আসছে ফেব্র্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য যে সময়ের কথা গত জুনে অন্তর্বর্তী সরকার বলেছিল, সেই সময়সূচিই এবার নিজের মুখে ঘোষণা করলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার,(০৫ আগস্ট ২০২৫) রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কাছে চিঠি দেবেন, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে।
বললেন, সিইসির কাছে চিঠি পাঠাবেন, যেন রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা হয়
সংস্কারের ক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌঁছানো গেছে; বিচারকাজও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে
এবার সবাইকে ভোট দিয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আহ্বান
বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করে পুরো পৃথিবীকে প্রতিবেশী বানানো হবে
মঙ্গলবার রাত ৮টা ২০ মিনিট থেকে তার এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি নিউজ ও বাংলাদেশ বেতারে একযোগে সম্প্রচার করা হয়। পঁয়ত্রিশ মিনিটের ভাষণে সরকারপ্রধান দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশি বাণিজ্য, সংস্কার, বিচার, নির্বাচনসহ সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেন।
সংস্কার, বিচার ও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এই তিনটিই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ বলে ভাষণে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আজ এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে এ বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করবো। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করবো।’
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাবো, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।’
তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি বেশি দূরে নয়। নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নিতে নিতেই ভোটের দিন এসে পড়বে। বহু বছর আমরা কেউ ভোট দিতে পারিনি। এবার আমরা সবাই ভোট দেবো। কেউ বাদ যাবে না। সবাই যেন বলতে পারি নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে দেশকে রওনা করার জন্য আমি আমার ভোটটা দিয়েছিলাম। আমার ভোটেই দেশটা সেপথে রওনা হতে পেরেছিল।’
জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে সব নাগরিকের কাছে আমার আহ্বান, আসুন, ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রথম বড় পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হই।’
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এর তিন দিনের মাথায় মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে নির্বাচন
আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
নির্বাচনের দাবি নিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ দেখা দিলে লন্ডনে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মুহাম্মদ ইউনূস। গত ১৩ জুন ওই বৈঠকের পর এক যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে সরকার।
এরপর মঙ্গলবার জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনে ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরুর আগে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে নির্বাচন আয়োজনের কথা বললেন প্রধান উপদেষ্টা। এবারের নির্বাচন যেন আনন্দ-উৎসবের দিক থেকে, শান্তি-শৃঙ্খলার দিক থেকে, ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে, সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে, সেজন্য সব আয়োজন সম্পন্ন করতে আগামীকাল (আজ) থেকেই মানসিক প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন শুরু করার ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার কারণে গত ১৫ বছর ধরে নাগরিকবৃন্দ ভোট দিতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে আমরা আমাদের বকেয়া আনন্দসহ মহা আনন্দে ভোট দিতে চাই। এবারের নির্বাচনে জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে যাবে এ রকম ভোটাররা নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে, তাদের এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য। এর মধ্যে নতুন নারী ভোটার থাকবে, নতুন পুরুষ ভোটার থাকবে। এর মধ্যে এমন ভোটার থাকবে যারা ১৫ বছর আগে থেকেই ভোট দিতে পারতো কিন্তু জীবনে একবারও ভোট দিতে পারেনি। এর মধ্যে আসবে যারা ১০ বছর আগে, ৫ বছর আগে ভোট দিতে পারত কিন্তু পারেনি। আর আসবে ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতীর দল যারা এই প্রথমবার ভোটার হওয়ার যোগ্যতা লাভ করলো এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোট দেয়ার সুযোগও পেয়ে গেল।’
তিনি বলেন, ‘নারী ভোটাররা যেন দেশের সর্বত্র নির্দ্বিধায় আনন্দ-উৎসাহ সহকারে তাদের ভোট দিতে পারে এটা নিশ্চিত করতে চাই। এবার যেন কেন্দ্রে কেন্দ্রে নারী ভোটারদের ঢল নামে আমরা সেই লক্ষ্যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ নির্বাচনের দিনকে ঈদের উৎসবের মতো করতে চান বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এবারের ভোটের আনন্দ থাকবে সবার মধ্যে। আপনারা সবাই বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন।’
*তিন দায়িত্ব*
