গণঅভ্যুত্থানে ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের’ পতন হলেও দলীয়করণের সেই ধারাবাহিকতা প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থাসহ সব জায়গায় অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘কিংস পার্টি’-এনসিপি গঠন করা হয়েছে দাবি করে সংস্থাটি বলছে, কয়েকটি দলের চাপে যে প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা ভবিষ্যতে প্রতিপক্ষ দমনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরির ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়
‘কিংস পার্টি’-এনসিপি গঠন
মানবতাবিরোধী অপরাধের
বিচার নিয়ে বিতর্ক
খুন-ডাকাতি ও অরাজকতা চলছে
বঞ্চিত হওয়ার নামে জনপ্রশাসনে অবৈধ সুবিধা আদায়
*বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি-সংঘাত ও ইজারা নিয়ন্ত্রণ
*গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
খর্ব হয়েছে
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দেশের গত এক বছরের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ মূল্যায়ন তুলে ধরেছে টিআইবি।
সোমবার,(৪ আগস্ট ২০২৫) ঢাকার ধানমন্ডিতে টিআইবির নিজস্ব কার্যালয়ে ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনের একটি খসড়া পাঠ করেন সংস্থার গবেষক শাহজাদা এম আকরাম ও মোহাম্মদ জুলকারনাইন।
প্রতিবেদনে সরকারের নেয়া সংস্কারের উদ্যোগ, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, জাতীয় ঐক্যমুক্ত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ, আর্থিক খাত, আইনশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ জ্বালানি, নির্বাচন ও গণমাধ্যম প্রসঙ্গ এসেছে।
এনসিপি ‘কিংস’ পার্টি:
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল বা কিংস পার্টি গঠন করা হয়েছে বলে টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।
এই কিংস পার্টি কারা এ প্রশ্নের উত্তরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা সবাই জানে যে, এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) হচ্ছে এই কিংস পার্টি। কারণ তাদের সহযোগী এখন সরকারের দুজন উপদেষ্টা রয়েছেন, আবার একজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করে এ দলে যুক্ত হয়েছেন।’
এ বিষয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দল গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তবে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অংশ হিসেবে সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত, জনগণের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ রাজনীতি শক্তি হিসেবে বিকশিত হওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অর্থের উৎসের অস্বচ্ছতা, দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, অনিয়মের বিদ্যমান সংস্কৃতি ধারণ করে আত্মঘাতী পথে ধাবিত হচ্ছে।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার:
গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ করা বিচারক ও কৌঁসুলিদের নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও এবং কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও ঢালাও মামলা উপযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপরাধের ধরন অনুযায়ী মামলা না দেয়ার ফলে মামলার ভিত্তি দুর্বল হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।’
এক্ষেত্রে মামলা ও গ্রেপ্তার ‘বাণিজ্যের’ অভিযোগ উঠেছে উল্লেখ করে টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তার উদ্দেশ্যে এবং চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতে অনেককে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ। মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার নামেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।’
খুন ও অরাজকতা চলছে:
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে টিআইবি বলছে, ‘খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, আন্দোলন, লুটপাট, অরাজকতা চলছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশের কার্যক্রমেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। কোনো পক্ষের প্রতি নমনীয় মনোভাব, আবার কোনো পক্ষের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে পুলিশ।’ পুলিশের নির্লিপ্ততা ও দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ পেশাদারিত্বের ঘাটতি প্রকাশ করছে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
বঞ্চিত হওয়ার নামে জনপ্রশাসনে অবৈধ সুবিধা আদায়:
জনপ্রশাসনের বর্তমান অবস্থার মূল্যায়ন করে টিআইবি বলছে, ‘এখন জনপ্রশাসনে একটি দলের অনুসারীদের পরিবর্তে অন্য দল বা দলগুলোর প্রাধান্য ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বঞ্চিত হওয়ার নামে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা আদায় চলছে।’
পদোন্নতি পাওয়া বা পদবঞ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে ‘সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণে ব্যর্থতার’ অভিযোগ ও স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘পতিত সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় বঞ্চিত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এক হাজার ৩০০ জনের বেশি কর্মকর্তা উপসচিব, যুগ্ম সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৫৫০ জনকে অনুমোদিত পদের বাইরে এবং ৭৬৪ জনকে ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দেয়া হয়েছে (এপ্রিল পর্যন্ত)। চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় মোট ৪০ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত)।’
