎসার পর তাকে রাশিয়ায় পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য।
খোকন ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। পরদিন ফের আন্দোলনে বের হলে ভুঁইঘর থেকে জালকুঁড়ির দিকে যাওয়ার পথে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হন। এরপর থেকেই তিনি নিয়মিত আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ৫ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে সাইনবোর্ড মোড়ে অবস্থান নেন। পরে ঢাকার দিকে মিছিল গেলে দুপুরে যাত্রাবাড়ী পৌঁছালে পুলিশের গুলিতে অনেকেই নিহত ও আহত হন।
খোকনের ভাষ্য, “তারা ‘স্বৈরাচার, ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিচ্ছিলেন। সামনে এগোতেই পুলিশ আবার গুলি চালায়। একজনের মাথা ছেদ করে গুলি বেরিয়ে যায়, আরেকজনও আহত হন।”
তিনি বলেন, ‘পরে সেনাবাহিনী এসে পুলিশকে চলে যেতে বলে এবং সেখানে অবস্থান নেয়। খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, এরপর সেনাবাহিনী চলে যায়। তখন পুলিশ ফের বেরিয়ে এসে ‘পাখির মতো’ গুলি চালায়। ফ্লাইওভারের নিচে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন।’
মুখে গুলি লাগলে তিনি ছটফট করতে থাকেন। এ সময় মুখের মাস্ক সরিয়ে ক্ষতবিক্ষত চেহারা ট্রাইব্যুনালের সামনে তুলে ধরেন।
তিনি জানান, ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মুগদা, ঢাকা মেডিকেল, মিরপুর ডেন্টাল, এরপর বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা হয়। ১০ দিন ছিলেন আইসিইউতে। চিকিৎসা শেষ না হওয়ায় তাকে রাশিয়ায় পাঠানো হয় এবং ৭ এপ্রিল দেশে ফেরেন। আবার ১২ আগস্ট চিকিৎসার জন্য রাশিয়া যাবেন, ১৮ আগস্ট তার অপারেশন।
তিনি শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ওবায়দুল কাদের, শামীম ওসমানের বিচার চান। তাদের বিরুদ্ধে ‘হাজার হাজার মানুষ হত্যার’ অভিযোগ তোলেন।
‘সত্য বলেছি’ বললেন খোকন
সাক্ষ্য শেষে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন তাকে জেরা করেন। তিনি দাবি করেন, পুলিশ গুলি চালায়নি; আন্দোলনকারীরাই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের আহত করেছেন।
খোকন বলেন, ‘এটা সত্য না।’
আইনজীবী আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও অন্যরা দায়ী নন, খোকন সত্য গোপন করে অসত্য জবানবন্দী দিয়েছেন।’
জবাবে খোকন বলেন, ‘সত্য জবানবন্দী দিয়েছি।’
সাক্ষ্য ও জেরা শেষে আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য সোমবার দিন ধার্য করে শুনানি মুলতবি করে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় (সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি)’র এ মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই শেষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জমা দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার রয়েছে। সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন ৮১ জন।
শেখ হাসিনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার: অ্যাটর্নি জেনারেল
রোববার প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য শুরুর আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে শেখ হাসিনার মতো কোনো স্বৈরাচারের জন্ম হয়নি। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার।
সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘আজকের (রোববার) দিনটি ঐতিহাসিক। কোনো স্বৈরাচারকে মিথ্যার ওপর পিএইচডি করতে হলে তাকে শেখ হাসিনার কাছে শিখতে হবে। পৃথিবীর সব স্বৈরশাসকের যদি কোনো সমিতি করা হয়, শেখ হাসিনা হবেন তার সভাপতি। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আমরা স্বৈরাচার ও তার সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল পৃথিবীর কোন স্বৈরাচারের কী পরিণতি হয়েছে, তা ট্রাইব্যুনালের সামনে তুলে ধরেন। জুলাই-আগস্টে গণহত্যার ন্যায়বিচার চেয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্র অনেক এগিয়েছে। আগের ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদ- নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের সামনে যে জুলাই হত্যাকা- ঘটেছে, তার সঠিক বিচার চাই। তবে আমরা অমানবিক বিচার চাই না।’
এ সময় তিনি ইংল্যান্ডের ও লিভার ক্রোমওয়েলের বর্ণনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ন্যায়বিচারের জন্য আমরা এখানে এসেছি। এমন একটি বিচার সম্পন্ন হোক, যে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘গেল ১৬ বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে খুন-চাঁদাবাজি, রাতে ভোট করা, বিদেশে টাকা পাচারসহ সব ধরনের অনিয়ম করা হতো। আর এসবের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলন হয়। টানা ৩৬ দিনের সেই আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনাসহ এমপি-মন্ত্রীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিথ্যা কথার জন্য পিএইচডি করতে হলে হিটলারও শেখ হাসিনার কাছে আসতেন। তবে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষোভ নেই। আমরা অপরাধের বিরুদ্ধে এসেছি। আমরা ন্যায়বিচার চাই, দেশের মানুষের স্বপ্নের বিচার চাই। ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়েই আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি চাইব। যুগ সন্ধিক্ষণে ন্যায়বিচারের জন্য দাঁড়িয়েছি। শুধু রাষ্ট্রপক্ষ নয়, সবাই ন্যায়বিচার পাবেন।’