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের তিনটি দায়িত্ব ছিল : সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা দেয়ালে দেয়ালে যে প্রত্যাশার কথা লিখে রেখেছিল তার অন্যতম ফোকাস ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার। সে লক্ষ্যে আমরা বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিলাম। তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান সংস্কার কমিশনগুলো যে সুপারিশ পেশ করেছে সেগুলোর মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বহু সংস্কার আমরা ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছি। এই সংস্কারগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক খাত, বিচার ব্যবস্থা ও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা আসবে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি হ্রাস পাবে।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকাজ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছিলাম। এই কমিশনে ৩০টিরও অধিক রাজনৈতিক দল ও জোট স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মতামত দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দুই মাস ধরে দলগত ও জোটগতভাবে আলোচনা করেছিল। এই প্রক্রিয়ায় যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো বাদ দিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯টি মৌলিক সংস্কারের বিষয় চিহ্নিত করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৩ দিন ধরে আলোচনা শেষে ১৯টি বিষয়ের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, যদিও কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।’
*সংস্কার, বিচার*
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বলেন, ‘সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি। ঐকমত্য কমিশনের পরিচালনায় দেশের সব রাজনৈতিক দল মিলে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিনিয়ত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ একটি ঐতিহাসিক অর্জন। এটা শুধু আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নয়, বৃহত্তর পরিম-লের রাজনৈতিক ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দলিল তো স্মরণীয় হয়ে থাকবেই, এটা রচনার প্রক্রিয়াও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দলিল প্রণয়নের জন্য আমি সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে এবং ঐকমত্য কমিশনের সদস্যবৃন্দকে বিশেষ করে এই উদ্যোগের নেতৃত্বদানকারী প্রফেসর আলী রীয়াজকে জাতির পক্ষ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এই আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা ছিল। আমরা আশা করছি এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে অচিরেই রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে এবং এর বাস্তবায়নেও ঐকমত্যে পৌঁছাবে। জুলাই সনদ বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও সক্ষমতা, নাগরিক অধিকারের সত্যিকারের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সামর্থ্যরে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিচারকাজ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে। বিচারের আনুষ্ঠানিক শুনানি পর্বও শুরু হয়েছে। ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে যারা জড়িত তাদের বিচার এ দেশের মাটিতে হবেই। বিচার প্রক্রিয়া ও এর ফলাফল ক্রমান্বয়ে মানুষের কাছে প্রকাশিত হতে থাকবে। বিচারের পুরো প্রক্রিয়া দেশবাসীর কাছে স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান রাখা হচ্ছে।’
*মার্কিন শুল্কনীতি*
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘গত এক বছরে আমরা অনেক সংকট ও সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে পার করেছি।’ এ সময় তিনি মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় কোমলমতি শিশুসহ নাগরিকদের নিহত হওয়ার শোক প্রকাশ করেন। মার্কিন শুল্কনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাত্র কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা সফলতার সঙ্গে শুল্ক আলোচনা সমাপ্ত করেছি। এর ফলে আমাদের অর্থনীতির সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে।’
দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার পালা। আমরা এখন অন্তর্বর্তী সরকার থেকে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যে আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে তার বড় কারণ হলো আমাদের রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদান। নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে মজবুত করতে হলে আমাদের চিন্তায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। আমি বরাবরই বলে এসেছি, এদেশের নদী ও বিশাল সমুদ্র আমাদের মূল্যবান সম্পদ। আমরা এ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সমান্তরালভাবে ‘পানিভিত্তিক অর্থনীতি’ গড়ে তুলতে চাই।’
*বঙ্গোপসাগর*
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, বঙ্গোপসাগরের একটা অংশও আমাদের দেশ। এর পরিমাণ আমাদের মোট জমির পরিমাণের চাইতে বেশি। আমরা প্রায় সবসময় জমিভিত্তিক আমাদের অর্ধেক দেশ নিয়ে মাথা ঘামাই। বাকি পানিভিত্তিক অর্ধেক দেশকে হিসেবেই ধরি না। কারণ আমরা ওই অংশে বসবাস করি না। আমরা তো হাওর-বাঁওড়েও বসবাস করি না। তাই বলে তো তাকে হিসেবের বাইরে রাখি না। এখন থেকে আমাদের অংশের বঙ্গোপসাগরকে আমরা আমাদের দেশের মূল্যবান অংশ, একথা সবসময় মাথায় রেখে অগ্রসর হবো। এই অংশের পানির ওপর দিয়ে দেশ-বিদেশের সঙ্গে আমরা বাণিজ্য করবো। তার মাধ্যমে আমরা পুরো পৃথিবীকে আমাদের প্রতিবেশী বানাবো।’