যুগ্ম সচিব ও সমপর্যায়ের পদে থাকা প্রশাসনের মোট ৪৫ জনকে ওএসডি করা হয়েছে উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়, মোট ৫১৬ জনকে ওএসডি করা হয়েছে। বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ডিসি ও এসপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিচার বিভাগেও আইন কর্মকর্তা নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনার অভিযোগ উঠেছে উল্লেখ করে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি মামলা নিষ্পন্ন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করছে।’
টিআইবি বলছে, জুলাই আন্দোলনের ‘শহীদ’ পরিবার ও আহতদের শিক্ষা ও চাকরিতে অগ্রাধিকার প্রদান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী।
রাজনৈতিক অস্থিরতা:
নির্বাচন নিয়ে টিআইবি বলছে, নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকার কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
সেই অস্থিরতা এখন কেটেছে কিনা জানতে চাইলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এখন তো একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে অস্থিরতা যে কোনো সময় হবে না, তা বলা যায় না।’
রাজনৈতিক দল নিয়ে টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘হেফাজতে ইসলামের একটি সমাবেশে নারী কমিশন সম্পর্কে দেয়া বক্তব্য অত্যন্ত অবমাননাকর ও অশ্লীল। কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের সম্পৃক্ততায় মাজার ভাঙা, নারীদের রাস্তাঘাটে হেনন্তা, মেলা-ওরশ-গান-নাটকের অনুষ্ঠান বন্ধ করা, পাঠাগারে হামলা, বিভিন্ন সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘কোনো স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া বা মানদণ্ড অনুসরণ না করে সচিবালয় থেকে শুরু করে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি প্রদানে কয়েকটি দলের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগের দখলে থাকার প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রমের দখল ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ও সংঘাত অব্যাহত রয়েছে।’
বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি ও সংঘাত:
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা শহরের ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন দুই কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। সিলেটের কোয়ারি ও নদনদী থেকে পাথর লুটপাট, সেতু, বাজার, ঘাট, বালুমহাল ও জলমহাল ইত্যাদি ইজারার নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়েছে।’
টিআইবি বলছে, ‘গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৪৭১টি রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতায় ১২১ জন নিহত এবং পাঁচ হাজার ১৮৯ জন আহত হয়েছেন। রাজনৈতিক সংঘাতের ৯২ শতাংশের ঘটনায় বিএনপি, ২২ শতাংশের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, ৫ শতাংশ জামায়াতে ইসলাম এবং ১ শতাংশের ক্ষেত্রে এনসিপির সম্পৃক্ততা রয়েছে।’
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব:
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ভিন্ন উপায়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে জানিয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘সাংবাদিক লেখক ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর হামলা ও হয়রানির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অন্তত ১৫০ জন সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হয়েছে। মব তৈরি করে গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোতে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। ২৪ জনের বেশি গণমাধ্যমকর্মীকে পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে।’
এছাড়া ৮টি সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং ১১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা প্রধান বরখাস্ত হয়েছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানসংক্রান্ত হত্যা মামলার আসামি করা হয়। তিনজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে নিহত হয়েছেন।’
সংস্কার নিয়ে টিআইবির হতাশা:
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার করতে গিয়ে সংকট আরও প্রকট হয়েছে মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের সুপারিশগুলো গ্রহণ না করে পিক অ্যান্ড চুজ পদ্ধতিতে দু-একটি করে অ্যাডহক ভিত্তিতে নেয়া হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জন্য শতাধিক সংস্কারের সুপারিশের মধ্যে টয়লেট পরিষ্কার রাখতে হবে এ রকম অতি নগণ্য কয়েকটিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নারী কমিশন, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যমসহ অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও খাত এখনও আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে বলা যায়।’
উপাচার্য নিয়োগের মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন:
টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘উপাচার্যের পদত্যাগ বা অপসারণের পরিপ্রেক্ষিতে ৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করা হলেও নিয়োগের মানদণ্ড ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে।’
ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা এলেও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি চলমান রয়েছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।
সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫
গণঅভ্যুত্থানে ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের’ পতন হলেও দলীয়করণের সেই ধারাবাহিকতা প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থাসহ সব জায়গায় অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘কিংস পার্টি’-এনসিপি গঠন করা হয়েছে দাবি করে সংস্থাটি বলছে, কয়েকটি দলের চাপে যে প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা ভবিষ্যতে প্রতিপক্ষ দমনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরির ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়
‘কিংস পার্টি’-এনসিপি গঠন
মানবতাবিরোধী অপরাধের
বিচার নিয়ে বিতর্ক
খুন-ডাকাতি ও অরাজকতা চলছে
বঞ্চিত হওয়ার নামে জনপ্রশাসনে অবৈধ সুবিধা আদায়
*বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি-সংঘাত ও ইজারা নিয়ন্ত্রণ
*গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
খর্ব হয়েছে
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দেশের গত এক বছরের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ মূল্যায়ন তুলে ধরেছে টিআইবি।
সোমবার,(৪ আগস্ট ২০২৫) ঢাকার ধানমন্ডিতে টিআইবির নিজস্ব কার্যালয়ে ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনের একটি খসড়া পাঠ করেন সংস্থার গবেষক শাহজাদা এম আকরাম ও মোহাম্মদ জুলকারনাইন।
প্রতিবেদনে সরকারের নেয়া সংস্কারের উদ্যোগ, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, জাতীয় ঐক্যমুক্ত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ, আর্থিক খাত, আইনশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ জ্বালানি, নির্বাচন ও গণমাধ্যম প্রসঙ্গ এসেছে।
এনসিপি ‘কিংস’ পার্টি:
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল বা কিংস পার্টি গঠন করা হয়েছে বলে টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।
এই কিংস পার্টি কারা এ প্রশ্নের উত্তরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা সবাই জানে যে, এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) হচ্ছে এই কিংস পার্টি। কারণ তাদের সহযোগী এখন সরকারের দুজন উপদেষ্টা রয়েছেন, আবার একজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করে এ দলে যুক্ত হয়েছেন।’
এ বিষয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দল গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তবে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অংশ হিসেবে সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত, জনগণের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ রাজনীতি শক্তি হিসেবে বিকশিত হওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অর্থের উৎসের অস্বচ্ছতা, দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, অনিয়মের বিদ্যমান সংস্কৃতি ধারণ করে আত্মঘাতী পথে ধাবিত হচ্ছে।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার:
গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ করা বিচারক ও কৌঁসুলিদের নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও এবং কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও ঢালাও মামলা উপযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপরাধের ধরন অনুযায়ী মামলা না দেয়ার ফলে মামলার ভিত্তি দুর্বল হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।’
এক্ষেত্রে মামলা ও গ্রেপ্তার ‘বাণিজ্যের’ অভিযোগ উঠেছে উল্লেখ করে টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তার উদ্দেশ্যে এবং চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতে অনেককে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ। মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার নামেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।’
খুন ও অরাজকতা চলছে:
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে টিআইবি বলছে, ‘খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, আন্দোলন, লুটপাট, অরাজকতা চলছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশের কার্যক্রমেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। কোনো পক্ষের প্রতি নমনীয় মনোভাব, আবার কোনো পক্ষের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে পুলিশ।’ পুলিশের নির্লিপ্ততা ও দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ পেশাদারিত্বের ঘাটতি প্রকাশ করছে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
বঞ্চিত হওয়ার নামে জনপ্রশাসনে অবৈধ সুবিধা আদায়:
জনপ্রশাসনের বর্তমান অবস্থার মূল্যায়ন করে টিআইবি বলছে, ‘এখন জনপ্রশাসনে একটি দলের অনুসারীদের পরিবর্তে অন্য দল বা দলগুলোর প্রাধান্য ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বঞ্চিত হওয়ার নামে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা আদায় চলছে।’
পদোন্নতি পাওয়া বা পদবঞ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে ‘সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণে ব্যর্থতার’ অভিযোগ ও স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘পতিত সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় বঞ্চিত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এক হাজার ৩০০ জনের বেশি কর্মকর্তা উপসচিব, যুগ্ম সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৫৫০ জনকে অনুমোদিত পদের বাইরে এবং ৭৬৪ জনকে ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দেয়া হয়েছে (এপ্রিল পর্যন্ত)। চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় মোট ৪০ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত)।’