তিনি বলেন, এই পানির মধ্যে আছে অফুরন্ত সম্পদ; মৎস্য সম্পদ, যা প্রতি বছর ফসল দেয়। এই পানির নিচে আছে অফুরন্ত গ্যাস। এর সবকিছুকে নিয়েই প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে চালিত করতে হবে।’
*চট্টগ্রাম বন্দর*
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত ড্রাই ডক লিমিটেডকে নিউ মুরিং টার্মিনাল কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দিয়েছে। তারা কাজ শুরু করা মাত্রই কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। প্রথম দুই সপ্তাহে দেখা গেছে, আগের তুলনায় প্রতিদিন গড়ে ২২৫টি বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। এ বন্দরকে আধুনিকভাবে গড়ে তোলা গেলে তা শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিতেই ভূমিকা রাখবে না, নেপাল, ভূটানসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অর্র্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বিনিময়ে তারাও উপকৃত হবে, আমরাও উপকৃত হব।’
*প্রেস কাউন্সিল*
সাংবাদিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সরকার ইতোমধ্যেই প্রেস কাউন্সিল পুনর্গঠন করেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা জানেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ গুজব ও অপতথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। দেশকে অস্থিতিশীল করতে হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে গুজব। অপতথ্য মোকাবিলা করার জন্য সাংবাদিকদের সক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। স্বৈরাচারী সরকার আমলে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা পরে সাইবার নিরাপত্তা আইনরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। আমরা এই আইনটি বাতিল করেছি। এই আইনের অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা বাতিল করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১২ মাস ধরে আপনাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জুলাইয়ের দাবি পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছি। আসুন, আজ জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই এই জাতিকে আমরা আর কখনও বিভক্ত হতে দেব না। আমরা সব নাগরিকের প্রতি মর্যাদাশীল থাকবো, তিনি যেই পরিচয়েরই হোন না কেন। আমরা দৈনন্দিন জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে সাময়িকভাবে যদি পথভ্রষ্ট হয়েও পড়ি প্রতিবছর জুলাই আমাদের নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হতে শক্তি জোগাবে।’
মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট ২০২৫
আসছে ফেব্র্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য যে সময়ের কথা গত জুনে অন্তর্বর্তী সরকার বলেছিল, সেই সময়সূচিই এবার নিজের মুখে ঘোষণা করলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার,(০৫ আগস্ট ২০২৫) রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কাছে চিঠি দেবেন, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে।
বললেন, সিইসির কাছে চিঠি পাঠাবেন, যেন রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা হয়
সংস্কারের ক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌঁছানো গেছে; বিচারকাজও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে
এবার সবাইকে ভোট দিয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আহ্বান
বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করে পুরো পৃথিবীকে প্রতিবেশী বানানো হবে
মঙ্গলবার রাত ৮টা ২০ মিনিট থেকে তার এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি নিউজ ও বাংলাদেশ বেতারে একযোগে সম্প্রচার করা হয়। পঁয়ত্রিশ মিনিটের ভাষণে সরকারপ্রধান দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশি বাণিজ্য, সংস্কার, বিচার, নির্বাচনসহ সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেন।
সংস্কার, বিচার ও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এই তিনটিই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ বলে ভাষণে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আজ এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে এ বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করবো। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করবো।’
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাবো, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।’
তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি বেশি দূরে নয়। নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নিতে নিতেই ভোটের দিন এসে পড়বে। বহু বছর আমরা কেউ ভোট দিতে পারিনি। এবার আমরা সবাই ভোট দেবো। কেউ বাদ যাবে না। সবাই যেন বলতে পারি নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে দেশকে রওনা করার জন্য আমি আমার ভোটটা দিয়েছিলাম। আমার ভোটেই দেশটা সেপথে রওনা হতে পেরেছিল।’
জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে সব নাগরিকের কাছে আমার আহ্বান, আসুন, ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রথম বড় পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হই।’
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এর তিন দিনের মাথায় মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে নির্বাচন
আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
নির্বাচনের দাবি নিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ দেখা দিলে লন্ডনে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মুহাম্মদ ইউনূস। গত ১৩ জুন ওই বৈঠকের পর এক যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে সরকার।
এরপর মঙ্গলবার জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনে ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরুর আগে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে নির্বাচন আয়োজনের কথা বললেন প্রধান উপদেষ্টা। এবারের নির্বাচন যেন আনন্দ-উৎসবের দিক থেকে, শান্তি-শৃঙ্খলার দিক থেকে, ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে, সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে, সেজন্য সব আয়োজন সম্পন্ন করতে আগামীকাল (আজ) থেকেই মানসিক প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন শুরু করার ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার কারণে গত ১৫ বছর ধরে নাগরিকবৃন্দ ভোট দিতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে আমরা আমাদের বকেয়া আনন্দসহ মহা আনন্দে ভোট দিতে চাই। এবারের নির্বাচনে জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে যাবে এ রকম ভোটাররা নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে, তাদের এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য। এর মধ্যে নতুন নারী ভোটার থাকবে, নতুন পুরুষ ভোটার থাকবে। এর মধ্যে এমন ভোটার থাকবে যারা ১৫ বছর আগে থেকেই ভোট দিতে পারতো কিন্তু জীবনে একবারও ভোট দিতে পারেনি। এর মধ্যে আসবে যারা ১০ বছর আগে, ৫ বছর আগে ভোট দিতে পারত কিন্তু পারেনি। আর আসবে ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতীর দল যারা এই প্রথমবার ভোটার হওয়ার যোগ্যতা লাভ করলো এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোট দেয়ার সুযোগও পেয়ে গেল।’
তিনি বলেন, ‘নারী ভোটাররা যেন দেশের সর্বত্র নির্দ্বিধায় আনন্দ-উৎসাহ সহকারে তাদের ভোট দিতে পারে এটা নিশ্চিত করতে চাই। এবার যেন কেন্দ্রে কেন্দ্রে নারী ভোটারদের ঢল নামে আমরা সেই লক্ষ্যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ নির্বাচনের দিনকে ঈদের উৎসবের মতো করতে চান বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এবারের ভোটের আনন্দ থাকবে সবার মধ্যে। আপনারা সবাই বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন।’
*তিন দায়িত্ব*
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের তিনটি দায়িত্ব ছিল : সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা দেয়ালে দেয়ালে যে প্রত্যাশার কথা লিখে রেখেছিল তার অন্যতম ফোকাস ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার। সে লক্ষ্যে আমরা বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিলাম। তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান সংস্কার কমিশনগুলো যে সুপারিশ পেশ করেছে সেগুলোর মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বহু সংস্কার আমরা ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছি। এই সংস্কারগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক খাত, বিচার ব্যবস্থা ও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা আসবে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি হ্রাস পাবে।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকাজ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছিলাম। এই কমিশনে ৩০টিরও অধিক রাজনৈতিক দল ও জোট স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মতামত দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দুই মাস ধরে দলগত ও জোটগতভাবে আলোচনা করেছিল। এই প্রক্রিয়ায় যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো বাদ দিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯টি মৌলিক সংস্কারের বিষয় চিহ্নিত করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৩ দিন ধরে আলোচনা শেষে ১৯টি বিষয়ের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, যদিও কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।’
*সংস্কার, বিচার*
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বলেন, ‘সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি। ঐকমত্য কমিশনের পরিচালনায় দেশের সব রাজনৈতিক দল মিলে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিনিয়ত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ একটি ঐতিহাসিক অর্জন। এটা শুধু আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নয়, বৃহত্তর পরিম-লের রাজনৈতিক ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দলিল তো স্মরণীয় হয়ে থাকবেই, এটা রচনার প্রক্রিয়াও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দলিল প্রণয়নের জন্য আমি সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে এবং ঐকমত্য কমিশনের সদস্যবৃন্দকে বিশেষ করে এই উদ্যোগের নেতৃত্বদানকারী প্রফেসর আলী রীয়াজকে জাতির পক্ষ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এই আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা ছিল। আমরা আশা করছি এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে অচিরেই রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে এবং এর বাস্তবায়নেও ঐকমত্যে পৌঁছাবে। জুলাই সনদ বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও সক্ষমতা, নাগরিক অধিকারের সত্যিকারের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সামর্থ্যরে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিচারকাজ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে। বিচারের আনুষ্ঠানিক শুনানি পর্বও শুরু হয়েছে। ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে যারা জড়িত তাদের বিচার এ দেশের মাটিতে হবেই। বিচার প্রক্রিয়া ও এর ফলাফল ক্রমান্বয়ে মানুষের কাছে প্রকাশিত হতে থাকবে। বিচারের পুরো প্রক্রিয়া দেশবাসীর কাছে স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান রাখা হচ্ছে।’
*মার্কিন শুল্কনীতি*
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘গত এক বছরে আমরা অনেক সংকট ও সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে পার করেছি।’ এ সময় তিনি মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় কোমলমতি শিশুসহ নাগরিকদের নিহত হওয়ার শোক প্রকাশ করেন। মার্কিন শুল্কনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাত্র কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা সফলতার সঙ্গে শুল্ক আলোচনা সমাপ্ত করেছি। এর ফলে আমাদের অর্থনীতির সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে।’
দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার পালা। আমরা এখন অন্তর্বর্তী সরকার থেকে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যে আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে তার বড় কারণ হলো আমাদের রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদান। নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে মজবুত করতে হলে আমাদের চিন্তায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। আমি বরাবরই বলে এসেছি, এদেশের নদী ও বিশাল সমুদ্র আমাদের মূল্যবান সম্পদ। আমরা এ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সমান্তরালভাবে ‘পানিভিত্তিক অর্থনীতি’ গড়ে তুলতে চাই।’
*বঙ্গোপসাগর*
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, বঙ্গোপসাগরের একটা অংশও আমাদের দেশ। এর পরিমাণ আমাদের মোট জমির পরিমাণের চাইতে বেশি। আমরা প্রায় সবসময় জমিভিত্তিক আমাদের অর্ধেক দেশ নিয়ে মাথা ঘামাই। বাকি পানিভিত্তিক অর্ধেক দেশকে হিসেবেই ধরি না। কারণ আমরা ওই অংশে বসবাস করি না। আমরা তো হাওর-বাঁওড়েও বসবাস করি না। তাই বলে তো তাকে হিসেবের বাইরে রাখি না। এখন থেকে আমাদের অংশের বঙ্গোপসাগরকে আমরা আমাদের দেশের মূল্যবান অংশ, একথা সবসময় মাথায় রেখে অগ্রসর হবো। এই অংশের পানির ওপর দিয়ে দেশ-বিদেশের সঙ্গে আমরা বাণিজ্য করবো। তার মাধ্যমে আমরা পুরো পৃথিবীকে আমাদের প্রতিবেশী বানাবো।’
তিনি বলেন, এই পানির মধ্যে আছে অফুরন্ত সম্পদ; মৎস্য সম্পদ, যা প্রতি বছর ফসল দেয়। এই পানির নিচে আছে অফুরন্ত গ্যাস। এর সবকিছুকে নিয়েই প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে চালিত করতে হবে।’
*চট্টগ্রাম বন্দর*
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত ড্রাই ডক লিমিটেডকে নিউ মুরিং টার্মিনাল কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দিয়েছে। তারা কাজ শুরু করা মাত্রই কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। প্রথম দুই সপ্তাহে দেখা গেছে, আগের তুলনায় প্রতিদিন গড়ে ২২৫টি বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। এ বন্দরকে আধুনিকভাবে গড়ে তোলা গেলে তা শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিতেই ভূমিকা রাখবে না, নেপাল, ভূটানসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অর্র্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বিনিময়ে তারাও উপকৃত হবে, আমরাও উপকৃত হব।’
*প্রেস কাউন্সিল*
সাংবাদিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সরকার ইতোমধ্যেই প্রেস কাউন্সিল পুনর্গঠন করেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা জানেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ গুজব ও অপতথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। দেশকে অস্থিতিশীল করতে হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে গুজব। অপতথ্য মোকাবিলা করার জন্য সাংবাদিকদের সক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। স্বৈরাচারী সরকার আমলে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা পরে সাইবার নিরাপত্তা আইনরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। আমরা এই আইনটি বাতিল করেছি। এই আইনের অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা বাতিল করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১২ মাস ধরে আপনাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জুলাইয়ের দাবি পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছি। আসুন, আজ জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই এই জাতিকে আমরা আর কখনও বিভক্ত হতে দেব না। আমরা সব নাগরিকের প্রতি মর্যাদাশীল থাকবো, তিনি যেই পরিচয়েরই হোন না কেন। আমরা দৈনন্দিন জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে সাময়িকভাবে যদি পথভ্রষ্ট হয়েও পড়ি প্রতিবছর জুলাই আমাদের নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হতে শক্তি জোগাবে।’