যুগ্ম সচিব ও সমপর্যায়ের পদে থাকা প্রশাসনের মোট ৪৫ জনকে ওএসডি করা হয়েছে উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়, মোট ৫১৬ জনকে ওএসডি করা হয়েছে। বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ডিসি ও এসপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিচার বিভাগেও আইন কর্মকর্তা নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনার অভিযোগ উঠেছে উল্লেখ করে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি মামলা নিষ্পন্ন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করছে।’
টিআইবি বলছে, জুলাই আন্দোলনের ‘শহীদ’ পরিবার ও আহতদের শিক্ষা ও চাকরিতে অগ্রাধিকার প্রদান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী।
রাজনৈতিক অস্থিরতা:
নির্বাচন নিয়ে টিআইবি বলছে, নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকার কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
সেই অস্থিরতা এখন কেটেছে কিনা জানতে চাইলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এখন তো একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে অস্থিরতা যে কোনো সময় হবে না, তা বলা যায় না।’
রাজনৈতিক দল নিয়ে টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘হেফাজতে ইসলামের একটি সমাবেশে নারী কমিশন সম্পর্কে দেয়া বক্তব্য অত্যন্ত অবমাননাকর ও অশ্লীল। কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের সম্পৃক্ততায় মাজার ভাঙা, নারীদের রাস্তাঘাটে হেনন্তা, মেলা-ওরশ-গান-নাটকের অনুষ্ঠান বন্ধ করা, পাঠাগারে হামলা, বিভিন্ন সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘কোনো স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া বা মানদণ্ড অনুসরণ না করে সচিবালয় থেকে শুরু করে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি প্রদানে কয়েকটি দলের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগের দখলে থাকার প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রমের দখল ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ও সংঘাত অব্যাহত রয়েছে।’
বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি ও সংঘাত:
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা শহরের ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন দুই কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। সিলেটের কোয়ারি ও নদনদী থেকে পাথর লুটপাট, সেতু, বাজার, ঘাট, বালুমহাল ও জলমহাল ইত্যাদি ইজারার নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়েছে।’
টিআইবি বলছে, ‘গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৪৭১টি রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতায় ১২১ জন নিহত এবং পাঁচ হাজার ১৮৯ জন আহত হয়েছেন। রাজনৈতিক সংঘাতের ৯২ শতাংশের ঘটনায় বিএনপি, ২২ শতাংশের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, ৫ শতাংশ জামায়াতে ইসলাম এবং ১ শতাংশের ক্ষেত্রে এনসিপির সম্পৃক্ততা রয়েছে।’
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব:
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ভিন্ন উপায়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে জানিয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘সাংবাদিক লেখক ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর হামলা ও হয়রানির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অন্তত ১৫০ জন সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হয়েছে। মব তৈরি করে গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোতে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। ২৪ জনের বেশি গণমাধ্যমকর্মীকে পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে।’
এছাড়া ৮টি সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং ১১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা প্রধান বরখাস্ত হয়েছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানসংক্রান্ত হত্যা মামলার আসামি করা হয়। তিনজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে নিহত হয়েছেন।’
সংস্কার নিয়ে টিআইবির হতাশা:
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার করতে গিয়ে সংকট আরও প্রকট হয়েছে মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের সুপারিশগুলো গ্রহণ না করে পিক অ্যান্ড চুজ পদ্ধতিতে দু-একটি করে অ্যাডহক ভিত্তিতে নেয়া হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জন্য শতাধিক সংস্কারের সুপারিশের মধ্যে টয়লেট পরিষ্কার রাখতে হবে এ রকম অতি নগণ্য কয়েকটিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নারী কমিশন, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যমসহ অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও খাত এখনও আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে বলা যায়।’
উপাচার্য নিয়োগের মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন:
টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘উপাচার্যের পদত্যাগ বা অপসারণের পরিপ্রেক্ষিতে ৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করা হলেও নিয়োগের মানদণ্ড ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে।’
ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা এলেও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি চলমান রয়েছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।